সকাল ন টা। প্রধানমন্ত্রী তার অফিস রুমে একা বসে আছেন। প্রধানমন্ত্রী’র মুখ থমথমে। চোখ ফেটে বেরিয়ে আসা অশ্রু প্রানপণে দমন করতে করতে তিনি দরজা ঠেলে প্রবেশ করতে থাকা প্রথম সাক্ষাৎকার প্রার্থী খনিজ সম্পদ মন্ত্রী’র দিকে তাকালেন। খনিজ সম্পদ মন্ত্রী বিনয়াবনত হয়ে বললেন- স্যার, আগামী বিশ বছরে দেশে উত্তোলনযোগ্য খনিজ সম্পদের যথাযথ ব্যবহার কিভাবে নিশ্চিত করা যায় সে বিষয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ আলোচনা করা দরকার। প্রধানমন্ত্রী ধমক দিয়ে বললেন- আজকে তুমি নিজেই খনির ভেতর গিয়ে বসে থাক! আজকে আমি এসব বিষয় নিয়ে কোন কথা বলব না!
খনিজ সম্পদ মন্ত্রী কাঁপতে কাঁপতে প্রধানমন্ত্রী’র দপ্তর থেকে বের হয়ে এলেন। তাঁর মনে হতে লাগল তাঁর পা দুটো আসলেই মাটির মধ্যে সেঁধিয়ে যাচ্ছে!
দ্বিতীয় সাক্ষাৎকার প্রার্থী যোগাযোগ মন্ত্রী দরজা ঠেলে প্রধানমন্ত্রীর রুমে ঢুকলেন। তারপর বিনয়াবনত হয়ে বললেন- স্যার, ঢাকা এবং চট্টগ্রামে নতুন নতুন আরো দশটা করে ফ্লাই ওভার নির্মান করে যানযট কিভাবে মাইনাসে নিয়ে আসা যায় সে বিষয়ে মাস্টার প্ল্যান করা হয়ে গেছে। মাস্টার প্ল্যান নিয়ে আপনার সাথে বসতে চাই। প্রধানমন্ত্রী শীতল গলায় বললেন- মাস্টার প্ল্যান হাতে নিয়ে তুমি মহাখালি ফ্লাই ওভারের নিচে গিয়ে বসে থাক! আজকে আমি এসব বিষয় নিয়ে কোন কথাই বলব না!!
যোগাযোগ মন্ত্রী কাঁপতে কাঁপতে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে বের হয়ে এলেন। তাঁর মনে হতে লাগল ঢাকা এবং চট্টগ্রামে নির্মীয়মাণ সব ফ্লাই ওভার আচমকা তাঁর মাথার উপর ভেঙ্গে পড়েছে!
তৃতীয় সাক্ষাৎকার প্রার্থী শিক্ষামন্ত্রী দরজা ঠেলে প্রধানমন্ত্রী’র রুমে ঢুকলেন। তারপর বিনয়াবনত হয়ে বললেন- স্যার, শিক্ষাকে কিভাবে আরো বিজ্ঞানমুখী করা যায় সেই ব্যাপারে সারাদেশে সেমিনার করতে চাইছি। আপনার কি মত? প্রধানমন্ত্রী রাগত স্বরে বললেন- সেমিনার না করে তুমি এক্ষুনি বাসায় চলে যাও! বাসায় বসে বসে ঠাকুরমার ঝুলি পড়।!! এক্ষুনি বিদেয় হও আমার সামনে থেকে!
শিক্ষামন্ত্রী আতঙ্কিত মন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর রূম থেকে বের হয়ে এলেন। তাঁর মনে হতে লাগল- ঠাকুর মা’র ঝুলির সবগুলো রাক্ষস খোক্ষস একযোগে তাকে গিলে ফেলতে আসছে!
চতুর্থ সাক্ষাৎকারপ্রার্থী মিডিয়ামন্ত্রী দরজা ঠেলে প্রধানমন্ত্রী’র রুমে ঢুকলেন। তারপর বিনয়াবনত হয়ে বললেন- স্যার, ফেসবুক সারা দেশে জ্যামিতিক হারে বাচালের সংখ্যা বৃদ্ধি করছে! ফেসবুক বন্ধ করে দিতে চাই! প্রধানমন্ত্রী রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন- বাচালামি না করে আমার সামনে থেকে যাও। গিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দাও- ‘আমি পাগল হয়ে গেছি!’ দেখ ক’টা লাইক পড়ে!!
প্রধানমন্ত্রী’র রুম থেকে বের হতে হতে মিডিয়ামন্ত্রীর নিঃশ্বাস আটকে আসল। তিনি কি আসলেই পাগল হয়ে গেছেন??
পঞ্চম সাক্ষাৎকার প্রার্থী হিসেবে যিনি ঢুকলেন তিনি প্রধানমন্ত্রী’র স্কুল শিক্ষক এবং প্রধানমন্ত্রী কে নিজের সন্তানের মত স্নেহ করেন। তাকে দেখে প্রধানমন্ত্রী’র দূ চোখ দিয়ে অশ্রুর ফোঁটা গড়িয়ে পড়ল। নিজের চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে সামনের চেয়ার দেখিয়ে আবেগ রুদ্ধ কন্ঠে প্রধানমন্ত্রী বললেন- স্যার বসেন।
স্যার কিছুটা দ্বিধাজড়ানো গলায় বললেন- তোমার কি হয়েছে মা? সবাই কে নাকি রূম থেকে বের করে দিচ্ছ? বলছ- আজকে কারো সাথেই কোন কাজ করবে না। তোমার কাজ মানেই ত দেশের কাজ মা। তুমি কাজ না করে বসে থাকলে দেশের কি হবে মা?
প্রধানমন্ত্রী র চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে টেবিলের উপর পড়ল। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে প্রধানমন্ত্রী বললেন- আজকে আমার একটা সন্তানের মৃত্যু হয়েছে স্যার। যতটুকু আলামত পাওয়া গেছে তাতে এটা মুটামুটি নিশ্চিত যে আমার মেয়েটাকে ধর্ষন করে মেরে ফেলা হয়েছে। আজকে আমি শুধু আমার মেয়ের হত্যার বিচারের জন্য যা যা করা লাগে করব। অন্য কিছু করব না।
স্যার তীক্ষ্ণ চোখে প্রধানমন্ত্রী’র দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
প্রধানমন্ত্রী’র পিএ পাংশু মুখে ঢুকল। ‘ স্যার, আপনার সাথে ফোনে কথা বলতে চায়! আপনার মেয়ে রত্না আর রুনা!! ছয় বছর আগে নিমতলী অগ্নিকান্ডের পর আপনি তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী কান্নারুদ্ধ ভারী গলায় বললেন- রত্না রুনা কে বলে দাও- সেদিন আমি রত্না রুনা ও আসমা র কোমল মা ছিলাম। আজকে আমি আমার ধর্ষিতা মৃত মেয়েটার কঠোর মা। সেদিন আমার মমতার কোমল হাতে আমি রত্না রুনা ও আসমা কে বৌ সাঁজিয়ে দিয়েছিলাম। আজকে আমি আমার নির্দয় পাষাণ হাতে আমার ধর্ষিতা মৃত মেয়ের হত্যাকারীর টুঁটি টিপে ধরব। কোমল মা হবার চেয়ে কঠিন মা হওয়া অনেক বেশি কঠিন!!
একটু পরে প্রধানমন্ত্রী’র পি এ আবার পাংশু মুখে ঢুকল। তোতলাতে তোতলাতে বলল- স্যা...স্যার, এ... এই বার আপনার নি... নিজের মে... মেয়ে!’ প্রধানমন্ত্রী দ্বিধাহীন স্পষ্ট উচ্চারনে বললেন- আজকে আমি অন্য কারো মা নই। এমন কি আমার নিজের ছেলেমেয়ের ও মা নই! আজকে আমি শুধু আমার ধর্ষিতা কন্যা জনিয়া বেগমের মা!!
পি এ মাথা নিচু করে বের হয়ে গেল।
রুমের মধ্যে কিছুক্ষন থমথমে নিস্তব্ধতা বিরাজ করল। প্রধানমন্ত্রী’র সামনে চেয়ারে বসে থাকা প্রধানমন্ত্রী’র স্যার পাঞ্জাবি’র পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছলেন। তারপর বললেন- মা, তুমি আজকে সত্যি সত্যি শুধুই জনিয়া বেগমের মা?
প্রধানমন্ত্রী কান্নারুদ্ধ অথচ দৃঢ় কন্ঠে বললেন- হ্যাঁ। আজকে আমি শুধুই জনিয়া বেগমের মা। স্বরাষ্টমন্ত্রী কে ইতোমধ্যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। জনিয়ার হত্যাকারীকে সাত হাত গর্ত থেকে হলেও খুঁজে বের করে আমার সামনে নিয়ে আসবে। আর আমার মেয়েটা যেরকম কষ্ট পেয়ে মরেছে শুওরের বাচ্চা টাকে ঠিক সেরকম কষ্ট দিয়ে মারা হবে!
স্যার প্রধানমন্ত্রী’র দিকে তাকিয়ে আছেন। প্রধানমন্ত্রী’র বিষাদ মাখা মুখটা অদ্ভুত এক আলোয় উদ্ভাসিত। সেই আলোর খানিকটা যেন রুমের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। ছড়িয়ে পড়া আলোটা প্রধানমন্ত্রী’র চারদিকে নেচে বেড়াচ্ছে প্রজাপতির মত। সেই আলোর ভেতর ক্ষণে ক্ষণে অদ্ভুত ভাবে ভেসে উঠছে একটি মিষ্টি কিশোরী মেয়ের মুখ। মেয়েটা প্রধানমন্ত্রী’র দিকে অসম্ভব আবেগমাখা বড় বড় চোখে তাকিয়ে বলছে- ‘মা মাগো, কে বলছে আমি মরে গেছি? তোমার মত মা থাকতে তার সন্তানের গায়ে কি কেউ কখনো হাত তুলতে পারে? এই যে দেখ মা! আমি বেঁচে আছি। দিব্যি ভাল, সুস্থ ভাবে বেঁচে আছি!’