আজকের প্রথম আলোর বর্ননা অনুযায়ী- নুসরাত আমান এবং আলভী আমানের মা মাহফুজা মালেক নিজেই তার দুই সন্তান কে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন। হত্যার কারন হিসাবে সন্তানদের পড়ালেখা ও ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বেগের কথা বলেছেন।
কোন মা অথবা বাবা তার সন্তানের পড়ালেখা ও ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে তাকে হত্যা করে ফেলবে, এটা আপাত দৃষ্টিতে অসম্ভব একটা ব্যাপার। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে , এটা সুস্থ মানুষের জন্য অসম্ভব ব্যাপার হলেও মানসিক ভাবে অসুস্থ বিকারগ্রস্থ মানুষের পক্ষে খুবই সম্ভব। মানসিক ভাবে অসুস্থ মানেই লেংটা পাগল না। দিব্যি স্যুটেড বুটেড হয়ে সমাজে চলাফেরা করা, সামাজিক সব মানদন্ডে চুড়ান্ত ভাবে সফল একজন মানুষ ও মানসিক ভাবে অসুস্থ হতে পারে। পাতলুনের আড়ালে পাছার ফোঁড়া যেমন ঢেকে রাখা যায়, সামাজিক পারিবারিক অফিসিয়াল সব ফরমালিটির আড়ালেও মানসিক অসুস্থতাকে সেরকম চমৎকার ঢেকে রাখা যায়। আধুনিক মানুষ অভিনয়ে পটু। কাজেই এখানে মানসিক ভাবে সুস্থ এবং মানসিক ভাবে অসুস্থ মানুষ কে চট করে আলাদা করা যায়না। তবে সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে তাকে হত্যা করার পর্যায়ে যেতে যে মাত্রার মানসিক অসুস্থতা দরকার সেটা একদিনে সঞ্চিত হয়না। ভুল ধারনার শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে সেটা ধীরে ধীরে সঞ্চিত হয়।
এক্ষেত্রে ভুল ধারনাটি হল এই-আমার সন্তান মানে আমার নিজস্ব ফ্যাক্টরি’র প্রোডাক্ট বা আমার মাল! এই ভুল ধারনার খপ্পরে যারা পড়েন নিজের সন্তান সম্পর্কে তারা ঠিক সেইভাবে চিন্তা করেন যেইভাবে একজন মুরগির খামারের মালিক তার খামারের মুরগি’র বাচ্চা সম্পর্কে চিন্তা করেন। ধরেন একটা ব্রিডার ফার্ম। এখানে একেকটা ডিম পাড়া মুরগি’র বাচ্চা অনেক দাম দিয়ে কিনতে হয়। সেই মুরগির বাচ্চা বড় হয়ে যতদিন ডিম পাড়ার উপযুক্ত না হচ্ছে ততদিন তার পেছনে খাদ্য, পানি, অষুধ, উপযুক্ত পরিবেশ ইত্যাদি বাবদ অনেক টাকা খরচ করতে হয়। উপযুক্ত বয়েসে মুরগি যখন প্রতিদিন একটা করে ডিম পাড়া আরম্ভ করে তখন হ্যাচারিতে সেই ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা বের করা হয় এবং সেই ফোটানো বাচ্চাগুলো(ব্রয়লার) বিক্রি করে এতদিনকার সব খরচ কয়েকগুন লাভ সহ উঠে আসে। একই ভাবে মানসিক প্রতিবন্ধী বাবা মা রা চিন্তা করে তার সন্তান হল তার পৌরুষ অথবা নারীত্ব সম্পত্তি’র একটা রূপান্তর মাত্র এবং তার জন্মের সময়ের হসপিটাল বা দাই খরচ থেকে শুরু করে তার ন্যাপি কিনা, বই কিনা, তাকে খেতে পরতে দেয়া, থাকতে দেয়া, স্কুল,কলেজে পড়ানো সবই তার পিছনে ইনভেস্টমেন্ট। এখন কোন মালিক যখন তার মালের পেছনে ইনভেস্ট করে তখন মাল কে ইচ্ছেয় হোক আর অনিচ্ছেয় হোক মালিকের ইচ্ছের কাছে নত হতে হয় এবং মালিকের নির্ধারন করে দেয়া পথের বাইরে সে কিছুই করতে পারেনা। বাবা মা রা যখন বাবা মা হবার পরিবর্তে তাদের সন্তান দের মালিক হয়ে যায় তখন সেই বাবা মায়ের আচরন হয়ে যায় ঠিক একজন মুরগির খামারের মালিকের মত। মুরগির খামারে একটা মুরগির বাচ্চাকে এমন ভাবে লালন পালন করা হয় যাতে সে মরে যাবার আগে সর্বোচ্চ পরিমান ডিম পেড়ে দেয়। একথা মাথায় রেখে তার খাওয়া, ঔষধ, পরিবেশ, তার জন্য মোরগ ইত্যাদি নির্ধারণ করা হয়। এখন খামারের মালিক যদি দেখে কোন বাচ্চা মুরগি নির্ধারিত পরিমান খাবার না খেয়ে বেশি বা কম খাচ্ছে, ঔষধ মুখে দিচ্ছেনা, এবং এর ফলে তার ভবিষ্যতে ডিম পাড়ার সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে তাতে করে খামারের মালিক মুরগি’র বাচ্চার ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন হন না বরং তার নিজের ভবিষ্যত নিয়েই উদ্বিগ্ন হন। এখান থেকে এই সিদ্ধান্তে উপনিত হওয়া খুব ভুল নয় যে, আমরা আমাদের চারপাশে তথাকথিত ছেলেমেয়ের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন যেসব মানসিক প্রতিবন্ধী বাবা মা কে দেখি তারা আসলে তাদের সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন নয়। বরং তারা তাদের নিজেদের ভবিষ্যত নিয়েই উদ্বিগ্ন। কারন মুরগি ঠিক মত ডিম না পাড়লে ইনভেস্টমেন্ট পুরাটাই লস।
কাহলিল জিব্রানের বিখ্যাত বই দ্য প্রফেট এর সন্তান সম্পর্কিত অধ্যায়ে তিনি খুব সুন্দর করে বলেছেন- ‘দে হ্যাভ কাম থ্রু ইউ, নট ফ্রম ইউ’ অর্থাৎ তারা তোমাদের মাধ্যমে এসেছে। তোমাদের ভেতর থেকে নয়’। পিতার শুক্রানু এবং মাতার ডিম্বানু থেকে যে সন্তানের জন্ম সেই শুক্রানু অথবা ডিম্বানু বাবা অথবা মা কেউ কোথাও থেকে টাকা দিয়ে আমদানি করেনি অথবা ল্যাবোরেটরিতে সৃষ্টি করেনি। এটা প্রাকৃতিক নিয়মে তাদের ভেতর তাদের ভেতর সঞ্চিত হয়েছে। সেই শুক্রানু এবং ডিম্বানুর ভেতরে যে তেইশ টা করে ক্রোমোজোম সেগুলোও প্রাকৃতিক নিয়মেই সৃষ্টি হয়েছে এবং প্রকৃতি নির্ধারিত কামনা বা ভালোবাসার কারনে বাবা মা র মিলনের ফলশ্রুতি তে শুক্রানু ডিম্বানুর মিলনের ফলে উৎপন্ন নিষিক্ত ডিম্বকোষের অভ্যন্তরস্থ জিন গুলো কি কি বৈশিষ্ট্য ধারন করবে তাতেও বাবা মা’র কোন ভুমিকা নেই। সন্তানের মধ্যে এমন বৈশিষ্ট্য থাকা খুবই সম্ভব যে বৈশিষ্ট্যের ছিটেফোঁটা ও বাবা মা র মধ্যে নেই। এই ভিন্ন রকম বৈশিষ্ট্যের কারনে অনেক ক্ষেত্রে সন্তানের মানসিকতা তার বাবা মা র থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হতে পারে। সন্তানের ভাল মন্দের উপলব্ধি তার বাবা মা র থেকে আলাদা হতে পারে। সন্তানের রুচিবোধ তার বাবা মা র থেকে আলাদা হতে পারে। সন্তানের সাফল্যের সংজ্ঞা তার বাবা মা র সাফল্যের সংজ্ঞা র থেকে আলাদা হতে পারে। কিন্তু যখুনি বাবা মা ‘বাবা মা’ হবার বদলে ‘সন্তানের মালিক’ হয়ে যায় তখন তারা সন্তানের এই ভিন্ন বৈশিষ্ট্য কে সহ্য করতে পারেনা। শুধু সহ্য করতে পারেনা তা নয়, সেই বৈশিষ্ট্য সমূহ সমূলে উৎপাটন করে তাদের কে ‘একান্তই নিজেদের স্বপ্নের ধারক এবং বাহক’ বানিয়ে ফেলাটা গুরু দায়ীত্ব মনে করে। সেই গুরু দায়ীত্ব পালন করতে গিয়ে তারা প্রতিদিন তথাকথিত ‘শাসনের কাঁচি’ হাতে সন্তানের তথাকথিত ‘অবাধ্যতার ল্যাজ’ কাটতে থাকে। এতে করে কাঁচির আঘাতে সন্তান যেমন আহত হয় তেমনি ল্যাজের বাড়ি খেয়ে বাপ মা ( মালিক মালকিন!) ও আহত হয়। এতে করে বাবা মা এবং সন্তানের মধ্যে চুড়ান্ত অসুস্থ একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক সম্পর্কের সূচনা হয় এবং আঘাত প্রত্যাঘাতের মধ্য দিয়ে এই অসুস্থ সম্পর্ক এগিয়ে যেতে থাকে। এই অসুস্থ আঘাত প্রত্যাঘাতের সম্পর্ক হল শত্রুতার সম্পর্ক এবং এর চুড়ান্ত নগ্ন রূপ হল- বাগে পেলে এক পক্ষ কর্তৃক অন্যপক্ষ কে হত্যা করা।
‘আমার সন্তান আমার মাল’ এই ভুল ধারনার শিকড়ের উপর গজানো অসুস্থতার বৃক্ষ সব সময় বট গাছ হয়না। কারন কু সংস্কার এবং অজ্ঞানতা মানুষ কে যতই খারাপ করুক, বেশির ভাগ মানুষ তার একেবারে ভেতরে সঞ্চিত মানবিকতাটুকু কে এড়িয়ে যেতে পারেনা এবং কুসংস্কার বা অজ্ঞানতার বশবর্তী হয়ে চুড়ান্ত রকম অমানবিক কোন সিদ্ধান্ত নেবার আগে সেই মানবিকতাবোধ তাকে প্রত্যাঘাত করে। তার ভেতরের অন্ধকার দানব টা পরাজিত হয়। কিন্তু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে সেটা হয়না। তাদের অন্ধত্ত্বের দেয়াল এতটাই পুরো থাকে যে তাদের ভেতরকার মানবিকতাবোধ সর্বশক্তি দিয়েও তাদের অন্ধত্ত্বের দেয়ালে ফাটল ধরাতে পারেনা। এরাই পারে ‘প্রতিপক্ষ সন্তান’ কে বাগে পেলে হত্যা করতে। এরাই পারে ‘প্রতিপক্ষ বাবা মা’ কে বাগে পেলে হত্যা করতে।
এই ধরনের হত্যাকান্ড যেগুলো মানুষের মৌলিক অনুভুতির মর্মমূলে গিয়ে আঘাত করে সেগুলো উৎপাটন করতে চাইলে এর বিচার করলেই শুধু হবেনা। এর নেপথ্যে যে ভ্রান্ত বিশ্বাস দায়ী সেটাকেও নিয়ে আসতে হবে মানুষের চোখের সামনে, আলোয়।