শফিয়ার রহমান মোল্যা’র বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে। একটু আগে আতুড় ঘর থেকে তার প্রথম সন্তানের কান্নার আওয়াজ শোনা গেছে। আওয়াজ শোনে বোঝা না গেলেও লিঙ্গ দেখে বোঝা গেছে সন্তান মেয়ে। লোকজন ‘নবীজী’র কন্যা সন্তান ছিল’, ‘ মোল্যা আজকে থেকে একটা বেহেশতের বাগানের মালিক হল’, ‘ যারা সৌভাগ্যবান তাদেরই কন্যা সন্তান জন্মায়’ ইত্যাদি বলে সান্তনা দিলেও মোল্যার মনে হয়েছে সে কোথায় যেন হেরে গেছে। পুত্র সন্তান জন্ম দেয়াটা যতটা পুরুষালী ব্যাপার, সন্মানের ব্যাপার, কন্যা সন্তান জন্ম দেয়াটা যে তা নয় সেটা মোল্যা বোঝে। কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়াটা যেন পরাজিত হবার বা পরীক্ষায় ফেল করবার মত একটা ব্যাপার। পরীক্ষায় ফেল করলে যেমন মানুষ নানান রকম সান্তনা দেয় কন্যা সন্তান জন্মালেও সেরকম নানান রকম সান্তনা দেয়। এই সান্তনার ব্যাপারটা যে একটা সামাজিক প্রহসন সেটা মোল্যা বোঝে। বোঝে বলেই রাগে তার ভেতর টা সাপের মত হিস হিস করে। রাগের কিছু অংশ তার নিজের উপর বর্তায়। কিছু অংশ স্ত্রী লাবিনা বেগমের উপর। কিছু অংশ আবার পুঁচকে কন্যা সন্তানটার দিকেও যায়। মোল্যার ধারনা একজন পুরুষ মানুষের বীর্যে দুধরনের পানি থাকে। শক্তিশালী পানি এবং দূর্বল পানি। সঙ্গমের সময় শক্তিশালী পানি স্ত্রী গর্ভে নিক্ষিপ্ত হলে পুত্র সন্তান হয়। দূর্বল পানি স্ত্রীর গর্ভে নিক্ষিপ্ত হলে কন্যা সন্তান হয়। স্ত্রী সঙ্গমের সময় শক্তিশালী পানিকে স্ত্রী গর্ভের দিকে ধাবিত করতে না পারার জন্য মোল্যা প্রথমে নিজেই নিজেকে মনে মনে গাল দেয়। এরপরে শক্তিশালী পানিকে নিজের দিকে টানতে না পারার জন্য প্রকাশ্যে স্ত্রী কে গাল দেয়। শেষে কাঁথাজড়ানো পুঁচকে ‘ অনাকাঙ্খিত দূর্বল পানির প্রোডাক্ট’ যেটা জনসমক্ষে মোল্যার মর্দাঙ্গি কে হেয় করে দিছে সেটার দিকে চোখ কটমট করে তাকায়!
এর পর থেকে মোল্যা সাবধান হয়ে যায়। স্ত্রী সঙ্গমের সময় মনে মনে দোয়া পড়ে- এবার যেন শক্তিশালী পানি আগায় থাকে। এবার যেন একটা পোলা হয়! কিন্তু মোল্যার ঈমান মনে হয় অত শক্তিশালী নয়। কাজেই এবারো দূর্বল পানির জয় হয়। আতুড় ঘরে উচ্চ কন্ঠে ক্রন্দনরত শিশুর মুখের দিকে কেউ তাকায় না। লিঙ্গের দিকে তাকিয়ে উপস্থিত সবার চেহারায় কাল ছায়া পড়ে। আতুড় ঘরের বাইরে মোল্যাকে যারা ‘দুইটা বেহেশতের বাগানের মালিক হয়েছে’ বলে সান্তনা দেয় তাদের কে মোল্যা খিঁচে গালাগাল করে- ‘যা যাহ! মোল্যা এত বলদ নয়, তগো নিজেগো পোলা আছে, মোল্যার মাইয়া হইছে দেইখা মনে হনে খুশি হইছত, হোগার পোলারা!’ গাল খেয়ে ওরা পালানোর পর মোল্লা নিজের নুনুতে হাত বোলায়- এবার দেখায় দেব!
কিন্তু মোল্যা কিছুই দেখাতে পারেনা। আঁতুড় ঘরে তৃতীয় বারের মত ‘নিকৃষ্ট দুই নম্বর মানব’ হিসেবে জন্মানো দ্বিতীয় লিঙ্গটা মোল্যাকে চরম বিপর্যস্ত করে তোলে। বন্ধু ছবর আলী তার দ্বিতীয় বার মেয়ে জন্মানোর সময় রসিকতাচ্ছলে যে আশঙ্কাটা প্রকাশ করেছিল সেটাই মোল্যার সত্য বলে মনে হয়। ছবর আলী খাক খাক করে হেসে বলেছিল- মোল্লার পানি আসলে পুরাই দূর্বল পানি! তার শক্তিশালী পানি ই নাই!! তার বৌ যতগুলো বাচ্চা বিয়াবে সব ‘ মেঞা’ হবে। পোলা হবেনা! খেতের পাশে ছ্যার ছ্যার করে মুততে থাকা ছবর আলীর পোলা’র নুনুর দিকে তাকিয়ে মোল্যার মন চুড়ান্ত খারাপ হয়ে গিয়েছিল! এরকম শক্তিশালি পানির একটা প্রোডাক্ট কি কখনো তার হবেনা? তার ঘরের কাঁথায় ছোট্ট নুনু উঁচিয়ে ছ্যার ছ্যার করে মুতবে না? হতাশার তীব্র অন্ধকার মোল্যার ভেতর টাকে কুঁকড়ে দেয়।
মোল্যা যখন শোকে উন্মাদ প্রায় তখন বন্ধু ছবর মিঞাই তাকে ছবর দেয়। ডেইল পাড়া’র কার যেন পরপর চারটা মেঞা হবার পর পোলা হইছিল। ছবর করলে মোল্যার ও ঘুমায় থাকা শক্তশালী পানি একদিন জেগে উঠবে। ছবর মিয়া আরেকটা কথাও অবশ্য বলছিল। আরেকটা বিয়া করলেও নাকি অনেক সময় ঘুমায় থাকা শক্তিশালী পানি জেগে উঠে। কিন্তু মোল্যা সে পথে যায় নি। সে আঁতুড় ঘরে পাঁচ নম্বর সন্তানের কান্নার আওয়াজ শোনা পর্যন্ত ছবর করেছে। মনে মনে বিড় বিড় করে দোয়া পড়েছে- আল্লাহ এবার যেন সমাজে মোল্যার আর অপমান না হয়। এবার যেন সবাই নিজের চোখে দেখতে পায় মোল্যার সতী সাধ্বী স্ত্রী আস্ত একখান নুনুওয়ালা পোলা বিয়াইছে। মোল্লার থলিতেও খলবলে কইমাছের মত শক্তিশালী পানি আছে। এতদিন খালি ঘুমায় ছিল!!
আঁতুড় ঘরে নবজাতক কান্না করে। আর কেউ কোন আওয়াজ করেনা! নবজাতক চিৎকার করে কান্না করে- আমি এসেছি, এই সুন্দর পৃথিবীতে আমি এসেছি। দেখ, দেখ আমি এসেছি!! অন্ধকার কূসংস্কারে আচ্ছন্ন পৃথিবী চিৎকার করে বলে- তুমি মেয়ে। তোমার জন্ম মানে তোমার বাবার পৌরুষের পরীক্ষায় ফেল করা। তোমার বাবার পানির দৌর্বল্য প্রমান হওয়া। তোমাকে কে আসতে বলেছে? কে?? কে???
‘জ্বলজ্বান্ত অপমানের টুকরা’ টার দিকে তাকিয়ে মোল্যা সাপের মত হিস হিস করে উঠে। তার থলিতে যে দূর্বল পানি ছাড়া শক্তিশালী পানি নাই সেটা নিশ্চিত ভাবে এতদিন কেউ জানত না। কিন্তু এই ‘নরকের কীট’ টা ভুমিষ্ট হয়ে সেই কথাই সারা পৃথিবীর কাছে ঘোষনা করছে। ‘পানি’ দিয়ে এই পৃথিবীতে নিজের পৌরুষ প্রতিষ্ঠার ব্যর্থতা ‘খুনি’ হয়ে গোছাবার উদ্যোগ নেয় মোল্যা।
জন্মদাতা পিতার ঢেলে দেয়া বিষ মুখে নিয়ে মরা শিশুটা চুপচাপ শুয়ে থাকে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এক টা ভু খন্ডে। আশপাশের সবাই ‘পলাতক মোল্যা’ কে খুঁজে বেড়ায়। নিজের ভেতরকার মোল্যা কে কেউ খুঁজেনা।
( গল্প সূত্রঃ ‘ ছেলে না হওয়ায় মেয়ের মুখে বিষ!’- প্রথম আলো, ২য় পৃষ্ঠা, ৪র্থ কলাম, মঙ্গল বার ১ মার্চ, ২০১৬)