সাদা কাফনে ঢাকা মায়ের লাশ টার দিকে তাকায় রফিক। রোগা পাতলা নিস্পন্দ শরীর টা একটা কাপড়ের পুটুলি’র মত খাটের উপর পড়ে আছে। চেহারাটা ফ্যাকাশে মমির মত। মৃত চেহারার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আন্দাজ করার চেষ্টা করে রফিক- মৃত্যুর আগে মা কি তাকে ক্ষমা করেছে নাকি করে নাই! কিন্তু চেহারা টা বড় বেশি জড়। সেখানে কোন অভিমানের ছাপ ও নাই। প্রশান্তির ছাপ ও নাই। ছোট বেলায় রফিক যখন বার আনা দামের সিক্স মিলিওন ডলার ম্যান লজেন্সের জন্য কান্নাকাটি করত আর মা কিনে দিতে পারত না তখন মা ঠিক এরকম নির্লিপ্ত ভাব ধরে থাকত। মা যেদিন স্কুলের বেতন পেত সেদিন রফিক, শফিক এবং জেবার জন্য সিক্স মিলিওন ডলার ম্যান লজেন্স কিনে আনত। লজেন্সের মোড়ক না খুলেই লজেন্সে কামড় দেয়া আড়াই বছরের জেবা বলত- মা, মি, আম্মিই ই, বাবা কোতায়?
ছোট্ট মানুষ টার এই একটা প্রশ্ন মায়ের উজ্জ্বল মুখটাকে মুহুর্তে ম্লান করে দিত। জ্বলজ্যান্ত মানুষ টা সকালে কোট টাই পরে অফিসে যাবার জন্য বের হল। আছরের নামাজের সালাম ফিরিয়ে শোনা গেল- কর্ণফুলিতে নৌকা ডুবি হয়েছে। এ পর্যন্ত তিন টা ডেড বডি উদ্ধার হয়েছে। রাবেয়া খাতুন এর স্বামী সৈয়দ শাহেদ আমিন ছাড়া বাকি দূটা ডেড বডির পায়ের তালু মাছে খেয়ে ফেলেছে। লাশ দাফনের পর চার দিনের ফাতেহা পর্যন্ত অনবরত কোরান শরীফ পড়ে স্বামীর জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন রাবেয়া খাতুন। আল্লাহ পানি তে ডুবে মরলে ত শহীদ হয়? শফিকের বাপ কি শহীদ হবে? সে নদীর পানিতে ডুবছে। তার বৌ, তিন টা অবুঝ সন্তান কি অভাবের পানিতে ডুবে মারা যাবে আল্লাহ? নাকি অন্যের দয়া নিয়ে বেঁচে থাকবে? আল্লাহ তুমি ছাড়া আমি যে আর কারো দয়া চাই না! আমার বার বছর বয়সে সবাই আমার আব্বা কে বলল- আমাকে মাদ্রাসা থেকে নামায় এনে হুজুরের কাছে খয়রাত দিতে। বোন দের মধ্যে আমি ই নাকি সবচেয়ে সুন্দর ছিলাম। আমাকে হুজুরের কাছে খয়রাত দিলে নাকি আমার আব্বার সব গুনাহ মাপ হয়ে যেত! বাবার চেয়ে দশ বছরের বড় নূরানী চেহারার হুজুর আমাকে খয়রাত নেবার জন্য অর্থাৎ বিয়ে করার জন্য একদিন আমাদের বাড়িতে তশরিফ রাখলেন। আমার সব কিছু স্পষ্ট মনে আছে। আব্বা নিজের হাতে হুজুরের ইস্তেঞ্জার জন্য চাপকল থেকে পানির বদনা ভরে দিয়েছিলেন। আব্বা এমনিতে মাথায় টুপি পরতেন না। সেদিন হুজুরের তরিকার চাঁদ-তারা দেয়া নৌকার মত একটা টুপি পরছিলেন। তরিকা টুপি পরে বদনায় করে হুজুরের জন্য আব্বার পানি নিয়ে যাবার দৃশ্য আমি বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখেছিলাম। হুজুরের উপর আমার প্রচন্ড রাগ হয়েছিল। খুব বেয়াদপি একটা কথা মনে আসছিল। হে আল্লাহ, তোমার ত কিছুই অজানা নেই। সেই মুহুর্তে আমি হুজুরের উদ্যেশ্যে ভয়ঙ্কর বেয়াদপি একটা কথা উচ্চারন করেছিলাম। ‘বান্দির পুতের সোনাটা কাইট্টা যদি কুত্তারে খিলাইতে পারতাম!’- আমার মনের এই ভয়ঙ্কর বেয়াদপি কথা তুমি ছাড়া আর কেউ আজ পর্যন্ত জানেনা আল্লাহ।
সেদিন আমার অশিক্ষিত মা ই আমাকে এই জানোয়ারের হাত থেকে রক্ষা করেছিল। সেদিনের আগ পর্যন্ত কে জানত মক্তবের উঠান না মাড়ানো ‘আধা আকল মেয়ে মানুষ’ ওম্মা খাতুনের এত বুদ্ধি! ওম্মা খাতুন আমাকে ডেকে সত্তর বছর বয়েসি নানিবুড়ির বোরখা পরিয়ে দিলেন! ওম্মা খাতুনের বুদ্ধি অনুযায়ী আমি মজলিশের সবার চোখের সামনে দিয়ে নানী বুড়ির বোরখা পরে বের হয়ে গেলাম। ঠা ঠা দুপুরে বিল পার হয়ে চলে গেলাম জুলেখা খালার বাসায়। জুলেখা খালা কে বললাম- ‘খালা আমাকে আগে গরম তরকারি দিয়ে ভাত দাও। তারপর ঢেঁকির ঘরে লুকায় রাখ। এখন ত ধান ভানার সময় না। ঢেঁকির ঘরে কেউ যাবেনা। তিন দিন পর আম্মা এসে আমাকে নিয়ে যাবে!’ জুলেখা খালা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে হঠাৎ কেঁদে দিয়েছিলেন। আমাকে বুকের সাথে চেপে ধরতে ধরতে বলেছিলেন- ‘তুই আমার মা, তুই আমার বুকের মদ্দে থাকবি। ঢেঁকির ঘরে ঢেঁকি থাকুক!’
হুজুরের এক মুরিদ যখন নিকাহ পড়াবার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন ওম্মা খাতুন মড়া কান্না জুড়ে দিলেন- বাড়ির পিছের কাঁঠাল গাছের জ্বীন আমার রাবেয়ারে নিয়ে গেছে রে নিয়ে গেছে! নানীবুড়ির ছুরত ধরে আইসা আমার মেয়েরে নিয়ে গেছে রে নিয়ে গেছে!! হুজুর ঠিক কথাই কইছিল রে ঠিক কথাই কইছিল!! কাঁঠাল গাছে জ্বীন আছে রে জ্বীন আছে!! ওম্মা খাতুন হুজুরের পায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন- হুজুর,আপনে গায়েবানা শক্তি দিয়ে ঠিকই বুঝেছিলেন কাঁঠাল গাছে ‘বেখুস জ্বীন’ এর বাসা! বেখুস জ্বীন যুবতি মেয়ে মানুষ মাথায় কাপড় না দিয়ে গাছের তলা দিয়ে গেলে তারে ধইরা নিয়া যায়। আজকে রাবেয়া মাথায় কাপড় দিয়েই কাঁঠাল গাছের নীচে গেছিল। কিন্তু বাতাসে মাথার কাপড় সরে যায়! বেখুস জ্বীন সাথে সাথে যোয়ান রাজকুমারের ছুরত ধরে রাবেয়ার সামনে এসে বলে- রাবেয়া রাবেয়া তুই কি ওই তিন বিয়া করা( আসলে ছয় বিয়ে, রাবেয়া কে খয়রাত নিতে আসার সময় তিন স্ত্রী বর্তমান ছিল। বাকী তিনজনের দুজন সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মারা যান। ‘খাব’ দেখে একজনের চরিত্র সম্পর্কে সন্দেহ হওয়ায় হুজুর তাকে তালাক দেন) বুড়া শয়তান( নাউজুবিল্লাহ!) টারে বিয়া করবি? তার চে আমারে বিয়া কর!! রাবেয়ারে চোখের পলকে জ্বীনের বাদশার খাস মহলে রেখে এসে জ্বীন নানি বুড়ির বোরখা পরে এখান থেকে পালিয়ে যায়!
ওম্মা খাতুনের গল্প যথেষ্ট গাঁজাখুরি ছিল বলেই হয়ত মজলিশে হাজেরান ওম্মা খাতুনের গল্পে যুক্তি খুঁজে পায়! বিশেষতঃ হাজেরানের প্রায় সবাই হুজুরের কাঁঠাল গাছে জ্বীন থাকার ফতোয়ার সাথে পরিচিত ছিল,অনেকেই নানী বুড়িকে চিনত এবং দুপুর বেলা নানীবুড়িকে বোরখা পরে অনেকেই বেরিয়ে যেতে দেখেছিল!! ওম্মা খাতুন যখন এই গল্প করতেছিল তখন বৃদ্ধা নানী বুড়ি শুন্য চোখে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়েছিল এবং তার মুখ দিয়ে অনবরত লালা পড়ে তার শুকনো খরখরে স্তনের উপর লেপটে থাকা ব্লাউজ ভিজে যাচ্ছিল। এই কুৎসিত নোংরা স্তন থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবার জন্য মজলিশে হাজেরানের কারো কোন চরিত্রের জোর প্রয়োজন হচ্ছিল না।
এভাবে হুজুরের তেলে হুজুর ভেজে সেদিন অশিক্ষিত আধা আকল মেয়ে মানুষ ওম্মা খাতুন আমাকে এই ভয়ঙ্কর বিয়ের কবল থেকে উদ্ধার করেছিল। পরে এই ঘটনা জানাজানি হবার পর হুজুর আমাকে এবং ওম্মা খাতুন কে চরিত্রহীন অপবাদ দেয় এবং আব্বা হুজুরের পরামর্শে ওম্মা খাতুন কে তালাক দেয়। অসহায় আমার আর মায়ের জন্য ফেরেশতা হয়ে আসে জোলেখা খালা। জোলেখা খালা কে ওম্মা খাতুন একদিন বলে- ও জোলায়খা! হুজুরের কাছে মিছা কত্থা কইছি। আমি ত এমনিতেই দোজখে যামু। মরবার আগে আরেকটা গোনা করতে মন চায়!
জোলেখা খালা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল- কি গোনাহ বুবু?
ওম্মা খাতুন বলেছিল- ওইযে পুকুর পাড়ের দক্ষিন মাথায় মেয়েদের স্কুল হইছে না? ওইখানে রাবেয়ারে ভর্তি করাতে মন চায়!
হে আল্লাহ, সেদিন, জোলেখা খালা আর ওম্মা খাতুন, এই দুই অশিক্ষিত আধা আকল মেয়েমানুষ দুইজনে দুই হাত ধরে যখন আমাকে স্কুলের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল তখন তাদের চেহারায় যে একটা আলো ফুটে উঠেছিল সেই আলোর কথা আমি কোন দিন ভুলব না। তাদের ভেতরের সেই আলো টা কেমনে যেন আমার ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল। আমি ফার্স্ট ডিভিশনে ম্যাট্রিক পাশ করেছিলাম।
জায়নামাজে সিজদা দিয়ে রাবেয়া খাতুন হু হু করে কাঁদতে থাকে- ক্যান, আল্লা আমার স্বামীরে ক্যান লইয়া গেলা? হুজুর বদদোয়া দিছিল তাই? হের বদদোয়া তুমি ক্যান শোনলা? হের খয়রাত ত হে ঠিকই পাইছিল! পাশের গ্রামের আজমিরি রে সে খয়রাত পাইছিল। তের বছরের আজমিরির গায়ের রঙ ত নাকি ঠিক কাঁচা সোনার মত ছিল!!
হুজুরের বদদোয়ায় তিন অবুঝ সন্তানের মাতা রাবেয়ার স্বামীর মৃত্যু হলেও ‘অভিশপ্ত বেপর্দা ফার্স্ট ডিভিশনে মেট্রিক পাশের সার্টিফিকেট টা রাবেয়া কে একটা স্কুল মাস্টারি জুটিয়ে দিয়েছিল। সেই স্কুল মাস্টারি টাই রাবেয়াকে পর মূখাপেক্ষী না হয়ে তিন সন্তান কে মানুষ করতে সাহায্য করেছিল।
মায়ের মরা মুখের দিকে তাকিয়ে এই ‘মানুষ’ শব্দটাই রফিকের সামনে বড় একটা প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। রফিক বুয়েট পাশ ইঞ্জিনিয়ার, শফিক ঢাকা মেডিক্যাল পাশ করা ডাক্তার। জেবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা মনোবিজ্ঞানী। কিন্তু রাবেয়ার জায়গা হচ্ছিল না কারো কাছেই! নিউটনের গ্রাভিটি আবিস্কারের মতই সবাই আবিস্কার করে ফেলেছিল- আসলে বাস্তবতা বড় কঠিন!! বাস্তবতার হাইওয়েতে চকচকে ভবিষ্যত সম্পন্ন উজ্জ্বল সন্তান নামক গতিশীল ঝকঝকে গাড়ির যায়গা আছে। সেখানে মা নামক অচল ঝুরঝুরে জৌলুসহীন গাড়িটি রাস্তা ব্লক করলেই ভেতরের অতি শঙ্কিত ট্রাফিক পুলিশ চোখ রাঙ্গায়। হাইওয়ে থেকে সরিয়ে ঝুরঝুরে গাড়িকে কোন কানাগলিতে ঢুকিয়ে দেয়া যায়-সেটা নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়!
রাবেয়া নিজেই তার তিন ছেলে মেয়েকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল-আমাকে ওল্ড হোমে রেখে আয়। আমার কিছু সঞ্চয় পত্র আছে। ওখান থেকে খরচ দেয়া যাবে। আর তোরা নিজেরাও বুড়ো বয়সের ওল্ড হোম খরচ টা রাখিস। সব টাকা খরচ করে ফেলিস না।
রফিক নিজেই উদ্যোগী হয়ে বেশ কম খরচের একটা বৃদ্ধ নিবাস খুঁজে বের করেছিল। বৃদ্ধ নিবাসের সামনে কাঁঠাল গাছ। মা কাঁঠাল ভালবাসে। রেজিষ্ট্রেশন টন শেষ করার পর তিন ভাইবোনের চেহারায় কেমন একটা হাসি খেলে গিয়েছিল! ‘ এতে মায়ের জন্য ও ভাল হল। তাদের জন্য ও ভাল হল’ কেন জানি এই কথাটা তিন ভাইবোন নিজেদের মধ্যে কয়েক শ বার বলাবলি করেছিল!
রাবেয়াকে আজকে সন্ধ্যাবেলাতে বৃদ্ধ নিবাসে রেখে আসার কথা ছিল। এই উপলক্ষে তিন ছেলেমেয়ে আজকে দুপুরে ভাত খাবার পরে মা কত কষ্ট করে তাদের ‘মানুষ’ করেছে তার স্মৃতিচারন করে একটু কান্না করেছিল। রাবেয়া তার ঘরে একা ছিল। কাজেই রাবেয়া কখন মরে গেছে তারা কেউ জানতে পারেনি।