মুখের ভেতর ঘা হয়ে ৫ মিলিমিটার ব্যাসের সাদা একটা গর্ত তৈরি হয়েছে।বিষের মত জ্বলছে। ডাক্তার রা এটাকে অ্যাপথাস আলসার বলে। টেনশন থেকে নাকি হয়। আমি কদিন ধরেই খুব টেনশনে আছি। অফিসে, বাসায় নানান ঝামেলা যাচ্ছে। বাসায় ঝামেলা মানেই বউয়ের সাথে ঝগড়া নয়। ঝামেলার আরো প্রকারভেদ আছে! বউ বলল, তোমাকে না দুতিন মাস আগে দাঁতের ডাক্তার কি একটা ওষুধ দিল মুখের ঘা শুকানোর জন্য। ব্যাথায় কুকুরের মত কুঁই কুঁই না করে ওটাই লাগিয়ে দেখ না!
ওয়ার্ড্রোবের উপরে টিভির পাশে ডাঁই করে রাখা অনেকগুলো ধুলাপড়া বোতলের ভেতর থেকে বউ ই বের করে দিল ছোট্ট কাঁচের বোতল টা। পুরা ধুলা জমে বোতলের গায়ের লেখাটেখা কিছু পড়া যাচ্ছে না। শুধু বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ঘসে একটুখানি M দেখা যেতে মনে পড়ল ওষুধের নাম মিউরাল। বউকে বললাম, এইটা না লাগিয়ে মিউরাল আরেকটা কিনে আনি?
বউ বলল, আহা এক্সপায়ার ডেট আছে কিনা দেখনা!
ধুলা মুছার জন্য এবার বউ নিজেই বাবুর সর্দি মোছা রুমাল এগিয়ে দিল। ধুলা পরিষ্কার করে দেখি এক্সপায়ার ডেট তখনো যায় নাই। কাজেই কটন বাড ওষুধের মধ্যে ভিজিয়ে চোখ বন্ধ করে ঘা তে লাগালাম। আগের অভিজ্ঞতা থেকে জানি এই ওষুধ ঘা তে লাগালে প্রচণ্ড জ্বলুনি অনুভূত হয়। কিন্তু দেখি সেরকম জ্বলল না। টেনশনে স্নায়ু ভোঁতা হয়ে যায় বলে কখনো শুনিনি কাজেই একটু বিস্মিত হলাম!
অফিসে পরদিন একটা প্রেজেন্টেশন ছিল। একটা গল্পও মাথার মধ্যে ঘুর ঘুর করছিল। সেসবের মধ্যে ডুবে গিয়ে মিউরালের কথা আর মনে রইল না। রাতে সব দেখে শুনে মুটামুটি সন্তুষ্ট হয়ে ঘুমাতে যাবার সময় খেয়াল করলাম মুখের ঘা য়ের ব্যাথা কিছুটা কমে গিয়েছে। যাক বাবা, তেজ কমলেও মিউরাল তাইলে পুরা এক্সপায়ার করেনি! কাজেই ঘুমাতে যাবার আগে আরেকবার লাগাব বলে মনস্থির করলাম।
আমি রাতে ঘুমানোর আগে দাঁত ব্রাশ করি। আজকেও তাই করছি। দাঁত ব্রাশ করতে করতে আয়নায় নিজের চেহারা দেখছি। বেসিনের উপরের তাকে মিউরালের বোতল আর পাশে কটন বাডের প্যাকেট রাখা আছে। দাঁত ব্রাশ শেষ হলেই মিউরাল দ্বিতীয় ডোজ লাগাব। হঠাৎ মনে হল আমার মুখের একপাশ টা ভয়ঙ্কর ফুলে উঠেছে। চোখের মণি দুটোও কেমন যেন ঠেলে বেরিয়ে আসছে। কপালে রক্তের একটা দাগ ফুটে উঠেই যেন মিলিয়ে গেল!
আতঙ্কে চিৎকার দিচ্ছিলাম। কিন্তু কোথায় কি! অই ত আয়নায় আমার পুরা স্বাভাবিক চেহারা দেখা যাচ্ছে। পেস্টের সাদা ফেনা জমা দাঁত, লম্বাটে নাক, ঈষৎ ভাঙ্গা গাল আর কিঞ্চিত ঘোলাটে দুটো চোখ আর আক্ষরিক অর্থে বড় কপাল। সব যা ছিল তাই আছে।
বেসিনের কাঁচের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে খেয়াল করলাম দাঁত ব্রাশের আগে মুখ ধুতে গিয়ে যে পানির ঝাপটা বেসিনের আয়নায় পড়েছে তা পিছলে পিছলে নিচে নামছে। মন একটা দূর্বল যুক্তি তৈরি করল। পানির ফোঁটা যেখান দিয়ে গড়িয়ে নামছে সেখানে কাঁচের প্রতিসরাঙ্ক চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে। কাজেই উল্টাপাল্টা প্রতিবিম্ব তৈরি হচ্ছে। কিন্তু কপালের রক্তের দাগ? সেটার কি ব্যাখ্যা?
খুব দ্রুত কটন বাড মিউরালের মধ্যে ভিজিয়ে ঘা এর মধ্যে লেপটে দিলাম। মনে হল এবার ব্যথাটা একটু বেশি লাগল। চোখে হাল্কা শর্ষে ফুল দেখলাম। কিন্তু শর্ষে ফুলের রঙটা টকটকে লাল!
ঘুমাতে যাবার সময় বুকের ভেতর প্রচণ্ড ধুকপুক টের পেলাম। আমার বউ আঁতকে উঠে বলল-তোমার কি হয়েছে?
বললাম- আমার মুখটা একটু ভাল করে ধরে টরে দেখ ত! সব ঠিক ঠাক আছে?
বউ ধড়মড় করে উঠে বসে লাইট জ্বালাল। আমার মুখের প্রতিটা অংশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করল। তারপর বলল, ইস আমাদের বিয়ের সময় তোমার মুখের চামড়া কত টান টান ছিল! এখন ত মনে হচ্ছে লুজ। তুমি কি সত্যি সত্যি বুড়া হয়ে যাচ্ছ ডিয়ার?
‘ওহ হো বলতে ভুলে গেছিলাম! কালকে ত ভোরে উঠে সাইটে যেতে হবে!’ এই কথা বলে বউয়ের মুখ এবং লাইট বন্ধ করে খাটের একপাশে কাত হয়ে চোখ বন্ধ করলাম।
লাল একটা শর্ষে ফুল স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। শর্ষে ফুল টা কোনার দিকে খানিকটা খয়েরি। কেন্দ্রে টকটকে লাল। কেন্দ্রের অংশটা মাঝে মাঝে থকথকে রক্তের আকার ধারণ করছে।
আমি সে অর্থে কোন কিছুর অস্তিত্ব টের পাচ্ছি না। শুধু মাথার ভেতর খুব নিম্ন কম্পাঙ্কের ভোঁতা একটা শব্দ টের পাচ্ছি। আর মনে হচ্ছে আমি এক জায়গায় স্থির নাই। ভাসতে ভাসতে কোন দিকে যাচ্ছে এবং শর্ষে ফুলটাও আমার সাথে সাথে যাচ্ছে। আমি হাত নেড়ে আমার স্ত্রী কে ছুঁয়ে দেখতে চাইলাম। ইয়া আল্লাহ! হাত বলেই ত কিছু নাই!!
নিম্ন কম্পাঙ্কের ভোঁতা শব্দটা হঠাৎ করেই থেমে গেল। শর্ষে ফুলটাও মনে হল হঠাত একবার জোরে দূলে উঠে থেমে গেল। আমি কোন শব্দ বা ভাষা শুনলাম না। কিন্তু আমার চেতনায় কিছু কথামালা টের পেলাম। কথামালা হুবহু এখানে তুলে দিচ্ছি-
আমরা তোমাদের জগতের বন্ধু। তোমাদের জগতে অল্প সময়ের ব্যবধানে কিছু পরিবর্তন দেখা দেবে। সেই পরিবর্তন গুলো তোমাদের জন্য শুভ হবে না বলে আমরা ধারনা করছি। পরিবর্তন গুলো কি রকম একটু ব্যাখ্যা করি।
খুব শীঘ্রই তোমরা ভার্চুয়ালাইজেশনের চরমে পৌঁছে যাবে। তোমাদের পারিবারিক, দাপ্তরিক, সামাজিক সব যোগাযোগ হয়ে যাবে ভার্চুয়াল। ধর তোমার দাঁতে ব্যথা। তোমার ডাক্তারের কাছে যাওয়া লাগবে না। তুমি তোমার ঘরে বসেই ডাক্তারের সাথে ভার্চুয়ালি যোগাযোগ করবে। ডাক্তার তার ঘরে বসে তোমার ঘরের রোবট কে ইন্সট্রাকশন দেবে। ইন্সট্রাকশন অনুযায়ী রবোট দাঁত ফিলিং করে দেবে বা ফেলে দেবে। সব শহরে সেন্ট্রাল ফুড পাইপিং থাকবে। তুমি তোমার পছন্দ অনুযায়ী কানেকশন নিবা। বাটন টিপলেই ‘ফাইন মেশড ফুড’ পাইপ বেয়ে চলে আসবে!
এতটুক শুনে আমার মাথায় অনেক প্রশ্ন চলে আসছিল। তার মধ্যে একটা প্রশ্ন ছিল এরকম,
সন্তান ও কি ভার্চুয়াল মেলামেশার মধ্য দিয়ে জন্মাবে?
আমার প্রশ্ন মনে হয় ওরা বুঝতে পারল। একটু থেমে জবাব আসল,
হ্যাঁ। নির্দিষ্ট বয়সে মেয়েরা ফার্টিলাইজেশন ব্যাঙ্কের নির্দিষ্ট চেম্বারে ডিম্বাণু জমা দেবে। ছেলেরা নির্দিষ্ট চেম্বারে শুক্রাণু জমা দেবে। কম্প্যাটিবিলিটি টেস্ট করে নির্দিষ্ট ডিম্বাণুর সাথে নির্দিষ্ট শুক্রাণুর মিলন ঘটিয়ে কৃত্রিম জরায়ুতে শিশু উৎপাদন করা হবে। সেই শিশু কনভেয়রে চড়ে চলে যাবে তার ‘ডিগ্রি অভ ফ্রিডম’ অনুযায়ী বানানো নির্দিষ্ট বাড়িতে!
শিশু একা কিভাবে বড় হবে?
শিশুর খাওয়া দাওয়া, গোসল, শৌচকর্ম সবকিছু মেশিন দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হবে।
কিন্তু শিশুকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করা? ভালোবাসা? বুকের দুধ খাওয়ানো?
খুব পাতলা বাউন্সিং বালিশ থাকবে! শিশুকে শোনানোর ব্যবস্থা থাকবে চমৎকার সব রাইমস। বুকের দুধের বিকল্প লাগবে। সন্তান গর্ভে ধারণ না করলে বুকে দুধ আসবে কিভাবে?
কিন্তু একটা সমস্যা!
সমস্যাটা তুমি ধরতে পেরেছ বলেই আমরা তোমার সাথে যোগাযোগ করেছি। এই সমস্যা দূর করার জন্য আমরা তোমার মাধ্যমে তোমাদের জগত কে বিস্তারিত নির্দেশনা দিতে চাই।
কিন্তু তার আগে তোমরা কারা সেইটা বল। আমার সাথে তোমাদের যোগাযোগ কিভাবে হল সেটাও বল।
আমরা ইরস। আমাদের কে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের ইন্সপেক্টর বলতে পার। আমরা জগতগুলো ঘুরে ঘুরে দেখি কোথায় কি সমস্যা হতে যাচ্ছে। তারপর সমস্যাটা হবার আগেই সেটা সমাধানের চেষ্টা করি।
জগতগুলো?
সব জগতের প্রাণীরাই মনে করে তারাই একমাত্র অস্তিত্ব!
আমার সাথে কিভাবে যোগাযোগ হল সেটা বল।
পুরো প্রক্রিয়াটা ব্যাখ্যা করা সম্ভব না। যতটুকু সম্ভব সেটা বলি। তোমার চিন্তা তরঙ্গ আমরা প্রথমে ডিটেক্ট করলাম। তারপর তোমার কো অর্ডিনেট ডিটেক্ট করলাম। এখন তোমাকে আমাদের নেটওয়ার্কে আনার জন্য তোমার মস্তিষ্কের সাথে যোগাযোগ করা দরকার। তোমার বাসায় বোতলে রাখা একটা মেডিসিনের ইন্টার মলিকিউলার স্পেসে আমরা ঢুকে গেলাম!
ইন্টার মলিকিউলার স্পেসে ঢুকে গেলে?
বাহ। তোমাদের জগতে নিউক্লিয়াস আর ইলেকট্রনের মধ্যেই ত কত জায়গা খালি!
কিন্তু কিভাবে বুঝলা যে আমি ঐ মেডিসিন ইউজ করব?
তোমাকে ত বলেছি ই সব কথা বোঝাতে পারব না। কারন তোমাদের আর আমাদের মধ্যে মাত্রার পার্থক্য আছে!
আমার মস্তিষ্কের মধ্যে কিভাবে গেলা?
যেকোন একটা স্নায়ুকোষে ঢুকতে পারলেই মস্তিষ্কে পৌঁছানো সম্ভব!
আমি আমার দেহের কোন অঙ্গের অস্তিত্ব টের পাচ্ছি না কেন?
সাময়িক ভাবে তোমার মষিষ্ক কে বিভক্ত করা হয়েছে। দেহের কার্যক্রম সচল রাখার জন্য যতটুকু দরকার সেটা রেখে বাকী মস্তিষ্ক কে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।
সেটার প্রয়োজন ছিল কি?
আমরা প্রয়োজন ছাড়া কিছু করিনা। এখন তোমার মস্তিষ্কের বিচ্ছিন্ন অংশের কর্মক্ষমতা প্রায় একষট্টি পার্সেন্ট। দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে না আনলে আট নয় পার্সেন্টের বেশি হত না।
আমার দেহটা কি আমার ঘরে চেতনাহীন ভাবে পড়ে আছে? আমার বউ বাচ্চা?
তুমি অল্প কিছু সময় পরেই ফেরত যাবে। তোমার বউ বাচ্চা ঘুমাচ্ছে।
ওরা কিছু টের ই পাবেনা।
তোমাদের ধন্যবাদ ইরস। এখন বল আমি পৃথিবীর জন্য কি করতে পারি?
পৃথিবী?
হ্যাঁ আমাদের সুন্দর গ্রহটার নাম পৃথিবী!
তুমি এখন তোমার ভাষায় বল, ভবিষ্যতে তোমাদের পৃথিবীতে যেভাবে শিশু জন্মদান এবং পালন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে তাতে কি কি সমস্যা হবে?
আমরা বাচ্চাদের আদর করে যে বুকে জড়িয়ে ধরি এটা কিন্তু বাচ্চারা নিবিড় ভাবে অনুভব করে। এই ‘ভালোবাসা তরঙ্গ’ বাচ্চার মানবিক গুনের বিকাশ ঘটায়। এখন এই ভালোবাসা তরঙ্গের সাথে এই আদি অন্তহীন মহাবিশ্বের ‘মূল বিন্দু’র সম্পর্ক! অস্তিত্বের সম্পর্ক!! একে যান্ত্রিক উপায়ে তৈরি করা সম্ভব না। এখন যেই শিশুরা এই ভালোবাসা তরঙ্গ না পেয়ে বড় হবে তাদের ত মানবিক গুনের বিকাশই ঘটবে না!
তুমি তোমাদের জগতের ভয়াবহ একটা সমস্যাকে সুন্দর ভাবে ডিকোড করে দিয়েছ। এখন আমাদের কাজ হবে এই সমস্যা থেকে তোমাদের পৃথিবী কে মুক্ত করার ব্যবস্থা করা।
কিভাবে?
তুমি আগে তোমার জগতে ফিরে যাও হে অনন্য মানুষ! তোমার জগতের মানুষকে ‘ভালোবাসা তরঙ্গে’র ধারনাটা দাও। বাকী টুকু আমরা করব!
তোমরা নিজেরাই করবে?
যখন প্রয়োজন হবে আমরা যোগাযোগ করব। তুমি শুধু ঐ মেডিসিনের বোতলটা একটা নির্দিষ্ট জায়গায় রাখিও। তাতে আমাদের সময় বাঁচবে!আপাতত বিদায়।
বিদায় ইরস!
বিদায় অনন্য মানুষদের একজন!
অন্ধকারের একটা পর্দা ঝুপ করে নেমে এল। লাল শর্ষে ফুলটা ধীরে ধীরে অন্ধকারে হারিয়ে গেল। ভারী ভেজা একটা অনুভূতি আমাকে বলে দিল আমার মস্তিষ্কের বিচ্ছিন্ন অংশ আবার আমার দেহে ফেরত এসেছে।
আমার চার বছরের ছোট্ট বাবা নিঃসীমা কখন আমার বুকের ভেতর এসে গুটিসুটি মেরে ঘুমাচ্ছে। ভালোবাসা তরঙ্গের একটা কম্পাংক ও যাতে মিস না হয় সেজন্য আমি আমার সোনাবাবাকে শক্ত করে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলাম।