টিক টিক টিক।ঘড়ির কাঁটায় ১২টা বেজে ২০ মিনিট।২ সপ্তাহের ক্লাসের সমাপ্তি।৮ মাসের লাফালাফির পর ইতিমধ্যে সবার বুঝা হয়ে গেছে বুয়েট কি জিনিস!
আমি আর মাহতাব হাঁটা দিলাম মাঠের দিকে।উদ্দেশ্য গল্প গুজব করে যোহরের আজান পর্যন্ত সময় কাটানো।শান্তি তখনও দূর অজানায়।ল্যাব যে এখনও বাকি।
টিপ টপ টিপ টপ।আক্ষরিক অর্থেই টিপ টিপ বৃষ্টি।মাঠের পাশে বসার জায়গাগুলো ঠিক গাছের ছায়ায় এমনভাবেই তৈরী যে ভাল রকম বৃষ্টিতে দিব্যি বসে থাকা যায়,বৃষ্টির ফোঁটাও পড়বে না।
বোঝাই যায় কোন ইন্জিনিয়ারের বুদ্ধি।নাহলে এত নিখুঁত হওয়া সম্ভব না।সেই নাম না জানা মানুষটির প্রতি শ্রদ্ধা।
সামনে মাঠ,ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি।পুরো মাঠের সীমানা জুড়েই গাছের সারি।কাজেই যতদৃর দৃষ্টি যায় কেবল ঘাস-পাতার সবুজ আর আকাশের নীল।এক কোণে লাল ইটের ছাত্রকল্যাণ ভবন কেমন যেন বেমানান ঠেকছে।
ভেজাও না,শুকনাও না,বৃষ্টির ফোঁটায় সবকিছুই সিক্ত।এমন দিনে বন্ধুর সাথে জীবন দর্শনের তত্ত্ব দেয়াটা আসে!
মাঠে একাই ছিলাম কিছুক্ষণ।অতঃপর ফুটবল নিয়ে কয়েকজন সিনিয়র ভাইয়ার প্রবেশ।নিয়ম-অনিয়মের বালাই নেই,নেই হার-জিত,কেবল ফুটবল খেলাটাই যেন আছে।যে যার মত খেলছেন।আমরা দর্শক সারিতে।
ঠিক এমন সময়টায় গুটি গুটি পায়ে DSLR ক্যামেরা হাতে আরেক সিনিয়রের প্রবেশ।এদিক ওদিক উত্সুক দৃষ্টি।হেঁটে চললেন ধীর পায়ে মাঠের ঐ পাশে।
এক পাশে ফুটবল খেলা চলছে,এক পাশে ছাত্রকল্যাণ ভবন,এক পাশে দর্শক সারিতে আমরা আর আরেক পাশে DSLR হাতে সেই ভাইয়া।মাঝ মাঠে অসীম শূন্যতা।যেন মিডফিল্ডার বিহীন এক দল যাতে শুধু স্ট্রাইকার আর উইঙ্গার!
প্রথমে দাঁড়িয়েই ছিলেন।কিছু সময় না যেতেই আমার চোখে ধরা পড়লেন হাঁটু গেঁড়ে বসা অবস্থায়।ভাবলাম মাঠে কাদা,প্যান্ট নষ্ট হচ্ছে।আমাদের দুই জনের জন্য তখনও আরও চমক অপেক্ষায়।আবিষ্কার করলাম উপুড় হয়ে সটান শুয়ে পড়েছেন তিনি।অখণ্ড মনযোগে ক্যামেরা তাক করা ঘাসের দিকে!
আযান হলো।একসময় উঠলাম।নামায পড়ে গন্তব্য কেমিস্ট্রি ল্যাব।কেটে গেছে প্রায় ৪০ মিনিট।মাঠের পাশ দিয়ে যাবার লোভ সামলানো অসম্ভব।পা বাড়ালাম সেদিকে।
আগের বারের তুলনায় এবার পার্থক্য শুধু একটাই,উনার মাথা এখন উল্টা দিকে।দেখে মনে হল উনি যেন স্থির আর পুরো দুনিয়াটা যেন ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে।ধীর স্থির,নিঃশ্বাসটাও যেন আটকানো।বিশ্বাস করুন,এই একটা পার্থক্য না থাকলে ধরেই নিতাম উনি ঘুমাচ্ছেন।নাহ,ভুল বলা হল।ঘুমাতেও বোধহয় আরও কম মনযোগের প্রয়োজন।
জীবনে কখনও এত মনযোগ দিয়ে কাউকে কিছু করতে দেখিনি।আর নিজের কথা?সে আর না বলি।তাহলে অমনযোগ শব্দটারও অসম্মান হবে।রবার্ট ব্রুস নাকি মাকড়শাকে দেখে নতুন করে যুদ্ধে নেমেছিলেন।আমার যুদ্ধ তো এখনও শুরুই হয় নাই।জীবন যুদ্ধে কি হবে জানি না,অন্তত আজকের ভাইয়াটার কাছ থেকে প্রেরণা পাবো আজীবন।হয়ত তাঁর সাথে আমার কখনই পরিচয় হবে না।তবে চিরজীবন তাঁকে একটিবার দেখার ইচ্ছা পুষে রাখবো নিজের ভিতর।হয়ত খুব সামান্য কিছুই হব আমি,তবে কথা দিচ্ছি চিরজীবন তাঁর কথা ভেবে আরও উদ্যমী হবার চেষ্টা করে যাবো ইনশাআল্লাহ।ভাইয়ার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।আমি সত্যিই অভিভূত!