কর্তৃবাচ্য: "হালাকু খাঁ বাগদাদ ধ্বংস করেন।"
কর্মবাচ্য: "হালাকু খাঁ কর্তৃক বাগদাদ ধ্বংস হয়।"
ছোটবেলায় একবারও পরীক্ষার খাতায় বাচ্য পরিবর্তনের প্রশ্নে লিখতে হয় নি বা বই থেকে পড়ে মুখস্থ করতে হয় নি এমন পাঠক পাওয়া হয়ত দুষ্করই হবে। প্রশ্ন হল, কে এই হালাকু খাঁ? কি তার পরিচয়? কেন ধ্বংস করলেন তিনি বাগদাদ? মোঙ্গল ইতিহাসের সবচেয়ে নিষ্ঠুর এই সেনাপতি কেবল বাগদাদ নয়, ধ্বংস করেছিলেন আরও বহু সমৃদ্ধ নগর, জনপদ, হত্যা করেন লাখ লাখ মানুষ।
পৃথিবীর ইতিহাসে দুর্ধর্ষ আর নৃশংস জাতির তালিকায় মোঙ্গল জাতির নাম গুরুত্বের সাথে আলোচিত হয়। মোঙ্গল জাতির কথা বললেই যার নাম আসে তিনি হলেন দ্যা গ্রেট চেঙ্গিস খাঁ। এক কথায় বললে, চেঙ্গিস খাঁ ছিলেন দুর্ধর্ষ মোঙ্গল জাতির জনক। বর্বর, যুদ্ধবাজ আজ যাযাবর মোঙ্গল গোত্রগুলোকে একত্রিত করে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে চেঙ্গিস খাঁনই বিশ্বের ইতিহাসে তাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অধিষ্ঠিত করেন। মোঙ্গল রীতি অনুযায়ী , পুরুষদের প্রথম বিয়ে হত পারিবারিকভাবে এবং রাজাদের ক্ষেত্রে এই প্রথম স্ত্রীই সম্রাজ্ঞী হতেন। তবে প্রায় সব মোঙ্গলই অসংখ্য বিয়ে করতেন। চেঙ্গিস খাঁনের প্রথম স্ত্রী বোরকের গর্ভে চেঙ্গিস খাঁনের পুত্রসংখ্যা ছিল চার- ইয়োচি, চাগাতাই, ওগেদেই এবং তলুই। চেঙ্গিস খাঁনের মৃত্যুর পর তাঁর ইচ্ছানুযায়ী উত্তরাধিকার হন ওগেদেই খাঁন এবং বাকি পুত্র এবং তৎকালীন সময়ে প্রাপ্তবয়স্ক নাতিরা ওগেদেই এর অধীনে বিভিন্ন অঞ্চলের শাসক নিযুক্ত হন। মোঙ্গলদের ভাষায় এই অঞ্চলগুলোকে 'খানাতে' বলা হত। হালাকু খাঁ ছিলেন চেঙ্গিস খাঁনে নাতি। চেঙ্গিস খাঁনের কনিষ্ঠ পুত্র তলুইয়ের বিয়ে হয় কেরইত গোত্রের রাজকন্যা সোরঘাঘতানি বেকির সাথে। আরিক বোকে, মোঙকে খাঁন, হালাকু খাঁন আর কুবলাই খাঁন- চার ছেলের জন্ম হয় তাঁদের ঘরে।
মোঙ্গলদের ধর্ম নিয়ে অনেকেই ভুল ধারণা পোষণ করেন। মোঙ্গলরা কেউ মুসলিম ছিলেন না। মুসলিম হওয়া দূরে থাক, ইসলাম ধ্বংস ছিল তাঁদের অন্যতম লক্ষ্য। নামের শেষে 'খাঁন' দেখে হয়ত অনেকেই ছোটবেলায় ভাবতেন তাঁরা মুসলিম এবং মুসলিম হয়েও কি করে এত নিষ্ঠুর ছিলেন, বিশেষত বাগদাদের মত পবিত্র মুসলিম নগরীতে কিভাবে তাঁরা ধ্বংসযজ্ঞ চালালেন- এমন প্রশ্ন হয়ত অনেকের মনেই জেগেছে। বস্তুত, মোঙ্গলরা ছিলেন তাঁদের যাযাবর জাতির নিজস্ব ধর্মের অনুসারী। মোঙ্গল জাতির পিতা চেঙ্গিস খাঁনের আসল নাম ছিল তেমুজিন। 'চেঙ্গিস খাঁন' তাঁর নিজের দেয়া নাম যার অর্থ 'মহান' ব্যক্তি। তাঁর স্বীয় বংশ ছাড়াও গোত্রপ্রধানদের নামের শেষেও 'খাঁন' যুক্ত হত সেসময়। আবার দেখা যায়, হালাকু খাঁনের সম্রাজ্ঞী ছিলেন দোকুজ খাতুন। এখানেও বিপত্তি! নাম 'খাতুন' হলেও তিনি ছিলেন খ্রীস্টান। কিন্তু হালাকু খাঁন নিজে ছিলেন বৌদ্ধ। অত্যন্ত কুশলী এবং দূরদর্শী চেঙ্গিস খাঁ তাঁর সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে ধর্মীয় উদারতে ঘোষণা করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু অনেক পশ্চিমা ইতিহাসবিদের মতে তিনি বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মের প্রতি কিছুটা বেশী সহানুভূতিশীল ছিলেন। মোঙ্গল সাম্রাজ্য বিস্তৃত হতে শুরু করলে মোঙ্গলদের অনেকেই এমনকি চেঙ্গিস খাঁনের উত্তরাধিকারীরাও বেশীরভাগ খ্রিস্ট নতুবা বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হন। রাশিয়া এবং পারস্যের অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, চেঙ্গিস খাঁনের বড় ছেলে ইয়োচিকে চেঙ্গিসের নির্দেশে বিষ খাইয়ে হত্যা করা হয়। উরঘ দখলের সময় ইয়োচি আপত্তি করেছিলেন। এই সমৃদ্ধ নগরীতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালান চেঙ্গিস খাঁ। ক্রুদ্ধ ইয়োচি পিতাকে পাগল আখ্যা দেন এবং সুলতান মাহমুদের সাথে চুক্তি করে মুসলিমদের সাহায্য করেন এবং নগরীর পুনরুদ্ধারে সাহায্য করেন। ভাইদেরকে ইয়োচি বলেছিলেন যে, পিতাকে হত্যা করতে পারলে খুশি হতেন। ধারণা করা হয়, এ কারণে চেঙ্গিস তাঁকে গোপনে হত্যার আদেশ দেন।
হালাকু খাঁনের মা সোরঘাঘতানি ছিলেন খ্রিস্টান। তিনি ছিলেন তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমতি মহিলা। তিনি মোঙ্গল রাজনীতি সফলতার সাথেই নিজের ছেলেদের অনুকূলে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। মূলত তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত ভূমিকাই তাঁর সব ছেলেকে নেতা হবার সুযোগ এনে দেয়, মোঙ্গলদের ভাষায় যাকে মূলত 'খাঁন' বলা হয়ে থাকে। ১২৫১ সালে মোঙকে খাঁ সম্রাট নির্বাচিত হন। খাঁন নির্বাচিত হয়েই মোঙকে এক বিশাল সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন। বিশাল সেনাবাহিনী মানে বিশাল দায়িত্বও বটে। তবে ১২৫৫ সালে মোঙকে তাঁর এই বিশাল বাহিনীর নেতৃত্ব পরম নির্ভরতায় তুলে দেন তাঁর ভাই হালাকু খাঁনের হাতে। মোঙ্গলদের ইতিহাসে বৃহত্তম বাহিনী গড়ে উঠেছিল হালাকু খাঁনের নেতৃত্বে। অন্য কোন মোঙ্গল সম্রাট দূরে থাক, চেঙ্গিস খাঁনের চেয়েও বড় ছিল হালাকু খাঁনের বাহিনী। কথিত আছে, সেসময় প্রায় সমগ্র মধ্য এশিয়া এবং রাশিয়া-ইউরোপের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত মোঙ্গল সাম্রাজ্যের সকল যুদ্ধে যেতে সক্ষম পুরুষদের পাঁচ ভাগের এক ভাগ ছিল হালাকু খাঁনের বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত। আরেকটি ব্যাপার হল হালাকু খাঁনের বাহিনী ছিল মূলত 'Conquering Force' অর্থাৎ, যে বাহিনী কেবল অন্য এলাকা দখলে যুদ্ধ করত। মোঙ্গলদের নিজস্ব প্রতিরক্ষা বাহিনী, খাঁন বা নেতাদের নিরাপত্তারক্ষী ছিল আলাদা। এহেন মোঙ্গল সাম্রাজ্যে চাষাবাদ বা ব্যবসা কে করত, এমনকি নতুন মোঙ্গল সন্তানদের জন্মই বা কিভাবে হত সেটা তারাই ভাল জানে!!!
মোঙ্গল সৈনিকরা ছিল অশ্বারোহী। ভৌগোলিক কারণে প্রাকৃতিক ভাবেই তারা হিংস্র ও কষ্টসহিষ্ণু ছিল। ছোটবেলা থেকেই মোঙ্গলরা ঘোড়ায় চড়তে পারদর্শী হয়ে উঠত। মোঙ্গল তীরন্দাজরা ছিল খুবই দক্ষ এবং তাদের অশ্বারোহী তলোয়ারধারী সৈন্যরা ছিল সমপরিমাণ নিষ্ঠুর। দিনের পর দিন ঘোড়ার পিঠে দৌড়ে বেড়ানোর ক্ষমতা ছিল তাদের। মার্কো পোলোর বর্ণনায়, গোসল, বিশ্রাম এমনকি খাওয়ার জন্যও বিন্দুমাত্র না থেমে একটানা ১০-১৫ দিন সওয়ারী করে যেতে সক্ষম ছিল মোঙ্গল যোদ্ধারা। মোঙ্গলদের রণ প্রশিক্ষণ ছিল খুবই কঠোর এবং এখনকার সৈনিকদের মতই শান্তিকালীন সময়ে প্রশিক্ষণের শিক্ষণগুলো অনুশীলন করানো হত। প্রায় এক হাজার বছর আগে যুদ্ধক্ষেত্রে মোঙ্গলরা যেসব কৌশল দেখিয়েছিল তার অনেকগুলোই ছিল সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে এবং সেগুলো আজও আধুনিক রণকৌশল হিসেবে বিবেচিত। মোঙ্গল জাতির জনক চেঙ্গিস খাঁনই সর্বপ্রথম সরাসরি তীর না ছুঁড়ে হাওয়ায় তীর ছোঁড়ার রীতি প্রচলন করেন, অনেকটা এখনকার মিসাইল ছোঁড়ার মত। মোঙ্গল তীরন্দাজরা ছিল খুবই হালকা বর্মে সজ্জিত। যে কোন তাঁর এই কৌশলগুলো মোঙ্গলদের বহুদূর থেকে এবং যেকোন অবস্থায় যেকোন দিকে এমনকি পেছনেও তীর ছুঁড়ে লক্ষ্যভেদে সক্ষম করে তুলেছিল। মোঙ্গলরাই সর্বপ্রথম বিশাল বাহিনীতে ছোট ছোট ইউনিট গড়ে তোলে যার ফলে কামানের গোলা ছুঁড়লেও তাদের ক্ষয়ক্ষতি কম হত। মুসলিমদের পর মোঙ্গলরাই তাদের অফিসারদের রক্ষায় গুরুত্বারোপ করে। সেসময় যুদ্ধে ইউরোপীয় অফিসারদের হত্যা করা খুব সহজ হলেও মুসলিম ও মোঙ্গল অফিসাররা সর্ব অবস্থায় অধীনস্থ সৈনিকদের দ্বারা রক্ষিত হত। যেকোন পরিস্থিতির জন্য মোঙ্গলদের সবসময় প্রস্তুত রাখা হত যা এখনকার সৈন্যবাহিনীগুলোতে করা হয়। প্রতিটি মোঙ্গল সেনাদল ১০ জনে গঠিত হত যার মধ্যে ৬ জন তীরন্দাজ এবং ৪ জন বল্লমধারী থাকত। বল্লমধারীরা সম্মুখ সমরে অংশ নিত, যার কারণে তারা ছিল খুবই ভারী বর্মে ঢাকা। মোঙ্গলরা তাদের ঘোড়াগুলোকে খুবই ভালবাসত এবং মোঙ্গলদের ঘোড়াগুলোও সৈনিকদের মত লোহার বর্মে ঢাকা থাকতো। ফলে শত্রুর তীরে ঘোড়াগুলোর ক্ষতি হত না। অপরদিকে অন্যান্য বাহিনীতে এই প্রচলন ছিল না। ফলে যুদ্ধে মোঙ্গলদের তীর শত্রুসেনা বিশেষত নাইটদের(Knights) বর্ম ভেদ করতে ব্যর্থ হলে মোঙ্গলরা তাদের ঘোড়াগুলোকে মেরে ফেলত যা শত্রুসেনাদের শক্তি অনেকখানি কমিয়ে দিত। মোঙ্গল তীরগুলো ছিল বিশেষভাবে তৈরী যাতে অন্য কেউ, বিশেষত শত্রুরা সেই তীর মোঙ্গলদের দিকে ছুঁড়ে মারতে না পারে। রণক্ষেত্রে বহুদূর থেকে মোঙ্গল তীরন্দাজরা বৃষ্টির মত তীর ছুঁড়ে শত্রুদের হত্যা বা ছত্রভঙ্গ করে দিত যার ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বল্লমধারীদের জন্য ধ্বংসলীলা চালানো ছাড়া আর তেমন কোন কাজ অবশিষ্ট থাকত না। দ্রুতগতি বজায় রাখতে প্রত্যেক মোঙ্গল সেনার একাধিক ঘোড়া থাকত যাতে করে ঘোড়া বদল করে গতি বজায় রাখা যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে মোঙ্গল সেনারা দিনে ১৬০ কিলোমিটার পথ পর্যন্ত পাড়ি দিতে সক্ষম ছিল যা তখনকার সময়ে ছিল এক প্রকার অসম্ভব। ফলে কখনও কখনও শত্রুরা তাদের অবস্থান আঁচ করতে পারলেও, তাদের অনুমিত সময়ের অনেক আগেই মোঙ্গলরা হানা দিত এবং শত্রুদের হতবাক করে দিত।
শেষ পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মে, ২০১৪ রাত ৮:৫৬