দুলাল মিয়া জার্মানী এসেছিলেন জাহাজের খোলে চড়ে। সেই ১৯৯০ সালের কথা। সেই শ্রীলঙ্কা থেকে দালাল জাহাজে তুলে দিয়েছিল কেবিন বয় হিসেবে। কৃষ্ণসাগরের তীরে বুলগেরিয়ার ভার্নাতে নেমে পালিয়ে গেলেন। তখন পূর্ব ইউরোপে সীমান্ত বলতে কিছু নেই। রাতের পর রাত না খেয়ে না ঘুমিয়ে এলোমেলো পুলিশের তাড়া খেয়ে একসময় তরকারীর ট্রাকে করে ইউক্রেনের কোন একটা শহরে পৌছলেন। তার সাথে ছিলেন আরো চার বাঙালী। সবাই দেশ ছেড়েছেন আর্থিক নিরাপত্তার আশায়। সেখান থেকে আরেকটা ট্রাকে করে আরেকজন দালালের মাধ্যমে লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে বাল্টিক সাগরের কাছে জঙ্গলে পালিয়ে ছিলেন প্রায় একমাস। তখন প্রায়ই দুদিন একদিন করে উপোষ যেত। জঙ্গলে এক ভারতীয় দালালের খামার বাড়িতে থাকতে হয়েছিল। বাইরে প্রচন্ড ঠান্ডা। তার মধ্যে অভুক্ত। প্রতিদিন ভেবেছেন মৃত্যুই হয়তো রক্ষা করতে পারে এই নরক থেকে। তারপর একদিন সেই দালাল সাগরপাড়ের একটা কন্টেইনারের ভিতরে ভরে দিলো। তারপর তারা কোথা দিয়ে কোথা যাচ্ছেন কিছুই জানতে পারেন নি তারা টানা ছয়দিন। কন্টেইনারের ভিতরে অন্ধকার। সঙ্গে কিছু শুকনো রুটি ছিল, দুদিনেই শেষ। তারপর একসময় কন্টেইনারের দরজা খুলে বেরিয়ে অন্ধকারে দৌড় দিতে গিয়ে ধরা পড়লেন। ভাষা জানেন না। আগেও জানতেন না। এতোদিন দালাল বাঁচিয়েছেন। সেই দালালের দাবীমতো এটা জার্মানী হবার কথা। একটা ছোট কাগজে শহরের নামও লেখা ছিল। পুলিশ আগাপাশতলা খালি করে দেওয়ায় সেটা দেখারও উপায় নেই। তারপর উদ্বাস্ত হিসেবে পাঠানো হলো "লাগারে"। সেখানে পরিচয় হলো আরো অনেক ভাগ্যান্বেষীর সাথে। কেউ কেউ হাঁটাপথে পোল্যান্ড পাড়ি দিয়ে পূর্বজার্মানীর কোথাও ধরা পড়েছেন। কেউ কেউ বার্লিনে ঢুকে পড়ার পরে ধরা পড়েছেন। সবাই জ্ঞানীলোকের মতো দালালের পরামর্শে আগেই পাসপোর্ট ছিড়ে ফেলেছেন। কারো কোনদেশ নেই। কেউ পরিচয় দিচ্ছেন শ্রীলঙ্কান,কেউ পাকিস্তানী, কেউ বাংলাদেশে আটকে পড়া বিহারী। তারপর আস্তে আস্তে অনেক ঘটনাই ঘটলো। কেউ কেউ ফিরে যেতে বাধ্য হলেন। দুয়েকজন মারা গেলেন। দুলাল মিয়ার ভাগ্য ভালো। তিনি তার ভিসিআর দেখা বিদ্যায় নিজেকে বিহারী বলে দাবী করলেন। মৃত একজনকে নিজের ভাইও বানিয়ে দিলেন। তারপর কাজের অনুমতি, আর কোনরকমে কোন শ্বেতাঙ্গীনীর কৃপালাভের চেষ্টা।
শহরের নাম ব্রেমারহাভেন। সরকারী টাকায় জার্মান ভাষা শিখতে গেলেন। কিছুটা এলোমেলো শব্দ আর বাকিটা ঈঙ্গীতে চালিয়ে নেয়ার বিদ্যা রপ্ত হলো একসময়। কাজ জুটলো একটা ইতালিয়ান রেস্তোরার কিচেনে। সেখানে বারে কাজ করতেন এক ইতালীয় সুন্দরী। তাকে হৃদয়ের কথা বলতে গিয়ে সেই চাকরি গেল। সুন্দরী ছিলেন মালিকের শালী। তারপর পিজার দোকানে। সেই দোকান লাটে উঠলে একটা লেবানিজ তরকারির দোকানে,সবশেষে সমুদ্রবন্দরের কাছে একটা বারে। সেখানে নানারকম ককটেল বানাতে শিখলেন। রকমারী মদের নাম জানলেন। একসময় সেখানেই কপাল খুলে গেলো।
তখন কাজ থেকে বেরিয়েই ডিসকোতে ঢুকতেন। বহু সাধনায় শেষ পর্যন্ত এক রণক্লান্ত অ্যালকোহলিক মধ্যবয়সী জার্মান নারীর কৃপা মিললো। বিয়ে হলো। কাগজ হলো। বিয়ের বছর ঘুরতেই পুত্রের মুখ দেখলেন। সেই বাবদ সরকারী অর্থও পেতে থাকলেন। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা প্রথম কিছুদিন পাত্তা না দিলেও পরে জামাই হিসেবে গ্রহণ করলেন। ভদ্রমহিলার এটা তৃতীয় বিবাহ । মেয়ের জীবনে স্থিতি এনে দেয়ায় দুলাল মিয়ার কাছে শ্বশুর-শাশুরী কৃতজ্ঞ। পাঁচ বছর পরে একটা লাল টুকটুকে পাসপোর্ট হাতে এলো। সিরাজদিখানের মোকাম্মেল মিয়ার চতুর্থ পুত্র দুলাল মিয়া হলেন ফেডারেল রিপাবলিক অফ জার্মানীর গর্বিত নাগরিক।
এদিকে সেই সময়ে সাথে আসা অন্য বাঙালীদের অনেকেরই কাগজ হয়েছে। কাগজ হবামাত্রই তারা দেশে গিয়ে একটা করে বঙ্গললনা তুলে নিয়ে এসেছেন। তারা কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ করেছিলেন। কাগজ হবার পরে বিল চুকিয়ে জার্মান বউ বিদায় করেছেন সবাই। একটা সমান্তরাল বাঙালী সমাজ গড়ে উঠতে শুরু করেছে। সেখানে দুলাল মিয়ার কদর কমতে লাগলো ধীরে ধীরে। দুলালের বউ তাকে ভালোবাসে। নিজেরও মায়া পড়ে গেছে। কিন্তু সপ্তাহে একবার তুর্কি ক্লাবের তাসের আড্ডায় গেলে নিজেকে অন্যগ্রহের মানুষ মনে হয়। সেদিন সেলিমভাই এর আব্বা-আম্মা এসে বেড়িয়ে গেলেন। দুলাল মিয়াকে দাওয়াত দিলেও তার বউকে ডাকা হয়নি। দুলাল গেলো না। পরে সেলিম ভাই তাকে আলাদা ডেকে ক্ষমা চেয়েছেন। এর আগে রাজুভাই তার ছেলের জন্মদিনে সব বাঙালী পরিবারকে ডাকলেও দুলালের পরিবার বাদ গিয়েছিল। রাজুভাই এর সাথে সেই থেকে কথা বন্ধ। এক রবিবার সন্ধ্যায় বারীভাই একা বসেছিলেন ক্লাবে। তার সাথে দুলালের খাতির একটু বেশী। বারীভাই এখনো বিয়ে করেননি। করার সময়ও পেরিয়ে গিয়েছে বহু আগে। তিনি চিরকুমার এসেছিলেন অনেক অল্পবয়সে শ্রমিক হিসেবে। থেকে গেছেন কোন অবৈধ কৌশল ছাড়াই। তার কাছে দু:খের কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলে দুলাল। বারীভাই বললেন, "তুমি তো মিয়া হ্যাপিলি ম্যারিড। বউপোলা নিয়া শ্বশুরবাড়ি থাকো। দরকার কি তোমার বাঙ্গালী সমাজের? সংসারে মন দাও মিয়া। যেই ক্যাচালের কথা কইতাছো সেইটা সমাধান হইবো না। এই সংসার ভাইঙ্গা অর্ধেক বয়সের একটা বিয়া কইরা আনলে পরে পস্তাইবা"।
দুলাল বোঝে আবার বোঝেও না।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০০৮ বিকাল ৪:৫৮