এবার আমেরিকার ডিসি মেট্রো এলাকায় আমরা ঈদ পালন করলাম ডিসেম্বরের ১৯ তারিখে। আগে থেকে ছুটি নিয়ে সকাল নয়টার ঈদের জামাত ধরলাম বাসার কাছে অনুষ্ঠিত এক অডিটেরিয়ামে। বড়ো জামাত হয়েছিল ডিসিতে। সেখানে যাওয়া হয়নি। প্রতিবারের মতো কোরবানী দেওয়ার একটা ইচ্ছে আছে। তবে আশেপাশের বন্ধুবান্ধবরা এই ঠান্ডায় কোরবানী দিতে মোটেও ইচ্ছুক না। তারা হয় দেশের বাড়ীতে কোরবানী দিচ্ছে, অথবা এখানে কোন বাঙ্গালী দোকানে কোরবানী দিবে। বহু কস্টে জোগাড় হলো চারটি পরিবার। যারা ভাগে গরু কোরবানী দিতে আগ্রহী। কথা মতো সকাল বেলা তারা একসাথে নামাজ পড়ে কোরবানী দিতে যাবে। সকাল সাতটার মধ্যে দুই প্রতিবেশীর বাসা থেকে ফোন আসল যে, তাদের সমস্যা হয়ে গেছে। তারা কোরবানী দিতে যাবে না। তাই বলে আমরা অবশিস্ট দুই পরিবার কি রণভঙ্গ দিতে পারি? আমরা ঠিক করলাম, যেভাবেই হোক, কোরবানী দিব।
যেই কথা সেই কাজ। সকাল সাড়ে নয়টায় ঈদের নামায শেষ হওয়ার পর পরই আমরা আর প্রতিবেশী চৌধুরী ভাই একযোগে কোরবানী দেওয়ার জন্য যাত্রা শুরু করলাম। গন্তব্য পেনসিলভ্যানিয়ার লিটলসটাউন শহরের এক আমেরিকান ফার্মের দিকে। বাসা থেকে দুরত্ব ১৬০ কিলোমিটার। যেতে সময় লাগবে প্রায় দু' ঘন্টা। পথে ট্রাফিক জ্যামে পড়লাম। কোথাও কোথাও আবার রাস্তা মেরামতের জন্য লেইন বন্ধ। তাই পৌঁছতে পৌঁছতে বেলা হয়ে গেল দুপোর বারোটা। গিয়ে দেখি ফার্মের সামনে বিশাল ভীঁড়। প্রায় সবাই বাংলাদেশী। দু'একটা পাকি পরিবার আর কিছু কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিম পরিবার। তাপমাত্রা শুণ্য ডিগ্রীর কাছে। তুষার পড়বে পড়বে বলে আকাশ গম্ভীর হয়ে আছে। এখন সিরিয়াল নাম্বার নিতে হবে। ছাগলের সিরিয়াল প্রায় শ'খানেকের উপর। গরুর পাবলিক কম। দাম মন্দ না। ছাগল আর ভেঁড়া ১৫০ থেকে ৩৫০ ডলার। আর গরু ৫০০ থেকে ১৮০০ ডলার। আমি গরুর সিরিয়ালে গিয়ে নাম লেখালাম। সিরিয়াল নাম্বার পড়ল ১৩তে। মনে মনে প্রমাদ গুণলাম। আমেরিকান ফার্ম মালিক এই সিরিয়াল ম্যানেজ করার দায়িত্ব দিয়েছে বাঙ্গালী ভলিন্টিয়ারদের কাছে। মালিকের দরকার গরু-ছাগল বিক্রি করা। সিরিয়াল ম্যানেজ করা না । আর দিনের শেষে বুঝলাম আমার অভাগা তের নাম্বার সিরিয়াল পড়ার কারণ হচ্ছে আমার দেশী ভাইয়েরা সিরিয়ালে তাদের বন্ধুবান্ধবের নাম টুকে রেখেছে আগেভাগেই। তারা মাঠে নেই। কিন্তু তাদের নাম আছে চিরকুটে। আর আমরা পড়েছি গ্যাড়াকলে, হাতে তের নাম্বারটি বারবার খসখস করে অপেক্ষায় প্রহর গুণছি।
একটু পরেই জানলাম, সিরিয়ালে আমাদের ডাক বিকেল চারটার আগে আসবে না। তাই দুপোর একটার দিকে গাড়ী নিয়ে ফার্ম থেকে আশেপাশে শপিং কমপ্লেক্সের দিকে ছুটলাম। আমার বাসা থেকে নুডলস নেয়া হয়েছে। প্রতিবেশী নাজমা ভাবী নিলেন টুনা স্যান্ডউইচ। গাড়ীতে বসে খাওয়া সারলাম। আমেরিকার শহরের বাইরের এলাকাগুলো যে কতোটা গ্রামীণ তা চিন্তাই করা যায় না। ঘর বাড়ীগুলো অনেক জায়গা, গাছপালা আর ঝোঁপঝাড় নিয়ে। তার মাঝে মাঝে চাষের দিগন্ত জোড়া জমি। শহরটির কাছেই রয়েছে গ্যাটিসবার্গ যেখানে আব্রাহাম লিংকন তার ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলাম। গাড়ী নিয়ে সেখানেও একটু ঢুঁ মেরে আসলাম। তারপরও ঘড়ির চাকা ঘুরে না। বাচ্চাদের কস্ট আরো বেশী। ঠান্ডার কারণে গাড়ীর বাইরেও বেশীক্ষণ থাকা যায় না। গাড়ী যেখানেই যায়, স্টার্ট দিয়ে হিটিং অন করে রাখতে হচ্ছে। তেল পুড়িয়ে গাড়ী গরম করে একটু স্বস্তি খুঁজে বেড়াচ্ছি। অবশেষে সাড়ে চারটার সময় ফিরে আসলাম ফার্মে। ভাবছি, এবার যদি সিরিয়ালে ডাক পড়ে।
এসে দেখি দশ নাম্বার সিরিয়াল চলছে। অবশেষে সন্ধ্যা ছয়টার দিকে আমাদের নাম্বার ডাকা হলো। গরু কিনলাম ছোট দেখে। তাও সাড়ে চারশত দিয়ে পাওয়াতে আমরা বেশ খুশী। কোন দামাদামি নেই। না কিনলে রাস্তা মাপতে পারেন। ফার্মের মালিকও জানে, এই মুসলমানদের আর কোন উপায় নেই। অবশেষে সাতটার দিকে আসল। এবার জবাই করার পালা। আগের সিরিয়ালের পাকির দেয়া ছুরির বদান্যতায় প্রস্তত। এখানে গরু বেঁধে রাখার কোন ব্যবস্থা নেই। বিবি গান দিয়ে শর্ট করে গরুর মাথায়। মাথা ঘুরে গরু জ্ঞান হারালেই কোরবানী দেওয়ার জন্য ছুরি চালাতে হয়। এখন আমাদের কেনা সাড়ে চারশত টাকার গরু অত্যন্তু কুশলী। সে কৌশলে মাথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখে। টার্গেট আর করা যাচ্ছে না। অবশেষে কর্মচারী মালিককে ডেকে পাঠাল। অভিজ্ঞ মালিক এসে খুব কম সময়ে শর্ট করল। আমি ছুরি চালালাম। কোরবানী শেষ। এবার ছোট ক্রেন দিয়ে গরুকে তুলে ভেতরে নিয়ে যাবে। তখন রাত আটটা বাজে। প্রতিবেশী হাসনাত ভাই আসলেন। তার গাড়ীতে আমার পরিবার আর নাজমা ভাবীদেরকে বাড়ীর দিকে পাঠিয়ে দিলাম। কারণ, আমাদের বাড়ী ফিরতে তখনও অনেক দেরী। পরের দিন বাচ্চাদের স্কুল। কাজেই, তাদেরকে রাখা উচিত হবে না।
রাত বাড়ার সাথে সাথে ঠান্ডার প্রকোপও বাড়ল। বাইরে থাকার জো নেই। আমি আর নাজমা ভাবীর ছেলে তানজির গাড়ীর ভেতর বসে আছি। গরু ঝুলিয়ে চামড়া ছাড়ানো হলো। তারপর স'মিলের করাতের মেশিনের নীচে রেখে গরু কাটা শুরু হলো। আমাদের গরু কাটা শেষ হলো রাত সাড়ে দশ টায়। বড়ো বাকেটে করে মাংসগুলো দু'ভাগ করে ভ্যানে তূললাম আমি আর তানজীর। ঠান্ডায় আমি অনেকটা কাবু। ঠান্ডায় হাতের দস্তানার ভেতরেই হাত জমে গেল। গাড়ীতে উঠে স্টার্ট দিলাম রাত ১০:৩৭ মিনিটে। রাতের বেলা খুব জোরে গাড়ী চালাবার জো নেই। পুলিশ ঘাপটি মেরে বসে থাকে স্পীডিং টিকেট দেওয়ার জন্য। সারাদিনের ক্লান্ত শরীরে মনে হলো, নিজেরই কোরবানী হয়ে গেছে। তানজিরকে তার বাসায় নামিয়ে আমি বাসায় ফিরলাম রাত ১:১৫ মিনিটে। আমার সহধর্মিনী তার ধর্ম রক্ষার জন্য আমার জন্য অপেক্ষা করছিল, যদিও তার পরের দিন কাজে যেতে হবে। বাসায় ফিরে আসার পর বলল, কোরবানীর মাংস বসিয়ে দিই। আমার উত্তর: "মাংসের কোন দরকার নেই। ডাল ভাত যা আছে তাই দাও, খেয়ে ঘুম দেই"। এতো রাতে কোরবানীর মাংস ধরতে মন চাইল না। আমার গাড়ীটা গ্যারেজে না ঢুকিয়ে বাইরে রেখে দিলাম। বাইরে ঠান্ডা শুণ্য ডিগ্রীর নীচে। সকালে উঠে তার বন্দোবস্ত করব। এতো ঠান্ডায় গাড়ীতে রাখা মাংসের কোন ক্ষতি হবে না। তাড়াতাড়ি ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকাল বেলা ভেবেছিলাম, তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে অফিসে যাব। ঘুম যখন ভাঙ্গল তখন সকাল নয়টা বাজে। শরীরটা তখনও ম্যাজম্যাজ করছে। অফিসে ফোন করে বললাম, আসব না। খালি বাসা। বউ কাজে। বাচ্চারা স্কুলে। সারাটা সকাল বসে বসে মাংস প্যাকেট করলাম। ডিপ ফ্রীজে ঢুকালাম। একসময় কিছু মাংস নিয়ে চুলায় বসিয়ে দিলাম। দুপোর বেলা কাজ থেকে স্ত্রী ফিরে এসে দেখেন তার গুণধর স্বামী ভাত আর গরম মাংসের ভুনা নিয়ে টেবিলে অপেক্ষা করছেন। একসাথে দুপুরের খাওয়া খেলাম।এরপর যারা এখানে কোরবানী দেননি, তাদের বাসায় মাংস বিতরণ করলাম। রাতের টেবিলে বাচ্চারা কোরবানীর মাংস দিয়ে ডিনার করে বলল, আব্বু রান্নাটা খুব মজা হয়েছে। মাংসটা বেশ সফট। আনন্দে আমার মনটা ভরে গেল। একটা তৃপ্তির হাসি আমার সমস্ত ক্লান্তি দূর করে দিল। মনে হলো, ঠিক এভাবেই আমিও আমার মা'কে বলতাম প্রত্যেক কোরবানী ঈদের সুস্বাদু মাংস খেয়ে। হোক না, বিদেশ। তাই বলে কি ঈদের আনন্দ এখানে থাকবে না? আমরা যদি আমাদের সন্তানদেরকে ঈদের সুন্দর স্মৃতি উপহার না দিতে পারি, তাহলে তারা তাদের উত্তরসূরীদেরকে কি দেবে?
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০০৭ সকাল ১০:৪১