স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তাদের লেখায় ও স্মৃতিচারণে বিভিন্ন ঘটনাবলীর মাধ্যমে তৎকালীন চিত্র তুলে ধরেছেন। লেখনীতে তারা বলেছেন, জিয়াউর রহমানই স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা দেন।
আবদুর রাজ্জাক
আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য ও এমপি আবদুর রাজ্জাক ১৯৮৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক মেঘনার সঙ্গে ‘বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়া খানের সাথে স্বাধীনতার প্রশ্নে আপোস প্রস্তাব বিবেচনা করছিলেন’- শিরোনামের সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “২৭ তারিখ সকালে চায়না বিল্ডিং-এর কাছে আমাদের বন্ধু আতিয়ারের বাসায় গেলাম। তার কাছ থেকে একটা লুঙ্গি ও একটা হাফশার্ট নিয়ে রওনা হলাম নদীর ওপার জিঞ্জিরায়। নদী পার হয়েই রওয়ানা হলাম গগনদের বাড়িতে। পথে দেখা হলো সিরাজুল আলম খানের সাথে। পরে একে একে আরো অনেকের সাথে দেখা হলো। সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে একজন লোক তার ঘাড়ে ইয়া বড় এক ট্রানজিস্টার। আমরা যাব বালাদিয়া। নৌকায় শুনলাম হঠাৎ কোনো এক বেতার যন্ত্র থেকে বলা হচ্ছে, ‘আই মেজর জিয়াউর রহমান ডিক্লেয়ার ইনডিপেনডেন্স অফ বাংলাদেশ’। আমরাতো অবাক, বলে কি? কিছুক্ষণ পরে আবার শুনলাম জিয়া বলছেঃ ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।”
জেনারেল (অব) শফিউল্লাহ
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৩ নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর শফিউল্লাহ (পরবর্তীতে মে· জে· এবং বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতা) তার গ্রন্থে BANGLADESH AT WAR (DHAKA, ACADEMIC PUBLISHERS ১৯৮৯) ৪৩-৪৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “মেজর জিয়া ২৫ মার্চের রাত্রিতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বিরোদ্ধে সদলবলে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন, তার কমান্ডিং অফিসার জানজুয়া ও অন্যদের প্রথমে গ্রেফতার এবং পরে হত্যা করে পাকিস্তান বাহিনীর বিরোদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। পরে ২৬ মার্চ তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তôান সামরিক বাহিনীর মোকাবেলার জন্য সকলকে আহবান করেন। এ ঘোষণায় তিনি নিজকে রাষ্ট্রপ্রধানরূপে ঘোষণা করেন। ২৭ মার্চ মেজর জিয়া স্বাধীন বেতার কেন্দ্র থেকে আর একটি ঘোষণায় বলেন, বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়করূপে আমি মেজর জিয়া শেখ মুজিবুর রহমানের পড়্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি (I MAJOR ZIA, PROVISIONAL COMMANDER IN-CHIEF OF THE BANGLADESH LIBERATION ARMY, HEREBY PROCLAIM, ON BEHALF OF SHEIK MUJIBUR RAHMAN, THE INDEPENDENCE OF BANGLADESH) তিনি আরো বলেন, আমরা বিড়াল-কুকুরের মতো মরবো না, বরং বাংলা মায়ের যোগ্য সন্তানরূপে (স্বাধীনতার জন্য) প্রাণ দেব। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এবং সমগ্র পুলিশ বাহিনী চট্টগ্রাম, কুমিলস্না, সিলেট, যশোর, বরিশাল, খুলনায় অবস্থিত পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের ঘিরে ফেলেছে। ভয়ংকর যুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে।”
মেজর (অব) রফিকুল ইসলাম
মেজর (অব) রফিক বীরউত্তম (বর্তমানে আ’লীগ নেতা ও এমপি) তার লেখা A TALE OF MILLIONS গ্রন্থের ১০৫-১০৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘২৭ মার্চের বিকালে তিনি (মেজর জিয়া) আসেন মদনাঘাটে এবং স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষণা দান করেন। প্রথমে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন।’
আঃ মালেক উকিল
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মালেক উকিল বলেছেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতারের পূর্ব মুহূর্ত অবধি কোনো নির্দেশ দান করেন নাই।’ (সূত্রঃ অলি আহাদ রচিত জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-’৭৫, পৃষ্ঠা ৪২৪-৪২৫)
ড· ওয়াজেদ মিয়া
২০০২ সালের ১৩ মার্চ ঢাকার দৈনিক নিউনেশন পত্রিকাকে শেখ হাসিনার স্বামী ড· ওয়াজেদ মিয়া (সম্প্রতি ইন্তেকাল করেছেন) বলেছেন, THE BANGABANDU NEITHER DECLARED INDEPENDENCE NOR HAND OVER ANY WRITTEN DOCUMENT TO ANY BODY
মেজর জেনারেল (অব) সুবিদ আলী
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব) সুবিদ আলী ভূঁইয়া তার ‘মুক্তিযুদ্ধে নয় মাস’ গ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘বেতারে পুনঃ পুনঃ ঘোষণা করা হচ্ছিলো আর পনের মিনিট পরে মেজর জিয়া বেতার ভাষণ দেবেন। ঘণ্টা দেড়েক চেষ্টার পর তিনি তার ঐতিহাসিক ভাষণটি তৈরি করে নিজেই সেটি ইংরেজিতে ও বাংলায় পাঠ করেন। তবে মেজর জিয়া ঐ বেতার ভাষণে নিজকে ‘হেড অব দি স্টেট’ অর্থাৎ ‘রাষ্ট্র প্রধান’রূপেই ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু পরের দিনই পূর্বের দেয়া বেতার ভাষণটির সংশোধন করে তিনি ঘোষণা দেন যে, এ মুক্তিযুদ্ধ তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে।”
মেজর জেনারেল (অব) ইব্রাহিম
২০০৭-এর স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সরকারি ক্রোড়পত্রে মে·জে· (অব) ইব্রাহিম ‘তিন যুগ পর মুক্তির স্বাদ’ শিরোনামে লেখা নিবন্ধে লিখেছেন, “চট্টগ্রামে অবস্থিত তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানের কালুরঘাট সম্প্রচার কেন্দ্র থেকে ২৭ মার্চ ১৯৭১ বিকাল বেলা প্রথমবার নিজ নামে ও নিজ দায়িত্বে মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।”
ড· ফেরদৌস কোরেশী
বর্তমানে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক পার্টি (পিডিপি) চেয়ারম্যান ফেরদৌস আহমদ কোরেশী বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা এবং জিয়াউর রহমান শীর্ষক এক নিবন্ধ লিখেছেন। তিনি এতে লিখেছেন, ২৫ মার্চ রাতের ট্রেনে আমি এবং মরহুম আতাউর রহমান খান রওয়ানা করেছিলাম চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। লালদীঘির মাঠে স্বাধীনতার দাবিতে আয়োজিত এক জনসভায় যোগ দিতে। কিন্তু সে ট্রেন চট্টগ্রাম অবধি যেতে পারেনি। লাকসাম পর্যন্ত কোনোক্রমে পৌঁছলাম। অতঃপর চাঁদপুর-নারায়ণগঞ্জ হয়ে ঢাকা ফেরা। চাঁদপুর থেকে স্ট্রিমারে চেপে ২৭ তারিখ সকালে আমরা নারায়ণগঞ্জে পৌঁছাই। তখন পাক বাহিনী ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সড়কে ব্যারিকেড সরিয়ে থেমে থেমে এগুচ্ছে। আমরা নৌকায় নদী পার হয়ে বুড়িগঙ্গার অপর পারে গেলাম। সেখানে একটা নৌকাতে খান সাহেবকে রেখে আমি পায়ে হেঁটে নদীর তীর ঘেঁসে জিঞ্জিরার দিকে এগুতে থাকলাম। সে এক বিচিত্র এবং লোমহর্ষক অভিজ্ঞতা। জিঞ্জিরায় পৌঁছাতে বিকেল গড়িয়ে এলো। আমাকে দেখে পরিচিত ছাত্র-কর্মীরা ঘিরে ধরলো। সবার প্রশ্ন- এখন কি হবে? কি হবে তা কি আমিও জানি? আর ঠিক সেই সময় পাশে একটি পান দোকানের সামনে প্রথমে প্রচণ্ড শোরগোল। তার পর চারদিকে একবারেই নিস্তব্ধ। চট্টগ্রাম থেকে ভেসে আসছে দুর্বল ট্রান্সমিশনের কিছু শব্দ তরঙ্গ। সবাই কান পেতে তা শোনার চেষ্টা করছে। অন্যদের সাথে আমিও এগিয়ে গেলাম। খুবই সংক্ষিপ্ত একটি ঘোষণা। ঘোষণাটি শেষ হতে মুহূর্তের মধ্যে গর্জে উঠল গোটা জনপদ। অখ্যাত এক মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠে ঘোষিত হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এই একটি ঘোষণায় হতোদ্যম মুক্তিকামী জনতা যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত জেগে উঠলো। চারদিকে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো- রেডিওতে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হচ্ছে।
ইন্দিরা গান্ধী
১৯৭১ সালের ৬ নবেম্বর কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বলেছেন, ÔTHE CRY OF INDEPENDENCE (OF BANGLADESH) AROSE AFTER SHEIKH MUJIB WAS ARRESTED AND NOT BEFORE HE (S• MUJIB) HIMSELF• SO FAR AS I KNOW HE HAS NOT ASKED FOR INDEPENDENCE EVEN NOW’
১৯৭২ সালের ১১ এপ্রিল নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তার প্রথম বেতার ভাষণে বলেছেন, “THE BRILLIANT SUCCESS OF OUR FIGHTING FORCES AND THE DAILY ADDITIONS TO THEIR STRENGTH IN MAIN POWER AND CAPTURED WEAPONS HAS ENABLED THE GOVERNMENT OF THE PEOPLEÕS REPUBLIC OF BANGLADESH• FIRST ANNOUNCED THROUGH MAJOR ZIAUR RAHMAN TO SETUP FULL-FLEDGED OPERATIONAL BASE FROM WHICH IT IS ADMINISTRATING THE LIBERATED AREAS (সূত্রঃ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, গবর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া)।
নীলম সঞ্জীব রেড্ডি
১৯৭৭ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ভারত সফরে গেলে সে দেশের রাষ্ট্রপতির দেয়া ভোজসভায় ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি নীলম সঞ্জীব রেড্ডি বলেছেন, YOUR POSITION IS ALREADY ASSORED IN THE ANNALS OF THE HISTORY OF YOUR COUNTRY AS A BRAVE FREEDOM FIGHTER WHO WAS THE FIRST TO DECLARE THE INDEPENDENCE OF BANGLADESH”
অনিল সরকার
২০০২ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ উৎসবে এসে ভারতীয় প্রতিনিধি দলের নেতা ত্রিপুরা রাজ্য সরকারের শিক্ষামন্ত্রী অনিল সরকার বলেছেন, ‘মেজর জিয়াউর রহমান প্রথম বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন’।
ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা সুখান্তষ্ট সিং
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা সুখান্তষ্ট সিং তার THE LIBERATION OF BANGLADESH• VOL• I (DELHIt LANCER PUBLISHERS ১৯৮০) বইয়ের ৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘ইতোমধ্যে ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার থেকে একজন বাঙালি অফিসার মেজর জিয়ার কণ্ঠস্বর ভেসে আসে’। তিনি আরো লিখেছেন, ‘এই ঘোষণার মাধ্যমে বাঙালি সেনা অফিসারগণ রাজনৈতিক নেতাদের অসন্তুষ্ট করতে চাননি। অন্যদিকে ইতিহাসের এই সন্ধিড়্গণে জাতিকে দিক-নির্দেশনা দেবার আবশ্যকতা ছিল’।
ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট
১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট শেখ মুজিবকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আপনি যদি বলতেন, ‘আমি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঘোষণা দিচ্ছি তাতে কি ঘটতো’। শেখ মুজিবের জবাব ছিলো- ‘বিশেষ করে এই দিনটিতে আমি তা করতে চাইনি যে, তারা বলুক ‘শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে এবং আঘাত হানা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই’। (সূত্র বাঙালী হত্যাকাণ্ড ও পাকিস্তানের ভাঙন, মাসুদুল হক)।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মার্চ, ২০১০ দুপুর ১:০৪