ঈদের সময় আমার জরুরী চিকিৎসা করতে গিয়ে অদ্ভূত এক অভিজ্ঞতার স্বীকার হয়েছি। ঈদের পুরো সময়টা অসুস্থতার কারণে আমার পরিবার ও আমার শ্বশুর পরিবারের ঈদ আনন্দ মলিন হয়ে গেছে। ঈদের সময় গ্রামের বাড়ি ভ্রমণ ও এরপর মারাত্মক অসুস্থ হলে ডাক্তার-শূণ্য অবস্থায় চিকিৎসার অভিজ্ঞতাই তুলে ধরছি এখানে।
ভ্রমণ মানেই আনন্দ। আর যদি হয় ঈদ ভ্রমণ তা হয় আনন্দ উৎসব। সারি সারি গাড়ির বহর শুধু প্রধানমন্ত্রী ও প্রভাবশালী মন্ত্রীরা পান। আর আমরা আমজনতা পায় ঈদের সময় শহর থেকে গ্রামে বা গ্রাম থেকে শহরে ফেরার সময়। তবে আমজনতার গাড়ির বহর অনেক দীর্ঘ। আর যদি ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ভেঙ্গে পড়ে তাহলে তা হয় আরো দীর্ঘতর, কষ্টকর। আরে ঈদের সময় ট্রেনের থাকে সিডিউল বিপর্যয়। এসব বিষয় মাথায় রেখেই আমার বউ-ছেলেকে ঈদের ১০ দিন আগেই গ্রামের বাড়ি ট্রেনযোগে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু আশংকা জানা সত্বেও ধরা খেয়েছি আমি।
ঢাকার কল্যাণপুর থেকে চাঁপাই নবাবগনজ্ যাওয়ার উদ্দেশ্যে ন্যাশনাল ট্রাভেল্সের গাড়িতে রওয়ানা দিয়েছি ২৩ সেপ্টেম্বর (২০১৫) রাত সাড়ে এগারোটার দিকে। সোহরাবের পেট্রোল পাম্প (কয়েকশ’ গজ) যেতেই লাগলো এক ঘন্টা। এরপর সাভার পর্যন্ত গাড়ি দ্রুতগতিতেই চললো। গাজিপুরের কবিরপুরে দাঁড়িয়ে গেলো গাড়ি। কয়েক ঘন্টা পর আঁচ করতে পারলাম কিছু একটা ঘটেছে। মনে হচ্ছিল গাড়িগুলো যানজটে আটকা পড়েনি, যেন পার্কিং করা হয়েছে রাস্তার ওপর। যাত্রীরা নেমে পড়েছে রাস্তার পাশে। পুরুষ ও ছেলে শিশুরা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিচ্ছে। আর মহিলা ও মেয়ে শিশুরা গাড়ির ভিতর যন্ত্রণা ভোগ করছে। কেননা, রাস্তার পাশে পুরুষদের মতো সেকাজ করার সুযোগ নেই মেয়েদের। বুঝলাম মেয়েরা এদেশে যেমন বাড়িতে আনেক কিছু সহ্য করে তেমনি সহ্য করছে অসহায়ের মতো গাড়িতে বসে। যাহোক, সাড়ে চার/পাঁচ ঘন্টা কবিরপুরে। অর্থাৎ সকাল সাড়ে আটটার দিকে ধীরগতিতে চলতে শুরু করলো গাড়ির বহর। এ অবস্থার কারণ হিসেবে জানলাম যে সেই রাতে সড়ক দুর্ঘটনাকবলিত গাড়ি রাস্তার ওপর পড়ে ছিল। আর পুলিশ-প্র্রশাসন ঘুমচ্ছিল। ঢাকা থেকে চাঁপাই যেতে সাধারণত: ছয় ঘন্টা লাগে। আফিস থেকে রাত সাড়ে নয়টার দিকে বের হয়েছিলাম। গ্রামের বাড়িতে পৌঁছেছি পরদিন রাত সাড়ে নয়টায় অর্থাৎ প্রায় ২৪ ঘন্টার "Journey by Bus"। এরপর শুরু হলো "A Journey (fight) for Treatment"। শুনুন সেই কাহিনী।
গ্রামের বাসায় পোঁছেই তলপেটে ও মেরুদন্ডের দু’পাশে প্রচুর ব্যাথা (গাড়িতেও তা অল্প অনুভূত হচ্ছিল) শুরু হলো। বিছানায় ছটপট করছি। সকলের আনন্দ মলিন হয়ে গেল আমাকে নিয়ে। ব্যাথার যন্ত্রণায় বমিও করছি। বমি হলে ব্যাথা একটু কমছে। পাশে কোন এমবিবিএস ডাক্তার নেই। আছে একজন গ্রাম্য ডাক্তার। তিনি অত্যন্ত ভালো মানুুষ। রাত ১২ টার দিকে মোবাইলে কল করা মাত্রই ছুুটে আসলেন আমাদের বাসায়। দিলেন ব্যাথার ইনজেকশন ও গ্যাসের ট্যাবলেট, আর ঘুমের বড়ি। ব্যাথা কিছুটা কমলো। ঘুমিয়ে পড়লাম দেড়টার দিকে। ঈদের সকালে একই অবস্থা। আবার প্রচুর ব্যাথা। ঈদের নামাজ পড়তে যেতে পারলাম না। খাবারও খেতে পারলাম না। কী করি এ অবস্হায়। আমার পরিচিত ঢাকার ডাক্তারকে ফোন দিয়ে পরামর্শ নিলাম এবং আরো কিছু ট্যাবলেট খেলাম।
ছেলে বাড়ি আসলে একজন মায়ের কী আনন্দ হয়--এটা সবার জানা। মা কিছু খাওয়াতে পারছেননা ছেলেকে-এতো এক মহাকষ্ট তাঁর জন্য। ঈদের দিন দুপুরে খাসির এক বাটি মাংস নিয়ে হাজির। আমার মাকে না করতে পারলাম না। খেয়ে ফেললাম চার-পাঁচ টুকরো। এরপর থেকে তলপেট ও ব্যাক পেইনের সাথে শুরু হলো উপরপেটের পেইন। পেট ফোলাও শুরু হলো। রাজশাহীতে কোন ডাক্তার আছে কিনা তা জানার জন্য ফোন দিলাম আমার পত্রিকার রাজশাহীর সাংবাদিক আনোয়ার আলী হিমু ভাইকে। তিনি খোঁজ নিয়ে জানালেন কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না ঈদের দিন। বললেন স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা নেন। পরের দিন একই অবস্হা। ডাক্তার নেই। আবস্থার আরো অবনতি হলে ঈদের পরের দিন একটা মাইক্রোবাসযোগে আমাকে রাজশাহী নিয়ে আসা হলো। ঢোকানো হলো ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে। ভর্তি হতে চাইলে আউটডোরে দেখাতে বললেন কর্তব্যরত স্টাফ। বসে আছেন একজন ইয়াং “ডাক্তার”। বয়স ২৫-২৬ হবে। হয়তো ইর্ন্টান। ব্যবস্থাপত্র দিলেন। বললেন আল্ট্রাসনো করতে হবে। তবে সেদিন হবে না। কারণ ডাক্তার-স্টাফ নেই, ছুটিতে। বললেন দীর্ঘ ভ্রমণের কারণে এমনটি হতে পারে। প্যান্ট-বেল্টের চাপে তলপেটে ব্যাথা হয়। রাজশাহীতে বাসায় চলে আসলাম। কিন্তু কোন উন্নতি নেই। পরের দিন অর্থাৎ ঈদের দ্বিতীয় দিন ১২টার দিকে গেলাম রাজশাহীর মুক্তি ক্লিনিকে। সাংবাদিক হিমু ভাইয়ের পরিচিত এনেসথেসিয়া বিশেষজ্ঞ এবং ওই ক্লিনিকের সম্ভবত একজন ডিরেক্টর ডা. ভদ্র। আমার পরিচয় পেয়ে তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে। নাম তাঁর ভদ্র, ব্যবহারেও অসম্ভব ভদ্র। শুধু আমি একজন সাংবাদিক বলে নয়। ওই ঈদের দিন বিশেষ ব্যবস্থায় একজন মহিলার সিজারের ব্যবস্থাও করিয়েছেন তিনি যা পরে জেনেছি। যাইহোক, আমার জন্য ফোন দিলেন বেশ কয়েকজন ডাক্তারকে। কাউকে পেলেন না। কেউ রাজশাহীর বাইরে, কেউ চিকিৎসা করবেননা, ছুটি কাটাবেন। ডা. ভদ্র বললেন এ অবন্থায় আপনাকে ছেড়ে দিলে কোথাও চিকিৎসা এখন পাবেন না। অথচ আপনাকে ভর্তি হতে হবে। আমি বললাম যেভাবেই হোক আমাকে ভর্তির ব্যবস্থা করেন। নিজেই শুরু করলেন চিকিৎসা। কিছু টেষ্ট দিলেন। পেটে প্রচন্ড গ্যাস এবং ইউরিন ইনফেকশন ধরা পড়লো। এরসাথে প্রচন্ড ব্যাক পেইন। অনেকটা নিশ্চিত হলাম জটিল কিছু হয়নি।
বিকেলে মুক্তি ক্লিনিকে একজন ডাক্তার এসেছেন। তিনি শিশু সাজারি বিশেষজ্ঞ। কোন উপায় না পেয়ে ডা. ভদ্র ওই শিশু সাজারি বিশেষজ্ঞের (তার রুমেই বসা এবং আমার সমস্যাগুলো শুনছিলেন ডা. ভদ্রের সাথে) শরণাপন্ন হলেন এবং বললেন দেখুন না এ সাংবাদিককের জন্য কোন ব্যবস্থা করা যায় কিনা? তিনি বিষয়টি আমলে নিলেন এবং তাঁর অধীনেই ভর্তির সিদ্ধান্ত দিলেন। আমিও সম্মতি দিলাম। ওটি রুমে গিয়ে স্যালাইন পুশ করা হলো। ৪০২ নং কেবিনে চারদিন চললো চিকিৎসা। ছুটি শেষে যখন অন্যান্য ডিউটি ডাক্তার ও নার্স আসলে তারা কানাঘুসা করতে লাগলো কেন আমি শিশু সাজারি বিশেষজ্ঞের অধীনে চিকিৎসা নিচ্ছি। আমিই বিষয়টি তাদের পরিস্কার করলাম যে আমার জন্য ডাক্তার না পাওয়ায় শিশু সাজারি বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হয়েছি। তিনদিন পর রিলিজ দেয়া হলো। বেড রেস্টে থাকতে বলা হলো সাতদিন।
সকল সমস্যা কাটিয়ে উঠেছি। ঢাকায় ফিরেছি। আজ অফিসে জয়েন করবো। ধন্যবাদ ডা. ভদ্র। আপনার ভদ্রতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। আপনার মতোই দেশের সকল ডাক্তারগণ ভদ্র হোক--এই কামনায়।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০১৬ সকাল ১১:২৩