সরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি’র উপর ভ্যাট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একটি গ্রহণযোগ্য ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের ফসল এটা। ধন্যবাদ সরকারকেও। দেরিতে হলেও ভ্যাট প্রত্যাহার করার জন্য। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে সকলের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা। আমি যখন ১৯৯৪-৯৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভতি হই তখন মাসে ১২ টাকা টিউশন ফি ও ৫০ টাকার মতো হল ভাড়া দিতে হতো একজন শিক্ষাথীকে। হলে খাওয়া যেতো দুবেলা ২০ টাকায় (দুপুরে ১১ টাকা+ রাতে ৯ টাকা)। সকালের নাস্তায় (দুই পরোটা ও ডাল) লাগতো ৫ টাকা। অথাৎ ২৫ টাকায় একজন ছাত্র বিলাসিতা না করলে তিনবেলা খেতে পারতো। এখন রাবি’র হলভাড়া মাসে ১০০টাকা (মেয়েদের জন্য ১১৫ টাকা), হল-এ দপুরের খাবার ২০ টাকা এবং রাতে ১৬ টাকা (মোট ৩৬ টাকা)। মজার ব্যাপার হল এখন জানলাম মাসিক বেতন এখনও ১২ টাকায় রয়ে গেছে। বাংলাদেশের সকল সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে চিত্রটা প্রায় (কিছুটা কম-বেশি) একই। একই রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়া সত্বেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষাথীকে টিউশন ফি বাবদ লক্ষ লক্ষ টাকা গুণতে হয়। নামমাত্র মূল্যে আবাসন ও খাবার সুবিধা পায়না তারা। আবাসন ও খাবার বাবদও গুণতে হয় হাজার হাজার টাকা। এটা বৈষম্য। সংবিধানের যে সমান আধিকার নাগরিকদের দেয়া হয়েছে সে অধিকারের পরিপন্থী এ ব্যবস্থা। হ্যাঁ, অনেকে মনে করতে পারেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেতো চলতে হবে শিক্ষথীদের টাকা দিয়ে। কিন্তু শিক্ষথীদের নিকট থেকে মাসে কত টাকা নিতে পারে একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়? এর মানদন্ডতো সরকারকেই নিধারণ করে দিতে হবে। সরকারকে বাজেটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাথীদের জন্য বরাদ্দ রাখতে হবে। কেননা, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থের উৎস সম্পকে “বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০” এ বলা হয়েছে:-
(১) কোন জনকল্যাণকামী ব্যক্তি, ব্যক্তিগোষ্ঠী, দাতব্য ট্রাস্ট বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নিঃশর্তভাবে প্রদত্ত দান;
(২) কোন জনকল্যাণকামী ব্যক্তি, ব্যক্তিগোষ্ঠী, দাতব্য ট্রাস্ট, প্রতিষ্ঠান বা সরকার হইতে প্রাপ্ত ঋণ;
(৩) কোন জনকল্যাণকামী ব্যক্তি, ব্যক্তিগোষ্ঠী, দাতব্য ট্রাস্ট বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদত্ত অনুদান;
(৪) শিক্ষার্থী ফি;
(৫) বিভিন্ন খাতে সৃষ্ট সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আয়;
(৬) সরকার বা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন কর্তৃক অনুমোদিত অন্যান্য উৎস।
অথাৎ ছয়টা আয়ের উৎসের মধ্যে শিক্ষার্থীদের ফি একটা। সরকার বা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন কর্তৃক অনুমোদিত অন্যান্য উৎস থেকে অবশ্যই বরাদ্দ থাকতে হবে। আর টিউশন ফি হতে হবে আর্থ-সামাজিক অবস্থার মানদন্ডে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কেননা, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০ এ বলা হয়েছে:
“প্রত্যেক বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় উহার প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহ করিবার নিমিত্ত শিক্ষার্থীদের জন্য দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার মানদন্ডে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি শিক্ষার্থী ফি কাঠামো প্রস্ত্তত করিয়া বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের অনুমোদন গ্রহণ করিবে।”
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০ এর অধীনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়জগুলো মূলত: একটি বোর্ড অব ট্রাস্টিজ কতৃক স্থাপিত ও পরিচালিত হয়ে থাকে। অনেকটা এনজিওদের মতো। কোম্পানী অ্যাক্ট অনুযায়ী নয়। তাই তাদের আয়কর দিতে হয় না। আইনানুযায়ী প্রত্যেক আর্থিক বছরের ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পূর্ববর্তী আর্থিক বছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব এবং সংরক্ষিত তহবিল ও সাধারণ তহবিলের হিসাব কমিশন ও সরকাররের নিকট প্রেরণ করতে হয়। “কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ তহবিলের অর্থ উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় ব্যয় ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্যে ব্যয় করা যায় না।” কিন্তু এসবের সুষ্টু ব্যবস্থাপনা কি হয়? শিক্ষাথীদের নিকট থেকে যে হাজার হাজার টাকা বিভিন্ন খাতের (যেমন লাইব্রেরি, খেলাধূলা প্রভৃতি) বিপরীতে নেয়া হয় তা কি সঠিকভাবে ব্যয় করা হয়? এসব বিষয় খতিয়ে দেখার সময় এসেছে। কোটি কোটি টাকা প্রতি বছর টিউশন ফি নিয়ে সে টাকা কী করে? নিশ্চতভাবেই বেশিরভাগ তাদের পকেটে যায়! তাই এসব জবাদিহি নেয়ার সময় এসেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাথীদের। সোচ্চার হতে হবে। বন্ধ করতে হবে উচ্চ টিউশন ফি। নিজের অধিকার আদায় করতে হবে যেভাবে আদায় হলো ভ্যাটহীন টিউশন ফি। এবার উচ্চ মাত্রায় টিউশন ফি’র বিরুদ্ধে আন্দোলন করে সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য এবং দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার মানদন্ডে সামঞ্জস্যপূর্ণ টিউশন ফি নিশ্চিত করতে হবে। আন্দোলনের প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি হবে যৌক্তিক, গ্রহণযোগ্য ও শান্তিপূণ যা এবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাথীরা দেখিয়েছে।
দ্রষ্টব্য: রেফ কোন শব্দেই লেখা যায়নি বলে দু:খিত।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:২৮