আফ্রিকা থেকে আধুনিক মানুষের ছড়িয়ে-পড়া শুরু হবার আগেই ধ্বনি নিয়ে অভিব্যক্তি প্রকাশ সে রপ্ত করেছিল। ভাষা তাকে দিল এক দুরন্ত ক্ষমতা, তার পাশের মানুষটির সঙ্গে ভাববিনিময়ের ক্ষমতা; তাতে একজনের থেকে অন্যজনে দক্ষতার ঠাঁই বদলে জোর সুবিধে।
ভাষা হলো আর্য সংস্কৃতির সব থেকে বড় চিহ্ন। ঋকবেদ থেকে বোঝা যায়, যে জনগণের সঙ্গে আর্যদের সংঘর্ষ হয়েছিল, তারা যে ভাষায় কথা বলত, তা আর্যদের ভাষা থেকে ভিন্ন ছিল। সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় ভাষাতাত্ত্বিক বিচারের মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, আর্যভাষা আগমনের পূর্বে এই ভূখন্ডের মানুষেরা কোল বা অস্ট্রিক জাতীয় ভাষা এবং কতকটা দ্রাবিড় ভাষা ব্যবহার করত। ভারতের প্রাচীনতম ভাষা কোল বা অস্ট্রিক ভাষা গোষ্ঠীর বংশধরদের মধ্যে সাঁওতালরা প্রধান। মুন্ডা, হো, খেড়িয়া, জুয়াং, অসুর প্রভৃতি আরও প্রায় ছোটবড় ১৮ টি দলের মানুষ রয়েছে ঐ ভাষাগোষ্ঠীতে।
কোল ভাষাগোষ্ঠীর যেসব মানুষ স্মরণাতীতকালে বাঙালি হয়ে গেছে, অর্থাৎ যারা আমাদের পূর্ব পুরুষ, তাদের সঙ্গে সাঁওতালদের সম্পর্ক অনুসন্ধানের একমাত্র উপায় উভয় ভাষারই বর্তমান অবস্থার ভিত্তিতে তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক বিচার। আর আমাদের এই বিচার এনে দেবে সংকর বাঙালি জাতির হারিয়ে যাওয়া এক ইতিহাস। এই ইতিহাসজ্ঞানই মার্কসের কথায় এনে দিতে পারে ভবিষ্যতের সমাজ পুনর্গঠনের সামর্থ্য।
সাহিত্যের যুগ-বিভাজনে মধ্যযুগ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্য বিশেষ ছন্দোবন্ধনে গড়ে ওঠা পদ্যকে ভিত্তি করে বিকশিত হয়েছে। সাহিত্য যেমন জীবনের প্রতিচ্ছবি, তেমিন কাব্য-ছন্দের নির্মাণও নির্ভর করে মানুষের স্বাভাবিক উচ্চারণভঙ্গীর ওপর। আর বাংলা ভাষার উচ্চারণভঙ্গী এসেছে অস্ট্রিক ভাষাগোষ্ঠীর সাঁওতাল, মুন্ডা, হো-দের কাছ থেকে। বাঙালির উচ্চারণ অসংস্কৃত তাই বাঙলা ছন্দ মুক্তি পেয়েছে সংস্কৃত ছন্দ নয় সাঁওতাল ছন্দের ঘরানায়। আর বাঙালি ভাবপ্রকাশভঙ্গী বা বাক্যগঠন যৌবনদীপ্ত সতেজ হয় সংস্কৃত ব্যাকরণের বিভক্তি কারকের পোষাক পরে নয়, সাঁওতাল ব্যাকরণের খালি পায়ে চলার তালে।
একইভাবে উল্লেখ্য, বাংলা কথ্য বাক্যমধ্যে ব্যবহৃত 'তো’, নির্দেশক টি-টা ইত্যাদি, ধ্বনাত্বক শব্দ, অনুকার শব্দ, এবং বাংলা ট-বর্গের বর্ণসমূহ এসেছে অনার্য ভাষাগোষ্ঠী থেকে। সুনীতিকুমার মনে করতেন বাংলা ভাষায় বহুবচন প্রকাশক গুলা, গুলি ও রা দ্রাবিড় ভাষার প্রভাবজাত। দ্রাবিড় ভাষাগোষ্ঠীর তামিল ভাষা থেকে গুলি, গুলা এবং ওরাওঁদের কুরুক বা কুড়খ ভাষা থেকে ‘রা’ এসেছে।
অনার্যদের জ্ঞাতিসম্পর্ক, কৃষিকাজ, মৃৎপাত্রনির্মাণ কৌশল ইত্যাদি বিষয় আর্যদের আকৃষ্ট করেছিল, যে জন্যে আর্য ভাষায় এ ধরনের শব্দাবলির সমৃদ্ধ উপস্থিতি রয়েছে, যেমন- কাকা (খুল্লতাত), কুলথ (এক ধরনের ডাল), কুলাল (কুম্ভবকার), হুন্ডা (পাত্র), কুন্ডল (কানের দুল), ধান, মাছ, গাছ-গাছড়া, জীবজন্তু ও পাখি, গ্রাম-বসতি ইত্যাদি অনেক নাম অনার্য ভাষা থেকে প্রাপ্ত। কৃষিকাজে ব্যবহৃত লাঙ্গল ও কোদাল এবং নদী পারাপারের ব্যবহৃত ডিঙ্গি, ডোঙ্গা শব্দের উৎস অস্ট্রিক ভাষা।
দ্রাবিড় ভাষাগোষ্ঠী থেকে বাংলায় আগত উল্লেখযোগ্য কিছু শব্দ হলো- মালভূমি’র মাল, যার অর্থ উঁচু জায়গা; ছেলেপিলে’র পিলে, যার অর্থ ছেলে বা খোকা ইত্যাদি। একইভাবে এই ভাষাগোষ্ঠীর অনেক শব্দ প্রাকৃতের মধ্য দিয়ে সংস্কৃতে স্থান পেয়েছে, যেমন-আন্না থেকে অন্ন, যার অর্থ ভাত; আব্বা থেকে পিতা অর্থে বাবা বা অবিকৃত আব্বা; আম্মা থেকে মাতা অর্থে মা বা অবিকৃত আম্মা; দুয়ার রো থেকে দুয়ার, যা জানালা বা দরজা অর্থে ব্যবহৃত; দেশ হুঁ থেকে দেশম্ বা দেশ; নীলু থেকে নীর/ নীল বা জল; পাচু থেকে পেচা; ষন্ডু থেকে ষাঁড়; বাগনো থেকে বাগান; মাঙ্গকি থেকে মাগি, যা স্ত্রীলোক অর্থে ব্যবহৃত; এমনকি মূর্তিপূজার প্রধান উপকরণ পুষ্প ও পূজা শব্দ দুটিও দ্রাবিড় গোষ্ঠীর।
এজন্যেই বাংলা শব্দের অভিধান তৈরি করতে গিয়ে ক্ষুদিরাম দাস দেখিয়েছেন, বাংলা শব্দ ভান্ডারের অধিকাংশই সাঁওতাল গোষ্ঠীর; যেগুলি সংস্কৃত জাত সেগুলিরও উৎস বহু পূর্বে কোল গোষ্ঠীরই ছিল। রবীন্দ্রনাথ থেকে সুনীতিকুমার কেউই এই দেশি শব্দের জয়ধ্বনি দিতে ভুলেন নি।
বাংলার কিছু বিখ্যাত স্থানের নাম আছে যেগুলিকে সংস্কৃত, আরবি, ফারসি দিয়ে বিচার করা যায় না, অথচ সহজেই কোলগোষ্ঠীয় ভাষা দিয়ে বিচার করা যায়। এগুলি মূলত কোল ভাষাগোষ্ঠীর লোকদের দেয়া নাম। দ্রাবিড় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ওরাওঁরা প্রাচীনযুগে পরিচিত ছিল ওড্র নামে। এদের মূল অধিবাস ভারতের উড়িষ্যা বা ওড়িষা, যা ওড্র শব্দ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। আদিবাসী অধ্যুষিত পালামৌ অঞ্চলের নামকরণও হয়েছে এদের মাধ্যমে। দ্রাবিড় গোষ্ঠীর ভাষায় পালামৌ শব্দের অর্থ প্রান্তর।
অধুনা ইতিহাসবিদ, সমাজতত্ত্ববিদ ও নৃতত্ত্ববিদদের গবেষণায় এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী নিযুক্ত ঐতিহাসিক মাক্সমুলারের নকল আর্য জাতির ইতিহাস তৈরি, তাদের ভারতে আগমন এবং অনার্য ও অসভ্য ভারতীয়দের সভ্য করে তোলার তত্ত্ব ভিত্তিহীন, অবৈজ্ঞানিক এবং ধান্দাবাজ রাজনৈতিক চাল। সুনীতিকুমার এ প্রসঙ্গে বলেন, সত্যের অনুসন্ধান করতে হলে এ সকল সংস্কারের উপর উঠতে হবে। কুক্ষণে এদেশে বিলেত থেকে নোতুন করে আর্য শব্দের আমদানি হয়েছিল। ম্যাক্স্মুলারের লেখা পড়ে, আর নব্য হিন্দুয়ানি দলের বিজ্ঞানের আর ইতিহাসের বদহজমের ফলে, একটা নোতুন গোঁড়ামি এসে আমাদের ঘাড়ে চেপে বসেছে, সেটার নাম হচ্ছে আর্য্যামি। এই গোঁড়ামি আমাদের দেশে নানা স্থানে নানা মূর্তি ধরেছে স্বাধীন চিন্তার শত্রু“ এই বহুরূপী রাক্ষসকে নিপাত না করলে ইতিহাস চর্চা বা ভাষাতত্ত্বের আলোচনা কোনোটারই পথ নিরাপদ হয় না। (কৃষ্ণনগর নদীয়া সাহিত্য পরিষদের পঞ্চম বার্ষিক অধিবেশনে পঠিত, সবুজপত্র : কার্তিক-অগ্রহায়ণ, ১৩২৫)
তথ্য সহায়তা :
ইরফান হাবিব, ভারতবর্ষের মানুষের ইতিহাস- ১ (প্রাক-ইতিহাস), অনু. কাবেরী বসু, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ২০০২;
সুহৃদকুমার ভৌমিক, আদিবাসীদের ভাষা ও বাঙলা, মারাংবুরু প্রেস, কলকাতা, ১৯৯৯;