"Everything originates in water
Everything sustained by water"
- Johann Wolfgang von Goethe (1749-1832)
পানি প্রাণের অস্তিত্বের অপর নাম। তাই প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে পানির প্রাপ্তির সহজলভ্যতাকে আশ্রয় করে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে মানুষের আবাস গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ পানিবাহিত পলিমাটি দিয়ে গঠিত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ব-দ্বীপ, যা পরাক্রমশালী নদী গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা (এইগ) বেসিন বা অববাহিকার সৃষ্টি। এর প্রবাহিত এলাকা প্রায় সাড়ে দশ লক্ষ বর্গকিলোমিটার যার ৭.৫% বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে গিয়ে সাগরে পড়েছে। বাংলাদেশের চার-পঞ্চমাংশ ভূখন্ড তৈরি হয়েছে গঙ্গা (পদ্মা)-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা (বরাক) নদী সিস্টেমের মাঝে। এই গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদী ব্যবস্থা ৫টি দেশ যথা ভারত, নেপাল, ভুটান, চীন ও বাংলাদেশ জুড়ে রয়েছে।
অববাহিকা-অঞ্চলে প্রায় ৩০০০ বছর বা তারও পূর্ব থেকে যে জনগোষ্ঠীর বসবাস, তার একটি অংশ ইতিহাসের নানান চড়াই উতরাই পেরিয়ে এসে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ নামে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
শত শত নদীর হাজার বছর ধরে বয়ে আনা পলিমাটির উর্বর সবুজ-শ্যামল ব-দ্বীপে জড়ো হয়ছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের নানাবিধ নৃগোষ্ঠীর মানুষ; বিচিত্র জাতের সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে একটি মিশ্র জাতিগোষ্ঠী। নদীনালা, খালবিলসহ ভূ-উপরস্থ ও সহজলভ্য ভূ-গর্ভস্থ পানি এদেশের ভূমিপুত্রদের কল্যাণে ব্যবহৃত সবচেয়ে মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ যা তাদের জীবন-জীবিকা ছাড়াও এদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণে অবিকল্প ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশের মানুষ সাধারণত দ’ুটি প্রাকৃতিক উৎস থেকে পানি পেয়ে থাকে- (ক) নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড় ও পুকুর তথা ভূউপরস্থ জলাশয় এবং (খ) ভূগর্ভস্থ পানি, যা গভীর ও অগভীর নলকূপের মাধ্যমে উত্তোলন করা হয়। এছাড়া আরেকটি অপ্রধান উৎস হিসেবে রয়েছে বৃষ্টির পানি। এক্ষেত্রে দুটি প্রধান উৎসের প্রথমটির ওপর দ্বিতীয়টি স¤পূর্ণভাবে নির্ভরশীল।
দেশের প্রায় সর্বত্র দিয়ে বয়ে যাওয়া শিরা-উপশিরার মতো নদীনালাগুলো এদেশের ভূচিত্র রচয়িতা ও এদেশের প্রাণ। এ প্রাণের ধারায় গড়ে উঠেছে এদেশের মানুষের জীবনধারা, হাজার বছরের সাহিত্য, সংস্কৃতি, সভ্যতা ও ইতিহাস। আর এজন্যেই বাংলাদেশকে নদীমাতৃকদেশ বলা হয়। প্রতিটি নদীই নির্দিষ্ট অঞ্চলে তার নিজস্ব অবদানের ক্ষেত্রে স্বমহিমায় অভিষিক্ত। জীবনের জন্য অপরিহার্যতা বিবেচনায় ভালোবেসে নদ-নদীগুলোকে দেওয়া হয়েছে অসাধারণ সুন্দর সুন্দর নাম- আত্রাই, আড়িয়াল খাঁ, কপোতাক্ষ, করতোয়া, কর্ণফুলী, কাঁকন, কীর্তনখোলা, কীর্তিনাশা, কুশিয়ারা, খোয়াই, গড়াই, চিত্রা, জলঢাকা, ডাকাতিয়া, তিতাস, তিস্তা, তুরাগ, ধলেশ্বরী, ধানসিঁড়ি, নাফ, পশুর, পদ্মা, পাহাড়ীয়া, পুণর্ভবা, ফেনী, বড়াল, ব্রক্ষ্মপূত্র, বাঙালি, বালু, বিরিশিরি, বুড়িগঙ্গা, ভৈরব, মধুমতী, মনু, মহানন্দা, ময়ূর, মাতামুহুরী, মুহুরী, মেঘনা, যমুনা, রূপসা, শঙ্খ, শিবসা, শীতলক্ষ্যা, সাঙ্গু, সুরমা, হালদা ইত্যাদি।
বাংলাপিডিয়া ও মাধ্যমিক ভূগোল গ্রন্থে উল্লিখিত তথ্যানুযায়ী দেশের অভ্যন্তরে প্রবাহিত নদনদীর সংখ্যা প্রায় ৭০০টি; বাংলাদেশ পরিসংখ্যান পকেট বুক ও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এর সূত্রমতে এ সংখ্যা ৩১০টি। তবে সংখ্যা যাইহোক, ২৪,১৪০ কিলোমিটার (বর্তমানে প্রায় ৬ হাজার কিলোমিটার) দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট এ নদীগুলো ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা, সুরমা-মেঘনা এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলের নদীসমূহ- এ ৪টি নদীব্যবস্থায় বিভক্ত। বাংলাদেশের অস্তিত্বের অপর নাম এদেশের নদীনালা। এসব নদ-নদীকে ঘিরেই এদেশের শহর-বন্দর-গঞ্জ-বাজার-ঘাট গড়ে উঠেছে। সহজে ও সুলভে মালামাল পরিবহন ও যোগাযোগের প্রধান পাথেয় নদী। বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি, বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্যনিরাপত্তা, কর্মসংস্থান তথা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম খাত কৃষি পুরোপুরি এদেশের সহজলভ্য নদীনালার পানির ওপর নির্ভরশীল। একইভাবে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক অগ্রগতির অপরিহার্য খাত শিল্প-কলকারখানাগুলো তাদের পণ্য পরিবহন ও উৎপাদনে নদীনালার ওপর নির্ভরশীল। একইভাবে স্মরণাতীতকাল থেকে এদেশের মানুষের প্রাণীজ আমিষের প্রধান উৎস, বিপুল জনগোষ্ঠীর জীবিকার উৎস, অন্যতম রপ্তানীখাত মৎসসম্পদ এদেশের নদীনালার ওপর নির্ভরশীল। এসকল প্রত্যক্ষ বিষয়াদি ছাড়াও পরোক্ষভাবে এসকল নদীনালা দেশের আবহাওয়া ও জলবায়ুর ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। মানুষের পাশাপাশি হাজার প্রজাতির পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, পোকামাকড় প্রভৃতির জীবনযাত্রা নদীকে আশ্রয় করে। এমনকি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভূগর্ভস্থ পানিতে মরণঘাতী আর্সেনিকের উপস্থিতি ধরা পড়ায় বিপুল সংখ্যক মানুষের সুপেয় পানির প্রধান আধার হিসেবে অপরিসীম ভূমিকা পালন করছে এদেশের নদ-নদী। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বব্যাপী পানির তীব্র চাহিদা বৃদ্ধি এবং এলক্ষ্যে শুরু হওয়া পানি-রাজনীতির শিকার হয়ে সুদীর্ঘকাল ধরে নদীর সঙ্গে এদেশের অধিবাসীদের আচ্ছেদ্য সম্পর্কের ভারসাম্যে বিঘœ ঘটতে শুরু করেছে। এখানে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের পানি প্রবাহের শতকরা ৯০ ভাগ পানির উৎস বাংলাদেশের বাইরে অবস্থিত। এদেশের ৫৭টি আন্তর্জাতিক নদীর মধ্যে ৫৪টির উৎস ভারতে এবং ৩টির উৎস মায়ানমারে। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর সমন্বয়ে বাংলাদেশে স্বাদু পানির যে প্রবাহ বিদ্যমান, তা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম নদী প্রবাহ। বিশেষজ্ঞদের ধারণা- কোনো কারণে এসকল নদ-নদী শুকিয়ে গেলে গোটা দেশটিই মৃত্যুমুখে পতিত হবে। আর এ আশংকা এদেশের মানুষের মনে এখন প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছে। কেননা, প্রতিবেশীদেশ ভারত অভিন্ন নদী ব্যবহারের আন্তর্জাতিক নীতিমালা বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে এগুলোতে একের পর এক বাঁধ নির্মাণপূর্বক পানি প্রত্যাহার শুরু করেছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং তাকে কেন্দ্র করে কৃষিকাজে ও সুপেয় পানির চাহিদা বৃদ্ধি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে পানি-রাজনীতির ভয়াবহ বিস্তার ঘটাচ্ছে।
কেননা, পৃথিবীর মোট আয়তনের তিন-চতুর্থাংশ পানিবেষ্টিত হলেও মানুষের ব্যবহারযোগ্য পানির পরিমাণ খুব বেশি নয়। এক হিসেব অনুযায়ী বিশ্বের মোট প্রাক্কলিত পানির পরিমাণ ১৩৮৬ মিলিয়ন কিউবিক কিলোমিটার। এর শতকরা ৯৬.৫ ভাগ তথা ১৩৪০ মিলিয়ন কিউবিক কিলোমিটার পানির উৎস সমুদ্র। সমুদ্রের এ পানি লবণাক্ত এবং মানুষের দৈনন্দিন কর্মকান্ড ও কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহারের অনুপযোগী। অন্যদিকে মিঠাপানির পরিমাণ মাত্র ২ দশমিক ৫ শতাংশ বা ৩৫ মিলিয় কিউবিক কিলোমিটার। কিন্তু এরমধ্যে ২৪.৪ মিলিয়ন কিউবিক কিলোমিটার তথা পানযোগ্য এ সামান্য পরিমাণ পানির দুই-তৃতীয়াংশ আবার মানুষের ধরাছোয়ার বাইরে হিমবাহ এবং মেরু অঞ্চলে জমাট বরফ অবস্থায় রয়েছে। অবশিষ্ট ১০.৬ মিলিয়ন কিউবিক কিলোমিটার পানি সুপেয়, যা পৃথিবীর মোট পানিসম্পদের শতকরা ০.৭৬ ভাগ মাত্র। এরমধ্যে আবার উল্লেখযোগ্যঅংশ জনবসতি থেকে এতদুরে যে তার নাগাল পাওয়া প্রায় দুঃসাধ্য।
সমীক্ষায় দেখা গেছে যে পৃথিবীতে যত পানি রয়েছে তার মাত্র ০.০৮ শতাংশ পরিমাণ পানি মানুষের ব্যবহারের আওতায় রয়েছে। অর্থাৎ পানি একটি সীমিত প্রাকৃতিক স¤পদ এবং কোনোভাবেই প্রকৃতির অন্তহীন দান হিসেবে পানির যথেচ্ছ ব্যবহারের অবকাশ নেই। তাই বর্তমান শতকে জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি অপর যে সমস্যাটি বিশ্ববাসীর সমুখে এসে দাঁড়িয়েছে, তা হচ্ছে নিরাপদ পানি।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, ২০৫০ সাল নাগাদ পৃথিবীতে প্রচন্ড পানি সংকট দেখা দিবে। এসময় পৃথিবীর মোট ৯৩০ কোটি মানুষের ৭০০ কোটিই নিরাপদ পানির সমস্যায় পড়বে। এখনই বিশ্বের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ হয় পর্যাপ্ত পানি পায় না অথবা তাদের কাছে নিরাপদ পানি পৌঁছায় না। অন্যদিকে, অপরিশোধিত বা অনিরাপদ পানি প্রতি বছর ২০ থেকে ২২ লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন ৩০ হাজার শিশু তাদের পঞ্চম জন্মদিন উপভোগ করার আগেই পৃথিবী থেকে দুঃখজনকভাবে বিদায় নিচ্ছে।