অলিখিত ইতিহাসের কোনো এক আনুমানিক কালে বহিরাগত আর্যদের বর্ণভিত্তিক সমাজব্যবস্থা, রাজনৈতিক- সামাজিক- সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য মেনে না নিতে পেরে অথবা নিজেদের সামগ্রিক স্বাতন্ত্র ধরে রাখতে আদিবাসীরা বেছে নিয়েছিল দূর্গম পাহাড় বা অরণ্যসঙ্কুল জনহীন প্রান্তর। নিজেদের মতো করেই চলছিল তাদের জীবন-জীবিকা। বজায় ছিল প্রকৃতির ন্যায় সাম্য বা সমতা ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা, যেখানে ভূমি বা বনের মতো প্রাকৃতিক সম্পত্তিতে কারো ব্যক্তিগত অধিকারের বালাই ছিল না, সেগুলো ছিল সামাজিক বা গোষ্ঠীগত সম্পত্তি। ক্ষমতা অনুযায়ী শ্রম, এবং প্রয়োজন অনুযায়ী ভোগ ছিল তাদের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। তৎবিপরীতে সভ্যতার মধ্যযুগের শেষ দিকে উপমহাদেশে আগত নব্য আর্যরা পুনরায় এই ভুখন্ডের সকল অধিবাসীদের ওপর কায়েম করতে সচেষ্ট হয় তাদের সামগ্রিক আধিপত্য, এমনকি সহজ-সরল আদিবাসীদের ওপরও। আগ্রাসনকে জ্ঞানতাত্ত্বিক বৈধতা দেওয়ার জন্যে তারা পেশাদার নৃবিজ্ঞানীদের দ্বারা লিখিয়ে নেয় পৃথিবীর তথাকথিত অনগ্রসর, অসভ্য মানুষদের সভ্য করার 'বৈধতা-মন্ত্র’, যার ধারাবাকিতায় তাদের করনীতি প্রলম্বিত হয় আদিবাসীদের সমতাভিত্তিক সম্পত্তিতে। সেখান থেকেই মূলত ক্ষয় শুরু আদিবাসীদের গল্পের মতো প্রাচুর্যময় জীবন ব্যবস্থার। আদিবাসী সাহিত্যের প্রাচুর্যময় জীবনের গল্প ক্রমশ দখল করে নিতে থাকে ক্রমবর্ধমান দুর্দশার কথামালা।
ইউরোপীয়দের কথিত সভ্যতার অগ্রগতি মানুষের মননকে করেছে জটিল জটিলতর, হাস্যকর আর অপাংতেয় করে তুলেছে বিশ্বাস, ভালোবাসা, প্রেম, অনুভূতি প্রভৃতির মতো মানবিক শব্দগুচ্ছকে। বর্তমান বাস্তবতায় তাই একজন মানুষ আর একটি পশুর মধ্যেকার পার্থক্যের চেয়ে একজন মানুষ আর অন্য আরেকজন মানুষের মধ্যে পার্থক্য অনেক বেশি। আদিবাসীরা আজও সেই সভ্যতার দোসর বনে যায়নি, যে জন্যে তাদের কখনো কখনো অসভ্য বলা হয়ে থাকে। এই অজুহাতেই প্রভুত্বকারী ইতিহাসে স্থান মেলেনা আদিবাসীদের সাম্যভাব ও মহান জাত্যবোধের মন্ত্রে উজ্জীবিত অসীম ত্যাগ-তিতিক্ষা ও বীরত্ব-গাঁথার। তবে প্রভুত্বকারী ইতিহাসের মতো জনগোষ্ঠীর মধ্যে পদে পদে বৈষম্য আর ভেদাভেদ বিরাজমান থাকলেও আদিবাসীদের সামাজিক দর্শন সাম্যবাদী।
কিন্তু ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রবর্তিত চিরস্থায় বন্দোবস্তসহ নব নব ফায়দানির্ভর আইনিব্যবস্থায় আর্থনীতিকভাবে, আদিবাসীরা যে নিজেদের সম্পদের মালিক, তা গৃহিত হয় নি। জমির অধিকার সম্পর্কিত আঞ্চলিক ব্যবস্থাকে অস্বীকার করা হয়েছে, বহিরাগতদের দ্বারা জমির অধিকারকে ক্ষমার চোখে দেখা হয়েছে এবং সময়বিশেষে উৎসাহিত করা হয়েছে, এবং ন্যায্য বিচারের প্রত্যাশাকেও করা হয়েছে কঠিন। একই ঘটনা ঘটেছে অন্যান্য সম্পদের ক্ষেত্রেও, যেমন মাছধরার অধিকার এবং সাধারণ সম্পত্তির উৎসগুলি। বনাঞ্চলকে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি করে সেখানকার জনসাধারণকে বিতাড়িত করা হয়েছে এই ভিত্তিহীন অভিযোগে যে, এদের কার্যকলাপ পরিবেশের ক্ষতিকর। রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপই এরপর বহুক্ষেত্রে পরিবেশের অবনতির জন্য দায়ভাগী, যেমন (বহুক্ষেত্রে বেআইনি) কাঠ এবং বাঁশ অপসারণের ক্রিয়াকলাপ।
ভারতীয় উপমহাদেশের আপাত স্থবির অথচ স্বংসম্পূর্ণ আর্থ-সামজিক ব্যবস্থায় ব্রিটিশ প্রবর্তিত পুঁজিবাদ নিত্যনতুন সংকটের চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী সমাজের বন্ধন আলগা করতে প্রয়াস পায়। এর থেকেই এক বিরোধ-প্রবণতার জন্ম হয়, যা পরে রূপায়িত হয় জাতি সচেতনতার আকারে। অতঃপর এই সচেতনতা বিদ্রোহের আকারে দানা বাঁধতে থাকে। এই আন্দোলন দেখা যায়, যা কৃষিসমাজে গড়ে নেয় এক বিদ্রোহের সংস্কৃতি।
১৭৭১ সালে সংঘটিত ভারতীয় ইতিহাসের প্রথম উপনিবেশ বিরোধী গণবিদ্রোহ ও তৎপরবর্তী সকল স্বাধীকার আন্দোলনে অপরিসীম ত্যাগ ও বীরত্বের সাক্ষ্য রেখেছে আদিবাসী মানুষ। কেবল ১৮৫৫ সালের বৃটিশ বিরোধী সাঁওতাল হুল বিদ্রোহে ২৩ হাজার আদিবাসী সাঁওতাল প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানা যায়। এমনিকরে মেদিনীপুরের চুয়াড়দের বিদ্রোহ (১৭৭০-৯৯), পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা বিদ্রোহ (১৭৭৬-৮৭), মেদিনীপুরের নায়েক বিদ্রোহ (১৮০৬-১৬), ময়মনসিংহের হাতিখেদা বিদ্রোহ (১৮ শতকের শেষভাগ), ময়মনসিংহের পাগলপন্থী বিদ্রোহ (১৮২৫-২৭), কোল উপজাতীর বিভিন্ন সময়ের বিদ্রোহ (১৮২৩-৮৯), সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫), ত্রিপুরারা কৃষক বিদ্রোহ (১৮৪৪-৯০), মুন্ডাদের উলগুলান (১৯০০) প্রভৃতি বিদ্রোহ ও গণসংগ্রামে অকাতরে জীবন দিয়েছেন তাঁরা।
এই সমস্ত অভ্যুত্থান ও বিদ্রোহগুলির মধ্যে চেহারায় কিছু কিছু পার্থক্য থাকলেও প্রকৃতিগত দিকের বিচারে তাদের মধ্যে ঐক্যসূত্র বর্তমান। এই সব অভ্যুত্থানের অংশগ্রহণকারীরা মূলত কৃষিভিত্তিক সমাজের নিচুতলার মানুষ। দ্বিতীয়ত তাদের অভ্যুত্থান ও বিদ্রোহের মূলকারণ জমিদারি ও মহাজনী শোষণ এবং সমাজের উপর তলার মানুষদের সামাজিক অত্যাচার ও নিপীড়ন, তৃতীয়ত, ওই অত্যাচার ও নিপীড়িনের প্রশ্রয়দাতা বিদেশী শাসকদের নির্মম অবহেলা ও ঔদাসীন্য এবং তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অত্যাচার ও শোষনও ওই বিদ্রোহগুলির পিছনে অন্যতম কারণ হিসেবে কাজ করেছে। চতুর্থত, প্রথম দিকে ঐসব অত্যাচারিত, নিপীড়িত ও প্রচঞ্চিত মানুষেরা প্রতিকারের জন্য শান্তিপূর্ণভাবে আবেদন নিয়ে হাজির হলেও শেষ পর্যন্ত তারা অনন্যোপায় হয়ে বিদ্রোহে ফেটে পড়েছে, অনেক ক্ষেত্রে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ নিয়েছে। নিজেদের আদিম অস্ত্রশস্ত্র Ñ তীরধনুক, দা-কুড়াল, টাঙ্গি, বর্শা প্রভৃতি নিয়েই আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত ও যুদ্ধবিদ্যায় সুশিক্ষিত বিশাল ইংরেজ সৈন্যবাহিনীর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। অসীম সাহসিকতার সাথে শেষ পর্যন্ত লড়াই করে প্রাণ দিয়েছে। কিন্তু শত্র“র কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। পরাজিত হয়েছে, কিন্তু বশ্যতা স্বীকার করেনি। পঞ্চমত, এই সব অথ্যুত্থান ও বিদ্রোহ ভারতের জনগণের সমস্ত সমস্যার মূল উৎস যে সমান্ততান্ত্রিক ভূমি ব্যবস্থা, বিশেষত ভারতের পূর্বাঞ্চলে সুচতুর ইংরেজ শাসক কর্ণওয়ালিশ প্রবর্তিতত যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, তার মূল ধরে রাববার নাড়া দিয়েছে। ওই ভূমি ব্যবস্থার অভ্যন্তরে যে ক্লেদ ও নির্মমতা ও সর্বোপরি কৃষক স্বার্থবিরোধী যেসব হীন ও নিষ্ঠুর চক্রান্ত আছে, অগণিত কৃষককে নিষ্ঠুর শোষণের যে সর্বনাশা ব্যবস্থার ওর মধ্যে নিহিত রয়েছে, তাকে উদঘাটিত করে দিয়েছে।
ইংরেজ শাসনের সূচনাকালে থেকে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের কৃষকদের এইসব সংগ্রামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে আদিবাসী কৃষকরা সবেচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের গারো, কুকি, নাগা, চাকমা, জামাতিয়া, ত্রিপুরা প্রভৃতি বিভিন্ন জাতি থেকে আরম্ভ করে পূর্ব ভারতের সাঁওতাল, কোল, মুন্ডা, ওঁরাও প্রভৃতির কৃষকরা বহু গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামের ইতিহাস রচনা করেছেন। একদিকে ইংরেজ বণিকদের নির্মম লুন্ঠন, জমিদার, ইজারাদার, মহাজন প্রভৃতির অমানুষিক শোষণ ও অত্যাচার অবিচার, তার সাথে সাথে আদিবাসীদের যুগযুগান্তব্যাপী অনুসৃত জীবনধারা এবং সামাজিক রীতিনীতি, নিয়ম-কানুনের অবলিুপ্তির আশঙ্কা ঐসব আদিবাসী জাতির মনে ক্ষোভ ও অসন্তোষের জন্ম দেয়। ওইসবের প্রতিকার চেয়েও যখন তারা দেখে যে প্রতিকারের কোনো সম্ভাবনা নেই, তখনই বাধ্য হয়ে বিদ্রোহের ধ্বজা তুলে ধরেছে। আর ঐসব বিদ্রোহ দমনের নামে ইংরেজ সরকার সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ইংরেজ শাসকদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে জমিদার ও মহাজন প্রভৃতি শোষকরা। তাদের যৌথ আক্রমণে হাজার হাজার কৃষক নিহত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই বিচারের ধার না ধেরে নির্বিচারে গণফাঁসি পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। সুদীর্ঘ কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে, অনেককে নির্বাসিত করা হয়েছে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে ভিটেছাড়া করা হয়েছে। কিন্তু তবুও আদিবাসীরা প্রবল শক্তিমান প্রতিপক্ষের আঘাতে আঘাতে জর্জর ও পর্যুদস্ত হয়েও হার মানে নি, বারবার মাথা তোলার চেষ্টা করেছে।
কিন্তু পরিতাপের বিষয়, আজ অবধি উপমহাদেশের এ সকল আদিবাসী বিদ্রোহ-সংগ্রাম ইতিহাসযোগ্য হয়ে স্থান নিতে পারেনি প্রথাগত ও প্রভাবশালী বিবরণে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বাঙালিভিন্ন আদিবাসীদের ত্যাগ এড়িয়ে যাওয়ার মতই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁদের অবদান লিপিবদ্ধ খন্ড বিদ্রোহ বা স্থানীয় হাঙ্গামা হিসেবে।