ধর্মকে অবজ্ঞা করা সহজ, নিন্দা করা আরও উপাদেয়, কিন্তু মানব অগ্রগতির এই চরমোৎকর্ষের পর্বেও পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের জীবনে ধর্মের যে নানামুখী প্রভাব রয়েছে তা অস্বীকার করা যায় না। ধর্মের মতো এতটা সম্মোহনশক্তি আর কিছুরই নেই। এমনকি বেশিরভাগ বিজ্ঞানী আজও ধর্মের প্রভাব ও প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেন; এটা মানুষের জীবনের প্রতিটি দিককে কোথাও প্রত্যক্ষ, কোথাও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করে চলেছে। তবে কীভাবে ঈশ্বরবিশ্বাস ও পরজাগতিক ধ্যান-ধারণা শত সহস্র বছর আগে মানুষের মগজে ঢুকে শিকড় গেড়ে বসেছে তা ব্যাখ্যা করতে গেলে একটু পেছনে ফিরে দেখতে হবে। দেখতে হবে আদিম মানুষদের মধ্যে কীভাবে আত্মার ধারণা বিস্তার লাভ করে, এবং পরবর্তী পর্যায়ে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে অদৃশ্য শক্তির ভূমিকার বিশ্বাস নিয়ে তা ধর্মের সংগঠন লাভ করে।
স্বপ্নের মাধ্যমেই মূলত আদি মানুষদের আত্মার অনুসন্ধান শুরু হয়। তারা ভাবত যে যখন তারা ঘুমায় তখন তাদের আর এক অস্তিত্ব জাগ্রত মানুষদের মতোই তাকে ঘুমন্ত শরীর থেকে বহু দূরে নিয়ে যায়, শিকার করায়, যুদ্ধ করায়, খায়-দায়। এবং মানুষের এই দ্বিতীয় সত্তার যেহেতু শরীরের প্রয়োজন হয় না, সেহেতু এই সত্ত্বা মানুষের মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকে। শুধু তা-ই নয়, জীবন্ত মানুষের চেয়ে মৃত মানুষের আত্মা উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন হয়ে থাকে। এজন্যে পরবর্তীতে কোনো গোষ্ঠীর বীর যোদ্ধা বা জাদুবিদ্যাসম্পন্ন রহস্যময় ব্যক্তিদের আত্মা বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন আত্মা বা শক্তির মর্যাদা নিয়ে পূজা পেতে শুরু করে। ঝড়, বন্যা, ক্ষরাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্তি পেতে বিগত আত্মা যারা এতদিনে দেব-দেবী বনে গেছেন তাদের প্রতি নৈবেদ্য ও বলি প্রদান করা শুরু হয়। আদিম মানুষদের অন্ধবিশ্বাস ও প্রকৃতিভীতি থেকেই এক সময় ধর্ম তাত্ত্বিক রূপ লাভ করে, এবং বিবর্তনের বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে সর্বশক্তিমান পরমেশ্বরের ধারণায় প্রতিষ্ঠা পায়। কল্পনা ও বিশ্বাসভিত্তিক এই অস্তিত্ব তথা ঈশ্বরের ধারণা আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে যেমন বিসদৃশ নিয়ে বিরাজমান; তেমনি উল্লেখযোগ্য বিভেদ রয়েছে প্রথিবীর বিবিধ প্রতিষ্ঠিত ধর্মগুলোর মধ্যেও। তবে পৃথিবীর সকল ধর্মবিশ্বাসের যেখানে মিল তা হচ্ছে- অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাস। আর অতিপ্রাকৃত মানে যা প্রাকৃতিক থেকে অতিরিক্ত কিছু, বা যা প্রকৃতির নিয়মানুসারী নয়। মানবীয় জ্ঞান তথা বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে অতীতের অনেক অতিপ্রাকৃত বিশ্বাস আজ সাধারণ জ্ঞানে পরিণত হয়েছে। যেমন- চাঁদ-তারা-নক্ষত্রমন্ডলী সম্পর্কিত অতিপ্রাকৃতিক বিশ্বাস মানুষের চন্দ্রবিজয়ের মধ্য রহস্যময়তা থেকে মুক্তি পেয়েছে। এই অতিপ্রাকৃতের বিশ্বাস ও ভয় ধর্মের একটি প্রধান অনুষঙ্গ। এভাবেই ধর্ম মানুষের সংস্কৃতির অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় এবং মানুষের সামাজিক ও মানসিক সমাধানের উপায় হিসেবে প্রভাব রাখে।
নুবিজ্ঞানীদের মতে ধর্মের জন্ম প্রাচীন প্রস্তর যুগে। তাঁরা দেখিয়েছেন মানুষের বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ধমসম্পর্কিত ধারণারও পরিবর্তন ঘটেছে। ধর্মের বিবর্তনবাদী চিন্তা অনুযায়ী মানুষের জীবনের অন্যান্য দিকের ধারবাহিক বিবর্তনের মতোই ধর্ম আজ একটি বিবর্তিত রূপ পরিগ্রহ করেছে যার আদিরুপের কিছু কিছু নমুনা নানা আদিবাসী স¤প্রদায়ের ধর্মাচরনের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। অন্যদিকে ধর্মের মনস্তত্ত্ববাদী চিস্তায় ধর্মের উদ্ভবকে মানুষের মনের অস্বাভাবিক অবস্থার পরিণতি হিসেবে দেখা হয়। মনের বিকার দশা থেকে জীবনের অর্থ সন্ধানে সহায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় ধর্ম। আর মানুষের মনের এই দ্বিধাদৈনতাকে সম্বল করেই গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি। বিখ্যাত চিন্তুক গ্রান্ট অ্যালেন তাঁর “ঈশ্বর ধারণার বিবর্তন” নামক গ্রন্থে উপকথা, নৃতত্ত্ববিদ্যা ও ধর্মবেত্তাদের প্রচুর ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থের পর্যালোচনা ও উদ্ভাবনীশক্তির সাহায্যে গবেষণার মাধ্যমে ঈশ্বর ধারণা ও ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির উপর বিজ্ঞানভিত্তিক আলোকপাত করেছেন। বিষয়ের উপরে বিস্তৃত তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপনের মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন, আদিম খ্রিষ্টধর্মে ঐশ্বরিক মানব কীভাবে এবং কেমন করে মৃত্যুর পর আবার পুনরুজ্জীবিত হলেন, এবং কুমারী মা, পবিত্র আত্মা, ধর্মীয় ঐতিহ্য, ধর্মরহস্যসম্পর্কিত মতবাদ, ধর্মীয় নীতিমালা, দৈব ঘটনাসমূহ এবং বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবের কারণ ও তাৎপর্য ইত্যাদি দিকগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে তিনি বলেছেন, এগুলির প্রতিটিই এক-একটি স্বতন্ত্র ঘটনা। খ্রিষ্টধর্মের দ্বারা এই স্বতন্ত্র ঘটনাবলী একত্রিত ও সংগঠিত হয়েছে। এমনিভাবে প্রায় প্রতিটি ধর্ম তার প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি গড়ার লক্ষ্যে উল্লিখিত পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। তবে ধর্মের এই রূপ তার বিবর্তন বা রূপান্তরের আধুনিক দশা। এর পূর্বে তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে ঈশ্বর ধারণার বিভিন্ন রূপ।
স্থান-কাল ও উৎপাদনের উপকরণের পরিবর্তনের প্রভাবে ঈশ্বর ধারণাও পরিবর্তিত রূপ লাভ করেছে। অসভ্য বলে কথিত মানুষদের বিশ্বাস ছিল- আত্মা শরীরের অনুরূপ হয়ে থাকে, তাই তারা মানুষের আকারে তৈরি কাঠ বা পাথরের মূর্তিতে মিলিত হতে পারে। এই ভাবনা থেকেই হয়ত পৌত্তোলিক পূজার প্রচলন। আবার রোমান, গ্রিকসহ অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতার অধিবাসীরা তাদের ঈশ্বরভাবনাকে প্রয়োজন অনুযায়ী নিজেদের মত করে গড়ে তুলেছিল। এবং সেই সময়কার দেব-দেবীরা প্রতিষ্ঠা পেতেন তাঁদের প্রতিষ্ঠাতাদের আশির্বাদক এবং অবিশ্বাসী ও শত্রুদের প্রতি প্রতিশোধপ্রবণ হিসেবে। যেমনিকরে প্রতিটি নগরের স্বতন্ত্র পৌরদেবতা ছিলেন, তেমনিভাবে প্রতিটি পরিবারেরও স্বতন্ত্র দেব-দেবী ছিল। একইসাথে উল্লেখ্য, সে সময়কার দেব-দেবীরা মানুষের প্রত্যক্ষ প্রয়োজনের নিরিখে নির্মিত হতেন। যেমন- যুদ্ধের সময় সহায়তা করা ও প্রতিপক্ষের হাত থেকে রক্ষা করা, ঝড়-বন্যা-খরা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করা, প্রয়োজনে বৃষ্টি নামিয়ে দেওয়া ইত্যাদি। মানুষ তাদের প্রত্যক্ষ প্রয়োজনকে সমানে রেখেই তখন দেব-দেবীদের সমানে প্রণত হত, অকারণ তপস্যা বা ধর্মাচরণ করার কথা তখনও ভাবনায় আসেনি তাদের। কিন্তু পরবর্তীকালে বুর্জোয়ারা মানুষকে অকারণ ধার্মিক হিসেবে প্রতিপন্ন করতে ধর্মের প্রয়োজনের অভাবকে জাগ্রত করে তোলে। নবগঠিত বুর্জোয়া শ্রেণী তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থে প্রতিবেশী নগর বা রাষ্ট্রসমূহের সাথে এক ধরনের সম্পর্ক গড়ে তুলতে প্রচেষ্টা চালায়। ফলে তাদের এমন ধরনের দেব-দেবী বা ঈশ্বর ধারণার প্রবর্তন করতে হয় যা একইসাথে বহু জাতিকে সংগঠিত করতে পারে, স্বীকৃতি দিতে পারে। এভাবেই ক্রমশ বিমূর্ত ঈশ্বরের ধারণা প্রতিষ্ঠা পায় মানব সমাজে। কারণ এর অন্তগূঢ় আকাক্সক্ষা- বিশ্বাত্মক ঈশ্বরের ধারণার মধ্য দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের সহজ স¤প্রসারণ। অবশ্য জানা যায়, বুজোয়াদের প্রতিষ্ঠিত এই একেশ্বরবাদী ধারণা প্রথম এসেছিল গ্রীক দাশনিক অ্যানাক্সাগোরাসের মস্তিস্ক থেকে।
বুর্জোরা বিশ্বব্যাপী সম্পদের অব্যক্তিগতকরণের লক্ষ্যে বিশ্বঈশ্বরের ধারণাকে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পেলেও তার পাশাপাশি যেমন ব্যক্তিগত সম্পদের পাহাড় রয়েছে, তেমনি বিশ্বঈশ্বরের পাশাপাশি অনেক আঞ্চলিক দেব-দেবীও রয়েছেন। এভাবেই সৃষ্ট ধর্মের প্রধান দুটি প্রকরণ- একেশ্বরবাদ ও বহুঈশ্বরবাদ। একেশ্বরবাদ বলতে ইহুদি, খ্রিষ্টান, মুসলমান প্রভৃতি ধর্ম যেখানে এক সর্বময়ক্ষমতাসম্পন্ন শক্তি বা স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাসসের কথা বলা হয়। আর বহুঈশ্বরবাদী ধর্ম, যেমন- সনাতন ও বিভিন্ন আদিবাসীদের ধর্ম একাধিক ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে। সমাজবিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানীদের মতে বহুঈশ্বরবাদ বা সর্বপ্রাণবাদ ধর্মের আদিরূপ। এজন্যে এখনো একেশ্বরবাদী ধর্মগুলোর বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতায় বহুঈশ্বরবাদ বা সর্বপ্রাণবাদের উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়। হিন্দুরা যেমন ঐশ্বর্য পেতে লক্ষ্মীর আরাধনা, বিদ্যার জন্যে স্বরস্বতীর পূজা করে থাকে, তেমনি ইসলাম ধর্মে আল্লাহ সর্বশক্তিমান হলেও বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে নবী-রাসুল-পীর-আউলিয়াদের মাজারে শরনাপন্ন হতে দেখা যায়।
তবে রীতিনীতি ও আচরনের বহুবিধ ভিন্নতা থাকলেও সকল ধর্মের প্রধান ভিত্তি বিশ্বাস। আর এই বিশ্বাস মানুষকে ধর্মের প্রতি প্রশ্ন করতে বাধা দেয় যা জ্ঞানের বিকাশে এক ধরনের প্রতিকুল ভূমিকা পালন করে। পরজাগতিক সুখ-সমৃদ্ধির মোহ ধর্মপ্রাণদের ইহাজাগতিক প্রগতির ভাবনা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
বিশ্বঈশ্বর ধারণার বিস্তৃতির লক্ষ্যে বুর্জোয়াদের যেমন প্রত্যক্ষ লাভের ব্যাপার ছিল, তেমনি ছিল প্রচ্ছন্ন অভিলাষ। এর নগ্ন প্রমাণ পাওয়া যায় চার্চ বা বিভিন্ন ধর্ম-প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সাধারণ জনগণকে পরজাগতিক ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে কার্যত জিম্মি করে স্বার্থ উদ্ধারের মাধ্যমে। এর মধ্য দিয়ে ধর্মপ্রতিষ্ঠ্নাগুলো অচিরেই প্রভুত সম্পদের মালিক বনে যায়। পাশাপাশি বিবিধ ধর্মীয় বাণীর মধ্য দিয়ে সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণীর না পাওয়ার বেদনাকে ভুলিয়ে দিতে “দুনিয়াতে যার সম্পদ কম, আখেরাতে তার হিসাব সহজ হবে” ইত্যাদি বয়ান প্রচার করে। পাশাপাশি শ্রম-শোষকদের সামাজিক কর্মধারাকে টিকিয়ে রাখতে ধর্ম শাসকদের পক্ষে বিভিন্ন ভূমিকা পালন করে থাকে। ধর্ম সমাজের শ্রেণী বিভেদকে স্বীকৃতি দিতে গিয়ে তা ঈশ্বরের ইচ্ছের প্রকাশ বলে অভিহিত করে। এবং এর জন্যে ঈশ্বরের কাছে হীনমন্য ও বিনীত হতে শেখায়। এমনিতর বিবিধ কৌশলপূর্ন বয়ানের মধ্য দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম মানুষের মধ্যেকার শ্রেণীবৈষম্যকে স্বীকৃতি দিয়ে মানবজাতির মহত্তর প্রগতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে।