কারো কারো মতে, লেখালেখিটা অনেকটাই স্বপ্রণোদিত। নিজ থেকেই হয়ে যায়। আবার অনেকেই লেখালেখি বেছে নেন নিতান্তই পেটের দায়ে। আকস্মিক লেখা শুরু করারও নজির আছে বৈকি। লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তো বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে "অতসীমামী" নামক লেখাটি লেখেন। এরপর আর তাঁর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। তাঁর কলম ঝরিয়েছে মুক্তা। যা কিনা বাংলা সাহিত্যের মূল্যবান সম্পদ।
লেখালেখি শব্দটা লেখা তার সাথে লেখির সমষ্টি। আমরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে লেখাপড়া করি। তবে তা একটি ছোট ক্ষেত্রকে নিয়েই সীমাবদ্ধ। কিন্ত সাহিত্যের মাঠ সুবিশাল, অনন্ত। নেই তার কোনো শেষ। কি কবিতা, কি গান কি গল্প, কি প্রবন্ধ নানা নামে চলে সাহিত্যের অবিরাম চর্চা।
লেখালেখির ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা সীমিত। আমার মতে, প্রতিষ্ঠান কেবল অক্ষর জ্ঞান এবং কতিপয় সাহিত্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। বাকিটা হয় লেখকের মনে। যা তাকে লেখার অনুপ্রেরণা দান করে। আবার বাধ্য হয়ে লিখতে শুরু করেও অনেকে বাজিমাৎ করে দেন।
তো লেখালেখি করার ক্ষেত্রে কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যাক।
১.পড়া, পড়া....: লেখালেখি করার প্রথম শর্তই হলো আপনাকে পড়তে হবে। কতটুকু পড়তে হবে? উত্তর হলো প্রচুর। যতোটা পারা যায়।
তিন গোয়েন্দার লেখক রকিব হাসানের কথাই বলি। তাঁর মতে, "পড়েছি ৪০০০ লিখেছি ৪০০"। অর্থাৎ ১০ গুণ পড়ার ফসল হলো ১ গুণ লেখা। এটা আসলে লেখক ভেদে বিভিন্ন রকম হয়।
আমি নতুন লেখালেখি শুরু করতে চাই। আমি কতগুলো বই পড়বো?
এক্ষেত্রে উত্তর হবে যতগুলো পড়তে পারেন। বিশ্বের সেরা সেরা লেখকদের বইয়ের একটা লিস্ট করুন এবং তারপর যেভাবেই হোক বইগুলো সংগ্রহ করে পড়া শুরু করুন। এটা প্রাতিষ্ঠানিক কোনোকিছু নয় যে আপনাকে কিছু অংশ পড়তে হবে। পুরোটা পড়ুন। কোনো বই পড়ে ভালো লাগলে, আবারো পড়তে পারেন।
এক্ষেত্রে নিচের কথাগুলো মনে রাখতে পারেনঃ
The more the merrier
" লেখালেখি শুরু করার আগে প্রয়োজন অন্যের লেখার সাথে পরিচিত হওয়া "
আপনি যতগুলো বই পড়বেন, ততগুলো ধারণার সাথে পরিচিত হবেন। যদি আপনি লেখক নাও হতে চান তবুও বইয়ের এ তথ্য আপনার কাজে লাগবে আজীবন।
বইয়ের মাধ্যমে লেখকের লেখার ধারার সাথে আপনার পরিচয় ঘটবে। নিত্যনতুন রকমের লেখার ধারার খোঁজ আপনি পেয়ে যাবেন। এটা একই সাথে আপনি কি লিখবেন তাও ঠিক করতে সহায়তা করবে।
তবে এক লেখকের ১০০ বই একেবারে পড়ার মতো কোনো কাজ না করাই ভালো। আমরা যা ভাবি তার একটা ছাপ যেমন আমাদের কর্মে পড়ে, তেমনি যা পড়ি তার ছায়া লেখায় পড়ার সম্ভাবনাটা বেশি হয়ে যায়। এজন্য সতর্কতা অবলম্বন প্রয়োজন !
২.সময়ঃ না, আপনার চোখ ভুল দেখেনি। লেখালেখির ক্ষেত্রে সময়ের প্রয়োজন। যতটা সময় লাগে ভাবতে, চিন্তার সাগরে ডুবে যেতে, লিখতে ততটা সময় লাগে না। এ যেন কোনো অংক যা একবার মিললেই ব্যাটে বলে ছয় !
আপনাকে লেখার সময় বের করতে হবে। আপনি তো আর পেশাদার লেখক নন, যে সারাদিন লেখালেখিই করবেন। দুনিয়ার কথা বড্ড জটিল। তাই লেখার জন্য যথেষ্ট সময় নিয়ে শুরু করতে হবে। শুরুতে বেশিরভাগ সময়ই কাটা উচিত নামীদামী লেখকের লেখা পড়ে। সাথে একটু কলম চালানো। ধীরে ধীরে এগোতে হবে !
৩.অভিজ্ঞতাঃ একটা বই পড়লে আপনি অন্যের একটি অভিজ্ঞতাকে নিজের পাশে পাবেন। তবে নিজের অভিজ্ঞতা না থাকলে লেখালেখিটা হবে না। এক্ষেত্রে ১০ বছরের চাকরীর অভিজ্ঞতা নয় পরিপার্শ্বের অভিজ্ঞতার কথা বোঝাতে চেয়েছি। আপনি যত বেশি দেখবেন, শুনবেন, করবেন ততই আপনার অভিজ্ঞতার ঝুলি সমৃদ্ধ হবে। পড়া বা লেখাটা তো অভিজ্ঞতা বাড়াবেই। তবে অন্যের অভিজ্ঞতা তো নিজের বলে চালানো যায় না !
আপনি আপনার চারপাশের সবকিছুকে গভীরভাবে দেখবেন। জানালার ধারের গাছটি, আকাশে ছুটে চলা পাখির কলরব, রাস্তার ধারের ভিক্ষুক ছেলেটিকে নিয়ে ভাবতে হবে। মনকে করতে হবে প্রকৃতির বন্ধু। পরিবেশ আপনার বন্ধু হলে সহজেই অনেক কাজ হয়ে যায় ।
এক্ষেত্রে ডায়েরিতে নিজের টুকরো টুকরো অভিজ্ঞতাকে লিখে রাখতে পারেন। এতে আপনার জীবনদর্শন ও লেখা হয়ে যাবে। কে জানে শত বছর পর, কিশোরী অ্যানা ফ্রাংকের মতোই আপনার ডায়েরি পঠিত হচ্ছে সারা পৃথিবীতে !
আপনি চারপাশের ঘটনাকে যতটা সুনিপুণ ভাবে লিখতে পারবেন ততোটাই আপনার লেখা ঔজ্জ্বল্য ছড়াবে। তাই জীবনকে নানা ভাবে দেখতে শিখুন। কেননা জীবন বড়ই বিচিত্র।
আপনার প্রত্যক্ষ করার তীক্ষ্ণ ক্ষমতাই পারে কোনো ঘটনাকে শব্দের জালে বাঁধতে। তাই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন। আপনি যতটা গভীরভাবে কোনোকিছু দেখবেন, ততোটাই গভীরতা পাবে আপনার লেখা।
৪.কল্পনাঃ লেখালেখির ক্ষেত্রে আপনাকে কল্পনা করতে হবে অনেক ! আমার এক টুকরো লেখায় এ বিষয়ে উপমা ও চিত্র রূপময়তা নিয়ে বলেছি। সময় করে পড়তে পারেন।
লেখার নিজস্বতা আনতে নিজের কল্পনার ডানাকে সুবিস্তৃত করা প্রয়োজন। যাতে সাধারণ একটা ঘটনাও হয়ে ওঠে অসাধারণ।
অত্যাধিক কল্পনা নির্ভর লেখা হলো সাইন্স ফিকশন। সেখানে কল্পনার মাত্রা ছাড়িয়ে পাঠক যায় অজানা এক জগতে।
কল্পনা কারো সাথে কারো মিলে যাওয়ার কথা নয়। এটা একান্তই লেখকের নিজস্বতা। যা লেখায় এনে দেয় অনন্যতা। যার মাধ্যমে লেখকের স্বতন্ত্র পরিচয় সৃষ্টি হয়।
তাই যত বেশি পারুন কল্পনা করুন !
৫.নিজস্বতাঃ আপনাকে লেখক হতে হলে নিজের মতো করেই লিখতে হবে। অন্যের লেখার ছাপ আপনার লেখায় থাকলে পাঠক তা ভালোভাবে গ্রহণ করবে না। তাই নিজস্বতা বজায় রাখতে হবে।
নিজেকে পাঠক হিসেবে কল্পনা করে নিজের লেখাগুলো পড়ুন। দেখুন কেমন মনে হয় ! সমালোচনা লেখালেখির ক্ষেত্রে ভালোমন্দ দুটোই । তবে আপনার লেখাকে সমালোচনার মুখোমুখি হতেই হবে। কেননা সবার তো আর এক ধরনের চিন্তাধারা নয়।
অনেকেই অনেক বিখ্যাত লেখকের আদলে লিখেন। তবে তাদের লেখা কারো কারো ভালো লাগলেও বেশিরভাগই দিন শেষে বলবে "অমুকের লেখার কপি "।
তাই নিজের মতো লিখুন। এতে লাভ বৈ ক্ষতি হবে না !
তো আজকেই শুরু হোক লেখালেখি !
উৎসর্গঃ সামু ব্লগের সকল গুণী ব্লগারদের যারা আমার কাছে ছোট ছোট লেখা চান

বিঃদ্রঃ লেখাটি আমার এক টুকরো লেখা..... পোস্টের দ্বিতীয় অংশ।
চলবে.....