রিকশায় যেতে যেতে মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় অবিশ্রান্ত চষে বেড়ানো মানুষের পায়ের পেশীতে কিঞ্চিত শিথিলতা লক্ষ্য করলাম। লক্ষ্য করলাম সহস্র চোখের কোলে বিন্দু বিন্দু ঘামের অসহায় অবস্থান। বেশ বুঝতে পারলাম দুপুর নেমেছে ব্যস্ততার মহাযজ্ঞে, অর্থ অনুসন্ধানের তাড়নাকে আপাত নির্বাসন দিয়ে ক্ষুধা নামের জৈবিক তাড়নাকে তুষ্ট করতে উদগ্রীব এখন মতিঝিলের মানুষ- হোটেল, রেস্তোরা, ফুটপাতের অনেকাংশ জুড়ে গড়ে ওঠা খাবার দোকানগুলোয় এসময় পা ফেলা মুশকিল। দৈনিক বাংলা মোড়, পুরানা পল্টন অতিক্রম করে পৌঁছলাম মৎস্য ভবনের কাছে। রিকশা থেকে নেমে পিচ ঢালা রাজপথ পেছনে ফেলে প্রবেশ করলাম রমনায়।
কেন? প্রচণ্ড গরম থেকে বাঁচতে?
হ্যাঁ, আজ গরম একটু বেশিই যেন! চৈত্রের শেষদিন আজ।
‘চৈত্র’। বাংলা সনের শেষ মাস এই চৈত্রের নামকরণ করা হয়েছে চিত্রা নক্ষত্রের নামানুসারে। পুরাণ মতে, চিত্রাসহ মোট সাতাশটি নক্ষত্র হচ্ছে দক্ষ প্রজাপতির সুন্দরী কন্যা।
প্রবাদতুল্য সুন্দরী এই কন্যাদের বিয়ে দেয়ার চিন্তায় উৎকণ্ঠিত হবারই কথা দক্ষের! কারণ, উপযুক্ত পাত্র চাই!
কিন্তু তেমন পাত্র খুঁজে পাওয়া কি সহজ বিষয়!
তাহলে? তাহলে কি অনূঢ়াই থেকে যাবে তারা?
না, বিধির বিধানে উপযুক্ত পাত্র পাওয়া গেল- একদিন মহাসমারোহে চন্দ্রদেবের সাথে বিয়ে হল দক্ষের সাতাশ কন্যার। দক্ষের এই সাতাশ কন্যার মধ্যে অনন্য সুন্দরী অথচ খরতাপময় মেজাজসম্পন্ন একজনের নাম বিশাখা।
হ্যাঁ, এই বিশাখা নক্ষত্রের নামানুসারেই বাংলা সনের প্রথম মাস বৈশাখের নামকরণ।
মাস হিসেবে বৈশাখের প্রথম হবার মর্যাদা কিন্তু বেশি দিনের নয়।
বৈদিক যুগে সৌরমতে বৎসর গণনার যে পদ্ধতি প্রচলিত ছিল, সেখানেও বৈশাখের খোঁজ মেলে। সে মতানুসারে বৈশাখের স্থান ছিল দ্বিতীয় পাদে।
তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ আর পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণের মতে বৈশাখের অবস্থান ছিল বৎসরের মাঝামাঝি জায়গায়।
আবার ব্রহ্মাণ্ড পুরাণের অনুষঙ্গপাদের একটি শ্লোক অনুসারে মাসচক্রে বৈশাখের অবস্থান ছিল চতুর্থে।
তখন অবশ্য আধুনিক বাংলা সনের অস্তিত্ব ছিল না; ছিল ভারতীয় সৌর সন গণনা পদ্ধতি।
মোগল সম্রাট আকবর ‘সুবে বাংলা’ প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশে ফসল কাটার মওসুমে খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে নতুন একটি সন প্রবর্তনের জন্য বিজ্ঞ রাজ-জ্যোতিষী পণ্ডিত আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজিকে অনুরোধ করেন। সম্রাটের অনুরোধে ফতেহউল্লাহ সিরাজি হিজরী চান্দ্র সন অনুসরণে সম্রাটের সিংহাসনে আরোহণের বছর এবং ভারতীয় সৌর সনের সমন্বয়ে বাংলা সন প্রবর্তন করেন। মাসের নামগুলো পুরোনো ভারতীয় সৌরমতে রেখেই পুনর্বিন্যস্ত করেন তিনি। সে অনুযায়ীই বৈশাখ বাংলা সনের প্রথম মাস হিসেবে যুক্ত হয় বর্ষতালিকায় প্রথমবারের মতো।
বাংলা সন সংক্রান্ত সম্রাটের নির্দেশনামা জারি হয় ১০ মার্চ, ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে, তবে তা কার্যকরের নির্দেশ দেয়া হয় ১১ মার্চ, ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ অর্থাৎ মোগল সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণের বছর থেকে।
মোগল সম্রাট আকবর প্রবর্তিত এই নতুন সন খুব দ্রুতই আত্মীভূত হয়ে যায় বাঙালির লোকজীবনে। বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সামাজিক আচার, কৃষি নির্ভর অর্থনীতির প্রবাহমান ধারায় কোনরকম বিঘ্ন সৃষ্টি তো নয়ই বরং সুললিত গতি সঞ্চার করতে করতে নতুন এই সন বয়ে যায় মহাকালের মোহনায়।
ইরানী নওরোজের আদলে বৈশাখের প্রথম দিনে বাংলা নববর্ষ পালনের উৎসব প্রবর্তনের উদ্যোগও নেন সম্রাট আকবর। সে উদ্যোগও সানন্দে বরণ করে নেয় উৎসবপ্রিয় বাঙালি জাতিসত্তা।
এরপর কালের গর্ভে বিলীন হয় মোগল শাসন, দুইশ বছর শোষণ শেষে বিদায় নেয় ইংরেজরা। ভারত ভাগ হয়। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভ্রান্ত ভিত্তিতে সৃষ্টি হয় পাকিস্তান।
বাঙালির বর্ষবরণ উৎসবকে শুরু থেকেই ভালো চোখে দেখেনি সাম্প্রদায়িক মনোভঙ্গি নিয়ে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রটি। বর্ষবরণ উৎসবের সারসত্ত্বায় প্রোথিত ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার প্রতিও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের বিরূপ মনোভাব পরিলক্ষিত হলো প্রকাশ্যেই। বাঙালির প্রাণের অংশ হয়ে ওঠা এই উৎসবটিকে হিন্দু সংস্কৃতির অন্ধ অনুসরণ হিসিবে অভিহিত করার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠল তারা। কিন্তু এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল বাঙালি, আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলা নববর্ষ পালনের মাধ্যমে প্রতিবাদে মুখর হল ছায়ানট।
১৯৬৪ সালে এই সাংস্কৃতিক সংগঠনটি নিজ উদ্যোগে পালন করল বাংলা নববর্ষ। তারপর ১৯৬৭ সালে বর্ষবরণের এই আয়োজনকে সর্বস্তরের মানুষের হৃদয়ের সাথে যোজন করার আকাঙ্ক্ষায় উৎসবের স্থান হিসেবে বেছে নিল তারা ঢাকার রমনা উদ্যানের অশ্বত্থমূলকে। সাধারণত অশ্বত্থ, বট, বিল্ব, আমলকি ও অশোক- এই পঞ্চবৃক্ষের উপস্থিতি পঞ্চবটি নামে পরিচিত। শ্রুতিবিচ্যুতি কিংবা শ্রুতিমধুরতার কারণে অশ্বত্থমূলের পরিবর্তে অনুষ্ঠানস্থল বটমূল হিসেবে পরিচিতি পেল। উৎসবপ্রিয় বাঙালিরা দলে দলে অংশ নিল এই অনন্য আয়োজনে । বাঙালির স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ অবলোকন করে বাংলা নববর্ষকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করতে বাধ্য হল প্রাদেশিক সরকার।
এরপর ৭১ এল বাঙালির জীবনে। তিরিশ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগে শুদ্ধ হলো আমাদের এই গাঙ্গেয় পললভূমি, ঋদ্ধ হলো আমাদের চেতনার ভিত্তিমূল তমসা হননকারী আলোতে।
আর রমনার বটমূল? বর্ষবরণের হৃদয়স্পর্শী আয়োজন নিয়ে ধীরে ধীরে পরিণত হলো অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সমৃদ্ধ বাঙালির পূণ্যতীর্থে।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই এপ্রিল, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:২৭