সন্দেহ নেই ঐশী বখে গেছে। কিন্তু তার মতো একটি মেয়ের পক্ষে এই হত্যাকাণ্ড সম্ভব নয়।
সেদিন আমার সহকর্মীর কথা বিশ্বাস হয়নি। আজ ঐশীর সুইসাইডাল নোটে সব পরিষ্কার হয়ে গেল। এই রকম লেখা পত্রিকার সম্পাদকরাই শুধু লিখতে পারেন। দেখুন, ঐশী নিজে লিখছে জ্বরে তার গা পুড়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় বাংলা যার একাডেমিক ভাষা নয়, সে কীভাবে এত সুন্দর করে লিখল?
আর বেশি দেরি নেই। খুব শিগগিরই সরকার পরিবর্তিত হচ্ছে। সব রহস্য বেরিয়ে আসবে।
ঐশীর সুইসাইডাল নোটটি মানবজমিন পত্রিকায় 'হুবহু' ছাপা হয়েছে।
স্টাফ রিপোর্টার: উচ্চাকাঙক্ষী ঐশী জীবনকে উপভোগ করতে গিয়ে নেশার জগতে হারিয়েছিল। আনন্দ খুঁজতে গিয়ে জড়িয়েছিল অনৈতিক সম্পর্কের অচ্ছেদ্য জালে। দীর্ঘদিনের এমন অভ্যস্ত ও বেপরোয়া জীবনে হঠাৎ করেই নেমে আসে বাধা। বাবা-মায়ের অতি শাসনের কবলে তিন মাস ধরে ফ্ল্যাটে বন্দি হয়ে পড়ে। কেড়ে নেয়া হয় মোবাইল ফোন। এতে ভীষণ হতাশ হয়ে পড়ে ঐশী। বেঁচে থাকার আশা হারিয়ে ফেলে। মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে অবাধ মেলামেশায় পিতা-মাতার আকস্মিক বাধা ও মাদকের নেশার ছোবলে। একপর্যায়ে আত্মহত্যা করে সকল হতাশা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে থাকে। শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে নিজের পিতামাতাকেই হত্যা করে সে। কোন ধরনের হতাশায় ভুগছিল ঐশী, পিতামাতার প্রতি কেন ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল সে বিষয়ে সবিস্তার বর্ণনা পাওয়া যায় তার লেখা ১২ পৃষ্ঠার একটি সুইসাইডাল নোটে। ঐশীর নিজের হাতের লেখা ওই নোট এখন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে। পাঠকের জন্য চিঠিটি হুবহু তুলে ধরা হলো
প্রিয় ভাইয়া/আপু
আমি জানিনা এ চিঠি আমি কাকে লিখছি। তারপরও কাউকে না কাউকে কিছু একটা বলতে খুব ইচ্ছা করছে। আমি আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। খুবই কঠিন সিদ্ধান্ত। এ সিদ্ধান্ত নেয়ার পর আরও কঠিন মনে হচ্ছে। বুক ভেঙে যাচ্ছে। আত্মহত্যার কারণ আমি কাউকে বলতে চাচ্ছি না। কারণ একজনের দুঃখ সাধারণত আরেকজন কখনওই মন থেকে বুঝতে পারে না। আমার আত্মহত্যার কারণ তোমার কাছে খুবই অপ্রয়োজনীয় ও হাস্যকর মনে হতে পারে। সুতরাং সেই ঝামেলাই গেলাম না। আমার এ চিঠিটাকে সুইসাইডাল নোট বলা যেতে পারে। তুমি নিশ্চয় অবাক হচ্ছো জীবনের শেষ কথাগুলো আমার আত্মীয় স্বজন, বাবা-মাকে না জানিয়ে কোন একজন অপরিচিতকে জানাচ্ছি। কারণ তারা কোনদিনও আমাকে বুঝতে পারেনি। আমার অনেক খারাপ দিক আছে। সেই খারাপ দিকগুলো চালাকি করে বুঝে ফেলা ছাড়া ভাল দিকগুলো কখনও বোঝার চেষ্টা করেছে কিনা তা সন্দেহ। আমার এ চিঠিখানা তাদের দেখাতে লজ্জা ও ঘৃণা লাগছে। মরে যাবো তবু কারও প্রতি কোন রাগ নেই। মানুষকে দোষ দিয়ে কি লাভ বলো। প্রত্যেকেরই তো নিজস্ব চিন্তাধারা, আশা থাকে। প্রত্যেকেই তো চায় তার ইচ্ছা পূরণ হোক। শুধু যেটা বুঝতে পারে না অন্য মানুষের যে আশা-আকাঙক্ষা থাকতে পারে, আনন্দের একটি নির্দিষ্ট কারণও থাকতে পারে। আমি জানি তারা আমাকে অনেক ভালবাসে, তাদের ভালবাসা নিয়ে প্রশ্ন তোলার বা দোষ ধরার ইচ্ছা, রাগ, শক্তি কোনটাই আমার এখন আর নেই। শুধু একটাই আফসোস থেকে গেল জীবনে অনেক স্বপ্ন ছিল কোনটাই পূরণ করতে পারলাম না। এ পৃথিবীর মানুষ সবাইকে বুকের মাঝে নিয়ে যে স্বপ্নগুলো দেখেছিলাম সবই কেমন যেন ধুয়ে মুছে গেল, সব শেষ। আচ্ছা সব কিছু এমন হয়ে গেল কেন, বলো তো?
ভাইয়া/আপু, আমি তো মানুষকে ভালবাসতে চেয়েছিলাম। পৃথিবীকে ভালবাসতে চেয়েছিলাম। মানুষের হাসি কান্না, আনন্দ ভাল লাগা, অনুভূতি, প্রেম, সবচেয়ে বড় কথা মানুষকে ভালবাসা। পৃথিবীর নানা জায়গার সৃষ্টি, এত সুন্দর পৃথিবী বেহেস্তকেও যেন হার মানায়। কেন শেষ পর্যন্ত এখানে বাস করে যেতে পারলাম না। কেন এসব উপভোগ করে যেতে পারলাম না। শেষ সময় পর্যন্ত। আমি জানি এর উত্তর একমাত্র ঈশ্বর ছাড়া আর কারও কাছে নেই। হয়তো বা ঈশ্বরের কাছেও নেই, আমি সব শুনে আসছি, তুমি মন দিয়ে যদি কোন কিছু চেয়ে থাকো তবে অবশ্যই তা পাবে। আমার স্বপ্ন আশা-আকাঙক্ষাগুলো আমি কি মন দিয়ে চাইনি? শুধু মন দিয়ে চাওয়া এ স্বপ্নগুলো পূরণ করার জন্য কত কিনা করলাম। মানসিকভাবে, শারীরিকভাবে, শারীরিক কষ্টটা.......।
আমার জন্য তা অনেক ছিলো। আহঃ, ওহঃ, ঠিক কষ্টের কথা বলতে গিয়ে আমার হাত কাঁপছে। একটা সময় ছিল এমন কোনোদিন যেতো না যে আমি কাঁদতাম না। জীবনের দুইটা বছর নষ্ট হয়ে গেল। দুইটা বছর একা একা কাটালাম। এ দুইটা বছর যে কিসের ভিতর দিয়ে গিয়েছি আমি আর ঈশ্বর ছাড়া আর কেউ জানে না। হাজার কষ্টের মধ্যেও একটা জিনিস চিন্তা করে স্বস্তি পেতাম। অন্তত আর কেউ না থাকুক ঈশ্বর আমার পাশে থাকবে। আর কেউ না বুঝুক অন্তত উনি আমার কষ্টটা বুঝবেন। আমি এখনও জানি তিনি আমার পাশে আছেন। যা হোক এসব কথাবার্তা বলা এখন অর্থহীন। মনের ভিতর এক অজানা উল্লাস হচ্ছে, কেন জানি মনে হচ্ছে মৃত্যুর পর আমার পছন্দের জায়গায় চলে যাবো। জায়গাটা পৃথিবীর মতোই হবে। কিন্তু এই পৃথিবীতে আমার স্বপ্নগুলো এখনও পূরণ হয়নি। যেগুলো পূরণ করতে হবে। মানুষ কেমন আজব প্রাণী তাই না! আশা (হোপ) মানুষ ছাড়তে পারে না। মরতেও চাই আশা নিয়ে। আমি জানি না মৃত্যুর পর কি হবে, দেখা যাক কি হয়, আসলে হয়তো মৃত্যুর পরের জীবন বলতে কিছুই নেই। শুধুই মাটির সঙ্গে মিশে যাবো। তাহলে তো সবই শেষ। যাহোক মৃত্যুর পর যদি কিছু না-ও পাই। এই পৃথিবীতে যতটুকু সময় কাটিয়েছি, আমার এ ছোট্ট জীবনে তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। তুমি হয়তো বা মনে করতে পারো। এ পৃথিবীতে এসে তো কিছুদিন পর আত্মহত্যাই করলাম। সময় নিশ্চয় ইহকালে ভাল কাটেনি, আবার কৃতজ্ঞ হওয়ার কি আছে। ন্যাকামির আর জায়গা পাই না। কি জানি?
ভাইয়া/আপু, কেন জানি ভাল লাগে পৃথিবীতে এসে অনেক কষ্ট পেয়েছি ঠিক আছে, সবচেয়ে বড় কষ্টটা হলো আশা শেষ হয়ে যাওয়ার কষ্ট। তীব্র হতাশা মাথার উপর ভেঙে পড়ার কষ্ট। মানুষ কি আশা ছাড়া বাঁচতে পারে বলো, এই একটা জিনিসই তো আছে। যা কিনা বহুদিন পর্যন্ত আঁকড়ে ধরে রাখা যায়। কিন্তু আমি যদি বলি পৃথিবীতে আমার জীবনের সময়গুলিতে কোন সুখ স্মৃতি নেই। তাহলে তো মিথ্যা বলা হবে। কত ভাল, কত আনন্দ, কত কি-ই না আছে। কত সুন্দর মানুষের হাসি, সেই সুখগুলো, কোন ছেলেকে প্রথম ভালো লাগা, সেই অনুভূতিগুলো। পছন্দের আত্মীয়স্বজন বা বন্ধু বান্ধবের সাথে জমিয়ে আড্ডা দেয়ার সেই সময়গুলো পৃথিবীর ইতিহাস পড়ে সুন্দর জায়গার দৃশ্য দেখে অভিভূত হওয়ার সময়গুলো .......মনে হয় কত আবিষ্কারই না করলাম। পৃথিবীর ব্যাপারে মানুষের জীবনের ব্যাপারে। মানুষের জীবন সম্বন্ধে কত সুন্দর সুন্দর তথ্যই না জানলাম। এর থেকে সুন্দর জিনিস আর কি-ই বা হতে পারে। মানুষের তৈরী কত অদ্ভুত-চমৎকার জিনিসই না দেখার সৌভাগ্য হলো। ঈশ্বরের বিশাল ও তুলনাহীন সৃষ্টি দেখতে পারলাম। এই জায়গাটাই না এলে এসব কিভাবে জানতাম। কিভাবে দেখতাম। মরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর এখন সব কিছুই সহজ মনে হচ্ছে। এক ধরনের স্বস্তি বোধ করছি। সবচেয়ে বেশি স্বস্তি বোধ করছি জীবনযুদ্ধ আর করতে হবে না।
জীবনযুদ্ধে হেরে গেলাম এই কথাটা আগে শুধু বইতে পড়তাম। তখন অনুভব করতে পারিনি। এখন বুঝতে পারছি জীবনযুদ্ধে হেরে যাওয়া আসলে কি জিনিস। আমি সব সময় শুনে এসেছি যারা আত্মহত্যা করে তারা নাকি দোজখে যায়। জিনিসটা কেন জানি বিশ্বাস করতে পারি না। কারণ সে মানুষটা এখন স্বেচ্ছায় আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে, তার ভিতরে কি পরিমাণ, হতাশা কষ্ট, দুঃখ থাকলেই না জানি সে এমন একটা কিছু করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এই জায়গাটাই আমরা কতই না ভালবাসি। হাজার কষ্টের মধ্যেও লড়াই করে যাই শুধুমাত্র এই জায়গাটাতে টিকে থাকার জন্য, একটু সুখে থাকার জন্য। একটা মানুষের বুক কতটা ভেঙে গেলে এই ধরনের, এই সাধের জীবন, পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তার বুক ভাঙা কষ্টের কি কোন দাম নেই। পৃথিবীর যেখানে আমরা এক টুকরো সুখের জন্য আমরা কত কিছুই না করি, এতো কষ্ট পাওয়ার পরও... কষ্ট পাওয়ার কি মুক্তি আছে। ঈশ্বর কি এতটাই পাষাণ। কি দোষ করেছিলাম আমরা। জীবনের কথা না হয় বাদই দিলাম। আমি এমনকি খারাপ কাজ করেছিলাম যে, রাত দিন ভবিষ্যতে কত কিছুই না করবো কল্পনা করে কত মানুষকে নিয়ে কল্পনা করে এই চোখটার সামনে কোন কিছুই সত্যি হতে দেখলাম না। মাঝখান দিয়ে জীবনের আরও যে যুদ্ধ করে যাবো সেই উপায়টাও শেষ হয়ে গেল। ঈশ্বর বুঝি আসলেই পাষাণ। লেখার মতো আর অনেক কিছুই আছে। কিন্তু আর কিছুই লিখতে পারছি না। জ্বরের জন্য হাত কাঁপছে। শরীর জ্বলন্ত আগুনের মতো গরম। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। এখন যে কেউ একজন গায়ে হাত রাখবে এমন কেউ নাই। থেকেও যেন নাই। এই কথাটা সত্যি মানুষ পৃথিবীতে আসে একা চলে যায়ও একা। হায়রে পৃথিবী কত ভালবাসার, কত সাধের। আমার এক সময় পৃথিবী নামে পরিচিত একটা ছেলে ছিল।
ঐশী/ডালিয়া।
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে আগস্ট, ২০১৩ বিকাল ৫:২২