somewhere in... blog

কালুরঘাটের শুক্কুর মিয়া ভাই- বেলাল মোহাম্মদ

২৬ শে মার্চ, ২০০৯ রাত ৮:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বেলাল মোহাম্মদ : লেখক, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক

Click This Link
দৈনিক যুগান্তর, ডিসেম্বর ১২, ২০০৮, শুক্রবার

কালুরঘাটের শুক্কুর মিয়া ভাই

বে লা ল মো হা ম্ম দ

সৈয়দ আবদুল শুক্কুর ২৭ থেকে ৩০ মার্চ (১৯৭১) কালুরঘাট প্রচার ভবনে আমাদের স্বনিষ্ঠ কারিগরি সহযোগিতা দিয়েছিলেন। আগ্রাবাদ বেতার ভবনে শুক্কুর মিয়াকে দেখতাম ক্যান্টিন চালক হিসেবে।

তখনকার দিনে আঞ্চলিক পরিচালকদের ক্ষমতা ছিল ৩য়-৪র্থ শ্রেণীর কর্মীদের নিয়োগদানের। সেই সুবাদে ১৯৬৪ সালে ম্যাকানিক পদে নিযুক্তি পেয়েছিলেন শুক্কুর মিয়া। আমার যদি ভুল না হয়, তাকে অফিসের গাড়িচালক হিসেবেও দেখেছিলাম অথবা হয়তো মোটরগাড়ি মেরামতের কাজ করতেই দেখতে পেয়েছিলাম। একই বছর আমিও অপেক্ষাকৃত বেশি মাসোহারা পেয়ে দৈনিক আজাদীর সংবাদ কক্ষ ছেড়ে চট্টগ্রাম বেতারে চুক্তিভিত্তিক লেখক-শিল্পী পদে যোগদান করেছিলাম।

শুক্কুর মিয়ার সঙ্গে সহোদরোপম ঘনিষ্ঠতার সূত্রপাত ঘটে কালুরঘাট প্রচার ভবনে ২৭ মার্চ ১৯৭১ সন্ধ্যাবেলা। পটিয়া থেকে মেজর জিয়াউর রহমানকে নিয়ে কালুরঘাটে পৌঁছে অফিস ভবনে বসে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তক্রমে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মেজর জিয়ার বক্তব্যের ইংলিশ মুসাবিদা তৈরি ও বঙ্গানুবাদের কাজ সম্পাদন করে প্রচারের জন্য ক্ষুদে স্টুডিওতে গিয়েই ট্রান্সমিটিং-এর দায়িত্বে নিয়োজিত দেখতে পেয়েছিলাম শুক্কুর মিয়াকে। তার পাশে অন্যমনস্কভাবে দাঁড়ানো টেকনিক্যাল এসিস্ট্যান্ট আমিনুর রহমান।

আগের দিন ২৬ মার্চ স্বাধীন বাংলা (বিপ্লবী) বেতার কেন্দ্রের উদ্বোধনী অধিবেশনে দু’জন উচ্চপদস্থ (রেডিও ইঞ্জিনিয়ার) বেতার কর্মীর কাছ থেকে ট্রান্সমিটিংয়ের সহযোগিতা শারীরিক জোরজবরদস্তি করে আদায় করেছিলাম, স্বভাবতই সেই রাতে তারা কালুরঘাট এলাকার আবাস ছেড়ে পালিয়েছিলেন। সেই অধিবেশনে আমাদের বিভিন্ন কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর তারবার্তার অনুবাদ এবং এমএ হান্নান ও কবি আবদুস সালামের বক্তব্য প্রচারকালে শুক্কুর মিয়া ছিলেন না। আমার ছায়াসঙ্গী হিসেবে শুধু ছিলেন আবুল কাশেম সন্দীপ ও আবদুল্লাহ আল ফারুক।

২৭ মার্চ প্রায় এককভাবেই শুক্কুর মিয়া ট্রান্সমিটিংয়ের দায়িত্ব নির্বাহ করেছিলেন। ম্যাকানিক পদে নিয়োজিত অবস্থায় আন্তরিক অভিলাষ ও নিষ্ঠাবলে তিনি আপন মনে বেতারের প্রচার সংক্রান্ত কারিগরি জ্ঞান রপ্ত করেছিলেন। আর বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলন ও ৭ মার্চের বজ্র কণ্ঠের ঘোষণায় অনুপ্রাণিত হয়ে সেই মুহূর্তে প্রচার যন্ত্রপাতি হ্যান্ডলিংয়ের দুঃসাহস অর্জন করেছিলেন। একই রকম দুঃসাহস আমাদের মধ্যে যেমনটি সংক্রমিত হয়েছিল বিমান হামলার পরদিন ৩১ মার্চ আস্ত একটি ১ কিলোওয়াট মধ্যম তরঙ্গ ট্রান্সমিটার তুলে নিয়ে (ডিসমেন্টাল) সরে পড়ার। সময়ের অনিবার্য প্রয়োজনে উপস্থিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ/বাস্তবায়নের বিষয়টি অবশ্যই বৈপ্লবিক। আর বিপ্লবীরা সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডের পরিণতি শুভ কিংবা অশুভ হতে পারে, তাই ভেবে দ্বিধাগ্রস্ত হয় না। বরং জীবনের ঝুঁকি নিয়েই অগ্রযাত্রা করে। ২৬ মার্চের স্বতঃস্ফ‚র্ত উদ্যোগ গ্রহণের সময় কি জানতাম, এই দিনটিই হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস।

৩ এপ্রিল ১৯৭১ পটিয়া থেকে রামগড় সীমান্তে যাত্রাকালে শুক্কুর মিয়াকে আমি বাড়িতে ফিরে যেতে বলেছিলাম। তিনি আগ্রহী ছিলেন আমাদের সঙ্গে থাকতে। চান্দগাঁও গ্রামের বাড়িতে তার পরিবার-পরিজন ছিলেন। বলেছিলাম আপনাকে আমরা আমাদেরই একজন মনে করব সব সময়। এই ক’দিন আপনার যে সহযোগিতা পেয়েছি, তার তো তুলনা নেই। (স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র : পৃষ্ঠা ৫৫)


দুই

চট্টগ্রাম থেকে চান্দগাঁওয়ের বাসিন্দা তরুণ নাট্যকর্মী শ্রীমান নোমানের ফোন বেগম মুশতারী শফীর কাছ থেকে নম্বর নিয়েছেন, জানালেন। তিনি বেতারে স্বাধীনতা ঘোষণা বিষয়ক সঠিক তথ্যটি জানতে আগ্রহী এবং ঢাকায় আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। আমি বললাম, বেশ তো, আপনি এখন চান্দগাঁওতেই আছেন আপনাদের গ্রামের শুক্কুর মিয়া সাহেবের বাড়িতে গিয়ে তাকে আমার শুভেচ্ছা দিন এবং যে বিষয়ে আমার কাছ থেকে জানতে চাইছেন, সেই একই বিষয়ে তার কাছ থেকেও জেনে আসুন।

টেলিফোনের আলাপচারিতার তারিখ ২৯ সেপ্টেম্বর ২০০৮। পরের দিন অর্থাৎ ৩০ সেপ্টেম্বর তথা মাহে শাওয়াল চাঁদ রাতে সৈয়দ আবদুল শুক্কুর ৭৪ বছর বয়সে মারা যান। ঈদের পরের দিন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসে নোমান এই আকস্মিক মৃত্যু সংবাদ জানান। অর্থাৎ ‘নুরুজ্জামান নাজির বাড়ি’তে গিয়ে প্রবীণ বাসিন্দা সৈয়দ আবদুল শুক্কুরের সঙ্গে তার দেখা করা হয়ে ওঠেনি।

কিছুদিন পরই চট্টগ্রামের একটি ব্যাংকে অফিসার পদে কর্মরত সৈয়দ জসীম উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা গেল। প্রয়াত সৈয়দ আবদুল শুক্কুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র। ১৯৭১ সালে ৬-৭ বছর বয়স ছিল, তখন আমাকে দেখেছিল, জানা গেল, ওরা ৪ ভাই, ২ বোন। সবাই কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠিত। মা সম্মানিত জোহরা খাতুন বৃদ্ধ বয়সে সাথীহারা হলেন!

সৈয়দ আবদুল শুক্কুর জীবিকার তাগিদে যুদ্ধকালীন চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের চাকরিতে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি ভালো উর্দু বলতে পারতেন। নিয়মিত অফিসীয় ডিউটি পালনের পাশাপাশি গোপনে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করতেন নানাভাবে। দেশ শত্র“মুক্ত হওয়ার পর তিনি নিজের সত্যিকার ভ‚মিকার কথা সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন। এছাড়া মুজিবনগর ফেরত আমরা কালুরঘাটের সহকর্মীরাও তার সম্পর্কে কর্তৃপক্ষের কাছে বলেছিলাম। সেই সুবাদে পদোন্নতি হয়েছিল তার তিনি এয়ারকন্ডিশনিং সুপারভাইজার হয়েছিলেন এবং পূর্ণ মেয়াদ চাকরি শেষে ১৯৯৫ সালে অবসর গ্রহণ করেছিলেন। রেকর্ডসূত্রে এক বছরের বয়োকনিষ্ঠ লক্ষ্য করা গেলেও পর্যবেক্ষণ সূত্রে শুক্কুর মিয়া আমার চেয়ে দু’বছরের বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন। বস্তুত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা কর্মীদের তালিকায় তার নাম যুক্ত হলে অর্থাৎ আমাদের সংখ্যা ১০-এর বদলে ১১ হলে তিনিই হতেন সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ। এদিকে আমাদের ১০ জনের মধ্যে ইতিপূর্বেই চারজন হারিয়ে গেছেন। তাদেরই একজন কাজী হাবিবউদ্দিন আহমদ মনির নাম মুক্তিযোদ্ধাদের তথাকথিত তালিকায় খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে জানা গেল সৈয়দ আবদুল শুক্কুর শবযাত্রাকালে যথাযথ সংবর্ধিত হয়েছিলেন। (ঢাকা ২৭.১০.২০০৮)





সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ রাত ৯:৩৩
৩৭৫ বার পঠিত
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ভারতীয় পতাকার অবমাননা

লিখেছেন সরলপাঠ, ০২ রা ডিসেম্বর, ২০২৪ ভোর ৪:৪৩

বাংলাদেশের ২/১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় পতাকার অবমাননা আমার কাছে ছেলেমী মনে হয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে ভারত বাংলাদেশের রাজনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করার কারণে বাংলাদেশের মানুষের মনে প্রচন্ড রকমের ভারত বিদ্বেষ তৈরি হয়েছে।

কিন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভিসা বন্ধ করায় ভারতকে ধন্যবাদ।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা ডিসেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩



ভারত ইদানীং ভিসা দিচ্ছেনা; তারা ভিসা না দিয়ে আমাদেরকে শিক্ষা দিতে চায়! তাদের করদ রাজ্য হাতছাড় হওয়া খুবই নাখোশ, এতোই নাখোশ যে মোদী মিডিয়া দিনরাত বয়ান দিচ্ছে এই দেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতের চিকিৎসা বয়কট এবং

লিখেছেন পবন সরকার, ০২ রা ডিসেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:৫৬


ভারতের এক হাসপাতাল ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশের কোন রুগিকে তারা চিকিৎসা দিবে না। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো যে হাসপাতাল থেকে এই ঘোষণা দেয়া হয়েছে সেই হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার জন্য বাংলাদেশের... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। চামচা পুঁজিবাদ থেকে চোরতন্ত্রে পরিণত হয়েছিল দেশ

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০২ রা ডিসেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:১৩






চামচা পুঁজিবাদ থেকে দেশ চোরতন্ত্রে পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, আমলা, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা মিলে চোরতন্ত্র করেছে।

সোমবার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখ হাসিনাকে ভারত ফেরত পাঠাবে তবে............

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০২ রা ডিসেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:৪২


শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে বিচারের জন্য ভারতের কাছে ফেরত চাইতে হলে অবশ্যই বাংলাদেশকে প্রতিহিংসামূলক বিচারপদ্ধতি বাদ দিতে হবে। বিচারে শেখ হাসিনা যাতে ন্যায় বিচার পান বাংলাদেশকে আগে তা নিশ্চয়তা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×