somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাম্যবাদঃ অতীত নাকি ভবিষ্যৎ (পর্ব ১: পরিচিতি)

০১ লা অক্টোবর, ২০১৭ দুপুর ২:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



অক্টোবর ২০১৭। এখন থেকে ঠিক ১০০ বছর আগে এই সময় সূচনা হয়েছিল প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের [1]। ইতিহাসে প্রথমবার পুঁজিবাদী শ্রেণী সংগ্রামকে চ্যালেঞ্জ করে স্বপ্নদ্রষ্টা কার্ল মার্ক্সের আদর্শে ভ্লাদিমিচ লেনিন একটি আদর্শ দেশ তৈরি করার পণ করেছিল। সোভিয়েত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হবার ৭৪ বছরের মাথায় লেনিনের স্বপ্নের ইতি ঘটে। কারণ হিসেবে শুধু পুঁজিবাদী পরাশক্তিই ছিল না, বরং সোভিয়েতরাও নানা সময়ে শক্তির উপাসনা করতে গিয়ে শক্তির অন্যায় প্রয়োগ করেছে। ১৯৯১ সালে যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে, তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন সংজ্ঞাগত সমাজতন্ত্র থেকে সহস্র মাইল দূরে ছিল। তবে আমার ব্লগ সিরিজের মুল আলোচ্য বিষয় সোভিয়েত ইউনিয়ন না, বরং সাম্যবাদ। এমন সমাজ যেখানে রাষ্ট্র, মুদ্রা কোন অর্থ বহন করবে না। মনমন্দিরে মার্ক্সের দেবমূর্তি বানানো যেমন যথার্থ না, ঠিক তেমনই তার অনুধাবনগুলোও সম্যক্রুপে নিধন করাও অনুচিত। আমি ব্লগ সিরিজে মার্ক্সের গুণগান গাইবো না, বরং তার চিন্তন, থিউরিগুলো যতটা আমাদের জন্য ও ভবিষ্যতের জন্য জানা গুরুত্বপূর্ণ সেটা নিয়ে কথা বলবো।



সাম্যবাদের কনসেপ্ট জনপ্রিয়তা প্রায় কার্ল মার্ক্সের “Dak Kapital" বইতে। সাম্যবাদকে সহজে বুঝানোর জন্য প্রথমে আমাদের বুঝতে হবে "উৎপাদনের মাধ্যম" (Means of Production) ও "শ্রম" (Labour) সম্পর্কে।

Means of Production অর্থাৎ যে উপায়ে কোন কিছু উৎপাদন করা হয়, সেটা পণ্যও হতে পারে সেবাও হতে পারে। আমার এই ব্লগের কথাই চিন্তা করি।

আমি এই ব্লগটি লিখেছি একটি ব্লগসাইটে, ব্লগ সাইটটির মালিক আমি নই বরং ব্লগের এডমিনরা। মার্ক্স এটাকে বলেছেন পুজিবাজি উৎপাদন। যেখানে উৎপাদনের মাধ্যমগুলো উৎপাদনকারিদের মালিকানায় না থেকে কোন ব্যাক্তিমালিকানায় থাকবে। উৎপাদিত পণ্য/সেবা মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে বিক্রি করা হবে। যেমন ব্লগসাইটগুলোর এডমিন পোস্টের সাথে বিজ্ঞাপন যোগ করে দেয়, ফলে পাঠকরা পোস্টগুলো পড়লে ব্লগ সাইটের মালিক ইনকাম হয়, অথচ ব্লগের যারা কন্টেন্ট বানাচ্ছে তারা শ্রম ব্যয় করেও তাদের পকেট খালি।

দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে শ্রম বা Labour। আর মার্ক্সের মতে শ্রম খুবই গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। মার্ক্স মনে করতেন মানুষ ব্যাক্তিগতভাবে প্রকৃতির কাছে দুর্বল, আমরা জৈবিকভাবে খুবই অক্ষম। একটা সাধারণ তৃণভোজী প্রাণী বা মাংসাশী প্রাণীকে কোন অচেনা অরণ্যে ছেড়ে দিলে সে তার জৈবিক বৈশিষ্ট্যে যতটা না খাপ খাওয়াতে পারবে, একজন একা মানুষ সেটা পারবে না। মানুষের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার বুদ্ধিমত্তা। অন্যপ্রাণীর মত পরিবেশে খাপ না খাওয়ানোর চেষ্টা করে মানুষ বরং উল্টো পরিবেশকে নিজের মত করে সাজাতে চায়। আর সেটার মাধ্যম হচ্ছে শ্রম বা Labour। আর এই শ্রমের মাঝে লুকিয়ে থাকে মানুষের সৃজনশীলতা, বুদ্ধিমত্তা ও শিল্প।



মানুষ সমাজে বাস করে কারণ একসাথে শ্রম বণ্টন করে বসবাস করলে পরিবেশে সহজে টিকে থাকতে পারবে। তাই মার্ক্স মনে করতেন মানব সমাজের মৌলিক মুদ্রা হচ্ছে শ্রম। তাই শ্রমই যেকোন জিনিসের মূল্য নির্ধারণ করে। আপনার কাছে যদি কাঠ থাকে আর আপনি সেটার কোন পরিবর্তন না করেন তাহলে সেটার মূল্য অপরিবর্তিত থেকে যাবে; কিন্তু যদি আপনি শ্রম ব্যয় করে কাঠকে চেয়ারে রূপান্তর করেন তাহলে সেটার মূল্য বৃদ্ধি পাবে। হ্যাঁ, এখন বলতে পারেন যদি কাঠের চাহিদা যোগানের হেরফের হয় তাহলে মূল্যেরও হেরফের হবে। কিন্তু না, আপনি যে জিনিসটা বলছেন সেটা হচ্ছে কাঠের "দাম", "মূল্য" না। কার্ল মার্ক্স দাম আর মূল্যকে ভিন্নভাবে দেখেছেন।



মূল্য আর দাম অবশ্যই নির্ভরশীল ও আপেক্ষিক; কিন্তু কোন জিনিসের মূল্য নির্ভর করে আদর্শ পরিবেশে কি পরিমাণ শ্রম এটার জন্য ব্যয় করা হয়েছে তার উপর। দাম পরিমাপের কোন যথার্থ নিয়ম নেই, নীতি নির্ধারকরা যেভাবে ইচ্ছা হাঁকতে পারে। অন্যদিক, মূল্য পরিমাপ করা হয় নির্দিষ্ট সময়ে ব্যয় হওয়া শ্রমের মাধ্যমে। যদি শ্রম ব্যয় না করে আমরা যন্ত্রের প্রয়োগ করি তখন পণ্যের মূল্য কমে যায়। কারণ একই কাজ শ্রম দিয়ে করার জন্য আমাদের নির্দিষ্ট বিষয়ে জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হয়, অর্থাৎ তুলনামূলক বেশি শ্রম ব্যয়। মার্ক্সের এই থিউরিকে বলা হয় Labor Theory of Value.



উল্লেখ্য যে, আদর্শমান পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে মূল্যের সম্পর্ক অনেক বেশি। একই জিনিস প্রতিকূল পরিবেশে উৎপাদন করতে যদি দ্বিগুণ সময় লাগে তাহলেও সেটার মূল্য পরিবর্তিত হবে না, আবার তুলনামূলক অনুকূল পরিবেশে অর্ধেক সময়ে উৎপাদন করতে পারলেও সেটার মূল্য পরিবর্তন হবে না। এটা গাণিতিকভাবে প্রকাশ করার অনেক প্রক্রিয়া আছে । উল্লেখ্য যে, তার Labor Theory of Value যথেষ্ট রীতিবিরুদ্ধ। বর্তমানে সবচেয়ে প্রচলিত অর্থনীতি প্রাধান্য দেয় Marginalism কে। Marginalism মনে করে LTOV নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে অকার্যকর, অন্যদিকে মার্ক্সবাদিরা মনে করে Marginalism নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে অকার্যকর।


কীভাবে মূল্য দামে পরিণত হয় এটা অর্থনীতিবিদদের আলোচনা-সমালোচনার একটি বড় বিষয়। কিছু কিছু অর্থনীতিবিদরা জিনিসের দাম নিয়েই শুধু চিন্তা করে, মূল্য নিয়ে না। কারণ বর্তমান পুঁজিবাদী অর্থনীতির নকশা করার জন্য দ্রুত পরিবর্তনশীল দামে মনোযোগ দেয়াটা অনেক জরুরি পুঁজিবাদী সমাজে। অন্যদিকে, "মূল্য" চিন্তার নতুন দিগন্ত তৈরি করে। যে দাম হাঁকা হচ্ছে সেটা আদৌ কি যথার্থ নাকি? যেমন যেটায় শ্রম ব্যয় করা হচ্ছে অনেক কিন্তু দাম কম, তাহলে অবশ্যই শ্রমিকদের কম বেতন দেয়া হচ্ছে। আবার শ্রমমূল্য থেকে দাম অনেক বেশি, মানে পুঁজিবাদীরা অন্যায্যভাবে অর্থ আত্মসাৎ করেছে। অধিকাংশ পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদরা "মূল্য" নিয়ে চিন্তা করা থেকে বিরত থাকে।


সাম্যবাদ বুঝতে হলে আমাদের বুঝতে হবে, শ্রমশক্তি বা Labour Power কি জিনিস। ধরুন, আপনি যদি কোন প্রতিষ্ঠানে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত কাজ করেন, মানে দৈনিক ৮ ঘণ্টা। এই শ্রমকে ফলপ্রুসু ও সচল রাখার জন্য অনেক কিছু প্রয়োজন; যেমন খাদ্য, উপযুক্ত পরিবেশ, বস্ত্র, বিশ্রামের ব্যবস্থা ইত্যাদি। আর এই সবই সম্ভব হয়েছে সমাজের অন্যদের শ্রমের কারণে। যে যে কারণে আপনি উৎপাদনশীলতা ধরে রেখেছেন এইসব কিছুকেও তাই "শ্রমসময়" দিয়ে পরিমাপ করা সম্ভব। ধরুন আপনার দৈনিক খাদ্যের যোগান দিতে প্রয়োজন ২ শ্রম ঘণ্টা, উপযুক্ত পরিবেশের যোগান দিতে আরও ২ শ্রম ঘণ্টা, বস্ত্রের ও বিশ্রামের যোগান দিতে দুই শ্রম ঘণ্টা আরও বিবিধ জিনিসের জন্য ১ শ্রম ঘণ্টা। অর্থাৎ আপনি যে কাজ করছেন সেটার মূল্য হচ্ছে ৭ শ্রম ঘণ্টা, এটা হচ্ছে শ্রম শক্তি বা Labour Power। কিন্তু কোম্পানিতে আপনি ৭ ঘণ্টা কাজ করেই বাড়িতে চলে যাবেন না, আপনাকে ৮ ঘণ্টা কাজ করা লাগবে। এই অতিরিক্ত এক শ্রমঘণ্টা হচ্ছে Surplus Value. একটা পুঁজিবাদী সমাজে যেখানে কোম্পানির মালিকানা সমাজের না বরং ব্যাক্তিমালিকের থাকবে তার জন্য এই Surplus Value হচ্ছে মুনাফা বা Profit।


আর এই মুনাফার অংশ পুঁজিবাদির একার পকেটে যাবে, আর এই অতিরিক্ত এক ঘণ্টা আপনার জন্য শোষণ। অন্যদিকে পুঁজিবাদীরা উৎপাদিত পণ্য যদি দৈনিক ১০০ শ্রমঘণ্টায় উৎপাদন করে, তাদের নিয়ত থাকবে সেটা যতটা বেশি ব্যবধানে সম্ভব বিক্রি করার। সে এক দিক দিয়ে শ্রমিকদের শোষণ করছে সাথে সাথে বাজারে অন্যায্য মূল্য হেঁকে ভোক্তাদের শোষণ করার চেষ্টা করছে। আর সকল মুনাফা নিজের কাছে কুক্ষগত করছে। পুঁজিবাদ পরিচালিতই হয় উৎপাদনশীলতার মাধ্যমে। তাই তাদের সবসময় উদ্দেশ্য থাকে কম ব্যয় করে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করার। তাই কার্ল মার্ক্স বলেছেন পুঁজিবাদ সংজ্ঞাগতভাবেই "অনিবার্য শোষক"। আর সেটা অবধাবিতভাবে সমাজে শ্রেণী ব্যবধান বাড়িয়েই যাবে। যদিও হতে পারে আপনার কোম্পানি আপনাকে অনেক বেতন দিচ্ছে; কিন্তু পুঁজিবাজে সে অবশ্যই আপনার থেকে যা আদায় করেছে তার থেকে সবসময় কম দিবে। এখন কেউ বলতে পারে যে বর্তমান পুঁজিবাদিরা নানা CSR (Corporate Social Responsibility) প্রকল্প নিচ্ছে, তারা সরকারকে কর দিচ্ছে; যা দিনশেষে সবার মঙ্গল আনছে। এইসব সম্ভব হয়নি পুঁজিবাদের কারন, বরং পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে কারণ সরকার বা অন্য সংস্থাগুলো, শ্রমিক ইউনিয়নগুলো তাদের শোষণকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে। তাছাড়া একটা পুঁজিবাদী সমাজে অর্থই ক্ষমতার হাতিয়ার হয়ে যায়; যার কারণে সরকারি নীতিমালা, রেগুলেশন, এমনকি নিয়ন্ত্রণকারি সংস্থাগুলোতে পুঁজিবাদীরা প্রভাব ফেলে অন্যায় বন্ধ করার ব্যবস্থাকেই অকেজো রুদ্ধ করছে। নির্বাচনী দলকে আর্থিক মদদ দেয়া, Lobbying, Corporate Consolidation ইত্যাদি খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের সমাজে; আর এর প্রভাব বেড়েই যাচ্ছে।
সাম্যবাদের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে Class Conflict । যা সমাজতত্ত্ব বা Sociology তে পড়াশুনার ক্ষেত্রেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোন সমাজে যখন নানা শ্রেণীর মানুষ নিজেদের আর্থসামাজিক চাহিদা পূরণ করার জন্য সংগ্রাম ও সংঘর্ষে জড়িত হয় তখন সেটাকে শ্রেণী সংগ্রাম বলে। এটা বুঝায় যে আমাদের সমাজ নানান শ্রেণী ও তাদের সংগ্রাম দ্বারা অযথার্থভাবে পরিচালিত হচ্ছে। সেখানে এক শ্রেণী নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য অন্য শ্রেণীকে নির্যাতন, শোষণ করছে।



আবহবিদ্যায় যখন আমরা আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলি তখন এটা দাবি করা হয় না যে বায়ুমণ্ডলের সকল বায়ুর তাপমাত্রা সমান ও একই দিকে যাচ্ছে। বরং আমরা গতিবিধি পরখ করে তাদের বৈশিষ্ট্যের উপর ভিক্তি করে নানা শ্রেণী বিভক্ত করি, যাতে আমরা ভবিষ্যতের পূর্বাভাস দিতে পারি। মার্ক্স মনে করতেন, যে শ্রেণী সংগ্রামের মডেল এতটাই শুদ্ধ যে এটার মাধ্যমে ভবিষ্যৎও অনুমান করা সম্ভব। সে মনে করতেন যখন উৎপাদনের মাধ্যম (Means of Production) এর সাথে শ্রমিক শ্রেণীর সম্পর্ক পরিবর্তন হবে তখন সমাজ অবশ্যম্ভাবিভাবে সাম্যবাদের দিকে চলে যাবে। এটাকে বলা হয় ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বা Historical Materialism। আর পরবর্তীতে যখন এটা নিয়ে আরও আলোচনা করা হবে যে, মার্ক্স কতটা ভুল ছিল (গত শতাব্দীর জন্য) , আবার ভুল হওয়া স্বত্বেও সাম্যবাদ ভবিষ্যতের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
কিছুক্ষণ আগে বলছিলাম যে Labour Theory of Value. অর্থাৎ কোন জিনিসের মূল্য নির্ভর করে সেটায় কি পরিমাণ শ্রম ব্যয় করা হয়েছে তার উপর। অন্যদিকে, যন্ত্রপাতি বা মেশিন এমন জিনিস যেটা আমাদের শ্রম ব্যয় কমিয়ে আনে। মার্ক্স মেশিনকে ভেবেছেন একটা শ্রমের কুণ্ডলীর মত। যখন কোন মেশিন কাজ করে এটা তার শ্রম উপর ব্যয় করা শ্রম মূল্যকে তার তৈরি করা নতুন পণ্যের মাঝে বণ্টন করে দেয়।


মানে ধরুন ১০০ শ্রমঘণ্টা ব্যয় করে একটি সাইকেল তৈরি করার মেশিন তৈরি করা হল। মেশিন ছাড়া আগে প্রতিদিন ২০ জনের প্রতিজনের ১০ শ্রমঘণ্টা ব্যয় করে ১০০টি সাইকেল তৈরি করা সম্ভব হত। অর্থাৎ ২০০ শ্রমঘণ্টায় ১০০ সাইকেল। প্রতি সাইকেলের মূল্য ২ শ্রমঘণ্টা।
কিন্তু এখন সাইকেল তৈরি করার মেশিন পরিচালনা করার জন্য একজন মেশিন পরিচালনাকারির ১০ শ্রম ঘণ্টা দিয়েই ১০০ সাইকেল তৈরি করা সম্ভব।

ধরুন সাইকেল তৈরি করার মেশিন মোট ৫০০ সাইকেল বানাতে পারবে। মানে সাইকেল তৈরির মেশিনের পিছনে যে শ্রমশক্তি ব্যয় হয়েছে (১০০ শ্রমঘণ্টা), সেটা ৫০০ সাইকেলে বন্টিত হবে। মানে সাইকেল প্রতি মেশিনের শ্রম ঘণ্টা হচ্ছে ০.২০।
অর্থাৎ এক দিনে মেশিন দিয়ে সাইকেল তৈরি করলে সাইকেল প্রতি শ্রমমূল্য হবে,
(১০০ সাইকেল/ ১০ মেশিন চালকের শ্রমঘণ্টা) + ( ১০০ সাইকেল গুন ০.২০ মেশিনের শ্রমঘণ্টা)
= ৩০ শ্রম ঘণ্টা।
মানে সাইকেল প্রতি শ্রম মূল্য ৩০/ ১০০ সাইকেল = ০.৩০ শ্রম ঘণ্টা।
যেখানে আগে সাইকেলের মূল্য ছিল ২ শ্রম ঘণ্টা, এখন সেটার মূল্য ০.৩০ শ্রমঘণ্টা।


তাই মেশিন বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেলে, মূল্যও বৈপ্লবিক হারে কমবে সাথে সাথে দামও। তাই দীর্ঘমেয়াদে, মুনাফার হার হ্রাস পাওয়া উচিত; মার্ক্স মনে করতেন। কিন্তু পুঁজিবাদে সেটা হচ্ছে না। বরং মনোপলি, প্রাইস ফিক্সিং, ভোক্তাবাদের মাধ্যমে দাম বেড়েই চলছে। ব্র্যান্ডের পণ্যের দাম দেখলে কেউ কল্পনাও করতে পারবে না যে কতটা কম মূল্য হতে পারে। মার্ক্স মনে করতেন যে পুঁজিবাদীদের টিকে থাকার এইসব ব্যবস্থাগুলো খুবই ভঙ্গুর ও স্বল্পমেয়াদি।



এইসব ব্যবস্থাগুলো প্রায়ই ভঙ্গে পড়ে যার কারণে আমরা বৈশ্বিক মন্দা, মুদ্রার দামের পতন, ইনফ্লেসন দেখি আমরা। আর মার্ক্স মনে করতেন একটা সময় এইসব নীতিগুলো একটা সময় অকেজো হয়ে পড়বে, পুঁজিবাদের মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলোর কারণেই। তখন চিরন্তনভাবে পুঁজিবাদী সমাজ বৈশ্বিক বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক সমাজে পরিণত হবে।



পুঁজিবাদী সমাজ বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে সমাজে। তাই প্রাথমিকভাবে একটা পুঁজিবাদী সমাজকে অনেক আধুনিক ও সফল মনে হলেও দীর্ঘমেয়াদে সেটা জীবনযাত্রা, শান্তি, পরিবেশকে অনিবার্যভাবে নষ্ট করবে বিচ্ছিনতার মাধ্যমে। বিচ্ছিনতা বা Allienation হচ্ছে এমন একটা প্রক্রিয়া যখন মানুষ তার আপন জগতেই পর হয়ে যায়। পুঁজিবাদের কারণে আমরা যে কাজ করবো সেখানে আমাদের সৃজনশীলতা, সিদ্ধান্ত ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হারাবো; পুরো নিয়ন্ত্রণটা গুটি কয়েক মানুষের কাছে পুঞ্জিভুত হয়ে যাবে। পুঁজিবাদি সমাজে আমাদের লোভ, চাহিদাকে অনৈতিকভাবে ব্যবহার করে একই কার্যক্ষেত্রে সবাইকে সবার জন্য পর করে ফেলবে। যে একতা ও সহযোগিতার কারণে সভ্যতা এগিয়েছে সেটা আর থাকবে না, বরং নিজের চাহিদা পূরণ করার জন্য অন্য কর্মীদের শত্রু ও প্রতিযোগী মনে করানো হবে; তবে সমাজে ভালবাসা, সৌহার্দ, ভ্রাতৃত্ব ম্লান হয়ে যাবে না; জীবন যান্ত্রিক হয়ে যাবে। মানুষের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাদের সৃজনশীলতা; আর যখন মানুষ চাহিদা পূরণের জন্য নিজের সৃজনশীলতা ও দক্ষতার চর্চা না করে বাধ্য হয়ে অন্য কিছু করবে তখন মানবিক সেই বৈশিষ্ট্যের কতল করবে পুঁজিবাদ।



ইতমধ্যেই Automation আমাদের অধিকাংশ কাজগুলো জব্দ করে ফেলছে। একটি পুঁজিবাদী সমাজে এটা শ্রমশ্রেণীর জন্য একটা বড় বিপর্যয়, কারণ পুঁজিবাদী সমাজে সকলেই পুঁজির উপর নির্ভর করে। এমন সমাজে যখন কাজের অভাবে বেকারত্ব দেখা দিবে তখন মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করাই শ্রমিক শ্রেণীদের জন্য কষ্টকর হয়ে যাবে, কিন্তু অন্যদিকে পুঁজিপতিরা পৃথিবীর অধিকাংশ সম্পত্তি জব্ধ করে ফেলবে। সমাজতান্ত্রিক সমাজে এটা হবে না, কারণ সকল সম্পত্তি যৌথভাবে সমাজ ভোগ করবে। বিশ্বব্যাপী যখন মানুষ এই শোষণকে উপলম্বি করবে আর সাম্যবাদের সমাধানকে বুঝতে পারবে, তখন বিশ্বব্যাপী বিপ্লব হবে আর পুঁজিবাদী সমাজ থেকে সমাজতান্ত্রিক সমাজে পরিণত হবে।


পরবর্তী পর্বে আলোচনা করবো আধুনিক পুঁজিবাদের অবস্থা ও ভবিষ্যতের সাম্যবাদের রূপ নিয়ে। সবাইকে কষ্ট করে পড়ার জন্য ধন্যবাদ। কোন প্রশ্ন থাকবে কমেন্টে দিবেন। তৃতীয় পর্বে সাম্যবাদ নিয়ে মৌলিক প্রশ্নউত্তর ও আপনাদের দেয়া প্রশ্ন উত্তরগুলো নিয়ে আরেকটি পোস্ট করা হবে। ভাল থাকবেন।

Reference:

[1] Russian Soviet Federated Socialist Republic RSFSR. (n.d.) The Great Soviet Encyclopedia, 3rd Edition. (1970-1979). Retrieved October 1 2017 from Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৪:৩৪
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×