৩ থেকে ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা বা ৬ মাসের কারাদণ্ডের মতো কাজ আমরা প্রতিদিন এভাবে করে থাকি যেন এটা কোন অন্যায় না। এমনকি আমাদের মাঝে ৯০ ভাগ মানুষ জানেই না যে এটা আসলে অপরাধ। আর সবচেয়ে বড় সমস্যা হল আজ আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষা মধ্য ও নিম্নবিত্ত মানুষের হাতের নাগালে এসেছে এই বেআইনি কর্মকাণ্ডের জন্যই। এই জায়গায় এসে আমরা সবাই অসহায় আমরা সবাই অপরাধী।
আমরা অনেকেই জানি কপিরাইট আইন বলতে একটা আইন আছে আমাদের দেশে। তবে কপিরাইট আসলে কি ? এর শাস্তি কি এ ব্যাপারে আমরা অধিকাংশই অজ্ঞ।
প্রথমে কপিরাইট ও এর জন্য প্রণীত ( ব্যবহারিক অর্থে অপ্রচলিত) আইন এর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি জেনে নেই।
কপিরাইট ও কপিরাইট আইন কি
কপি বা অনুলিপি অর্থ বর্ণ, চিত্র, শব্দ বা অন্য কোন মাধ্যম ব্যবহার করিয়া লিখিত, শব্দ রেকর্ডিং, চলচ্চিত্র, গ্রাফিঙ্ চিত্র বা অন্য কোন বস্তুগত প্রকৃতি বা ডিজিটাল সংকেত আকারে পুনরুৎপাদন (স্থির বা চলমান), দ্বিমাত্রিক, ত্রিমাত্রিক বা পরাবাস্তব নির্বিশেষে।
[ উৎস ঃ কপিরাইট আইন, ২০০০ ধারা ১(১) ]
উক্ত বিষয়গুলোর জন্য যে আইন রক্ষিত থাকে তাই কপিরাইট আইন
সহজ ভাষায় বলতে গেলে উপরোক্ত বিষয়গুলোর লেখক, নির্মাতা বা যার কাছে উক্ত মাধ্যমের সত্ত্ব রয়েছে তার অনুমুতি ছাড়া কোন রকম ব্যবসায়িক বা অব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে আদানপ্রদান করা হলে কপিরাইট আইন ভঙ্গ করা হবে।
কপিরাইট আইন লঙ্ঘনের শাস্তিঃ
প্রথমবার এই আইন লঙ্ঘন করার শাস্তি ন্যূনতম ৬ মাস থেকে সর্বোচ্চ ৪ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড তার সাথে ৫০ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২ লক্ষ টাকার দণ্ড। [ কপিরাইট আইন, ২০০০ ধারা ৮২ (১) ]
একই অপরাধ আবার করলে ৬ মাস থেকে ৩ বছরের কারাদণ্ড সাথে ১ থেকে ৩ লক্ষ টাকার দণ্ড [ কপিরাইট আইন, ২০০০ ধারা ৮৩ ]
পরিস্থিতি ও অপরাধ ভেদে এর শাস্তি ৫ বছর পর্যন্তও আছে।
দেশের পাইরেসি সংস্কৃতি ও এর প্রতিকার
কপিরাইট আইন এর অধিনে কিছু বেআইনি কর্মকাণ্ড যা আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত ঘটে যাচ্ছে
১. বই কপি করে বিক্রি যার এক পয়সাও লেখক পায় না ঃ
আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার প্রধান উপাদান অর্থাৎ বিদেশী লেখকের বই যা প্রকৃতপক্ষে ১-২ হাজার টাকা দাম হবার কথা তা মাত্র ১০০-১৫০ টাকায় কিনে থাকি। নীলক্ষেত এই বিশেষ জাদুবিদ্যার জন্য বিখ্যাত। এর মানে এই না বিদেশের মহান মহান বই লেখক হাজার হাজার টাকা দামের বই বাংলাদেশে কম দামে বিক্রি করছে। নীলক্ষেতে বই বিক্রির এক পয়সাও তারা পায় না। এমনকি উনারা জানেও না তাদের বই আমাদের দেশে এত বেশি প্রচলিত। এই সমস্যার ভুক্তভুগি শুধু যে বিদেশী লেখক তা নয়। বরং দেশি অনেক লেখক এই সমস্যায় অতিষ্ঠ। দেশের বিখ্যাত লেখকদের বইগুলো এভাবেই কপিকরন প্রক্রিয়ায় তাদের আওতার বাইরে চলে যাচ্ছে।
এই বিষয়টা অনেক জটিল বটে। কারন উচ্চ শিক্ষা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়তো দেশের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মেধাবি শিক্ষার্থীদের জন্য যদি না এই কপিকরন সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটতো। যেখানে আসল বই কিনতে দরকার পড়তে পারে প্রতি ৪/৬ মাসে ১০-১২ হাজার টাকা সেখানে আমরা মাত্র ১ হাজার টাকায় আমাদের প্রয়োজনীয় সবকিছু পেয়ে যাচ্ছি। আর আমাদের মতো দরিদ্র দেশে যেখানে মানুষের আয় অনেক কম সেখানে গড়ে প্রতি মাসে ২-৩ হাজার টাকা শুধু বই কিনবার পিছনে ব্যয় করা কতটা কষ্ট সাধ্য হতে পারে সেটা শুধুমাত্র তারাই জানেনে যারা তাদের সন্তানদের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করতে হিমশিম খায়।
তবে এর একটা উপায় আছে। আমার মতে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো করা হলে কিছুটা হলেও উপকার পাওয়া যাবেঃ
প্রতিকারঃ
ক। দেশে লাইব্রেরির পরিমান আরও বাড়াতে হবে যেখানে লাইব্রেরির কতৃপক্ষ আসল বই কিনে আনবে আর শিক্ষার্থীরাও বইয়ের পূর্ণ দাম দিতে হবে না বই থেকে জ্ঞান আরহনের জন্য।
খ। শিক্ষার্থীদের নীলক্ষেতমুখি না হয়ে লাইব্রেরিমুখি হতে হবে। [ ১৫-২০ দিনের জন্য বই এনে পড়লে বই পড়ার প্রতি একটা আগ্রহ থাকে, যেটা অসীম সময় পর্যন্ত নিজের কাছে থাকা কিনা বই এর মধ্যে থাকে না ( পরীক্ষিত) ]
গ। আমাদের মাঝে একটা মূল্যবোধ গঠন করতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে যারা কপি করে বই নিজের স্বার্থে বিক্রি করছে তারা এক রকমের চুরি করছে। ধর্মীয় দৃষ্টিতে এটা পাপ বা হারাম। অন্যদিকে আমরা অন্যায়ের ভাগিদার হয়ে আমরাও সমান পাপ বা হারাম কাজ করছি।
ঘ। আমাদের একটা আন্দোলনের প্রয়োজন। ব্যাক্তিগতভাবে আমার কাছে বিদেশী লেখকদের বইগুলোর মূল্য মাত্রাতিক্ত মনে হয়। আমার মনে একটা বিশ্বব্যাপি আন্দোলনের প্রয়োজন। শিক্ষা কি শুধু ধনী পশ্চিমাদের জন্য? ৩য় বিশ্বের দেশগুলোর কম আয়ের মানুষের কি উচ্চশিক্ষার কোন অধিকার নেই। আমাদের এই আন্দোলনকে সামনে আনতে হবে। আমি জানি এটা খুব বড় একটা ব্যপার। তবে কাউকে না কাউকে তো হাত উঠাতে হবেই।
২. নেট থেকে বিনামূল্য গান, সফটওয়্যার(ওপেনসোর্স ব্যতীত) ডাউনলোড করা ঃ
যতই দিন যাচ্ছে আমাদের মাঝে এই সংস্কৃতি আরও বড় আকার ধারন করছে। আমরা এখন আর দোকানে গিয়ে সিডি কিনে গানের অ্যালবাম শুনছে চাই না। বিশ্বব্যাপি তথ্যজাল অর্থাৎ ইন্টারনেটে এখন এক আধুনিক ধরণের চোরের উৎপত্তি ঘটেছে। তারা প্রথমে দাম দিয়ে গান কিনে, তাদের ওয়েবসাইট এ সেগুলো প্রকাশ করে, নেট ভিজিট এর জন্য বিজ্ঞাপন নেয় মোট কথা অন্যের গানের মাধ্যমে টাকা রোজগার করে। আর আমরা পাপি নেটিজ্যানরা এই চোরগুলোকে আরও স্প্রিহা দেই যখন আমরা বিনামূল্যে গান গুলো তাদের ডিজিটাল চোরাই বাজার থেকে ডাউনলোড করে লই । আমরাও তাদের পাপের ভাগিদার হই।
আপনারা হয়তো জানলে অবাক হবেন আপনি যে উইন্ডোজ ব্যবহার করছেন তাও এক প্রকার চোরাই মাল । আপনি যখন কম্পিউটার, ল্যাপটপ কিনতে যান তখন তারা ঐ উইন্ডোজ আগে থেকে setup করে দেয় আপনার জন্য। আর সেই অর্থ পায় না অপারেটিং সিস্টেম কোম্পানি। যদি দেখেন যে আপনার ল্যাপটপ বা পিসিতে কোন ওএস এর স্টিকার নাই তার মানে আপনিও চুরি করা সফটওয়্যার ব্যবহার করছেন।
ধরুন, আপনি একজন গায়ক। আপনি অনেক কষ্ট করে নিজে সুর তৈরি করলেন, গান রচনা করলেন আর অ্যালবাম বাজারে ছাড়লেন। আপনার খরচ পড়লো ৫০০০০ থেকে ১০০০০০ টাকা। এখন এক সপ্তাহ পরে দেখলেন আপনি আপনার বিনিয়োগক্রীত টাকাও বিক্রিত অ্যালবাম থেকে পেলেন না। অনেক ঘাটাই করে আপনি জানতে পারলেন আপনার গান এখন দেশে প্রচলিত ওয়েবসাইটগুলোতে চলে এসেছে আর আপনার গান প্রচুর ডাউনলোডও হয়েছে। সাইট এডমিনরা লালে লাল আর আপনার লাল বাতি জলে গিয়েছে লোকসানে। এভাবেই আমরা না জেনেই ধ্বংস করছি আমাদের দেশের সঙ্গীত শিল্পকে।
প্রতিকারঃ
ক। এসব চোরবাজার সাইটগুলো বন্ধ করতে হবে।
খ। একটু কষ্ট করে দোকানে গিয়ে অ্যালবাম কিনতে হবে। কিনার সময় চিন্তা করবেন আপনার সামান্য Contribution এদেশের সঙ্গীতশিল্পকে জীবিত রাখছে। আপনার মাধ্যমে শুরু হবে এক নতুন সংস্কৃতি।
গ। আমাদের মাঝে একটা মূল্যবোধ গঠন করতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে যারা অন্যের সফটওয়্যার নিজের স্বার্থরক্ষার জন্য ব্যবহার করছে তারা এক রকমের চুরি করছে। ধর্মীয় দৃষ্টিতে এটা পাপ বা হারাম। অন্যদিকে আমরা অন্যায়ের ভাগিদার হয়ে আমরাও সমান পাপ বা হারাম কাজ করছি।
৩. প্রচলিত মুভি, গেম পাইরাটেড সিডি আকারে বিক্রি করা।
২ নং আর এটার মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নেই। তবে চলচ্চিত্র এর সাথে জড়িত থাকে অনেক পক্ষ। গান চুরি করার চেয়ে এটা আরও বেশি ক্ষতিকর। কেননা ওখানে শুধু গায়ক আর মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির সাথে যুক্তি হাতে গোনা কিছু মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় আর এখানে অনেক অনেক বেশি মানুষ ক্ষতির ভাগ গুনে।
আমাদের দেশের চলচ্চিত্রশিল্প নষ্ট হবার পিছনেও এর কিছু কারন রয়েছে। এক সময় ছিল যখন আমরা উপমহাদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনে পাশের দেশগুলোর সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে আর কখনো তাদের থেকে এগিয়ে চলতাম। কারন তখন দেশের মানুষ হল এ গিয়ে বা আসল ভিসিআর কিনে সিনেমা দেখত। অভিনেতা শিল্পিরা পেত তাদের ন্যায্য মূল্য। এখন পাইরেসির জন্য তারা পাচ্ছে না তেমন মূল্য তাই চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কমিয়ে আনতে হয়েছে তাদের বাজেট। ফল, নিম্ন মানের ছবি। যেখানে পাশের দেশ ভারত যারা একসময় আমাদের মতো ছিল আজ তাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ রফতানি খাত চলচ্চিত্র শিল্প। সুদুর আমেরিকা, কানাডা, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়ার প্রেক্ষাগৃহে তাদের সিনেমা প্রচার করা হয়।
প্রতিকার ঃ
ক। পাইরেট সিডি বিক্রি একটা চক্র আকারে আমাদের দেশের সাপ্লাই চেনে বসে গিয়েছে। এই চক্রকে বন্ধ করতে হবে
খ। আমাদের মাঝের নৈতিকতাকে জাগ্রত করতে হবে। এই পাইরেসিতে আমাদের কি ক্ষতি তা অনুভব করতে হবে।
তাছাড়া আরও কিছু মাধ্যমে কপিরাইট আইন লঙ্গন করা হয়।
৪) কোন ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠানের প্যাটেন্ট থাকা সুর, ছন্দ, লিরিক নকল বা পরিবর্তন করে নিজের মতো করে তৈরি করে বিক্রি করা ( দেশের প্রচলিত সিনেমার গানগুলোতে অনেক সময় আমরা ভারতীয় গানের সুরের এমনকি লিরিকেরও মিল পাই, বিনা অনুমুতিতে করলে এটা একটা বেআইনি কাজ)
৫) অন্যের তোলা ছবি, ডিজাইন, ড্রয়িং, নকশা নকল করে ব্যবহার করা। ( অনেক সময় আমরা ফেসবুক এ কভার ফটো দেয়ার সময় এগুলো করি, আবার বিশেষ করে বুটিকগুলোতে নকশা নকল করা খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার)
আমাদের দেশে মেধাবি মানুষের অভাব নেই যাদের ক্ষমতা আছে সূক্ষ্মপর্যবেক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে এই সমাজ ও দেশকে বদলে দেয়ায়। নিজের ২ বেলা খাবার ও সম্মানই তো মানুষ চায় তাদের এই মেধার ব্যবহারের বিনিময়। আমরা আজ যেমন নিজেদের ২ পয়সা বাঁচানোর জন্য অবৈধ কাজ করছি বা প্রশ্রয় দিচ্ছি, ঠিক তেমনি নিজেদের মেধাবি সন্তানদের পশ্চিমমুখি ও হতাশ করছি। ঘরে নিজের চেয়ারে বসে যখন ল্যাপটপ দিয়ে কয়েক মিনিটে চোর বাজার থেকে গান নামাচ্ছি তখন একবারও ভেবে দেখছি না এই সামান্য পদক্ষেপ আমাদের ভবিষ্যৎকে আমাদের শিল্পকে, আমাদের মেধা- আমাদের গর্ভ সব কিছুকে মুছে ফেলছে। এখনি সময় ভাবার। সুন্দর ভবিষ্যতের আশার বিদায় জানাচ্ছি। ধন্যবাদ সবাইকে।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০১৩ রাত ৮:১৬