জার্মানির প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই নবাগত ছাত্রছাত্রীদের জন্য আয়োজন করা হয় নানা ধরণের প্রোগ্রামের। TU Dresden এ যেটাকে বলা হয় ওয়েলকাম উইক প্রোগ্রাম। তারই আওতায় গত ১৮ অক্টোবর আয়োজন করা হয়েছিল হাইকিং প্রোগ্রামের, যার গন্তব্য ছিল ড্রেসডেন শহরের পাশেই অবস্থিত Saxon Switzerland যা এই এলাকায় অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি ক্লাইম্বিং এবং হাইকিং এরিয়া ।
দিনের শুরুটাই হল বিপত্তি দিয়ে। তার আগের দিন হঠাৎ করেই রিজিওনাল ট্রেনচালকরা কর্মবিরতিতে চলে গেলেন। এই খবর ছড়িয়ে পড়ায় বেশির ভাগ ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টরাই মনে করল সম্ভবত এই প্রোগ্রাম হচ্ছে না।সৌভাগ্যবশত খবরটা আমার কানে পৌঁছায়নি। তা না হলে পরের দিন সকালে হয়ত ঘুমই ভাঙতো না আমার! সেইদিন রেলস্টেশনে গিয়ে খবরটা শুনেই হতভম্ব অবস্থা আমার! সেই সাথেই বুঝতে পারলাম আমাকে সহ নিয়ে ১৮ জনের দলে কেন আমিই একমাত্র নন-জার্মান। ধন্যি সেই ১৭ জার্মান!! তারা জিদ ধরে ছিল। এই লাইনের ট্রেন বন্ধ তো কি হয়েছে? তারা যাবেই যাবে। আধা ঘণ্টা ধরে একে ওকে ধরে কিভাবে যেন অন্য একটা ট্রেনে উঠার অনুমতি ম্যানেজ করে ফেলল। এখানেও ছিল আরেক মজার ব্যাপার। আমাদের সাথে ইন্টারন্যাশনাল অফিসের যে দুজন প্রতিনিধি ছিল তারা ট্রেনের কর্মকর্তাকে কি বুঝিয়েছিল কে জানে, তিনি মনে হয় ধরে নিয়েছিলেন শুধু এই দুজনই যাবে। পরে ট্রেন ছাড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে যখন তিনি দেখলেন ২ জন না, ১৮ জনের রীতিমত বিশাল এক দল তখন রীতিমত অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন তিনি। হুমকির সুরে অনেক কথা বলে বিদায় নিলেন। জার্মান ভাষায় যতটুকু দখল আছে তাতে করে যা বুঝলাম তা সহজ বাংলায় হল, কাউকে যেন সিটে বসতে না দেখি। সবাই করিডোরে দাঁড়িয়ে থাকো। একজনকেও যদি বসতে দেখি তাহলে সবাইকে পরের স্টেশনে নামিয়ে দিব।অতঃপর সুবোধ বালক বালিকার মত সবাই দাঁড়িয়ে গেলাম ট্রেনের করিডোরে।
অবশেষে প্রায় ২৫-৩০ মিনিট পর ট্রেন থামলো কাঙ্ক্ষিত স্টেশনে। জায়গাটা শহর থেকে অনেক দূরে, যাকে বলে কান্ট্রিসাইড। আগে থেকেই অল্প অল্প শুনেছিলাম, এখন নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছি জার্মানির নয়নাভিরাম কান্ট্রিসাইডের এক নমুনা। স্টেশনের পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে এলবে নদী। নদীর উপরের সেতু দিয়ে হেঁটে অন্য পাড়ে দাঁড়ালাম আমরা। তার পরেই শুরু হল হাইকিং।
প্রথমে আমার অনুভূতি ছিল এরকম। মাত্র ৫৫০ মিটার। এ আর এমন কি! প্রথমদিকে আসলেই কষ্ট তেমন একটা হয়নি। কারণ তখনো রাস্তা খুব বেশি খাড়া উপরে উঠতে শুরু করেনি। পাইন গাছের নিবিড় অরণ্যের মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটতে মোটেও খারাপ লাগছিল না। নির্জন বুনো সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে করতে এগিয়ে চলছিল সবাই। যদিও একটু সাবধানে হাঁটতে হচ্ছিল, কারণ আগের দিনের বৃষ্টিতে রাস্তা কর্দমাক্ত হয়ে আছে। হঠাৎ মাঝে একটা যায়গায় দেখা গেল সামনে যাবার আর সোজা রাস্তা নেই। প্রায় ১৫-২০ ফুট গভীর একটা খাদ হয়ে গেছে। অন্য উপায় না দেখে শুরু হল খাদ ধরে নামা। মাটি পিচ্ছিল হয়ে আছে রীতিমত। নামার সময় এক পর্যায়ে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছিলাম। সেই সময় সামনে একটা গাছের গুড়ি পড়ে থাকতে দেখে তার উপর পা ফেলে ব্যালেন্স ঠিক করার চেষ্টা করতে গেলাম। ফল হল ঠিক উল্টো। আমি জানতাম না, বৃষ্টিতে ভিজলে এই জাতের গাছ বরং আরো বেশি পিচ্ছিল হয়ে যায়। যা হবার তাই হল। পা পিছলে গেলাম পুরো। তবে ভাগ্য ভাল। আমার ঠিক পিছনে থাকা জার্মানটা সময়মত ধরে ফেলল আমাকে। না হয়, কাদায় গড়াগড়ি করে আমার সাধের টি-শার্ট আর জিন্সের অবস্থা হত করুণ।
খাদ পেরিয়ে পৌঁছানো হল অন্য পাড়ে। এবার মোটামুটি সমতল জমি দিয়েই কিছুদূর এগিয়ে যাওয়া হল। এবার সামনে পড়লো কৃষিকাজের জন্য প্রস্তুত করে রাখা বিশাল ভূমি। সেই সময় আমার পাশে হাঁটতে থাকা ডেব্রা বললো,সামারে সময় নিয়ে কখনো এখানে আবার এসো। তখন এই জমিগুলোর দিকে তাকালেই দেখবে রঙের মেলা বসে গেছে যেন। কথাটা শুনে মনে মনে কল্পনা করছিলাম এই জায়গাটা তখন কেমন দেখাবে। তবে কল্পণার দৌড় থেমে গেল একটু পরেই। কারণ, সামনে এবার পাহাড় খাড়া উপরে উঠতে শুরু করেছে। যত উপরে উঠছি, ততই যেন আরো খাড়া হয়ে উঠছে পাহাড়। দল থেকে একটু পিছিয়ে পড়লাম এবার। এবারের অনুভূতি হল, ‘নেহাত অনেক দিন পাহাড়ে চড়ার অভ্যাস নাই। নাহলে জার্মানগুলোকে দেখিয়ে দিতাম, পাহাড়ে উঠা কাকে বলে?’
তবে একটা কথা অস্বীকার করা যাবে না। যতই উপরে উঠছিলাম, ততই যেন আশপাশটা আরো বেশি সৌন্দর্য্য নিয়ে হাজির হচ্ছিল আমার সামনে। এটাই হয়তো অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছিল সামনে এগিয়ে যাবার জন্য। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল, এলবে নদীর পাড় থেকে যাত্রা শুরু করার পর অনন্তকাল কেটে গেছে। ঘড়ির দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলাম কেটেছে মাত্র সোয়া এক ঘণ্টা। আরো প্রায় ১৫-২০ মিনিট (আমার মনে হয়েছিল অন্তত আরো ১ ঘণ্টার বেশি) ধরে চড়াই পেরিয়ে পৌঁছালাম পাহাড় চূড়ায়। আর আচমকাই যেন প্রকৃতি অন্যরকম একটা রূপ নিয়ে ধরা দিল আমার চোখে। পাহাড় কিনারায় এসে দাঁড়ালাম। এইদিক দিয়ে একদম রুক্ষ পাথুরে রূপ নিয়ে সোজা নেমে গেছে পাহাড়টা। নিচের দিকে তাকালেই চোখে পড়ে সরু ফিতার মত এলবে নদী আর তার পাড়ে ঘন সবুজের আচ্ছাদন। আর অন্যদিকে তাকালে দেখা যায়, জার্মানির নৈস্বর্গিক কান্ট্রিসাইড। ঠিক যেন ছবির মত। চোখ ধাঁধানো সূর্যালোক আর দিগন্ত বিস্তৃত আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল চাঁদের পাহাড়মুভির সেই গানটা, “আকাশ হঠাত খুলে গেছে সূর্য সীমানায়/ অনেক দূরে পাহাড় চূড়োয় নতুন ঠিকানায়/ পায়ের নিচে অন্য মহাদেশ/ কে জানে তার কোথায় আছে শেষ
এক ঘণ্টারও কিছু বেশি সময় ছিলাম সেখানে। এই সময়ে প্রকৃতি দেখার পাশাপাশি চলল লাঞ্চ সেরে নেয়া, ফটোসেশন ইত্যাদি। তারই মধ্যে আমাদের সাথে যোগ দিল আমাদের ভার্সিটিরই অন্য একটা গ্রুপ, যেটা এর আগের রাত থেকেই এখানে আছে ক্যাম্পিং করে। আমাদের ক্লাসের এক ইন্ডিয়ান ছেলে, এক চাইনিজ ছেলে আর এক তাইওয়ানিজ মেয়েকেও পেয়ে গেলাম সেই গ্রুপে। ক্লাসমেটদের পেয়ে এবার উপভোগ্যতা আরেকটু বাড়লো।
ঘণ্টাখানেক পর শুরু হল নেমে আসার পালা অন্য আরেক রাস্তা ধরে। তারপর এলবের পাড় ধরে আরো এক ঘণ্টা হাঁটা চলল। এরপর হাজির হলাম এক গ্রামের প্রবেশ পথে। আবার শুরু হল চড়াই ভাঙ্গা। ছবির মত সাজানো এই গ্রামের ভিতর দিয়ে যেতে এবার আর কেন যেন আগের বারের মত ক্লান্তি অনুভব হল না। এখানে চোখে পড়ল প্রায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আমলের অনেক এন্টিক গাড়ি। গ্রামের পর আবার অরণ্য। অদ্ভূত এক নিস্তব্ধতা এখানে। জগতের সব কোলাহল যেন আচমকা থমকে গেছে এখানে এসে, শুধু পায়ের নিচে ঝরা পাতার মর্মর ধ্বনি ছাড়া।
অবশেষে প্রায় বিকাল ৪টা নাগাদ শেষ হল যাত্রা। এবার ফেরার পালা। ক্লান্ত শরীর ঘরে ফিরতে চায়। কিন্তু পাতা ঝরা বুনো পথের সৌন্দর্য্য, ধীরলয়ে বয়ে চলা এলবে নদীতীরের শান্ত-স্নিগ্ধ রূপ আর দিগন্তবিস্তৃত সবুজের হাতছানি কেমন যেন একটা পিছুটান তৈরি করে। তাই, আপাতত বিদায় Saxon Switzerland, কিন্তু কথা দিছি আবারো কোন এক সময় আমি ফিরে আসবো ।
***********************************
আবারো সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি অন্যের লেখা শেয়ার করার জন্য । সময়ের জন্য নিজের ট্যুর নিলে লিখতে পারছি না। কিন্তু ভ্রমন কাহিনিতো আপনাদের সাথে শেয়ার করতেই হবে। তাইতো ড্রেসডেনের সৌরভ ভাইয়ের লেখাটা যেটি আমাদের নভেম্বর মাসের জার্মান প্রবাসে ম্যাগজিনে-http://www.germanprobashe.com/archives/2149 প্রকাশিত হয়েছে আপাতত সেটিই শেয়ার করলাম আপনাদের সাথে। আশা করি খারাপ লাগে নি। ধন্যবাদ ।
**************************************
প্রকাশিত হল জার্মানি থেকে প্রকাশিত আমাদের জার্মান প্রবাসে ম্যাগাজিন - নভেম্বর ২০১৪ - 'যেমন খুশি তেমন'
http://www.germanprobashe.com/archives/2149
--------------------------------------------------------------------
প্রিয় পাঠক, ইতিপূর্বে আমাদের ম্যাগাজিনের প্রায় সব সংখ্যাই বিভিন্ন দিবসকেন্দ্রিক লেখা দিয়ে সাজিয়েছি। এবার একটু ভিন্ন স্বাদ নিয়ে হাজির হলাম। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা কয়েকজন বাংলাদেশি এবারের সংখ্যায় লিখেছেন নানারকম বিষয়ে। আশাকরি প্রতিটা লেখাই আপনারা আগের মতই উপভোগ করবেন।
আপনারা যখন লেখাগুলো পড়বেন তখন জানবেন প্রত্যেকটা লেখাই চমকপ্রদ, তা হোক ভাষার দিক দিয়ে বা লেখার মাঝের ঘটনা পরম্পরায়। পৃথিবীর ২য় বৃহত্তম মেট্রোপলিটন শহর দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল থেকে ইমরোজ লিখেছেন চট্টগ্রাম ও সিউল নিয়ে এক হৃদয়ছোঁয়া মনোমুগ্ধকর লেখা। জাহিদ কবীর হিমন সম্প্রতি বাংলাদেশ ঘুরে এসে লিখেছেন 'কেমন আছে বাংলাদেশ' শিরোনামে। ড্রেসডেন থেকে সৌরভ পাহাড়ে উঠার কাহিনি নিয়ে লিখেছেন রোমাঞ্চকর ভ্রমণের গল্প। জার্মানিতে শিক্ষার্থীদের ভোজন নিয়ে হাস্যরসে পূর্ণ একটি লেখা রাইসুল ইসলাম তামীম লিখেছেন। নিজের মাকে নিয়ে হৃদয়স্পর্শী স্মৃতিচারণা করেছেন ইকবাল নাজির সুমন। ইয়েনা শহর নিয়ে লিখেছেন রোহিদ, চুয়েট থেকে অটল ভৌমিক লিখেছেন মর্মান্তিক এক স্বপ্নভঙ্গের কথা। জিগেন থেকে আহাদ আহাম্মদ চৌধুরী লিখেছেন কি করে প্রিয় দেশ বাংলাদেশকে আরো অনেকদূর এগিয়ে নেওয়া যেতে পারে।
এছাড়াও আছে বিখ্যাত অক্টোবর ফেস্ট নিয়ে একটি তৌসিফ বিন আলমের লেখা+ছবি ও মনির হোসেনের একটি কবিতা।