আমার আশে-পাশে মামলাবাজ, আমলাবাজ, পুলিশবাজ, সাংখাতিকবাজ, নাডাবাজ, মশাবাজ-সহ মেলা ধরনের মানুষ দেখি তবে আমি নিজেকে বিনোদনবাজ মানুষ হিসাবেই দেখি। এই বিনোদন খুঁজতে খুঁজতেই এক সময় ব্লগে এসে পড়ি। এক কে জানি পোষ্ট দিয়েছিল - কিভাবে পানি গরম করতে হয়। সেই পোষ্ট দেখে আমিও ভাবছিলাম একটা পোষ্ট দেই - "কিভাবে সিং-ওয়ালা তিমি মাছ দিয়ে চোতরা-পাতার ঝোল রান্না করতে হয়"। ব্লগ থেকে এইরকম অনেক বিনোদন পেয়েছি। তবে শুরুর দিকে কিছু মেধাবী গদ্যকারের লেখার কারনে ব্লগের নেশা হয়। ২০০৬/০৭/০৮ এর দিকে মানাম আহমেদের এমন কোন পোষ্ট ছিলি না যা আমি পড়ি নাই। আফসুস, উনি সব পোষ্ট মুছে ফেলেছেন। তবে অরূপ, মাশীদ, ডটু রাসেল ( ........), মাহবুব মুর্শেদ, হিমু, আরিফ জেবতিক... এদের ভ্রমনের গল্প, প্রেমের গল্প, টেকি পোষ্ট, বন্ধুত্বপূর্ন আড্ডা কিংবা কৌশিকের নেয়া বিভিন্ন ব্লগারের সাক্ষাতকার গ্রোগ্রাসে গিলতাম আর মাঝে মাঝে অতিথি হিসাবে ভয়ে ভয়ে কমেন্ট করতাম। তখন আমার জন্য ব্লগ ছিল পৃথিবী দেখার জানালা। সেই জানালা দিয়ে আলোর সাথে সাথে কিছু অন্ধকার আসলেও সেটাকে বিনোদন হিসাবে নিতাম বলে ঝামেলা হত না।
২ লাইনের একটা পোষ্ট লেখতে, আমি সাধারনত 2-টা কলম, ৩-টা পেন্সিল, ৪-টা দাঁত ভাংগি। আমি কি রকম গাধা তার একতা নমুনা দেই। ইউনিভার্সিটি উঠার আগ পর্যন্ত IKEA কে আমি মনে করতাম একটা রেষ্টটুরেন্ট। তবে আমার মশা-লেভের (গাধা লেভেলের চেয়েও কম) জ্ঞান সত্বেও দেখলাম আমার সমমনা বেশকিছু নাডা বন্ধু, বড় ভাই/বোন জুটে গেছে ব্লগে। আমার সকাল শুরু হত এদের সাথে ব্লগে আড্ডা দিয়ে আবার রাতে ঘুমাতে যেতাম এদের সাথে নাডামি করে। আবার কিছু কিছু লেখকের গদ্য আর পদ্য পড়ে মনে হত- এরা কি ভাইটামিনযুক্ত ভাত খায় নাকি সিংহের মাথার স্যুপ খায়!! যেমন ধরেন নির্ঝর নৈশব্দ এর লেখা পড়তে গিয়ে আমার কয়েকবার দাঁত ভেঙ্গেছে। আমি সিউর উনি পাথর দিয়ে ব্লগে লেখত। তবে ব্লগে আসতাম মূলত আড্ডা দিতে। দেখি পুরান কারে কারে মনে করতে পারি। সবচেয়ে বেশী আড্ডা দিছি মনে হয় এদের সাথেঃ
শ্রাবনের ফুল - আমরা দুজনেই প্রায় সমবয়সী হওয়ার কারনে শ্রাফুর সাথে আড্ডা সেইরাম জমত। রাতের পর রাত আমরা আড্ডা দিতাম। মাঝে মাঝেই সে আড্ডা পোষ্ট দিত আর আমরা দুনিয়ার এমুন কিছু ছিল না যা নিয়া আড্ডাই নাই।
নাজমুল আহমেদ - তাকে নাজুপা বলে ক্ষেপাতাম তবে নাজুপার কোন পোষ্ট মিস দিতাম না। আমার মতে নিখাদ বিনোদন ভরা পোষ্ট মিস করা পাপ।
ত্রাতুল - বন্ধু মানুষ কিন্তু একদিন হুট করে ফেসবুকে কয়- দোস্ত বিয়া করিয়ালাইছি!! আহারে! ইন্নানিন্নাহে...... ছেলেটা নাডা কিন্তু ভালো আছিল
ভাঙ্গন - জেডা কঠিন কঠিন কোবেতে লেখত!!
নাহোল - আরেক আড্ডাবাজ। রাতভর আড্ডাইতাম আমরা।
বুলবুল আহমেদ পান্না - আমাদের উকিল সাব। ব্লগে কেউ কিছু কইলেই উকিল সাবের ভয় দেখাইতাম। উকিল সাবও আমাদের ৪০০, ৫০০, ৪-কুটি, ৬-কুটি, নটি থুক্কু নয়-কুটি ধারার ভয় দেখাইত।
সোনালীডানা - শান্তশিষ্ট নার্ড। তবে জেডারে সেইরাম ভালা পাইতাম। জেডা গুটিকয়েক ব্লগারদের একজন যাদের সাথে ব্লগের বাইরেও কথা-বার্তা হত।
নথিকবিডি - জেডার সরলতা আমাকে এখনও আমাকে মুগ্ধ করে। ব্লগে না থাকলেও মুখবইয়ে মাঝে মাঝে ব্লগের ভালোদিনগুলোর যাবর কাটি।
আলী আরাফাত শান্ত - ব্লগের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত শান্ত এর সাথেই আমার যোগাযোগ আছে, এমনকি যখন ব্লগে আসতাম না, তখনও ও মাঝে মাঝে নক দিয়ে খবরা-খবর নিত। শান্ত লগে টং দুকানে চা খাইতে ভালু লাগে। ব্লগের বাইরেও সে সমান জনপ্রিয়

অনন্ত দিগন্ত - পোলাডা বদ কিন্তু বন্ধু হিসাবে অসাধারন। এখন সমানে ফেসবুকায় কিন্তু ব্লগে আসে না। ওর সবচেয়ে ভালো থিক ছিল। সব সময় হাসি-খুশি থাকত
রুদ্রপ্রতাপ - আমার চেয়ে বড় নাডা। রম্য লেখার জন্য উনি হচ্ছেন বস মানুষ। উনার লেখা পড়ে হাসতে হাসতে শেষ হয়ে যেতাম। উনার রম্য সব সময় মিস করব। ব্লগে খুব বেশি রম্য লেখক দেখি না।
কাকঁন - বেশ কিছু দিন ধুমায়া ব্লগিং করে কুথায় যেন হারিয়ে গেলেন।
ফারা তন্বী - জেডী আর শ্রাফু মিলে আমারে পচাইতো। আফসুস
পল্লী বাউল - জেডার নাম শুনলেই আমার "আগে কত সুন্দর দিন কাটাইতাম গানটা কথা মনে পড়ে যায়" আর গ্রামে ফিরে যেতে মন চায়।
নাঈম - আমার কাছের বন্ধুদের আরেকজন। সবাই উম্মাদ নাঈম বলে ডাকতাম। মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে খুব সিরিয়াস আর জাশিদের বাঁশ দিত।
সহেলী - আপুর লেখত ভালো তবে সমানে কমেন্টাইতো।
অরুনাভ - ব্লগে যখন অতিথি হিসাবে কমেন্ট করতাম, তখন একদিন জেডারে ফুন দিয়ে কইছিলাম-জেডা, আমি আপনার ফ্যান, আপনার সাথে দেখা করতে চাই। জেডা আমারে কয়- আন্নে হাগল কি কুন?
নতুন - নতুন জেডাই মনে হয় সব সময় ব্লগে এক্টিভ। ব্লগের বাইরে জেডার লগে যতবার দেখা হইছে, ততবারই খুব ভালো কাটছে।
এরশাদ বাদশা - বাদশা জেডার সাথে কমেন্টে কমেন্টে আড্ডা হত
চতুষ্কোণ - আমি, রাকিব ভাই, আসিফ ভাই, চতুষ্কোণ ভাই মিলে সকাল সকাল শুরু করতাম কমেন্টে কমেন্টে আড্ডানো। আসিফ ভাই কোরিয়া থেকে দেশে ফেয়ার পরে আর তেমন আড্ডানো হয়নি।
এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল স্বর্ণা - স্বর্ণা জেডীর নাম শুনলেই আমার ডর লাগে। নামের মধ্যেই কেমন ইটি ইটি গন্ধ তবে ব্লগার হিসাবে অতিব ভালো মনের। এলিয়েনরা যেমন আম্রিকা ছাড়া অন্য কোন দেশে আসে না, তেমনি জেডীও আম্রিকার অনেক গল্প শুনাইতো আমাগো।
বৃত্তবন্দী - এই পাবলিক ব্লগের চেয়ে ব্লগের বাইরেই বেশী জনপ্রিয়। জেডার কবিতাগুলো নায়িকাদের মত সুন্দর। এত কবিতা কিভাবে লেখে জানতে মঞ্চায়।
অক্ষর - ইনি মিস্টার NOBODY। উনার ব্লগে আছে- nobody is perfect. i am NOBODY। বসের সাথে ব্লগের শুরুর দিকে সেইরাম আড্ডাইতাম। অন্য অনেকের মত উনিও বিবাহের পরে ক্যাঙ্গারুদের দেশে হারাই গেছে।
রাজামশাই - ফুলের জন্য উনার প্যশন ছিল মুগ্ধ করার মত। অনেক সময় এমনসব ফুলের উপর উনি পোষ্ট দিতেন যেগুলোর নাম জীবনেও শুনি নাই। ফুল নিয়ে জানার জন্য উনার ব্লগ হচ্ছে বেষ্ট। এত চমৎকার লেখতেন কিন্তু হঠাৎ করে একদিন শুনি নাই। প্রচন্ড কষ্ট পেয়েছিলাম।
ইমন জুবায়ের - ব্লগের ওয়ান অফ দ্যা মোষ্ট ব্রিলিয়ান্ট ব্লগারস ছিলেন ইমন ভাই। রেয়ার কিছু সাব্জেক্ট-এর উপরে উনার এমন অগাধ জ্ঞান ছিল যা ব্লগের মনে হয় অধিকাংশ লোকের কোন ধারনাই ছিল না। উনাকে সব সময় মিস করব।
এছাড়া আরও বেশ কিছু ভাইয়া আর আপু আছে যাদের কাছ থেকে প্রচুর স্নেহ পেয়েছি। অনেকে আবার রীতিমত ছোট ভাইয়ের মত শাসাত।
আহমেদ রাকিব - ব্লগের অনেক সাষ্টিয়ানের মধ্যে রাকিব ভাইয়া ছিল চমৎকার মানুষ। উনার লেখার হাত ছিল সেইরাম। উনার ব্লগের বাইরেও নানা বিষয় নিয়ে কথা হত। আমি আর সোনালীডানারে একবার সেইরাম খাওয়াইছিল কিন্তু বিবাহের পরে উনিও হাওয়া হয়ে গেছে। আফসুস
নাআমি - ব্লগে অফুন্ত স্নেহ পেয়েছি আপুর কাছ থেকে। মাঝে মাঝে ফোন করেও খবরা-খবর নিতেন। উনার একপোষ্টেই গান, কবিতা, ছড়া, ছবি, ভিডিও সবই পেতাম। তবে কোন কারনে এখন সব ডিলিট করে দিছে। ব্লগের কারো সাথে মনে হয় আর যোগাযোগও করে না! আপু এত ভালো লেখত তবে সব ডাক্তারের মত উনিও ব্যস্ত।
চিটি (হামিদা রহমান) - আপু লিখত কম কিন্তু লেখার মান ছিল সেইরাম। উনিও আফসুসিত কারনে উনার সব লেখা ডিলিট দিয়ে ব্লগ থেকে হাওয়া হয়ে গেছে। চিটি আপুর সাথে কথা ছিল লস এঞ্জেলসে গেলে উনি আমাকে চা খাওয়াবে। কয়েক বছর আগে যখন লস এঞ্জেলসে গেলাম তখন আপুর কথা মনে হয়েছিল কিন্তু যোগাযোগ না থাকায় সেই চা আর খাওয়া হল না। আফসুস
আরিয়ানা - আরিয়ানা আপু একবার ক্যাম্বোডিয়া গিয়ে একটা পোষ্ট দিয়েছিল। এরপর থেকে আমি আপু ক্যাম্বোডিয়া আপু ডাকতাম। সিঙ্গাপুর থেকে অজিগো দেশে মুভ করার পরে আপুও আর পোষ্ট তেমন দেয় না।
মেহবুবা - ব্লগে যদি কাউকে বড় বোন মনে করি, তাইলে সেটা মেহবুবা আপু। আপুর সব পোষ্টে মনে হয় কমেন্ট করা হয়নি কিন্তু মোটামুটি সব পোষ্ট পড়া আছে, এমনকি যখন ব্লগে ছিলাম না, তখনও। ব্লগে লগিং না করে আপুর লেখা পড়তাম। আমি কি সব অখাদ্য লিখি, সেইগুলো নাকি উনার বাচ্চারাও পড়ে। উনার বাচ্ছারা আমার মত বদ না হলেই হল। তবে উনার লেখার চেয়ে উনাকে আমার মানুষ হিসাবে অসাধারন মনে হয়। এক ক্রিসমাসে বন্ধুর বাসায় গিয়ে ঠেলায় পড়ছিলাম। সবাই মিলে ধরছে আমাকে বাংলাদেশী রান্না করতে হবে। তবে মেহবুবা আপুর দেওয়া ভুনা খিচুড়ী এবং চিংড়ী মালাইকারী সেই যাত্রায় আমাকে বাচিয়ে ছিল। আপুকে কখনও বলা হয়নি- অনেক ধন্যবাদ আপু।
অনেকের ব্লগ ফলো করতাম রান্নার রেসিপি আর গ্রমন কাহানি পড়ার জন্য। অনেকেই ভ্রমন কাহানি লেখেন ব্লগে তবে সবারটা ঠিক সুখ-পাঠ্য হয় না। তবে সুরঞ্জনা আপু আর জুন আপুর ভ্রমন ব্লগগুলো পড়তে মজা পাইতাম। হাল্কা লেখা পরার জন্য শায়মা ওরফে অপ্সরা ওরফে শায়মার আরো কয়েকটা নিকের লেখা পড়তাম। আচ্ছা শায়মা, তুমি এতডি নিক সামলাও কেমনে? ইউজার নেইম আর পাসয়ার্ড রাখার জন্য তোমার কয়ডা পকেট আছে?

গদ্যের জন্য বস হচ্ছে হাসান ভাই আর ইমন আপু। বিশেষ করে হাসান ভাইয়ের মাথায় এত গল্পের প্লট আসে কেমনে? আমার মনে হয় উনার কাছে "গল্পের প্লট ম্যানেজমেন্ট" সফটওয়ার আছে

এই রকম আরও প্রচুর ব্লগার আছে যাদের লেখা, কথোপোকথন, স্নেহ আমার বেড়ে উঠার দিনগুলোতে আমাকে প্রচুর সাহায্য করেছে, আমার থট প্রসেসকে ইম্রপুভ করতে, আর সব মিলিয়ে আমাকে আমার একটা বেটার ভার্সন হতে! এই অজানা অচেনা মানুষগুলো আমাকে প্রচুর দিয়েছে কিন্তু তাদেরকে কখনও একটা ধন্যবাদও দেওয়া হয়নি। এক দশক পূর্তির এই পোষ্টটা সেইসব ব্লগারদের যারা এত অচেনা হয়েও খুব চেনা মনে হয়। জয়তু ব্লগিং!
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে আগস্ট, ২০১৮ রাত ১২:১১