পর্ব ১
আজকে এডভার্টাইজের কিছু কমন জিনিস অন্যরকম ভাবে আলোচনা করি, দেখেন তো ভাবনার খোরাক জন্মায় কিনা ?
আচ্ছা, লাস্ট কোন জিনিস টা কিনেছিলেন, অথবা কোন সেবাটা নিয়েছিলেন বিজ্ঞাপন দেখে ?
বাসার সবাইকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, আব্বু কিনেছে গ্যালাক্সি ট্যাব, আম্মু কিনেছে অটবির একটা ছোট টুল টাইপের ফার্নিচার, আমি কিনেছি রুচি চানাচুর। এক ফ্রেন্ড কিনলো মোবাইলের একটা প্যাকেজ।
আমারটার ব্যাপারে বলি। মানে কেন রুচি চানাচুর কিনলাম। আমার ঝাল কিছু খেতে ইচ্ছা হচ্ছিলো। গেলাম নিচের টং দোকানে, গিয়া দেখি রুচি চানাচুর বাদে আর কিছু নাই। কাজেই অনেক টা বাধ্য হয়ে কিনলাম। আব্বু গ্যালাক্সি ট্যাব কিনেছিলো কারন বাজেটের মধ্যে ঐটাই কাজের জিনিস, আর দেখামাত্র পছন্দ হইসিলো। আম্মু অটবি থেকে টুল কিনেছে কারন ডিজাইন টা অনেক জোস। ফ্রেন্ড বাংলালিঙ্ক কিনেছে কারন তার দরকার ৭ টা এফএনএফ।
কি বুঝা গেল ? বুঝা গেলো, আমরা এড দেখে জিনিসটার সাথে পরিচিত হচ্ছি, আর কিছু জিনিস বিবেচনায় এনে তারপর ক্রয় করছি। বিবেচনা করার মত জিনিসগুলো কখনো দাম, কখনো যায়গা, কখনো কোয়ালিটি ইত্যাদি ইত্যাদি। তাইলে আসেন, এই সমস্ত এড স্ট্রাটেজি নিয়া আজকে কথা বলি।
মনে করেন, আপনার দরকার একটা নতুন টিভি কিনা। সনি ব্রাভিয়ার এড দেখে আপনার খুব পছন্দ হলো। বাজেট ঠিক করে আপনি গেলেন দোকানে। ব্যাটা ফাউল দোকানদার বললো কি, ভাই ব্রাভিয়ার তো প্রোডাকশন কম, আমরা রাখিনা। দাম অনেক বেশি। আপনি সামসাং দেখেন, থ্রিডি টিভি, কোয়ালিটি ভালো এবং দামেও ব্রাভিয়ার চেয়ে কম। আপনার সামসাং দেখে ভালো লাগলো এবং কিনে নিয়ে আসলেন।
এরকম ব্যাপার কিন্ত হরহামেশাই হচ্ছে। তার মানে আপনি যতই ভাবনা চিন্তা করে যান না কেন, যখন মার্কেটে যাচ্ছেন, তখন ইন্সট্যান্ট যেটা পারছেন, সেটাই কিনছেন। ব্রাভিয়ার একটা প্রোডাক্ট কম বিক্রি হলো যায়গামত না থাকার কারনে। আবার সামসাং এর একটা প্রোডাক্ট বেশি বিক্রি হল একটা স্পটের কারনে।
এডভার্টাইজিং এর ভাষায় ইহাকে বলা হয় হটস্পট। মানে আপনার পন্য টা যায়গামত প্লেস করা।
রাইট প্লেসমেন্টের একটি সুন্দর এড দেখুন
ভালো ভালো ব্রান্ডগুলা এই কাজটা খুব ভালো পারে। যেমন ধরেন নকিয়া। মোবাইলের শো রুমে গেলে দেখবেন, ঠিক চোখ বরাবর ডিসপ্লেতে সব নোকিয়া আর সামসাং। মানুষ হাটু গেড়ে বসে নিচের তাক খুব কম ই দেখে। সো আই লেভেলের তাক টাই হচ্ছে হটস্পট। আমার চানাচুর কিনার কথা মনে করে দেখেন। বড় দোকানে কয়েক ব্রান্ডের চানাচুর থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্ত আমি গেসিলাম টং দোকানে। কাজেই সেখানে শুধুমাত্র রুচি চানাচুর দেখে সেটাই কিনেছি। এইটাও রাইট প্লেসমেন্টের একটা ভালো উদাহরন।
এই রকম আরো কিছু জিনিস হচ্ছে, প্রাইস (দাম), প্রোডাক্ট ( পন্য/সেবা) প্লেস (যায়গা) প্রমোশন ( প্রচার ) পিয়ার গ্রুপ ইত্যাদি।
পিয়ার গ্রুপ টা আবার কি জিনিস, তাই না ?
উদাহরন দেই, কনভার্স কিন্ত খুব ই ফেমাস একটা জুতার কোম্পানি। আমাদের ইয়াং পোলাপান কে দেখবেন ইদানিং অনেক রং বেরঙ্গের কনভার্স পড়ে।
কিন্ত কনভার্স এর কোন বিজ্ঞাপন দেখেছেন কখনো ? দেখেন নি। কারন বাংলাদেশে কনভার্স ট্রেন্ড চালু হয়েছে দেখাদেখি। মানে, আমার ফ্রেন্ডের দেখাদেখি আমি, আমার দেখাদেখি আরেকজন, তার দেখাদেখি আরেক টা গ্রুপ, এভাবে। ইহাই হচ্ছে পিয়ার গ্রুপ। সাধারনত ফ্যাশন সচেতন জিনিসের ব্রান্ডিং বা এডভার্টাইজিং এ পিয়ার গ্রুপ টার্গেট অনেক ইম্মপর্টেন্ট। অনেক সময় দেখবেন একটা জিনিস কিনলে আরেক টা সেম জিনিস ফ্রি দেয়। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে পিয়ার গ্রুপ বাড়ানো।
এই রকম আরেকটা দরকারি জিনিস হচ্ছে ক্রাউডিং । মনে করেন আমি আপনাকে বললাম, দূর্যোধন তো লালটিপ মুভিটার একটা সেই রকম রিভিউ লেখসে। আপনি শুনলেন, পাত্তা দিলেন না। কিছুক্ষন পর আরেকজন ব্লগার বললো- আরে ভাই লালটিপের রিভিউটা পড়েছেন ? হা হা সেই রকম হৈসে। আপনি চিন্তা করলেন, কি লেখলো ব্যাটা কে জানে। বাসায় আসার পর পিসি খুলতেই দেখলেন ফেসবুকে আপনার ১০ জন ফ্রেন্ড শেয়ার করসে দুর্যোধনের লালটিপ। বৌ চা দিয়ে গেল- তার কপালেও লালটিপ। ফেসবুকে ফান পেজে ঢুকলেন সেখানেও লালটিপ। আপনি এক সময় লাল্টিপের রিভিউ টা পড়েই ফেলবেন। সেটা অতিরিক্ত আগ্রহের জন্য হোক অথবা বিরক্তির জন্যই হোক। বাট হিট কিন্ত বাড়লো দূর্যোধনের ( দূর্যোদা আবার মাইন্ড কইরো না, মজা করলাম )।
আপনাদের একটা মজার কাহিনী বলি, আমরা এইচএসবিসি ব্যাঙ্ক বনানী ব্রাঞ্চের ব্রান্ডিং কিভাবে করলাম, সেই কাহিনী।
আমাদের ক্লায়েন্ট হচ্ছে এইচএসবিসি। এখন প্লানিং এন্ড স্ট্রাটেজির মিটিং বসলো। কি ভাবে এড দেয়া যায়, কি কি করা যায়। একটা কথা বলা হয় নাই, ব্রান্ডিং এবং এডভার্টাইজিং কিংবা যে কোন মাস কমিউনিকেশনে সবচাইতে জরুরি হচ্ছে টার্গেট গ্রুপ (টিজি) ঠিক করা। মানে কে হবে আপনার কনজিউমার, কি কিনবে আপনার পন্য। অথবা কার জন্য বানাচ্ছেন এড। যারা বাংলালিঙ্ক এর বর্তমানের এড দেখে কিছুটা হতাশ, তাদের বলছি- একটা টিভিসি নির্মানে অনেক বড় একটা ভুমিকা রাখে টিজি (টার্গেট গ্রুপ), বাংলালিঙ্ক এর প্রধান উদ্দেশ্য এখন মধ্য ও নিম্নবিত্ত সবার মাঝেই তাদের সেবা পৌছে দেয়া। তাই টার্গেট গ্রুপ চেঞ্জের কারনে তারা এখন নাচগান সম্বলিত এড তৈরি করছে। বেশি হাই থটিক এড হয়তো গ্রামের অনেক মানুষের মাথার উপর দিয়ে যেতে পারে। হতাশ হবার কিছু নেই। বিশেষ বিশেষ দিনে তারা এখনো সেই রকম এড লঞ্চ করে থাকে।
এখন এইচএসবিসি ব্যাঙ্ক বনানীর জন্য তো একটা আস্ত টেলিভিশন এড বানানোর কোন মানে নাই। সারা দেশের মানুষ কে বনানী ব্রাঞ্চের এড দেখায়া লাভ কি ? তাইলে কি করা যায় ?
প্রথমে ঠিক করলাম টার্গেট গ্রুপ। আমাদের টার্গেট গ্রুপ হচ্ছে মধ্যবয়স্ক ইস্টাবলিশ উচ্চবিত্ত মানুষ। এবং অবশ্যই বনানীর বাসিন্দা। তো তাদের কে কোথায় পাই ? চিন্তা করে বের হলো, তাদের সবাইকে পাওয়া যাবে বনানি লেকের পাশে বা পার্কে, ভোরে। কারন নিম্নবিত্ত লোক জন ভোরে জগিং করেনা। কয়েক দিন বাদে আমরা একটা ইভেন্টের আয়োজন করলাম। বনানী পার্কের পাশে প্রেসার মাপার। লোক জন জগিং করতে আসে, ক্লান্ত হয়ে ফিরে যাবার সময় আমাদের থেকে বিনামুল্যে প্রেশার মেপে যায়। খুশি হয়। আমরা একটা করে লিফ্লেট ধরিয়ে দেই, যাতে লেখা "এইচেসবিসি ব্যাঙ্ক এখন বনানীতে।" তারা সেইটা হাতে নেয় একবার চোখ বুলায়, এবং কিছুক্ষন পর ফেলে দেয়।
আমরা কিন্ত জানি ৮০ % লোক এই কাগজ টা ফেলে দিবে। তাই হলো ২য় ব্যাবস্থা। তারা যখন বাসায় আসে, ফ্রেশ হয়ে খবরের কাগজ নিয়ে বসে। দেখে নিচে বড় করে লেখা " এইচেসবিসি ব্যাঙ্ক এখন বনানীতে", এবার তারা একটু খেয়াল করে পড়ে। যাই হোক অফিসে যাবার সময় তারাই আবার দেখে - বাসার সামনে রাস্তার মোড়ে বড় করে লেখা "এইচেসবিসি ব্যাঙ্ক এখন বনানীতে"।
আমাদের যাদের দরকার, যাদের আমাদের কে দরকার তারা আমাদের এভাবেই খুজে নেয়। ইহার ই নাম ক্রাউডিং। প্রথমে আমরা একবার তাদের নক করলাম প্রেশার মেপে দেয়ার মাধ্যমে, তারপর খবরের কাগজে, তারপর বিল বোর্ডে, সম্ভব হলে বিটিএল এর মাধ্যমে।
এবার বলি ব্রান্ড এম্বাসাডর নিয়ে। এইটাও কিন্ত অনেক ইম্পর্টেন্ট।
ব্রান্ড এম্বাসাডর হচ্ছেন একজন সেলিব্রেটি, যাকে সাধারন মানুষ ভালো ভাবে নিবে। গুডউইল কিন্ত অনেক ইম্পর্টেন্ট একটা জিনিস।এইটা নির্ভরতার প্রতিক। আপনার কঞ্জিউমার যদি আপনার উপর নির্ভর করতে না পারে, তাইলে সে আপনার পন্য কিনবে কেন ?
উদাহরন দেই, আগে হুইলের ব্রান্ড এম্বাসাডর ছিলো শিমুল। সেল মধ্যম জাতের। এম্বাসাডর চেঞ্জ করে রিয়াজ কে দেয়া মাত্রই মার্কেট শেয়ার বেড়ে গেলো প্রায় ৪০ %, তার মানে শিমুলের চেয়ে রিয়াজ কে হুইলের টার্গেট গ্রুপের মানুষ বেশি চিনে। হুইল আসলে রিয়াজের গুডুইল টাকেই ব্যাবহার করছে নিজের পন্য বিক্রির স্ট্রাটেজি হিসেবে।
আজকে শেষ করি প্রাইসের ব্যাপার দিয়ে। আমাদের বাঙ্গালিদের মাঝে দাম নিয়ে অদ্ভুত একটা মেন্টালিটি কাজ করে। আমরা মনে করি দাম বেশি মানে জিনিস ভালো।
বাংলাদেশের সবচাইতে ভালো কন্ট্রাসেপ্টরি পিলের মধ্য ভালো হচ্ছে জার্মান একটা পিল। এইটা আমাদের সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ইমপোর্ট করে এবং ৬ টাকা দামে বিক্রি করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে আমরা ৬ টাকা দিয়ে ঐটা নয়া কিনে ২০ টাকা দিয়ে নরডেট বা ফেমিকন কিনি ? কেন ? কারন আমরা মনে করি, দাম যেহেতু ৬ টাকা, জিনিস টা হবে বুয়া ব্রান্ড। বুয়ার জন্য ৬ টাকার জিনিস কিনা যায়, আমাদের জন্য এই জিনিস না।
লাক্সের দাম ২০ টাকা থেকে ২৪ টাকা করে দেয়ার পর বেড়ে গিয়েছিলো মার্কেট শেয়ার।
কাজেই ভালোভাবে মার্কেট এনালাইজ করেই এডভার্টাইজিং ফিল্ডে নামা উচিত। এই জন্যই এই সাব্জেক্ট নিয়ে ঘাটাঘাটি করছি।
আমি চেষ্টা করেছি বাস্তব উদাহরন গুলো আপনাদের সামনে নিয়ে আসতে, যাতা আপনাদের বুঝতে সুবিধা হয়, জানিনা কতটুকু বুঝাতে পারলাম। নেক্সট পর্বে আলোচনা করবো ক্রিয়েটিভ এড নিয়ে। সেই সাথে এড এজেন্সি ও মিদিয়ার কিছু ব্যাপার স্যাপার নিয়ে।
সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
সাথে থাকুন।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১১:৪১