সরকার আর দেশের মানুষকে নির্বোধ বানিয়ে তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন খাতের নাম ভাঙ্গিয়ে শতকোটি টাকা লুটেপুটে নিয়ে যাচ্ছে লুটেরা বেনিয়ার দল। একসময় এপটেক, নিট ইত্যাদি বিদেশী শিক্ষাবেনিয়ারা শতকোটি টাকা লুট করে নিয়েছে দক্ষ তথ্যপ্রযুক্তি জনবল তৈরী করার নাম করে। পরে আসলো মেডিকেল ট্রান্সক্রিপশন। আর এখন কল সেন্টার। হাজার হাজার কোটি টাকার বিদেশী কাজের লোভনীয় মার্কেট সোনার হরিন থেকে গেলেও লুটপাটের তাতে কমতি নেই। আজকের প্রথম আলোর একটি খবর এরকম "কল সেন্টারের নামে কোটি টাকা নিয়ে উধাও বেনটেল"
‘বাংলাদেশের ১৪ কোটি মানুষকে কল সেন্টারের আওতায় আন্তর্জাতিক মানের কাস্টমার কেয়ার সার্ভিস দেওয়া হবে। দেশের প্রথম ডিজিটাল কল সেন্টার বেনটেল ২৪x৭ দেশের সেরা ফ্রানচাইজ পার্টনার হিসেবে এখন আপনাকেই খুঁজছে। আপনি যদি সত্ ও উদ্যোগী হন, তাহলে আপনার জন্যই এই সুযোগ। মাত্র তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা বিনিয়োগ করুন। তিন মাসে উঠে আসবে টাকা, এরপর কেবলই লাভ।’
দেশের বিভিন্ন দৈনিকে ও টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন দিয়ে এভাবেই তরুণদের আকৃষ্ট করেছিল বাংলাদেশের প্রথম ডিজিটাল কল সেন্টারের দাবিদার বেনটেল কেয়ার। এরপর অনেকেই এই কল সেন্টারের ফ্রানচাইজি (এজেন্ট) হওয়ার জন্য বেনটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তি করেন। কিন্তু তাঁদের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা নিয়ে কল সেন্টারটির মালিক শাহেদ লতিফ এখন উধাও। ঈদের পর থেকে তাঁদের কার্যালয় তালাবদ্ধ। এ ছাড়া প্রশিক্ষণ ও চাকরির কথা বলে আরও ৩২ লাখ টাকা নিয়ে পালিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। অনেক কর্মীর বেতনও বকেয়া।
এ ঘটনায় ঢাকার ধানমন্ডি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন ১৫ তরুণ। এতে বলা হয়, তাঁদের ১৫ জনের কাছ থেকে ৪৭ লাখ ৪৯ হাজার টাকা নিয়ে পালিয়েছেন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। তাঁদের কারও সঙ্গেই এখন যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। জিডিতে আরও অভিযোগ করা হয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় অংশীদার করার নামে প্রতিষ্ঠানটি আরও অনেকের কাছ থেকে এভাবে কোটি কোটি টাকা আত্মসাত্ করেছে।
প্রতারিত তরুণেরা প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁরা বিভিন্ন সময়ে অন্য জেলার এজেন্টদের নাম-ঠিকানা জানতে চাইতেন। কিন্তু কোম্পানির লোকজন বলতেন, কল সেন্টারটি চালু হলেই সবাই সবাইকে চিনতে পারবেন।
ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা সালাহউদ্দিন বলেন, ‘পত্রিকার বিজ্ঞাপন দেখে আমি বেনটেল কেয়ার ফ্রানচাইজি হতে আবেদন করি। তারা আমাকে পুরান ঢাকার ফ্রানচাইজি করে এবং চার কিস্তিতে পাঁচ লাখ চার হাজার টাকা নেয়। কিন্তু ঈদের পর আমরা কার্যালয়ে গিয়ে দেখি সেটি তালাবদ্ধ। ইতিমধ্যে আমি জানতে পারি, প্রতিষ্ঠানটি আমার মতো অনেকের সঙ্গে প্রতারণা করে কয়েক কোটি টাকা আত্মসাত্ করে পালিয়েছে।’
সালাউদ্দিনের মতোই মিরপুরে কল সেন্টারের কথা বলে মাহফুজুল বাহারের কাছ থেকে দুই লাখ ২২ হাজার টাকা, নারায়ণগঞ্জের মোহাম্মদ আয়ুবের কাছ থেকে দুই লাখ ৬১ হাজার টাকা, সাভারের আবু সায়ীদের দুই লাখ, চাঁদপুরের হাসান মাহমুদের দুই লাখ ৩৪ হাজার, চট্টগ্রামের জাহিদুল আলমের তিন লাখ ১৭ হাজার, চট্টগ্রামের বন্দর এলাকার মোজাফফর হোসেনের পাঁচ লাখ, কোতোয়ালির ইকবালের দুই লাখ ৮০ হাজার টাকা নিয়েছিল বেনটেল। তাঁরা জানিয়েছেন, সারা দেশে এভাবে আরও অনেকের কাছ থেকে অন্তত দুই থেকে তিন কোটি টাকা নিয়ে পালিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
কল সেন্টার কী: অন্য দেশের সঙ্গে যোগাযোগ এবং যেকোনো বিষয়ে তথ্য সরবরাহের উদ্দেশ্য নিয়ে দেশে কল সেন্টারের ব্যবসা শুরুর অনুমতি দেয় সরকার। সেন্টারগুলো চালু হলে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে কল সেন্টারের নির্দিষ্ট একটি নম্বরে ফোন করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরি, অন্য সেবাসহ সব ধরনের তথ্য মিলবে।
অফিস এখন তালাবদ্ধ: বেনটেল কল সেন্টারের ধানমন্ডির প্রধান কার্যালয় এবং কল সেন্টার প্রশিক্ষণ কার্যালয় দুটোই এখন বন্ধ। কল সেন্টারের ধানমন্ডির কার্যালয়ে তিন দিন গিয়ে বাইরে থেকে তালা লাগানো দেখা গেছে। ভবনের মালিক জানান, তিনিও দুই মাসের ভাড়া পাবেন।
ঈদের পর থেকে প্রতিষ্ঠানটির মালিক শাহেদ লতিফের মোবাইল ফোন বন্ধ। পশ্চিম ধানমন্ডির যে বাসায় তিনি থাকতেন, সেখানে কথা হয় তাঁর বাবা-মায়ের সঙ্গে। বাবা-মায়ের অনুরোধ, পত্রিকায় যেন তাঁদের নাম প্রকাশ করা না হয়। শাহেদ লতিফের মা বলেন, ‘টাকার জন্য অনেকেই এই বাড়িতে আসছে। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। কিন্তু তাঁর ছেলে যে এভাবে প্রতারণা করেছে, সেটি তাঁরা জানতেন না। ফলে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছেন না।’ শাহেদের সঙ্গে তাঁদের কারও যোগাযোগ নেই বলেও জানান তিনি।
প্রতারিত তরুণেরা শাহেদ লতিফের ভাই জাহেদ লতিফ, ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও বেনটেলের অংশীদার করপোরেট হেড ইমন হাসান, প্রধান হিসাব কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইউনুস, হিসাব বিভাগের আরেক কর্মকর্তা শরীফুল আলম চৌধুরী, মুরাদ হাসান ও তৈয়বা সুলতানা এবং ব্যবস্থাপক সঞ্জয় মিত্রের বিরুদ্ধেও প্রতারণার অভিযোগ এনেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইমন হাসান বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হচ্ছে সেগুলো ঠিক নয়। তিনি প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মচারী ছিলেন। তাঁরও বেতন বকেয়া রেখে শাহেদ লতিফ প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে পালিয়ে দেশের বাইরে চলে গেছেন। তিনিও এই ঘটনার বিচার দাবি করেন। একই কথা বলেছেন মো. ইউনুস। তবে অন্যদের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।
কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও বেতন বাকি: ধানমন্ডির কার্যালয়ে গত বুধবার গিয়ে দেখা মেলে বেনটেলের লজিস্টিক অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন ব্যবস্থাপক মনিরুজ্জামানের। তাঁর দুই লাখ ৫৫ হাজার টাকা বেতন বাকি আছে বলে তিনি দাবি করেন।
কল সেন্টারে কাস্টমার এক্সিকিউটিভ হিসেবে কাজ করতেন শরিফুল। তিনি জানান, তাঁরা ২২ জন এখানে চাকরি করতেন। তাঁদের প্রত্যেকের ৪১ হাজার টাকা করে বেতন বকেয়া। শরিফুল জানান, এই কল সেন্টারে ১০০ জন ৩২ হাজার টাকা করে দিয়েছিলেন প্রশিক্ষণের জন্য। কথা ছিল, ভারত থেকে লোক এনে তাঁদের প্রশিক্ষণ, সনদ ও চাকরি দেওয়া হবে। কিন্তু প্রশিক্ষণের সব টাকা নিয়ে পালিয়েছেন মালিক। এ ঘটনায় তিনি বাদী হয়ে ধানমন্ডি থানায় একটি জিডি করেছেন।
বিটিআরসির বক্তব্য: বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) থেকে এ বছরের ৭ মে বেনটেল কেয়ার ২৪X৭ নামের এই প্রতিষ্ঠানটিকে লাইসেন্স দেওয়া হয়। কল সেন্টারের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, মাত্র পাঁচ হাজার টাকা দিলেই কল সেন্টারের লাইসেন্স পাওয়া যায়। ফলে অসত্ ব্যক্তিরা মাত্র পাঁচ হাজার টাকায় লাইসেন্স নিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছেন। বেনটেল কেয়ার তাদের অন্যতম।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিটিআরসির সাবেক কর্মকর্তা আব্বাস ফারুক বলেন, ইন্টারনেট-সংক্রান্ত সব ধরনের সেবা দেশের সব জেলা-উপজেলা-থানায় পৌঁছে দিতে স্বল্পমূল্যে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল।
বিটিআরসির লিগ্যাল অ্যান্ড লাইসেন্স বিভাগের পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম শহিদুজ্জামান বলেন, কেউ অর্থসংক্রান্ত প্রতারণা করলে তাঁর বিরুদ্ধে বিটিআরসি কিছু করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের তিনি পুলিশের সহায়তা নেওয়ার পরামর্শ দেন।
প্রতারিতরা এখন কী করতে পারেন জানতে চাইলে বিটিআরসির আরেক কর্মকর্তা বলেন, ভুক্তভোগীরা কমিশনের কাছে সরাসরি অভিযোগ জানাতে পারেন। কমিশন তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা পেলে প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্স বাতিল করে দেবে। কমিশনের এর বেশি কিছু করার ক্ষমতা নেই। পুলিশই যা করার করবে।
এ ব্যাপারে ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ আলম বলেন, তাঁরা অভিযোগগুলোর তদন্ত করছেন। আইনি-প্রক্রিয়ায় যা করার তাঁরা করবেন।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশেন অব কল সেন্টার অ্যান্ড আউট সোর্সিংয়ের (বিএসিসিও) আহ্বায়ক আহমেদুল হক বলেন, কেউ যেন এভাবে লাইসেন্স নিয়ে প্রতারণা করতে না পারে, সে জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেই তত্পর হতে হবে। তবে তাঁরা সবাইকে সচেতন করার কাজটি করবেন।