somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একজন প্রিয় কবি আবুল হাসান- জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি

০৪ ঠা আগস্ট, ২০১৫ সকাল ১১:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সে এক পাথর আছে কেবলি লাবণ্য ধরে, উজ্জ্বলতা ধরে আর্দ্র,
মায়াবী করুণ
এটা সেই পাথরের নাম নাকি? এটা তাই?
এটা কি পাথর নাকি কোনো নদী? উপগ্রহ? কোনো রাজা?
পৃথিবীর তিনভাগ জলের সমান কারো কান্না ভেজা চোখ?
মহাকাশে ছড়ানো ছয়টি তারা? তীব্র তীক্ষ্ণ তমোহর
কী অর্থ বহন করে এই সব মিলিত অক্ষর?
~ আবুল হাসান

একজন প্রিয় কবি আবুল হাসানের আজ জন্মদিন (জন্মঃ ১৯৪৭, ৪ আগস্ট-মৃত্যুঃ ১৯৭৫, ২৬ নভেম্বর)। মাত্র ২৮ বছর বয়সে তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন।

আবুল হাসান আমার প্রিয় প্রসঙ্গ .. আসাদ চৌধুরী
(কবি আসাদ চৌধুরীর স্মৃতিচারণ)
আবুল হাসান আমার প্রিয় প্রসঙ্গ। এই প্রসঙ্গ একবার উঠলে আমি খুব সহজে অন্য প্রসঙ্গে যেতে চাই না। প্রসঙ্গের সূত্র ধরে আলাপের আয়তন বাড়াই। মাত্র তিনটি কবিতার বই-র মধ্যে হাসান আছেন। হাসান আছে স্মৃতিতে। তাঁর কবিতার মূল্যায়নের চেষ্টাই আমি করবো না, নিশ্চয়ই যোগ্য সমালোচক এই আনন্দময় কিন্তু অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কাজটি করবেন। আমি যেখানেই কবিতা পড়তে যাই, প্রথমেই হাসানের কিছু কবিতা পড়ি। মনে হয়, হাসান বেঁচে থাকলে তিনিও যেতেন।

হাসান যেদিন মারা গেলেন, সেদিন আমিও টেলিভিশনের স্মরণসভায় ছিলাম। শামসুর রাহমান অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছিলেন। কথা ছিল আমি সবার শেষে বলবো, আর যদি সময় থেকে হাসানের কিছু কবিতা শোনাবো। আমি কবিতা পড়তে পারিনি। এমন কি, কবিতা পড়ার মতো মানসিক অবস্থাও আমার সে-সময় ছিলো না। বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিলো হাসপাতালের একটি মুখ, তাঁর নাকে তুলো গোঁজা, মুখে ম্লান হাসি, চোখ বোঁজা। আমার বুকটা হু হু করছিল। এত দিন পড়ে হাসানকে নিয়ে কিছু লিখতে গিয়ে সেই একই রকম আবেগ ভেতরে নাড়া দিচ্ছে।

আবুল হাসান, শুনতাম, কেননা তখন আমি ব্রাহ্মনবাড়িয়ায়, বেশ বেয়াড়া, উদ্ধত, এমনকি বেয়াদবও। অথচ আমার ধারণা ঠিক উলটো। কেন জানি না, হাসান আমাকে অতিরিক্ত সমীহ করতেন। মাঝে-মাঝে ছোটখাট ব্যাপারে ছোট ভাইয়ের মতোই আবদার করতেন।কোনো সময়ে মৃদু তিরস্কারে দেখেছি শিশুসুলভ নিষ্পাপ অভিমান। যেন, ‘আসাদ ভাই শেষ পর্যন্ত আপনিও ভুল বুঝলেন’ মার্কা হাসি। জার্মানি থেকে ফিরে গুলবাগে ছিলেন। আমি তাকে কোনোদিন বাসায় পাইনি। ঢাকার রাস্তা, ঢাকার গাছপালা, অনর্গল মানুষের প্রবাহ তাকে ঘরছাড়া করেছিলো? হাসানকে কখনও কখনও মনে হতো নাগরিক বাউল। শিল্প সাহিত্য সম্পর্কে মতামত দিতেন অকপটে। বলতেন প্রবল বিশ্বাস নিয়ে, যেখানে তর্ক অচল। তাঁর সরলতা, তাঁর আচরণ আমার বড় ভাল লাগতো। হাসান সুন্দর ছিলেন, যথার্থ সুপুরুষ ছিলেন, আর সুন্দরের প্রতি আমার অসীম দুর্বলতা তো রয়েছেই।

হাসান মারা যাওয়ার পর যারা হাসপাতালে, জানাজায় গিয়েছিলেন তাঁদের চোখে যে শোক প্রত্যক্ষ করেছি তার মধ্যে সামাজিকতার অনেক ঊর্ধে, প্রাণের ব্যাপার ছিল। সামাজিক প্রতিষ্ঠায় প্রতিষ্ঠিত যারা-তাদের মৃত্যুতে উৎসবের অহঙ্কার থাকে, দেখানোর ব্যাপার থাকে, কিন্তু সেখানে তা ছিলো না। হাসানের সংস্পর্শে যারাই এসেছেন, পেশায় তিনি যেই হোন, কবিতা তাকে স্পর্শ করতো। তিনি বুঝতে বাধ্য হতেন, একজন কবির মুখোমুখি তিনি হয়েছেন। সমগ্র অস্তিত্বে জীবন-যাপনে এমন কি মৃত্যুকে কি সহজভাবে মেনে নেয়ার মধ্যে স্মৃতিতে – তিনি, আবুল হাসান, সমকালের সবচেয়ে সোচ্চার কবি – কবি- একজন কবিই। ...

( শিশির দত্ত সম্পাদিত ‘সম্পাদক’, ১৯৭৯ থেকে)
- মুহম্মদ যুবায়ের

প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী
অতো বড় চোখ নিয়ে, অতো বড় খোঁপা নিয়ে
অতো বড় দীর্ঘশ্বাস বুকের নিঃশ্বাস নিয়ে
যতো তুমি মেলে দাও কোমরের কোমল সারশ
যতো তুমি খুলে দাও ঘরের পাহারা
যতো আনো ও-আঙ্গুলে অবৈধ ইশারা
যতো না জাগাও তুমি ফুলের সুরভী
আঁচলে আলগা করো কোমলতা, অন্ধকার
মাটি থেকে মৌনতার ময়ূর নাচাও কোন
আমি ফিরব না আর, আমি কোনদিন
কারো প্রেমিক হবো না; প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী চাই আজ
আমি সব প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী হবো।
.....
লেখাটি গ্রুপে দেওয়া যথাযথ হোল কিনা জানিনা। হাসান কে নিয়ে কোন লেখা চোখে পড়লেই আবেগাক্রান্ত হয়ে যাই। কবিতা ভালোবাসে কিন্তু হাসানের কবিতার প্রেমে পড়েনি এমন মানুষ খুব কমই আছে। সব প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে চেয়েছিলেন যিনি, তিনি অনুরাগী ছিলেন সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী মেধাবী, সুন্দরী সিনিয়র সুরাইয়ার। তার সে প্রেম কতখানি সুরাইয়ার হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিল,তা জানা যায়নি।। কিন্তু জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত সুরাইয়া তার গভীর মমতার হাত হাসানের উপর থেকে সরাননি জানা যায় এই লেখা থেকে। হয়তো এই ক্ষণকালীন প্রাপ্তিতেই হাসানের অধরা ভালোবাসা পূর্ণতা পেয়েছিল।
(আফরোজা সিমিন, প্রিয় কবিতারা, জানুয়ারী ১০, ২০১৫ )

"১৯৭৫-এর ২৬ নভেম্বর। সকালে ক্লাসে যাওয়ার পথে খবর পাওয়া গেলো, তরুণ কবি আবুল হাসান প্রয়াত। তাঁর কবিতা আমার প্রিয়। আবুল হাসান দীর্ঘকাল অসুস্থ ছিলেন, সরকারি উদ্যোগে চিকিৎসার জন্যে তাঁকে পাঠানো হয়েছিলো বার্লিনে। যতোদূর জানি, একজন কবির চিকিৎসার জন্যে সরকারি তৎপরতা ও সহায়তার ঘটনা বাংলাদেশে সেই প্রথম।

ফিরে আসার পর হাসান অল্প কিছুদিন ভালো ছিলেন, তারপর তাঁকে আবার পি জি হাসপাতালে (এখন শেখ মুজিব হাসপাতাল) ভর্তি করতে হয়। চিকিৎসকরা আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন, সুরাইয়া আপা ছাড়েননি। আবুল হাসানের সঙ্গে সুরাইয়া আপার বন্ধুত্ব বা ততোধিক ঘনিষ্ঠতা হয়েছিলো, এই মর্মে কথাবার্তা শোনা যেতো। সেসব অবান্তর, কবির সেই শেষ সময়ে সুরাইয়া খানম অবতীর্ণ হয়েছিলেন মমতাময়ীর ভূমিকায়।
প্রিয় কবির মৃত্যুসংবাদ পেয়ে ক্লাস করতে যাওয়া যায় না। পি জি হাসপাতালে পৌঁছে দেখলাম উদভ্রান্ত সুরাইয়া আপাকে, প্রয়াত কবির বিছানার পাশে দাঁড়ানো। তাঁকে অমন করুণ ও অসহায় আগে কোনোদিন দেখিনি। কিছু কিছু ছবি চিরকালের মতো হৃদয়কন্দরে জেগে থাকে, আজও সে মুখ ভোলা হয়নি।

কবির বন্ধু-আত্মীয়-ভক্তরা তখন ধীরে ধীরে সমবেত হচ্ছেন পি জি হাসপাতালে কবির অন্তিম শয্যাটিকে ঘিরে। অতো মানুষের সংকুলান সেই ছোট্টো কক্ষে হওয়ার কথা নয়, আমরা কেউ কেউ বাইরে বারান্দায় দাঁড়ানো। সুরাইয়া আপা হঠাৎ বেরিয়ে এলেন। কী ভেবে কে জানে, আমার হাত ধরে বললেন, ‘ওরা হাসানের লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যেতে চায়। তা কিছুতেই হতে পারে না, হাসানের খুব ইচ্ছে ছিলো তার কবর হবে রেসকোর্সের একপাশে। সে বলে গেছে। আমার কথা কেউ শুনছে না, তুমি একটু বুঝিয়ে বলবে ওদের?’
জীবনে একেকটা অসহায় সময় আসে যখন মানুষ খুব অবুঝ ও যুক্তিহীন হয়ে যায়। তখন অতি সামান্য কিছুকেও শক্ত অবলম্বন ভাবতে ইচ্ছে করে। না হলে এতো মানুষ থাকতে সুরাইয়া আপা আমাকে এই অনুরোধটি কেন করবেন? আমার কী ক্ষমতা, আমি তো সত্যিই কেউ না, আমার কথা কে শুনবে? তাঁর তখন সেসব বিবেচনা করার অবস্থা নেই।

বুঝতে পারি, অনেকের কাছে প্রত্যাখ্যাত ও উপেক্ষিত হয়ে সবাইকে তিনি একই অনুরোধ করে যাচ্ছেন, হাসানের কবর যেন ঢাকায় হয়। হঠাৎ রাহাত খানকে দেখতে পাই। আমি সুরাইয়া আপাকে তাঁর কাছে নিয়ে যাই। বলি, ‘রাহাত ভাই কিছু একটা করতে পারবেন হয়তো।’
নিজের অসহায়ত্ব নিয়ে সরে এসেছিলাম সেদিন। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া আর কোনোদিন হয়নি। পেরে উঠিনি। সুরাইয়া আপা একটিমাত্র অনুরোধ করেছিলেন, যা রক্ষা করার ক্ষমতা আমার ছিলো না।"
(মোহাম্মদ যুবায়ের)


ছবি দুটি সুরাইয়ার।

ভালোবাসার কবিতা লিখবো না
- আবুল হাসান
‘তোমাকে ভালোবাসি তাই ভালোবাসার কবিতা লিখিনি।
আমার ভালোবাসা ছাড়া আর কোনো কবিতা সফল হয়নি,
আমার এক ফোঁটা হাহাকার থেকে এক লক্ষ কোটি
ভালোবাসার কবিতার জন্ম হয়েছে।
আমার একাকীত্বের এক শতাংশ হাতে নিয়ে
তুমি আমার ভালোবাসার মুকুট পরেছো মাথায়!
আমাকে শোষণের নামে তৈরি করেছো আত্মরক্ষার মৃন্ময়ী যৌবন।
বলো বলো হে ম্লান মেয়ে,এতো স্পর্ধা কেন তোমার?
ভালোবাসার ঔরসে আমার জন্ম! অহংকার আমার জননী!
তুমি আমার কাছে নতজানু হও,তুমি ছাড়া আমি
আর কোনো ভূগোল জানি না,
আর কোনো ইতিহাস কোথাও পড়িনি!
আমার একা থাকার পাশে তোমার একাকার হাহাকার নিয়ে দাঁড়াও!
হে মেয়ে ম্লান মেয়ে তুমি তোমার হাহাকার নিয়ে দাঁড়াও!
আমার অপার করুণার মধ্যে তোমারও বিস্তৃতি!
তুমি কোন্ দুঃসাহসে তবে
আমার স্বীকৃতি চাও,হে ম্লান মেয়ে আমার স্বীকৃতি চাও কেন?
তোমার মূর্খতা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধে,পৃথিবীটা পুড়ে যাবে
হেলেনের গ্রীস হবে পুনর্বার আমার কবিতা!
এই ভয়ে প্রতিশোধস্পৃহায়
আজো আমি ভালোবাসার কবিতা লিখিনি
কোনোদিন ভালোবাসার কবিতা লিখিনি।
হে মেয়ে হে ম্লান মেয়ে তোমাকে ভালোবাসি তাই
ভালোবাসার কবিতা আমি কোনোদিন কখনো লিখবো না!’

নির্মলেন্দু গুণকে লিখা আবুল হাসানের শেষপত্র

আবুল হাসান
মহাদেবের বাসা
প্রিয় গুণ,
আজ রাত্রে মহাদেবের সাথে আল মাহমুদের এক তুমুল বাক বিতন্ডার পর, মহাদেবের বাসায় এসে দেখি তোমার একটি অভিমানী চিঠি, মহাদেবের কাছে যা তুমি লিখেছ। চিঠিটা বারবার পড়লুম- অনেকদিন পর তোমার সান্নিধ্য চিঠির মাধ্যমে পেয়ে একদিকে যেমন ভালো লাগলো, অন্যদিকে তেমন আহত হলুম, এই ভেবে যে তুমি আমার ঠিকানা জানা সত্বেও একটা চিঠি আমাকে লেখোনি। জানি না কী কারণ; তবে চিঠি না পেলেও তোমার সম্পর্কে অনবরত এর ওর কাছ থেকে খবর নিতে চেষ্টা করেছি- মাঝে মাঝে তোমার অনুপস্থিতির নৈঃসঙ্গের তাড়নায়ই হয়তোবা। এছাড়া এর পেছনে আর কোনো মানবিক কারণ নেই। এক সময় ছিল, যখোন তুমি আমাকে হলুদ পোষ্ট কার্ডে চিঠি লিখতে-তখন তুমি বাইরে থাকলেও মনে হতো তোমার উপস্থিতি উজ্জ্বলভাবে বর্তমান।
আমি মানুষ হিসেবে কতটুকু সৎ এবং শুভ বুদ্ধির সেটা বিচার সাপেক্ষ, তবে বন্ধু হিসেবে এক সময় তো আমরা পরস্পরের কাছাকাছি এসেছিলাম। আমাদের জীবন যাপনের সূত্রগুলি একে একে পরে ছিন্ন-বিছিন্ন হয়ে চতুর্দিকে বিক্ষিপ্ত হলেও সেই প্রবল প্রোচ্ছন্ন দিনগুলির কি কোনো কিছুই আর আমাদের মধ্যে অবশিষ্ট নেই, যা তোমার স্মৃতিকে একবারও নাড়া দিতে পারে? বা পারতো? এবং সেই স্মৃতির সুবাদে একটা চিঠি কি আমিও পেতে পারতুম না? মানি, আমার নিজের কিছু কিছু এককেন্দ্রিক দোষ-ত্রুটি এবং মানবিক দুর্বলতা শেষকালে আমাদের দু’জনকে দুদিকে সরিয়ে দিয়েছিলো- প্রথম দিকে আমি যা ভালোবাসতুম না সেইগুলি তোমার ভালোবাসার জিনিস ছিলো- পরে যখোন, তুমি সে সব পরিত্যাগ করলে এবং সেই সময়ে যখোন আমাদের সবচেয়ে নিকটবর্তী হওয়ার সময়, কেন জানি না এক অনির্দিষ্ট অদৃষ্টের তাড়নায় আমরা দু’জন পরস্পরের কাছ থেকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম। বিচ্ছিন্নতার কারণ হয়ত আমার দুরারোগ্য ব্যাধির তাড়না।

বার্লিন থেকে আসার পর আমি অন্য মানুষ। ফলে পুরনো যোগসূত্র সংস্থাপনের চেষ্টা করেছি যতবার-ততবার দেখেছি আমার শরীর আমার বৈরী। তুমি যা ভালোবাসো সেই সব আমার শরীর ভালোবাসে না, তবে অসুস্থ্যতার কারণেই। কিন্তু সত্তায় আমাদের যে গভীর সম্পর্কের সূত্র, কবির সঙ্গে কবির, সেই সম্পর্ককে তো আমি কোনদিন ম্লান করিনি। ১৫ই আগষ্টের পরে; তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে-ি কন্তু পরে একটি হঠাৎ জানলুম তুমি আর ঢাকায় নেই। তোমার ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার ব্যাপারটায় দুঃখ পেয়েছিলাম, নৈঃসঙ্গও কম বাজেনি। কিন্তু পরে আবার ভেবেছি যেভাবে তুমি মাঝে মাঝে বাড়ী যাও সেইভাবেই হয়তো গিয়েছ পরে আবার কিছুদিনের মধ্যে ফিরে আসবে। কিন্তু পরে জানতে পারলুম, তুমি গিয়েছ অনেক দিনের জন্য। বাড়ী গিয়ে তুমি বিভিন্ন জনের কাছে চিঠি দিয়েছ, সেইসব চিঠিতেই এসব জানতে পেরেছি। আমিও অপেক্ষায় ছিলুম। একটা চিঠি পাবো, কিন্তু সব সময় অপেক্ষা যে ফলপ্রসু হবে, এটার কোনো কথা নেই।

মহাদেবের কাছে তোমার চিঠি বারবার পড়েছি বারবার পড়ার মতোই। কবির চিঠির মধ্যে যে দুঃখবোধ এবং নৈঃসঙ্গবোধ এবং থাকে, তার সব রকম চীৎকার হঠাৎ আমাকেও একা সম্পূর্ণ একা করে দিয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য। এই একাকীত্বের দরকার ছিল আমারও। আমি অনেকদিন এরকম সুন্দরভাবে একা হতে পারিনি। বার্লিন থেকে আসার পর আমি এই একাকীত্বই বিভিন্ন জনের সান্নিধ্যে খুঁজতে চেষ্টা করেছি। যার জন্য আমি এক রমণীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম, এখন সেই শ্রীমতিও আমাকে আর একাকীত্ব দিতে পারেন না। হতে পারে এই একাকীত্ব কেবল তুমিই একবার আমাকে অনেকদিন ধরে দিয়েছিলেন। তুমি কি ভুলেই গেলে সেইসব দিনের কথা যখন শীতের কুয়াশার মধ্যরাত্রির বাতাসকে আমরা সাক্ষী রেখে ঢাকা শহরের অলিগলি বেড়িয়েছি। আমরা তখোন কী সুখী ছিলাম না। সেই সুখের কারণেই কি তুমি আবার ফিরে আসতে পারো না? যতোই ভালোবাসার পিছনে ধাবমান আমাদের ছায়া এর ওর সঙ্গে ঘুরুক তুমিও জানো আর আমিও জানি, এক সময় আমরাই আমাদের প্রেমিক ছিলাম। আর একমাত্র পুরুষ এবং আর একজন পুরুষই ভালোবাসার স্মৃতি সংরক্ষণ করতে পারে- কারণ রমণীরা অতি নশ্বর-কিন্তু সেই নশ্বরতার বেদনাবোধ কেবল কবি পুরুষেরাই একমাত্র গ্রহণ করিতে পারে। সেই নশ্বরতার অঙ্গীকারে আমরা আমাদের বে’ধেছিলুম একদিন। এখনও সেই বোধ, সেই ভালোবাসা আমার জীবনের একমাত্র স্মৃতি জানি না তোমার ক্ষেত্রে তার স্পর্শ আর কতদূর মূল্যবান। ভালোবাসা নিও। ভালো থেকো। এবং ফিরে এসো।
ইতি
চির শুভাকাঙ্খী
হাসান

আমার কথাঃ
বলা দরকার এই চিঠিতেই প্রথম হাসান আমাকে ‘প্রিয় গুণ’ বলে সম্বোধন করলো। তীব্র অভিমান প্রসূত না হলে, হাসান সর্বদা আমাকে নির্মল বলেই সম্বোধন করতো। গ্রামে ফিরে গিয়ে আমি হাসানের কাছে কেন কোনো পত্র লিখিনি, পাঠকের কাছে তা কৌতুহলের বিষয় হতে পারে ভেবেই বলি-১৯৭৪ এর স্বীয় চিকিৎসার্থে হাসান যখন বার্লিনে গিয়েছিলেন, আমি অনেক আশা করেও হাসানের একটি চিঠিও তখন পাইনি। হাসানের বিরুদ্ধে এ ব্যাপারে আমারও অভিযোগ ও অভিমান কম ছিল না। পুরো ব্যাপারটাই ছিল শিশু সুলভ মান-অভিমানের।
নির্মলেন্দু গুণ
( সূত্রঃ সম্পাদক, শিশির দত্ত,১৯৭৯। সংগ্রহঃ কমলেশ দাশগুপ্তের লিটল ম্যাগাজিন গবেষণা কেন্দ্র, চট্টগ্রাম)


(কবি নুরুল হুদার সাথে হাসান)

শুভ জন্মদিন, প্রিয় কবি- যেখানেই থাকুন, ভাল থাকুন।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ১২:৩৫
৩১টি মন্তব্য ৩০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×