একটি পকেটমার ধরা পড়িয়াছে।
কি আনন্দ !!! জনতা জনার্দন সর্বদাই এমন কিছু উপলক্ষের অপেক্ষায় থাকেন.........হাতের জোর পরখ করিয়া লইবার এমন মুফৎ সুযোগ প্রতিদিন আসে না.........
“মার........মার........জুরে মার........আরো জুরে মার........মাইরা ফেল শালারে.......”
উপস্থিত কেউ কেউ আবার ঘটনায় বিশেষ আনন্দ পাইতেছেন। যে সে ঘটনা তো নয়, এ যে সাক্ষাৎ শয়তান ধরা পড়িয়াছে !! অতএব চিৎকার, "কোপা সামসু, কোপা".......
হাড় জিড়জিড়া সহস্র কালের বুভুক্ষু সাক্ষাৎ শয়তানটিকে কোপানো হইতেছে........
হঠাৎ রঙ্গমঞে পুলিশের আগমন........
পুলিশেরা পরিস্থিতি বুঝিল যে এমন চলিতে থাকিলে হ্য়তো বেচারা মারাই যাইবে....... অতএব তাহারা বাংলা ছবির উত্তরাধিকারে প্রাপ্ত সংলাপ আওড়াইল.......
"থামুন.......আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না"
জনতা সরিয়া পুলিশকে জায়গা করিয়া দিলে পুলিশ পকেটমারটিকে ধরিয়া তাহাদের নীল গাড়িটিতে তুলিতে তুলিতে বলিল , "এইবার তবে হাজতে চল ব্যাটা......আজকাল তোর বড়ই বাড় বাড়িয়াছে".........
নাগরিক আচরণে এমন অনাকাংখিত হস্তক্ষেপে জনতা ঈষৎ বিমর্ষ হইয়া নিজ নিজ গৃহের পথ ধরে.......
(এরপর সেই ধুরন্ধরের সহিৎ পুলিশের কি প্রকারে রফা হইয়াছিল........তাহা কাকপক্ষী তো দূরে থাক.........থানার দেয়ালের পতংগটিও জানে নাই........)
**********************
দুরে দাঁড়াইয়া পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করিতেছিল এক বালক……….জনতার রোষ দেখিয়া বালক স্তম্ভিত হইল.........কেননা, সামান্য চুরিতেই যাহারা এত উৎসাহী হইয়া চোর পিটায়........জাতীয় পর্যায়ে তাহাদের এ হেন উদাসীনতা কেন ??
তবে মনে মনে সে অত্যন্ত পুলকিত হইল। বস্তুত, সামান্য টাকার জন্যে পকেটমারটিকে এমন তীব্র ধোলাই দেওয়া সে সমর্থন করে নাই.........
পকেটমারটিকে "বাঁচাইবার" কারণে পুলিশের প্রতি শ্রদ্ধায় তাহার মস্তক অবনত হইয়া আসিল।
**********************
এক বৃদ্ধ রিক্সাওয়ালা........বয়স ষাটের বেশি বই কম নহে, সারা জীবনের সন্চয় জমাইয়া বহু কষ্টে একটি রিক্সা কিনিয়াছে। অদ্য সেই রিক্সার "পরথম খ্যাপ।"
সহসা জনৈক পুলিশ দৌড়াইয়া আসিয়া বেধরক বৃদ্ধ রিক্সাওয়ালাটিকে পিটানো আরম্ভ করিল !
জানা গেল, রিক্সাওয়ালাটি "সিংগেল" অতিক্রম করিয়াছে.........
পুলিশটি শীর্ণগাত্র বয়ষ্ক রিক্সাওয়ালাকে চাবকাইয়া, চড়াইয়া এবং পিটাইয়াই ক্ষান্ত হইলেন না........তিনি মনের সুখে রিক্সাটিও ভাংগা শুরু করিলেন.......বৃদ্ধ রিক্সাওয়ালা তাহার হাতে পায়ে ধরিয়া কোন মতে রিক্সাটি বাঁচাইলেন.......
এমতাবস্থায় পুলিশ মহাশয় রিক্সাওয়ালাকে বিভিন্ন ইতর প্রাণীর সন্তান হিসাবে আখ্যা দিলেন......তাহার জন্ম পরিচয় নিয়া সন্দেহ প্রকাশ করিলেন.......এবং পরমুহুর্তেই ঘোষণা দিলেন, "তোর মাতৃদেবীর সহিৎ আমি শারিরীক সম্পর্ক স্থাপন করি"......।
ঘটনাচক্রে সেইখানেই সেই বালকটি কোথাও যাইবার নিমিত্তে রিক্সা ঠিক করিতেছিল .......সে এই ঘটনা সম্পূর্ণই প্রত্যক্ষ করিল।
একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলিল বালক। অতঃপর পুলিশটিকে অনুসরণ করিয়া গিয়া উপস্থিত হইল থানার সামনে ।
থানার অদূরেই একটি ঝাঁ-চকচকে বাড়ি উঠিয়াছে। বিশাল সেই বাড়িটি, দেখলেই চোখে লাগিয়া থাকার মত।
বালক স্থানীয় এক চায়ের দোকানিকে জিজ্ঞাসা করিল, "কে থাকে মামা এই বাড়িতে ? এত বড়লোকি বাড়ি ? "
দোকানি কহিল, "বাড়ি তো মামা ডেবেলফারের। কিন্তুক সব ফুলুরে মনে করেন তাহে থানার উসি শাব আর হ্যার পরিবার, আত্ত্বীয়-স্বজন। হ্যাতে ব্যাকডি ফুলুর কিন্না লইচে।
কি মনে করিয়া বালক আপন মনেই বোধ হয় হাসিয়া উঠিল।
ইহার পর সে সোজা গিয়া উপস্থিত হইল থানায়। থানা হাজতের সামনে অপেক্ষমাণদের জন্য চেয়ার পাতা রহিয়াছে। থানা হাজতে জনৈক ব্যক্তিকে কিঞ্চিৎ "ডলা" দেয়া হইতেছে। সম্ভবত লোকটির অসামান্য প্রাণশক্তি, তাই সে এখনো মরে নাই। তবে চিৎকারের চোটে কান পাতা যাইতেছে না। তবুও বালক কান পাতিল। ভিতর হইতে শোনা গেল :
: ঐ.......এরে লয়া যা। ভিতরে নিয়া বাইন্দা রাখ। আইজকা ভোর রাইতে জাগনা থাকিস। গাজিপুরের দিক যাওন লাগতে পারে। চুতমারানির পুলায় মুখ খুলে নাই।
: গোপন অস্ত্র উদ্ধারে যাইবেন নাকি ছার ?
: আবার বেশি কতা কস ? যা করতে কইছি কর। ভিতরে নিয়া বাইন্দা রাখ।
অতঃপর কিছুক্ষণের ধ্স্তাধস্তির শব্দ, অতঃপর ওসি সাহেব বালককে ডাক দিলেন।
: এই যে তুমি, আস........এই দিকে আস।
বালক ওসি সাহেবের সামনে গিয়া দাঁড়াইল।
: কি হইছে ? বল।
: না, মানে কিছু না। আমরা আসলে এই এলাকায় নতুন আসচি তো, তাই আব্বা বললেন যে আপনার সাথে দেখা করে দোয়া নিয়ে যাইতে।
থানার সকলে হাঁ করিয়া বালকের দিকে তাকাইয়া আছে। যেন এই রকম বিচিত্র কথা তাহারা কোনও দিন শোনে নাই। ঢাকা শহরে ওসির কাছে দোয়া নিতে পাঠানোর মত বিচিত্র বাপ-মাও আছে ? চিন্তা করিয়া তাহারা কোনও কূল-কিনারা পাইল না।
:ওহ আচ্ছা, আচ্ছা........তো কি করে তুমার আব্বা ?
:জি মানে.......গার্মেন্টসের ব্যবসা আছে আমাদের।
:ও........ভাল, ভাল। তো এইখানে কি নতুন ফ্ল্যাট কিনসো ?
:জি।
:ভাল, ভাল। তো কোন সমস্যা টমস্যা হইলে বইলো আরকি।
জি, তা তো অবশ্যই। আচ্ছা স্যার, ঐ সাদা রং এর নতুন বাড়িটা তো আপনার, না ?
হ্যাঁ, হ্যাঁ আইসো একদিন তুমার আব্বারে নিয়া।
শুনলাম সবগুলা ফ্ল্যাট আপনার একার স্যার ?
হে হে হে........আরে না না, মাইনষের কথায় কান দাও কেন ? আমি শুধু আমারটা কিনসি, বাকি গুলা আত্ত্বীয় স্বজনের আর কি........হে হে হে।
ওসি সাহেবের কন্ঠ দিয়া মধু যেন উথলাইয়া পড়িতেছে।
কিছু মনে না করলে স্যার একটা কথা জিজ্ঞাসা করি ?
হ্যাঁ, হ্যাঁ.........করো।
কত নিল স্যার ?
"হে হে হে..........বেশি না……..একেকটা ষাইট লাখ......কমেই পায়া গেছি.......কি বল ?"
জি, জি, তা তো বটেই। অসম্ভব সুন্দর আপনার বাড়িটা।
হে হে হে.......সবই তোমাগো দোয়া আর কি........"কিছু মনে না করলে স্যার, আরেকটা প্রশ্ন করি ?
“হ্যাঁ, হ্যাঁ........করো।
আপনার বেতনটা কত ?" বলার সাথে সাথে থানার মধ্যে যেন একটি বজ্রপাত ঘটিল।
"নয়.......ওসি সাহেব কথা শেষ করিতে পারিলেন না........
সকল পুলিশের নজর একত্রে বালকের উপর আসিয়া পড়িল এবং এবং তাহারা অবাক দৃষ্টিতে বালকটিকে নতুনভাবে অবলোকন করিলেন।
"তোতলাইতে শুরু করিলেন ওসি সাহেব। কে-কেন ? এইডা দিয়া তু-তুমি কি করবা ? মাইনষের বেতন জিগানো কু-কুন দেশি ভদ্রতা ? মা-বাপ আদব-কায়দা শিখায় নাই ?"
হা হা হা হা করিয়া হাসিয়া উঠিল বালক.......পুলিশের হর্তাকর্তারা অবাক দৃষ্টিতে বালকের কাণ্ড পর্যবেক্ষণ করিতেছেন.........
পিছনে হ্তভম্ব কিছু পুলিশকে লইয়া আসিল সোজা বাহির হইয়া আসিল বালক
উৎসুক জনতা সহসা এত পুলিশ একত্রে দেখিয়া ভীত হইয়া উঠিল। তাহারাও এক দৃষ্টিতে বালকের দিকে তাকাইয়া আছে। কারন, তাহার পিছনেই পুলিশের দল।
প্রকাশ্য দিবালোকে বালক থানার সামনে প্যান্টের জিপার খুলিয়া দাঁড়াইল………
এবং আবেগের বেগে প্রাকৃতিক ছোট কর্মটি আরম্ভ করিয়া দিলো !!........
চিৎকার দিয়া কহিল, "পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু পুলিশের নামে শুরু করিলাম"
********************************
এই যে ঘটনাটি ঘটিল.......ইহার ফলে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ থামিয়া যায় নাই.......ইহার ফলে সোমালিয়ার ক্ষুধা কমিয়া যায় নাই......ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণালী অক্ষরে এই ঘটনা স্থান করিয়া নিতে পারে নাই...........
তথাপি এই তুচ্ছ ঘটনা তৃতীয় বিশ্বের এক অর্বাচীন বালকের হৃদয়ে বিপ্লবের যে বীজের অন্কুরোদ্গম করিয়া দিয়া গেল, বিজয়ের যে অমূল্য আনন্দে তাহাকে উদ্ভাসিত করিয়া দিয়া গেল.......তাহাতে বোধ করি জগতের সমগ্র পাপ পরাজিত হইয়া গেল.....