হ্যা রাসেল, মা তোর সাথে কথা বলবে। নে কথা বল।
আমি ঘুমে আচ্ছন্ন তবুও ফোনটা ধরি, কথা বলি। ঘুমের মধ্যে থাকাবস্থায় অলসতা হোক কিংবা বিরক্তবোধ হোক সেই সময় কথা বলতে না চাইলেও কিছু কিছু ফোন কিছু মানুষকে উপেক্ষা করা যায় না। কথা বলতে হয়, তাদের কাছাকাছি থাকতে হয়।
আমি ফোনটা নিয়ে বলি, হ্যা দাদী কেমন আছো?
- আমি ভালো আছি ভাই। তুমি কেমন আছো?
হ্যা দাদী আমিও ভালো। তোমার শরীর কেমন আছে? জানতে চাই আমি।
-আমার আর শরীর ভাই। আছে কোনরকম। তুমি কবে আসবা ভাই?
আমি যত কথা সংক্ষেপ করতে চাই, দাদী তত কথা বাড়িয়ে যায়। প্রায়ই দিন এমন হয়েছে যে কথা বলতে ইচ্ছে করেনা তবুও কথা বলে যেতে হয় এমন ভোরে। কথা বলার পর আর ঘুম আসেনা। বুকের মধ্যে কিছু একটা ধুকপুক করে। কানের মধ্যে গুনগুনিয়ে ভেসে আসে কোমল ও মমতাময় এক শব্দ “ভাই”। মনে হয় পৃথিবীর অন্যতম সুখী মানুষ আমি।
তিনি আমাদের ছোটদাদী। বাড়ীর বড়দের দেখেই আমিও ডাকতাম ছোটদাদী। আর দাদাকে ডাকতাম ছোটদাদা বলে। আমাদের বাড়ী থেকে একটা বাগান পরেই ছিলো তাদের বাড়ি। সেই দাদা ও দাদী ছিলেন অসম্ভব রকমের ভালো মানুষ। যখন আমার দাদীর নাতী নাততি হয়ে বড় হয়ে গেছে তখন সেই দাদা দাদী সবে তাদের ছেলে মেয়েদের বিবাহ দিচ্ছেন।
আমরা যারা সেইসময়ে বড় হয়েছি তারা প্রায়ই কখনোই মুরুব্বীদের নাম না জেনেই বড় হয়ে গিয়েছি। অথচ সেই মুরুব্বীদের জন্য বুকের মধ্যে অনেকখানি জায়গা থাকে, থাকে অনেক অধিকার ও ভালোবাসা। তেমনই ছিলো আমার ছোটদাদী। সেই দাদাদাদীর কারো নাম জানতাম না। সবে স্কুলে গিয়ে পড়া শিখেছি। দুই বর্নের শব্দগুলো ভালো করে পড়তে পারি, তিন বর্নের দিলে তুলনামূলক সহজগুলো পারি। আর চার বর্নের দিলে তো আর পারিনা।
সেই সময় দাদীদের বাসায় যেতাম টেলিভিশন দেখতে, আমাদের বাসায় টেলিভিশন অনেক পরে নেয়া হয়েছিলো। টেলিভিশন দেখার জন্য ঘনঘন যেতাম। একটা কাঠের বাক্সের উপর টেলিভিশন রাখা থাকতো, আর আমরা সবাই লাইন ধরে দেখতাম। ছোট হবার কারনে আমাদের আসন হতো একেবারে সামনের দিকে। ঘাড় এদিক সেদিক না করে টেলিভিশনের দিকে একভাবেই তাকিয়ে থাকার এক বিরল রেকর্ড আমাদের ছিলো। বিজ্ঞাপন হলেও এর ব্যাতিক্রম হতোনা, বিজ্ঞাপনও মুখস্ত হয়ে গিয়েছিলো। মাঝে মাঝে কোন কোন দিন শুধুমাত্র বিজ্ঞাপনের সময়গুলোতে এদিকে সেদিকে তাকাতাম, দেখতাম কতজন এসেছে, কারা কারা এসেছে। একদিন সেই বাক্সের পায়ের দিকে চোখ গেলো, দুইদিকে কিছু একটা লেখা ছিলো। চার অক্ষরের বানান। ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়লাম। তবুও অর্থ উদ্ধার করতে পারিনা।
বেশ কয়েকদিন যাবার পর অনেক চেষ্টায় উদ্ধার করতে পেরেছিলাম যে বাক্সের দুই দিকে লেখা আছে রমজান ও মরিয়ম। এই দুইটা কার নাম বুঝতেই পারিনা। আমি এসেই মা কে জিজ্ঞেস করি। মা বলে তোমার দাদা দাদীর নাম। সেদিনই জানলাম দাদা ও দাদীর নাম।
একদিন সন্ধ্যাবেলা রমজান দাদা এলেন আমাদের বাসায়। উঠোনে বেঞ্চ পাতা, বাসার সবাই তখন ঘরের বাইরে বারান্দায় বসে আছি। তখনকার সময়ে এত নিয়মিত বিদ্যুৎ থাকতো না। উঠোনে কিংবা ঘরের বারান্দায় শুয়ে বসে থেকে কেটে যেত অর্ধেক রাত। শেষ রাতে যখন বিদ্যুৎ আসতো তখন সবাই যার যার ঘরে যেতাম। অথচ অনেক রাতেই আমাদের ঘরের বাইরে বারান্দায় পাটি বিছিয়ে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিতে হয়েছিলো বিদ্যুৎ এর আশায়।
রমজান দাদা আমার দাদার কাছে বলে, ভাই আমি চিন্তা করছি সামনের চৈত্রমাসে আমার ঐ পাঁচ বিঘা দাগে পাকা ঘর উঠাবো।
দাদা বলে পাঁচ বিঘা দাগ তো মাঠের মধ্যে, ওখানে কিভাবে থাকবি? চুরি চামারি তো লেগেই আছে। অমন যায়গায় একা একা থাকা যায় নাকি? মানুষ নাই জন নাই।
ছেলেরাও চাচ্ছে ওখানেই ঘর উঠুক। তাছাড়া এখানের ৬ কাঠা জমিতে চার ছেলের একসাথে থাকা হবেনা। তারচেয়ে ওখানে গেলে চারভাই একসাথে থাকতে পারবে।
দাদা কিছু বলেনা। চুপ করে থাকে। একজন ভাই তার থেকে একটু দূরে চলে যাচ্ছে। এখন আর ঘুম থেকে উঠেই তার সাথে দেখা হবেনা। বুদ্ধি হওয়ার পর এই শেষ বয়সে এসে এই নিয়মে ছেদ পড়বে। একটু খারাপ লাগছে তাই।
দাদার নীরবতা ভেঙ্গে রমজান দাদা বলে ওটা মেইন রোড। একসময় ওখান থেকে ব্যাবসা বানিজ্যও হবে। ছেলেপিলে কিছু করে খেতে পারবে।
দাদা কিছু বলেনা, শুধু ঢোক গিলার শব্দ হয়। সেই শব্দ নীরবতার পরিবেশটায় ঢোক গেলার শব্দ যেন নীরবতার ছেদ ঘটায়। তারপর আবার থ থ করে দেয়। শূন্য করে দেয় বুকের ভেতর।
কোন একদিন দেখি রমজান দাদার পাঁচ বিঘার দাগে বালু আসে, ইট আসে স্তুপাকারে জমা হয়। আমার দাদাকে ডেকে বাড়ীর পুতাও দিয়ে দেয়। আপাতত মাথা গোঁজার জন্য তিনটা ঘর উঠানো হয়।
দাদা দাদীরা একসময় চলেও যায় তাদের সেই নতুন বাড়িতে। আমার দাদা মন ভার করে থাকে। রমজান দাদা নিয়ম করে যে প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমাদের বাড়ী আসতো সেটাও তখন থেকে অনিয়মিত হয়ে যায়। নতুন বাড়ীতে নানা কাজে ব্যাস্ত হয়ে যায়। ছোট দাদী আমাদের বাড়িতে আসাটা বেড়ে যায়। দাদীর কাছে বসে কান্নাকাটি করে। একা একা তার সেখানে মন টিকেনা।
এরপর একসময় দাদাদাদীকে রেখে বাবা মায়ের সাথে আমিও মেহেরপুর চলে যাই। তারপর যখন মাঝে মাঝে আসতাম রমজান দাদা আর মরিয়ম দাদীর সাথে এসেই দেখা করে আসতাম। একসময় মেহেরপুর থেকে আমি ঢাকায় চলে আসি, পড়াশোনার উদ্দেশ্যে। তখন গ্রামে যাওয়া আগের চেয়ে কম হয়ে যায়। গ্রামে গেলেই ছোটদাদা আর ছোটদাদীর কাছে ছুটে যেতাম। আমার ভাই এসেছে ভাই এসেছে বলে বাড়ী মাথায় করে রাখতো। নিজেই চেয়ার এনে দিতো বসার জন্য। দাদীর তখন ছোট ছোট সবে নাতি নাতনি হয়েছে। তারা আমায় ঘিরে ধরে। সেইসব ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের চোখে বিস্ময়। আমি ঢাকা থেকে এসেছি, আমার আলাদা এক কদর যেন। মুড়ি, মুড়কী, নাড়ু কিংবা খাবার যা কিছু ঘরে থাকতো তাই এনে দিতো আমার সামনে। পড়াশোনা কয়দিন আছে, কয়দিন ছুটি, কবে আবার ঢাকা যাবো, নানান প্রশ্নে আমায় ব্যস্ত করে রাখতো।
দাদীর সবচেয়ে ছোট ছেলে বুলবুল আমার চেয়ে ৩ মাসের ছোট। আমার সাথে দাদীর কথা বাড়তে থাকে, আবার খানিকক্ষণ পরে দাদীই বলে যাও ভাই বুলবুলের কাছে যাও গল্প করো। যতদিন গ্রামেই থাকি দাদীর বাড়ী গেলে দাদী চেয়ার এগিয়ে দিতো, বসে বসে গল্প করতো, মনের কষ্টগুলোর কথা বলে নিজে হালকা হতো।
***
আমি একদিন সন্ধ্যায় ঢাকা থেকে আমার দাদীকে ফোন দিয়েছি। আমার দাদীর সাথে কথা বলতে বলতেই পাশ থেকে একজন আমার দাদীকে জিজ্ঞেস করে কে ফোন করেছে বুবু। দাদী বলে আমাদের রাসেল ফোন দিয়েছে।
আমি দাদীকে জিজ্ঞেস করি তোমার পাশে কে দাদী?
দাদী বলে তোর ছোটদাদী।
আমি দাদীকে বলি দাও তো কথা বলি।
ওপাশ থেকে ফোন ধরেই ছোটদাদী জিজ্ঞেস করে ভাই কেমন আছো?
আমি বলি ভালো। তুমি কেমন আছো?
আমি আছি কোনরকম। তুমি কবে আসবা ভাই?
কথা গড়িয়ে যায় অনেকক্ষণ। আমিও ফোন রেখে দিই। তারপর থেকে ছোটদাদী প্রায়ই বুলবুল চাচার মোবাইল দিয়ে কল দিতো, কথা হতো বেশ সময় ধরে। আমিও ফোন দিয়ে কথা বলতাম । এক ধরনের টান হয়ে গিয়েছিলো কথা বলার জন্য।
বেখেয়ালে কিংবা ব্যস্ততার কারনে মাঝের অনেকদিন ফোন আর দিতে পারিনি। এর মধ্যে অনেক সময় গড়িয়েছে। ছোট দাদীর আর খোঁজ পাইনা, ছোটদাদীও আর ফোন দেয়না ।
বুলবুল চাচাকে একদিন ফোন দিই। চাচা বলেন, মা পরে গিয়ে কোমরে খুব আঘাত পেয়েছে। স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা করতে পারছেনা।
বুকের মধ্যে ধক করে উঠে, বিষণ্ণতা ছুঁয়ে যায় সারাক্ষণ। এমন সুস্থ ও জলজ্যান্ত মানুষ বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাতরাচ্ছে ভাবতেই চোখটা ছলছল করে উঠে । মন টা খারাপ হয়ে যায়।
আমি জিজ্ঞেস করি কতদিন এমন অবস্থায় আছে?
দশ বারোদিন মত। চাচা নির্লিপ্তভাবে উত্তর করেন।
ঈদের সময় গ্রামের বাড়ী গিয়ে ছোটদাদীর কাছে ছুটে গেলাম।
আমায় ধরে ছোটদাদীর কান্না। ভাই আমি আর হাটাচলা করতে পারবোনা, তোমায় আর চেয়ার এগিয়ে দিতে পারবোনা, তোমায় খাবারের থালা এগিয়ে দিতে পারবোনা ভাই। দাদী অঝোরে কেঁদে যান। কান্না থামিয়ে কথার এক পর্যায়ে বলেন ভাই তুমি তোমার চাচাদের বোঝাও। আমি আর পারিনা ভাই।
আমি বলি কি হয়েছে চাচাদের?
জমি ভাগ হচ্ছে। পুকুরের ধারে যায়গা কেউ নিতে চাচ্ছেনা। এই নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে মারামারি। তোমার দাদাকে আর কেউ মানছেনা। বলতে বলতে আবার কেঁদে উঠেন।
একটু পরে আমার হাতদুটো ধরে আকুতির সুরে বলেন ভাই তুমি বললে ওরা সবাই শুনবে, তুমি ওদের বলো, ওদের বোঝাও। তুমি শিক্ষিত মানুষ তোমার কথা ওরা শুনবে।
আমি মাথা নত করে ফেলি, আমার প্রতি এত ভালোবাসা এত বিশ্বাস আমাকে অবশ্যই মাথা নত করে থাকতে হবে, এই ভালোবাসা আমাকে উদ্বেলিত করে। কথা আটকে যায় গলায়। আমি দাদীর দিকে তাকাতে পারিনা, চলে আসি।
বুলবুল চাচার কাছে বিস্তারিত সব শুনি। তারপর ছোটদাদীর সম্পর্কে জানতে চাই। জিজ্ঞেস করি দাদীকে চিকিৎসা ক্যানো করাচ্ছিস না।
চাচা বলে ঝামেলা মিটুক তারপর রাজশাহী নিয়ে যাবো। এখন ভেড়ামারার ডাঃ এর ওষুধগুলো চলুক।
তারপর ধীরে ধীরে সময় কেটে যায়। ছোটদাদীর চিকিৎসা চলতে থাকে, অবস্থার উন্নতি আর হয়না। একটা জাগায় স্থির থেকে যায়। ছোটদাদী আর কখনই স্বাভাবিকভাবে হাটাচলাফেরা করতে পারবে না তখন থেকে এটা আমরা ধরেই নিয়েছিলাম তবুও মনের মধ্যে সবসময় খচখচ করে। একটা কি যেন মন টা ভার করে রাখে সবসময়।
***
রোজা শুরু হয়েছে। সেহরি খেয়ে আমি শুয়েছি। বুলবুল চাচা ফোন করেছে। কথা বলতে বলতে একপর্যায়ে ফোনটা ছোটদাদীর কাছে দিয়ে দেয়।
ভাই কবে আসবা?
আমি বলি দাদী আমি ২৫-২৬ রোজায় বাসায় যাবো।
আগে আসতে পারবানা ভাই?
না দাদী যাওয়া হবেনা, আমার ক্লাশ চলবে।
দাদী বলে আমাদের হাফিজার বিয়ে, তুমি আসতে পারলে ভালো হতো।
হাফিজা মানে আমাদের হাশেম চাচার মেয়ে? জানতে চাই আমি।
দাদী বলে হ্যা ভাই আমাদের হাশেমের মেয়ে।
কিন্ত ওর তো বয়স কম, এত অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া কেনো?
ভালো ছেলে পেলাম ভাই, তাই বিয়ে দিয়ে দিচ্ছি।
আমি বলি মেয়েটা ইন্টারমিডিয়েট পাশ করুক, তখন বিয়ে দিলেই তো ভালো হতো।
দাদী বলে বাদ দাও ভাই, হাশেম অমন ছেলে হাতছাড়া করতে চাইছে না।
আমি আর কথা বাড়াতে পারিনা, জিজ্ঞেস করি বিয়ে কবে?
দাদী বলে এই তো ভাই সামনের শুক্রবার। মানে ১৬ রোজার দিন।
আমি বলি, দেখি দাদী ছুটি করতে পারি কিনা। পারলে আমি যাবো দাদী।
অথচ আমার যাওয়া হয়নি বিয়েতে। সরাসরি কখনোই না আমি বলতে পারিনা ছোটদাদীকে, কোনদিন পারিও নি।
তারপর ঈদের সময় বাড়ী গেলাম। ছোটদাদী তার নাতী জামাইয়ের গল্প করে। বিয়ের দিনের গল্প করে। চোখেমুখে তার আনন্দের ঝিলিক। সুখী একটা মানুষ। নির্মল ও শুদ্ধ হাসির রশ্মি ছড়িয়ে পড়ছে। ছড়িয়ে দিচ্ছে সুখ ও শান্তির পাখনা।
***
এরমধ্যে একবছর হয়ে গিয়েছে।
আবারো সেই ঈদের সময় গ্রামে গিয়ে যখন ছোটদাদীর কাছে গেলাম। মনটা খারাপ হয়ে গেলো। ছোটদাদী এবার একেবারেই বিছানাগত। আগে হাটা চলাফেরা করতে না পারলেও উঠে বসে বা লাঠি দিয়ে চলাফেরা করতে পারতো। এখন আর নিজ থেকে কোন কিছু করার সামর্থ নেই। কোন কিছুতে সাড়া শব্দও নেই।
আমি গিয়ে বিছানায় ছোটদাদীর পাশে বসতেই আমার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিলো, শুষ্ক সেই হাসি। সেই হাসি আমার মন ভালো করেনা, আরো ভার করে দেয়। এমন স্থির না থাকা মানুষ টা একসময় সারা বাড়ী দাপিয়ে বেড়াত, সদা হাস্যময়, সদা চঞ্চল মানুষটা আজ নির্জিব, নিস্তেজ শুধুমাত্র চোখের মধ্যে প্রাণ টা নিয়ে জড়সড় হয়ে শুয়ে আছে বিছানার এক কোনায়।
ছোটদাদী জিজ্ঞেস করে ভাই কবে আসলা? কথাগুলো জড়িয়ে আসে।
আমি বলি গতকাল এসেছি দাদী।
বুলবুল আমার ভাইকে একটা চেয়ার এনে দে। কথা টা বলেই জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেয় দাদী। মনে হচ্ছে এতটুকু কথা বলে বেশ ক্লান্ত হয়ে গেছে।
দাদীকে কেউ একজন উঠিয়ে দেয়। আমি দাদীর হাতটা ধরি।
বলি দাদী তুমি কান্না করছো ক্যানো?
বিড়বিড় করে কি যেন বলে, বলেই কান্না। কথাগুলো জড়িয়ে যাচ্ছে।
তুমি সুস্থ হয়ে যাবা দাদী। চিকিৎসা করালে সুস্থ হয়ে যাবা।
পাশে বসে থাকা ফুপু ওড়না দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলে উঠে কয়দিন থেকে মা কিছুই খেতে পারছেনা। তুমি একটু জুস টা খাওয়াতে পারো কিনা দেখো।
নাও এখন একটু জুস খাও বলে আমি একটা গ্লাস এগিয়ে দিই।
ইশারায় গ্লাস সরিয়ে দেয়। বিড়বিড় করে বলে আমি আর সুস্থ হবোনা ভাই, আমি আর বাচবোনা। বলেই কান্না শুরু করে দেয়। নির্জিব চোখ দুটোতে আকুতি স্পষ্ট ধরা দেয়, এমন একটা কাথার ভাজের মত শরীর থেকে এত কান্নার পানি কোথা থেকে আসছে আমি বুঝতে হিমশিম খাই। আমি দাদীকে কাছে টেনে নিই। এই কান্নার অর্থ আমি খুব টের পাই। আমার কথাও আর আসছেনা, চোখ ছলছল করে উঠে।
সেদিন অনেকক্ষণ বসেছিলাম। বাড়ি ফিরে আর ঘুম আসেনা। পরেরদিন আবার যাই, দেখি দাদী ঘুমিয়ে আছে। ঘুম ভাঙ্গিয়ে ডেকে তুলতে ইচ্ছে করেনা। অনেকক্ষণ ছোটদাদীর বিছানার পাশে বসে চাচার সাথে, ফুপুর সাথে গল্প করি। আবার পরের দিন গিয়ে দেখি দাদী ঘুমাচ্ছে। সেদিনও ডাকতে ইচ্ছে হয়নি। একদিন পর আবার আমি ঢাকা ফিরে আসি। আর দাদীর সাথে কথা বলা হয়নি। দাদীকে শুধু ঘুমন্তবস্থায় দুটো দিন দেখে গেলাম।
***
অগ্রহায়ণ মাস। সবে ঢাকায় একটু ঠান্ডা শুরু হয়েছে। কাথামুড়ি দিয়ে ভোরের দিকে বেশ ঘুম আসে। সকালের দিকে একটু আলসেমি আসে। ঘরের জানালাগুলো সব লাগিয়ে রেখেছি, একেবারে নিকষ অন্ধকার। কাথা জড়িয়ে ঘুমে আচ্ছন্ন আমি । ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখি- আমি শৈশবে ফিরে গিয়েছি। একটা আঁকাবাঁকা গ্রাম্য রাস্তা বেয়ে যাচ্ছি আমি, সাইকেল চালিয়ে। আমার সাথে আরো অনেকে আছে। গ্রামের যে ছোট্ট কালভার্ট আছে সেখানে আমরা সবাই একসাথে। সবার কাছে সাইকেল, নতুন নতুন মডেলের সাইকেল। আর আমার কাছে বাসার সেই পুরনো হিরো সাইকেল টা। কে আগে নদীর ঘাটে যেতে পারে, এই জন্য কালভার্ট থেকে সব একসাথে যাত্রা শুরু হবে। যাচ্ছি যাচ্ছি, সবাই যাচ্ছি। আমি আধাপ্যাডেল মেরে যাচ্ছি, ফুল প্যাডেল মারতে পারছিনা। আমার সঙ্গীরা সবাই আমাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে অথচ আমি পিছিয়ে পড়ছি। জোরে জোরে প্যাডেল দিচ্ছি তবুও ধরতে পারছিনা কাউকে। মন খারাপ লাগছে তবুও জোর চেষ্টা করে যাচ্ছি। সবাই আবার নদীর পার থেকে ফিরে আসছে। আমায় দেখে তারা জোরে জোরে সাইকেল এর বেল বাজাচ্ছে। এতই তীব্র যে আর সহ্য করতে পারছিনা।
ঘুম ভেঙ্গে যায় আমার। দেখি কানের কাছে মোবাইল বাজে, জনি ভাই ফোন করেছে। মোবাইলের রিংটোন কানের মধ্যে সাইকেলের বেল বাজার মত করে বেজেই যাচ্ছে। একটু আরামে ঘুমাতে চাই তাই ফোনটা সাইলেন্ট করে রাখি, অথচ আবার কি মনে করে ফোন টা রিসিভ করি।
বিড়বিড় ও ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলি হ্যা জনি ভাই.....।।
জনি ভাই বলে উঠে ছোটদাদী মারা গেলো একটু আগে। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহী রাজিউন।
আমি ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসি। জিজ্ঞেস করি কি বলেন? কখন মারা গেলো?
এইতো ফজরের আজানের পর, পাঁচটার দিকে। আর শোন আমি তোরে পরে আবার ফোন দিচ্ছি বলে জনি ভাই ফোনটা রেখে দিলো।
আমি ফোনটা কানে নিয়েই বসে থাকে। কয়টা বাজে এখন? এখন বাস ধরলে কি বাসা পৌছাতে পারবো? মোবাইল টা সামনে নিয়ে সময় টা দেখা দরকার অথচ ইচ্ছা করেনা। মোবাইলটা কানে নিয়েই আমি বালিশে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ি। স্বপ্নের বাকিটুকু দেখা দরকার। চোখ বন্ধ করি, দেখি আমার বন্ধুরা আমাকে রেখে রাস্তার উল্টোদিকে চলতে শুরু করেছে। এখন আর সাইকেলের বেল বাজার আওয়াজ আসেনা। কানের মধ্যে একটা সুর ভেসে আসে, গুনগুনিয়ে বাজতে থাকে একটা মধুর কোমল ও মমতাময়ী এক ডাক “ভাই তুমি কবে আসবা?”
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে অক্টোবর, ২০১৯ রাত ১১:১৯