আমার নানুবাড়ী ছিলো উপজেলা শহরে। আমরা তখন গ্রামে থাকতাম বলে শহরে সবসময় খুব আগ্রহ নিয়ে যেতে চাইতাম। কি একটা কাজে বাবা নানুবাড়ী গিয়েছিলো, সাথে যথারীতি আমিও। সেদিন রাত্রে থেকে পরের দিন আবার বাবার সাথে চলে আসলাম। এসেই নামলাম ডাংমড়কা। ডাংমড়কা হচ্ছে আমার গ্রামের বাড়ি থেকে ৫ কিমি দুরের একটা জায়গা এবং নিকটতম জায়গা যেখান থেকে সদরের বাস চলাচল করে।
সেখানেই আমার বাবার ব্যাবসা, সেখানেই গদিঘর। ডাংমড়কা নেমেই গদিঘরে যেতেই বাবা ব্যাবসার কাযে হঠাৎই যেন ব্যাস্ত হয়ে গেলো। আমার দিকে তাকানোর সময় নেই। আমি একা একা এই সেই করে বেড়াচ্ছি, মন খারাপ করে বসে আছি। বাবা খানিকবাদে বাইরে গেলেন। গেলেন তো গেলেনই, ফেরার আর নাম গন্ধ নাই। যতই সময় যাচ্ছিলো ততই রাগ হচ্ছিলো বাবার উপর।
বেশ খানিকটা সময় গেলে বাবা আসলেন। আমার শুষ্ক আর মলিন মুখটা দেখেই কিনা আমায় নিয়ে হোটেলে গেলেন। ডাংমরকা তে তখন দুইটা হোটেল। সবচেয়ে ভালো হোটেলটা চকচকে নতুন ঢেউটিন দিয়ে ঘেরা, উপরে চাটাই দিয়ে তার উপর ঢেউটিনের ছাউনি, প্লাস্টিকের চেয়ার আর কাঠের টেবিলের উপর নীল খয়েরি পলিথিন বিছিয়ে দেওয়া থাকতো সবসময়। হোটেলটার মাঝে টিউবওয়েল ছিলো। অন্য হোটেলে এত কিছু ছিলোনা। সেই হোটেলে গেলে একটা আভিজাত্যপূর্ন ভাব আসতো। সেই হোটেলে বসে আমার প্রিয় ঝোলের মিষ্টি খেলাম, একেবারে পেট পুরে। বাবার বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা লেগে যাবে। এখন সবে জোহরের আজান দিয়েছে, অর্ধেক বেলা। খাওয়া শেষে বাবাকে তাড়া দিতে লাগলাম বাসায় যাবার জন্য। একটু পরপর বাবাকে গিয়ে বলি চলো বাবা চলো, বাসায় চলো। বাবার ব্যাস্ততার জন্য হয়তো চাইলেও যেতে পারছিলো না। অথচ আমার বাসায় যাওয়ার জন্য ছটফট লাগছিলো।
অগত্যা ঘ্যানঘ্যানানি থেকে বাচার জন্য নিরুপায় হয়ে বাবা গ্রামের একজনের চলতি ভ্যানে আমায় উঠিয়ে দিলো। আমায় বাজারে নামিয়ে দেবে। বাজার থেকে বাড়ী একা একাই যেতে হবে আমায়। বাজার থেকে আমি একা যেতে পারবো কিনা বাবা বারবার আমায় জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হওয়ার পর ভ্যানে উঠিয়ে দিয়েছে। আমি বাবাকে নিশ্চিত করেছি- আজ তো আদাবাড়ীর হাট, অনেক মানুষ থাকবে। আমার যেতে সমস্যা হবে না।
আমাদের গ্রামের বাজার থেকে থেকে বাড়ী যাবার রাস্তা ২ টা। ডান দিক দিয়ে গেলে ১ কিমি চেয়েও কম হয়, আর বামদিকে ১ কিমি চেয়ে একটু বেশিই হয়। বাজার নেমে আমি সোজা হাটের মধ্যে গেলাম। বাতাশা খুরমা কিনতে হবে। আসার সময় বাবা টাকা দিয়েছিলো।
খুরমা বাতাশা কিনে বাজার থেকে ডান দিকের রাস্তায় কাদা মাড়িয়ে কিছু দুর যাবার পর রুস্তম পাগলের সাথে দেখা হয়ে গেলো। আর তখনই সঙ্গে সঙ্গেই মনে হলো এই রাস্তার মাঝে যে পুল (কালভার্ট) আছে তার পাশেই তো রুস্তম পাগলের বাড়ি। রুস্তম পাগলকে আমরা চতুর পাগল নামেই জানতাম। চতুর পাগলকে দেখেই আমার বুকের মধ্যে ধুকপুক শুরু হয়ে গেলো। ক্যানো যে বাবাকে আগ বাড়িয়ে বলতে যাবার সময় একবারো চতুর পাগলের কথা মনে হলোনা, নইলে কি আর এই বিপদে পড়তে হতো। নিজের বেশি বোঝার জন্য এখন চতুর পাগলের সামনে পড়তে হলো। এখন যদি কামড়ে দেয়? চতুর পাগল যেভাবে তাকিয়ে আছে চোখের দিকে তাকালেই তো রক্ত হিম হয়ে যায়। নিজের চুল নিজেরই ছিড়তে ইচ্ছে করছিলো। নিজের অমন অসহায়ত্বের জন্য খুব কান্না পাচ্ছিলো। কি এমন হতো বাবার সাথে সন্ধ্যায় একসাথে আসলে?
চতুর পাগলের চোখে চোখ পড়তে যেইনা সে পা বাড়িয়েছে অমনি আমি কাদা ভেঙ্গে দৌড়ে বাজারে চলে আসি। হাফাতে হাফাতে এসে শুকনো স্থানে দাঁড়ালাম পরিচিত কাউকে পাবার আশায়, পেলেই তার হাত ধরে চলে যাবো। অথচ অনেক্ষন দাঁড়িয়ে থেকেও কাউকেই বাজার থেকে বাড়ি যেতে দেখলাম না, সবাই বাড়ি থেকে বাজারে আসছে। সময়ে যেই জিনিস টা চাই সেটা কখনোই হতে চায়না। গত শুক্রবারেই তো আমি বাজারে আসবো অথচ কাউকেই বাজারে যেতে দেখলাম না, আর আজ সবাই যেন বাজারে আসার প্রতিযোগীতায় নেমেছে। বাজার থেকে যে বাড়ি যেতে হবে সেটা মনে হচ্ছে সবাই ভুলে গেছে আজ।
বাজারে আমি আইয়ুব কাকার দোকানের সামনে মাচানে গিয়ে বসে আছি। অথচ কাউকে এ পথে যেতে দেখছিনা, সবাই শুধু আসছে তো আসছেই। বাজারের বাম দিকের রাস্তা দিয়ে যাবো সেই সাহস পাচ্ছিনা। একে তো দুরের রাস্তা তার উপর কখনো যাইনি সেই রাস্তায়। তাই চিন্তা বাদ।
মাচানে বসে ভাবতে লাগলাম আচ্ছা চতুর পাগল এখন কি করছে? চাকু বা ছুড়ি নিয়ে কি বসে আছে তার বাড়ির সামনে? থাকার কথা, একটু আগেই না গেলো সে। আমাকে যখন দেখেছে নিশ্চয় বাসার সামনে বসে আছে। এসব ভাবনা আমার রক্ত হিম করে দেয়। বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যায়।
এখন তো চতুর পাগল বাড়ির সামনে বসে অপেক্ষা করছে, আমার যেতে দেরী হচ্ছে দেখে সে যদি বাজারে চলে আসে? তখন আর রেহাই পাবো না। যা করার এখুনি করতে হবে। ইশ যদি পাখির মত উড়তে পারতাম।
আইয়ুব কাকা আমাকে নতুন শার্ট অথচ কাদামাখা পা দেখে বললেন কিগো ব্যাটা মাউরের মত একা বসে আছো ক্যানো?
আমি বললাম এমনিই কাকা। তারপর খানিক এদিক সেদিক করে চাচাকে জিজ্ঞেস করলাম আচ্ছা, আজিত দাদা (উনার বাবা) বাজারে আসেনি আজ?
আব্বা তো চলে গেলো সাইকেল নিয়ে।
কাকার এই কথাটা আমার আশার প্রদীপের আলোটুকুও নিভিয়ে দিলো এক নিমিষেই। নিকষ অন্ধকারে ছেয়ে গেলো আমার মন।
আমি আরো অন্য কারোর জন্য অপেক্ষায় থাকলাম। মাচানে বসে আছি তো আছিই। হয়তো দেখবো বাজার শেষ করে দাদা কিংবা বড়চাচা বাড়ির দিকে যাচ্ছে। আমি তাদের সাথে চলে যাবো। সেই আশাতেই রইলাম।
আচ্ছা চতুর পাগল কি সত্যিই মানুষের মাংশ খায়? ধুরু মানুষ আবার মানুষের মাংশ খায় নাকি-নিজের মনকে শান্ত্বনা দিই। কিন্ত নাসিম ভাই যে বলে তাকে একবার চিমটি দিয়ে তার শরীর থেকে মাংশ উঠিয়ে নিয়েছিলো। নাসিম ভাই হয়তো মিথ্যা বলেছে এই ভেবে মনকে আবারো শান্ত্বনা দিই। কিন্ত নিজে শান্ত হতে পারিনা। ওপাড়ার রহমান সেদিন আমাদের দোকানে এসেছিলো, সেখানেই চতুর পাগল রহমানকে কামড় দিয়ে তার মাংশ খেয়েছিলো। রহমান এর সেকি কান্না। আমার সাথে চোখ পড়াতে তেড়ে এসে আমাকে বলছিলো "তোর গোত্ত খাবো"। সেদিন তো ইলিয়াসকে দেখেই চোখের পাতা উল্টিয়ে হাত দুটো দুই কানে নিয়ে আঙুল নাড়াতে নাড়াতে বলে "রসুন দিয়ে তোর গোত্ত (গোশত) খাবো"। এগুলো তো আর মিথ্যা না। নিশ্চয়ই চতুর পাগল মানুষের মাংশ খায়।
আমি মাচানে ভয়ে ভয়ে বসেই থাকি। দেখি দূরে কে একজন আসছে নীল জামা গায়ে।
চতুরই তো।
আমি উঠে এক দৌড়। সোজা গিয়ে নেমে পড়লাম ঈদগাহ এর পেছন বরাবর মাঠ দিয়ে।সেই মাঠকে আমরা জোল বলতাম। বাজার থেকে এই মাঠ দিয়ে আমাদের বাড়ি ৫-৭ মিনিটের রাস্তা, শুকনার সময় বাবার সাথে কত গিয়েছি। অথচ বর্ষাকালে মাঠটা সম্পূর্ন পানির নিচে থাকে যার জন্য যাওয়া আসাটাও বন্ধ।
আমি পড়িমরি করে সেই জোলের মধ্যে দিয়ে দৌড় দিলাম। পায়ের কনুইয়ের চেয়ে সামান্য বেশি পানি ছিলো- আমি সেই পথ বরাবর চলেছি। এক হাতে চামড়া স্যান্ডেল আর অন্য হাতে বাতাশা খুরমা। বেশ খানিক্ষন চলার পর আমি আবিস্কার করলাম-আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি। পেছনে ফিরে যাওয়ার পথ ভুলে গিয়েছি, সে পথ আর চিনতে পারছি না। আবার সামনে যে তোজাম নানার বাশবাগান ছিলো সেটাও দেখতে পাচ্ছিনা। তোজাম নানার বাশবাগান না পেলে তো পুকুরে ডুবে যাবো। ওপারার সিরাজ মেম্বারের কতগুলো পুকুর এক জাগায় আছে-গুনেই শেষ করা যায়না।
ততক্ষনে আমি হাটু পানি মাড়িয়ে এসেছি, কোমর ছুই ছুই পানি। মাঠের চারিদিকে পানি আর পানি। কেউ নাই -শুধু আমি। সত্যিই আমি কান্না শুরু করে দিয়েছি তখন। আমি ধরেই নিয়েছি হয়তো আর বাড়ি যেতে পারবোনা কোনদিন। মা, বাবা, দাদা-দাদির সাথে আর কোনদিন দেখাও হবেনা। যতই ভাবছি ততই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে, বিষন্নতায় সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। বুকের ধুকপুকানি টা তখন ঢিবঢিব শুরু করে দিয়েছে।
কিছুদূর যাই যাই করে অনেকদুর এগিয়ে আসলাম, পানি কোমড় ছাড়িয়েছে-সেদিকে চিন্তা নাই। আমার মনে হচ্ছে দুরের ঐ গাছগুলোর কাছে যেতে পারলে দেখবো দাদী আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। দাদীর কথা মনে হতে পানিতে ভয় আরো জাকিয়ে বসলো। সবসময় দাদী পুকুরে বা নদীতে গোসল করতে বারণ করতো-
বলতো পুকুরে কাথাজরা আছে।
আমি দাদিকে বলতাম আচ্ছা দাদী কাথাজরা টা আবার কি?
কাথার মত একটা জন্তু, বাচ্ছা ছেলেপিলে দেখলে কাথার মত করে তার শরীরের মধ্যে জড়িয়ে নেয়। চাপ দিয়ে মেরে ফেলে।
এগুলো মনে হতেই ভয়টা আরো জাকিয়ে বসলো। কখনো এমন অসহায়ের মত থেকেছি বলে মনে হলোনা। চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। এত পানি অথচ কেউ নৌকা বা ভেলা নিয়ে এদিকে সেদিকেও আসছে না, অন্যসময় তারা ভেলা নিয়ে মাছ ধরে বেড়ায় সারাক্ষন। চারিদিকে শুনশান নীরবতা। হুট করেই পানিতে কি নড়াচড়া'র শব্দ হলো। দাদীর সেই কাথাজরা ভেবে আমি পড়িমরি করে আরো জোরে দৌড়াতে লাগলাম। অন্যসময় দাদী কাথাজরা'র কথা বললে আমি হেসেই উড়িয়ে দিতাম। অথচ এখন পানিতে নড়াচড়া'র শব্দ শুনে মনে হলো- সত্যিই কাথাজরা বলে কিছু একটা আছে।
দৌড়ে শ্যালো মেশিন ঢাকা দেওয়া আছে এমন একটা জাগায় এসে পৌছালাম। ছোট্ট একটা ঘর, পাটকাঠির বেড়া আর উপরে খড়ের ছাউনি দেওয়া। সেই ঘরে শ্যালো মেশিন রাখা। ঘরের চারপাশের সেই যায়গাটা উঁচু। সেখানে এসে মনে পড়লো আমি আমার পরিচিত এলাকায় এসে পড়েছি। এই যে শ্যালোর পাশে বাবলা গাছ, তারপাশে শিশু গাছ। গাছ দুটোর পাশে একটা মাচা। গরমের সময় এই মাচায় গামছা প্যান্ট রেখে শ্যালো তে কত গোসল করেছি।
শ্যালো যখন চিনেছি, তখন বাসা আমি ফিরতে পারবো এই সাহসটুকু হয়ে গেলো আমার। শ্যালোর ড্রেন যেইদিক দিয়ে গেছে সেটা ধরে
গেলেই তো আকিমদ্দি দাদার বাগান, আর আকিমদ্দি দাদার বাগানে যেতে পারলেই আমি বাড়ি পৌছে যাবো নিশ্চিত। ড্রেনের ধার দিয়ে যেতে যেতে পা পিছলে পড়ে গেলাম ড্রেনের মধ্যে। গলা অবধী পানি। আমার বাতাশা খুরমা সব ভিজে একাকার, হাত ফসকে সব পানিতে পড়ে গেলো। মন খারাপ চেয়ে ভয়টা বেশি হয়ে গেলো। কেননা সামনে এখন পাটক্ষেত, ছোট ছোট পাট গাছ যার সবটুকুই পানিতে তলিয়ে আছে। পাটক্ষেতের উপর দিয়ে যাবো ভাবতেই গা শিউরে উঠলো। বাবার কাছ থেকে শোনা পাটক্ষেতের মধ্যে জোঁক থাকে, যেনতেন জোঁক না একেবারে বড় বড় জোঁক পাট গাছ বা জলজ গাছে থাকে। বড়চাচা একবার এই জোলে বিত্তি নিতে এসে জোকে কামড় দিয়েছিলো। কি যে কষ্ট করলো বড়চাচা, কত রক্ত ঝরলো। সেই কথাগুলো ভেবে ওপথে আর না গিয়ে আবার ডান দিকে চলে গেলাম। অনেক সময় এদিক দিয়ে ওদিক দিয়ে হেটে একটা বাগান পেয়ে সেখানে গিয়ে উঠলাম। হাত পা সব জড়ো হয়ে কুচকে গেছে। পায়ের তালু আর হাতের তালু সব সাদা হয়ে আছে।
কে গো ছেইলিডা? একজনের কথায় পিছনে ফিরলাম। একজন বয়স্ক মহিলা আমায় ডাকছেন।
আমি কি উত্তর দেবো তার আগেই উনি আমায় বললেন তুমি ম্যাডামের ছেলে না?
আমি তখন কাপছি ঠান্ডায়। তার মধ্যেই হ্যা সূচক মাথা ঝাকালাম।
কোথা থেকে আসছো তুমি? বলেই তিনি আমার কাছে এগিয়ে আসলেন।
বাজার থেকে।
তো এই জোল দিয়ে ক্যানো?
আমি কান্না শুরু করে দিলাম। তিনি আমায় তার শাড়ীর আচল দিয়ে মাথা, গলা, হাত মুছিয়ে দিলেন। আমাকে ধরে তার বাড়ি নিয়ে গেলো। আমিও গেলাম অসহায়ের মত। টিউবওয়েল পানি দিয়ে হাত মুখ ধুইইয়ে দিলেন। আমি মহিলা কে তখনো চিনতে পারিনি। চেনা চেনা লাগলেও আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আকিমদ্দির বাগানে যে আসতে পারিনি সেটা বুঝে গিয়েছি ততক্ষনে।
সন্ধ্যা নেমে আসছে। আমি মহিলাকে বললাম আমি বাড়ী যাবো।
বাড়ি চিনতে পারবা?
আমার ভয় লাগছিলো কেননা আমি তখনো জানিনা যে কোথায় এসে উঠেছি আমি। তবুও বললাম হ্যাঁ পারবো আমি।
উনার সাথে বাইরে বের হতেই সব পরিস্কার হয়ে গেলো। আমার আম্মার স্কুলের পেছনের বাড়িতেই ছিলাম এতক্ষন। স্কুল দেখেই সব চিনতে পারলাম।
দাঁড়াও, এদিক দিয়ে কেউ সাইকেলে গেলে তোমায় উঠিয়ে দিচ্ছি। মহিলা বললেন৷
না আমি হেটে যেতে পারবো। কয়েকবার বলা সত্বেও উনি আমায় ছাড়েন না। প্রায় সন্ধ্যা লাগোয়া, আজান দেবে যেকোন সময়। এমন সময় একজন সাইকেলে করে এসে বাড়ির সামনে দাড়ালো। আমাকে দেখেই উনি বললেন রাসেল কোম্পানি নাকি?
আমি হ্যাঁ বা না কিছুই বললাম না, শুধু নিষ্পলক তাকিয়ে থাকলাম। আমার তখন বাড়ি যাবার জন্য ছটফট লাগছে। উনি তখন আবার জিজ্ঞেস করলো- তো রাসেল কোম্পানি কখন আসলা?
আমার কিছু বলার আগে মহিলা বললেন রাসেল পথ ভুলে বাজার থেকে বাড়ি যাবার জন্য জোলের মধ্যে দিয়ে আসতে আসতে এখানে উঠে পড়েছে।
আরেহ শর্বনাশ! লোকটি বিস্মিত হয়ে যান। বাজার থেকে জোলের মধ্যে দিয়ে একা একা আসলো, মাঠের মধ্যে কত পুকুর, ডোবা নালা আছে সেখানে পড়ে গেলে কি শর্বনাশ টাই না হতো।
আমিতো সেটাই ভাবছি, জোলের কথা ভেবেই তো আমার জানে পানি শুকিয়ে যাচ্ছে৷ যাও রাসেলকে তার বাড়ি রেখে আসো, বাড়িতে না পেয়ে হয়তো খোজাখুজি শুরু করে দিয়েছে। লোকটির উদ্দ্যেশ্যে মহিলা কথাগুলো বললেন।
তাদের কথাবার্তার ধরনে তাদের সম্পর্ক আচ করতে পারলাম। লোকটিকে আমি চিনি। আম্মার সাথে স্কুলে আসলে আমায় দেখলেই রাসেল কোম্পানি কোম্পানি করতো। এসব শুনলে রাগ হতো আমার। আমায় দেখলে তার পানির কথা মনে হয় ক্যানো?
মহিলাটি আবার তার বর কে তাড়া দিলেন-যাও তাড়াতাড়ি, কতক্ষন পানিতে ভিজেছে কে জানে।
'আসো রাসেল কোম্পানি' বলেই লোকটি আমায় তার সাইকেলে উঠিয়ে নিলো।
বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে উনি চলে গেলেন। আমি বাসায় চুপিচুপি এসে সোজা গোসল করতে শুরু করলাম। শার্ট প্যান্ট সব চেঞ্জ করে নতুন শার্ট আর প্যান্ট পড়লাম। বাড়ির কেউই জানলো না কি আমার ব্যাপারটা।
রাতের বেলা আমার জ্বর চলে আসলো। সন্ধ্যায় গোসল করেছি এটাকেই আম্মা ধরলো জ্বরের কারন হিসেবে। আমি জোলের পানিতে যে সারাটা বিকেল দৌড়েছি সেটা আর কাউকেই বললাম না।
পরের দিন আম্মা স্কুল থেকে এসেই আমায় জিজ্ঞেস করেন ক্যানো আমি জোল দিয়ে এসেছি।
আমি উত্তর দেইনা দেখে আম্মা আরো জোর করেন। ভয়ে আমি বলে ফেলি চতুর পাগলের জন্য জোল দিয়ে এসেছি। আম্মা কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছেনা। আমার জ্বর ১০৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট। স্কুল থেকে এসেই দেখেন আমার মাথায় দাদী পানি দিচ্ছে। জ্বর যেন নামছে না। আম্মারো কাঁদো কাঁদো অবস্থা।
সন্ধ্যার পর মাগরিবের নামাজ শেষে চতুর পাগল দেখি দাদার সাথে আমাদের বাড়ি এসেছে। চতুর পাগল দাদাদের বয়সী। জ্বরে আমি জবুথবু হয়ে শুয়ে আছি। আম্মা চেয়ার এগিয়ে দেবার শব্দে আমি চোখ খুলেছি। চতুর পাগল কে দেখে এবার আর আমার ভয় হলোনা। মাথা থেকে টুপি খুলে উনি চেয়ারে বসলেন।
আমার কপালে হাত রেখে বললেন "এই শালা পাগল আমাকে দেখে পালিয়ে গেলি ক্যানো?"
আপনে মানুষের গোশত খান।
সবাই হো হো করে হেসে উঠে। হাসির মাঝেই চতুর পাগল বলে আর তাই তুই আমার ভয়ে পালিয়ে এলি?
আপনি তো গোশত খান। পালাবো না তো কি করবো?
আমার চোখ দিয়ে টপটপ পানি পড়ছে দেখে উনি বললেন "আরেহ আমিতো তোর দাদা হই, একটু ঠাট্টা করি তোদের সাথে"
ঠাট্টা করেন তো তাহলে গোত্ত খাবো গোত্ত খাবো করেন ক্যানো?
চতুর পাগল উচ্চস্বরে হাসি শুরু করে দিলো। হাসতে হাসতেই বললো তুই এত অঘা ক্যানো? মানুষ কখনো মানুষের গোস্ত খায়?
আমার তখনো রাগে গা হাত পা খিটমিট করছে। চতুর পাগল তখন আমার কপালে হাত রেখে বলে বাপ রে কত জ্বর।
আমার খিটখিটে মেজাজ দেখে দাদী বলে তোমার দাদা হয়, একটু মশকরা করে তোমার সাথে। নাসিম, জয়নুল ওদের সাথেও তো মশকরা করে।
চতুর পাগল আচমকা আমার কপালে চুমু এটে দিলো। অথচ আমি বাধা দিলাম না। মানুষটা যতটা খারাপ ভাবছিলাম ততটা খারাপ না।
পাঞ্জাবীর হাতা দিয়ে উনি উনার চোখ মুছছিলো। তাই দেখে আমার দাদা উনাকে বলছিলো তুই আস্ত একটা পাগল। কাঁদছিস ক্যানো তুই?
তারপর আর কোনদিন আমি উনাকে চতুর পাগল বলতাম না। রুস্তম দাদা বলে ডাকলে উনাকে মনে হতো পৃথিবীর সবচেয়ে নিরীহ মানুষ। "তোর গোত্ত খাবো" এই কথাটা তারপর থেকে উনার কাছে আমি কখনোই শুনিনি। উনি ক্যানো এই কথাগুলো বলতো তাও বুঝলাম যেদিন তাকে প্রথম দাদা বলে ডাকলাম। এমন অনেক চতুর পাগল আমরা নিজেরা অজান্তে তৈরী করছি নিত্যদিন। কেউই নিখুঁত নয়, সৃষ্টিকর্তা সবাইকে সব দিক পরিপূর্ণ করে তৈরি করে না এই কথাটা আমরা বেমালুম ভুলে যাই, ভুলে থাকি সবসময়
(চলবে...)
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে অক্টোবর, ২০১৯ সকাল ১১:১৩