৮ বছরের রিমা খুব কৌতুহলী হয়ে তার দাদীকে জিজ্ঞেস করে ও দাদী তুমি নাকি কখনো বাসে উঠোনি?
দাদী তখন খেজুর পাতা দিয়ে পাটি উঠাচ্ছিলো। ঘাড় নাউঠিয়েই বলে- নারে উঠিনি।
আব্বা কাল রাতে বলছিলো তুমি কখনো বাস গাড়ীতে উঠোনি।
দাদী শুধু হাসে। পাটি বুনিয়ে যাচ্ছেই। রিমার দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে দেয়।
ক্যানো উঠোনি? রিমা এবার কাছে এসে জিজ্ঞেস করে।
আমার তো তেমন কেউ নাই। কার বাড়ী যাবো বাসে করে?
তোমার কেউ নেই ?
তুই আছিস, আমার আর কাকে লাগবে?
তাহলে ঐ যে রাকিবুক কাকা আসে, তোমায় যে ফুপু ফুপু করে ডাকে?
ও হ্যা আমার ভাইয়ের ছেলে।
রাকিবুল কাকার বাড়ী গেলেও তো বাসে উঠতে পারো। আমি এই ছোট মানুষ উঠেছি আর তুমি এখনো বাসেই উঠোনি?
দাদী শুধু হাসে। বলে তুমি বড় হয়ে আমায় বাসে উঠিও। তুমি আর আমি মিলে বাসে চড়বো।
জানো দাদী এবার আব্বা আমায় বাসে উঠিয়েছে। খালার বাড়ি যাবার সময়।
দাদী উৎসাহিত হয়ে বলে ভাল করেছো। চড়তে খুব মজা তাইনা রে?
রিমা দ্বিগুন উৎসাহে বলে হ্যা দাদী খুব মজা। তুমি যেদিন চড়বা সেদিন বুঝবা কত মজা।
দাদী শুধু অবাক বিস্ময়ে ভাবে। সত্যিই এই জীবনে কখনোই তার বাসে চড়া হয়নি। গল্পই শুনে এসেছে। শুধু কি বাস? এক গরুর গাড়ী আর ভ্যান ছাড়া কোন কিছুতেই সে চড়েনি। গরুর গাড়ী আর ভ্যানে যে চড়েছে তাও হাতে গোনা দুই থেকে তিন বার হবে হয়তো। দাদীর বাস বা মটরযানে কখনোই চড়া হয়নি। চড়তে যে ইচ্ছে হয়নি তা না, কিন্ত কখনো তেমন সুযোগ বা উপলক্ষ্য হয়ে উঠেনি।
একই গ্রামে রিমার দাদার সাথে তার বিয়ে হয়েছে। তারপর এই বাড়ী এই গ্রাম ছেড়ে কখনো কোথাও যাওয়া হয়নি, দেখা হয়নি বাইরের জগতের অনেক কিছুই। সারাজীবন হাজী বাড়ী কাজ করেই কাটিয়ে দিয়েছে, বেশিরভাগ সময় খেয়েছে থেকেছে সেই হাজিদের বাসায়। এতই কাজ যে কাজের ফাকে নিজের পরিবারকে সময় দিতে পারেনি। অবশ্য পরিবার বলতে ছেলে নাসির আর তার বাবা। নাসিরের বাবাও তো হাজি বাড়ীর হাজী সাহেবের সাথেই থেকেছে সবসময়, তাদের কাজে কাজেই দিন গিয়েছে।
দাদার সাথে বিয়ের পর দাদী সেবার খুব অসুস্থ। অবস্থা বেগতিক দেখে দাদা সদরে নিতে চেয়েছিল অথচ সেবার যায়নি। লজ্জায় যায়নি। এত মানুষ, এত পুরুষের ভিড় ঠেলে অতদুরের শহরে যাওয়া পছন্দ হয়নি। আবার শহরে গিয়ে তো সেই পুরুষ ডাক্তারই তাকে দেখবে। যাওয়া হয়নি সেবার। মাঝে মাঝে ছেলে নাসিরের যখন ঢাকা থেকে ফিরে তখন তার মুখে বাসের গল্প শুনে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যায়। অথচ এখন এই বয়সে মনে হয় সেবার ডাক্তার দেখাতে গেলে হয়তো বাসে চড়া হতো।
দাদীর তখন বিয়ের পরপর, সেসময় মানুষ এত শহর গঞ্জে যেত না, হাতে গোনা জনাকয়েক যে যে সদরে গেছে তাদের নাম বলে দেওয়া যেত। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার যাবার তেমন ব্যাবস্থা ছিলোনা, খুবই দুরূহ পথ। রিমার দাদা একদিন হুট করে এসে বলে কাল সদরে যেতে হবে।
কাল ? কি ব্যাপার?
হাজী সাহেব শহরে যাবে তাই সাথে নেবে আমায়।
কাল কখন যাবে? জিজ্ঞেস করে দাদী।
খুব ভোরে।
যেতে বুঝি অনেক সময় লাগবে?
হুম তাতো লাগবে।
আসবা কবে?
কালই আসবো।
গরুর গাড়ী নিয়ে যাবা এত দূরের পথ। কাল ফিরতে পারবা?
গরুর গাড়ি নিয়ে তো মথুরাপুর পর্যন্ত যাবো। মথুরাপুর থেকে এখন বাস চলে। ঘন্টা দুই মত লাগবে সদরে পৌছাইতে।
বাস? সে আবার কি?
বাস হচ্ছে ইঞ্জিনে চলে। তেল দিলেই ভুটভুট করে যায়।
দাদী আশ্চর্য হয়ে ভাবে এও কি সম্ভব? গরু ঘোড়া কেউ নাই অথচ কি এমন গাড়ী যে তেল দিলেই একা একাই চলে? উৎসুক হয়ে দাদাকে জিজ্ঞেস করে হ্যাগো সত্যিই এমন কিছু আছে? আমার না বিশ্বাস হচ্ছেনা।
দাদা হাসি হাসি মুখ নিয়ে বলে তোকেও একদিন চড়াবো। সেদিন দেখবি কি আচানক জিনিস।
আচ্ছা বাস দেখতে কেমন গো?
ছোট্ট একটা ঘরের মতন, তার মধ্যে আবার বসার ব্যাবস্থাও আছে।
সেই যে মনেমনে বাস দেখার স্বপ্ন, একটু ছুয়ে দেখার স্বপ্ন তিলে তিলে বড় করেছে। আর সেই বাসে একটু চড়তে পারলে তো সোনায় সোহাগা। সারাদিন আনমনে ভাবে কি এক যন্ত্র যে তেল দিলেই চলে, না লাগে গরু না লাগে ঘোড়া।
হাজী বাড়ী দিনের বেলায় কাজ করার সময় হাজী সাহেবের স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করে আচ্ছা চাচী আপনি যে সদরে যান মাঝে মাঝে ডাক্তার দেখাতে, তো সেখানে যান কিসে?
বাসে। হাজী সাহেবের স্ত্রী উত্তর করে।
বাসে কি সব পুরুষমানুষ? কোন মেয়েছেলে যায়না?
যায় তো। মেয়েদের বসার জন্য আলাদা সিট বরাদ্দ থাকে। সামনের দিকে। সামনে বসলে রাস্তার সব দেখা যায়।
দাদা সেদিন ফিরে এসেছিলো অনেক রাত করে। শুয়ে থাকতে থাকতে দাদী জিজ্ঞেস করেছিলো হ্যা গো বাস চড়তে কেমন?
অনেক মজার, কত্ত মানুষ একসাথে যেতে পারে। আর এত্ত জোরে যায় তুমি কল্পনাও করতে পারবেনা। চেয়ারগুলো সব গদি লাগানো, বসে যা আরাম।
বাসের চাকা কয়টা? গরুর গাড়ির মত ২টা নাকি ভ্যানের মতন ৩টা?
দাদা সেদিন খুব হেসেছিলো। বলেছিলো এত চাকা যে তুমি গুনে শেষ করতে পারবেনা।
দাদী হা হয়ে থাকে।
দাদা তার মুখে হাত দিয়ে বলে বাসের চার চাকা।
চার চাকার যে গাড়ী হয় দাদী কখনো চিন্তাই করেনি। সেদিনের গল্পের পর দাদীর মনে সেই সুপ্ত বাসনা তীব্র হয়ে উঠে। এরপর যদি কখনো সুযোগ হয় তবে দাদী যাবেই যাবে। কয়েকদিন শুধু বাসের কথা ভাবলো, মনে মনে বাসের এক কাল্পনিক ছবিও এঁকে ফেলেছে। একদিন তো লজ্জা ও ইতস্তত করতে করতে দাদাকে বলেই ফেললো আমায় চড়াবে বাসে?
আচ্ছা নিয়ে যাবোনি। তা কোথায় যাবে শুনি?
তোমার সাথে সদরে যাবো।
সদরে গিয়ে কোথায় উঠবে? কেউ কি আছে নাকি আমাদের দাদা জিজ্ঞেস করে।
সদরে আমার চাচীর এক ভাই থাকে, ওখানে গেলেও মন্দ হয়না।
আচ্ছা দেখা যাক, যাবোনি।
সেবার খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো বেশ কিছুদিন। অবস্থার উন্নতি না দেখে দাদা একদিন বললেন চল তোকে কাল সদরে নিয়ে যায়?
দাদী সেবার গেলো না, লজ্জায় গেলোনা। এত পুরুষের ভিড় ঠেলে যাওয়ার কথা চিন্তাই করতে পারেনা। বিয়ের পর এখনো বাড়ীর বাইরেই যায়নি। আর সদরের কথা তো চিন্তাই করতে পারেনা। আবার অন্যমনে ভাবতো গেলেই বা কি এমন মন্দ হতো? বাইরের কে তাকে চিনে? বড্ড দোটানায় পড়ে গিয়েছিলো, দুই দিন ধরে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি যে যাবে কি যাবেনা। শেষ পর্যন্ত আর যাওয়া হয়নি। পরেরবার যদি সুযোগ আসে তবে সেবার সংকোচ ভেঙ্গে যাবে, এই চিন্তা নিয়ে সেবার না করেছিলো।
পরে আর কখনো যাওয়া হয়নি। যাওয়ার সুযোগটুকুও হয়নি।
আব্বাকে বলবো তোমাকে যেন বাসে করে ঐ ঢাকা নিয়ে যায়। রিমার কথায় সম্বিত ফিরে পায় দাদী খাদিজা আক্তার।
ঢাকায় আমার কে আছেরে পাগলী?
আব্বা যে ঈদের আগে যায়।
নাসির তো গরু নিয়ে যায়।
গরু নিয়ে গেলে কি যাওয়া যাবেনা?
গিয়ে আমি থাকবো কোথায়?
রিমা চিন্তায় পড়ে যায়, বাবা যায় তাহলে দাদী ক্যানো যেতে পারবেনা? তার ছোট মাথায় কোন সমাধান আসেনা।
ফুপুর বাড়ী বাস যায়না? জিজ্ঞেস করে রিমা
তোর ফুপুর বাড়ি তো করদকান্তি গ্রামে। এই যে ঐ মাঠ, ওটা পার হলেই তো তোর ফুপুর বাড়ি।
আমার খালার বাড়ী তোমাকে নিয়ে যাবো দাদী। তাহলে তুমি বাসে উঠতে পারবা।
নারে আমি কোথাও যাবোনা।
তাহলে তো তুমি বাসে উঠতে পারবানা।
বাসে উঠে আর কি হবে বুবু? তোর দাদা খুব করে আমায় ধরেছিলো বাসে উঠানোর জন্য। তখনই চড়িনি। আর এখন চড়েই বা কি আর না চড়্লেই বা কি?
তো চড়োনি ক্যানো?
সেবার আমি অসুস্থ ছিলাম বলে যাওয়া হয়নি। তারপর সংসারের কত্ত কাজ, হাজী বাড়ীর কাজও বেড়ে গেলো। এই কাজ ফেলে আর যাবার সময় হয়নি। তোর বাপে যখন ছোট, তোর চেয়েও ছোট তখন তোর দাদা মারা গেল। তারপর কাজের পর কাজ আর কত কষ্টে দিন পার করেছি। অমন সময়ে তাই আর বাসে চড়ার ভূত মাথায় চাপেনি।
রিমা কিছুই বলেনা শুধু তাকায় দাদীর দিকে। দাদীর ছলছল চোখের দিকে।
ও দাদী তুমি হাজী বাড়ি কাজ করতে আগে?
হ্যা করতাম। আমি করতাম, তোর দাদাও করতো।
এখন করোনা?
না করিনা। বয়স হয়ে গেছে, তাছাড়া হাজীদের আর অত জমি জায়গা নাই, রাখাল কৃষক লাগেনা।
খাদিজা বেগম রিমাকে কাছে টেনে বলে যাও খেয়ে স্কুলে যাও, মা রুটি বানিয়েছে ওগুলো খেয়ে যাও মধু।
তুমি কি খাবা?
আমি ভাত খাবো। পান্তা ভাত।
দাদী আমিও খাবো, তুমি যে মরিচ পেয়াজ দিয়ে মাখাও আমার খেতে খুব ভালো লাগে।
দাদী হাসে, রিমাকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে কপালে একটা চুমু এটে দেন।
যাও ময়না কল থেকে এক জগ পানি আনো। আমি ভাত মাখাচ্ছি।
দাদী মরিচ পেঁয়াজ কাটতে বসে যায়। রিমা ওদিকে টিউবওয়েলে পানি আনতে গেলো। রিমা টিউবওয়েল চাপতে পারেনা। টিউবওয়েলের হাতা ধরে ঝুল খায়, কখনো বুক লাগিয়ে ঝুলে পানি উঠায়। কত কষ্ট করে পানি উঠায় অথচ দাদী যদি জিজ্ঞেস করে হ্যারে কষ্ট হলো তোর? রিমা হেসে হেসে উত্তর করে না দাদী আমার একটুকুও কষ্ট হয়নি।
পানি এনে দাদী নাতি দুজনেই খেতে শুরু করে। পান্তা ভাত মরিচ পেঁয়াজ দিয়ে মাখানো পান্তা ভাত।
দাদীকে খুব ভালোবাসে রিমা। দাদী ছাড়া কিছু বোঝেনা।
খাওয়া শেষ করে দাদী বাগানের মধ্যে দিয়ে রিমাকে স্কুলে দিয়ে আসে। প্রতিদিনই সে এমন করে। স্কুলে থাকার সময়টুকু যেন কাটতে চায়না। স্কুল ছুটির সময় বাগানের মধ্যে দাদী বসে থাকে। তারপর ছুটি শেষে দুজনে বাড়ি ফেরে।
ও দাদী তোমাকে না বলেছি তুমি খালি পায়ে হাটবেনা।
ক্যানো খালি পায়ে হাটলে কি হয়?
পায়ে অসুখ হয় আমাদের বইতে লেখা আছে।
আমি সারাজীবনেও তো কোন দিন স্যান্ডেল পড়িনি। কই আমার তো কোন অসুখ হয়নি।
সেদিন পায়ের মধ্যে কি ঢুকে গেছিলো, খেয়াল নাই?
ও তো স্যান্ডেল পায়ে দিলেও হতো।
তুমি স্যান্ডেল পায়ে দিবা কিন্ত। আব্বা সেদিন তোমায় স্যান্ডেল কিনে দিলো আর তুমি আবার সেগুলান ফুপুকে দিয়ে দিলা।
বোন, আমি জীবনেও স্যান্ডেল পড়িনি। এই বুড়ো বয়সে স্যান্ডেল পড়লে পায়ের মধ্যে চুলকায়।
রিমা হাসে। জোড়ে জোড়ে হাসে। স্যান্ডেল পায়ে দিলে পা চুলকায় এইটা কোন কথা? বরং স্যান্ডেল না পায়ে দিলেই তো চুলকায় পা।
দাদীও হাসে। রিমাকে শক্ত করে ধরে। বলে আমার ওসব লাগবেনা। তুমিই সাজুগুজু করে রানী হয়ে থাকো তাহলেই আমার হবে।
এই যে তুমি বাগানের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছো, এখন যদি পায়ে কিছু বাঁধে তাহলে কি হবে?
পায়ে কিছু বাধবেনা। আমায় নিয়ে তুই তো ভারী চিন্তা করিস।
**
বিকেলে খাদিজা বেগম যখন গুল দিয়ে দাত মাজতেছিলো তখন পাশের বাড়ীর সফুরা আসলো। পিরে টেন নিয়ে বসতে বসতে বলে খাদিজা আইয়ূব জামাইয়ের কথা কিছু শুনেছিস?
না তো। গুলের পিক ফেলতে ফেলতে বলে খাদিজা বেগম। বা হাত থেকে গুল আঙ্গুলে নিয়ে মুখে দিয়ে দাত মাজতে মাজতে আবার জিজ্ঞেস করে ক্যানো কি হয়েছে?
জামাই তো যাই যাই অবস্থা।
হয়েছে কি সেটা তো বলবি?
শরীর দুর্বল, একেবারে ভেঙ্গে গেছে। কিছুই খেতে পারসেনা। শুধু উলটা পালটা বকে। বাচবেনা মনে হয়।
আহারে, চাচা কত ভালো মানুষ ছিল। আইয়ূব এর জন্য খাদিজার খুব দুঃখ হয়।
খাদিজাদের বাড়ীর পেছনে আইয়ুব চাচার বাড়ী ছিলো। সেই যে ৪৭ এর দেশভাগের সময় এসে একসাথে এসেছিলো ওপার থেকে। আইয়ুবের অবশ্য কেউ ছিলোনা। হাজী সাহেবের সাথে একাই এসেছিলো এই দেশে। প্রথম প্রথম হাজীদের বাড়ীতেই থাকতো। তারপর বয়স বাড়ার পর হাজী সাহেব নিজে তার বিয়ে দেন । স্বাভাবিকভাবে বিয়ের পর তার আলাদা একটা ঘর, একটা বাড়ীর দরকার হওয়াতে হাজী সাহেব তাকে একটা জমি দিয়েছিলো। সেই জমি আবার খাদিজার বাড়ীর পেছনে। সেই থেকে খাদিজার সাথে সুখে দুক্ষে এঁকে অপরের পাশে পেয়েছে। ছেলেমেয়েরা ভালো জীবনের আশায় এই গ্রাম পারি দিয়ে শহরে গিয়েছে আজ প্রায় ১৮ বছর হলো।
চাচার সাথে সেই দুই তিন বছর আগে দেখা। বলে উঠে সফুরা।
খাদিজা বলে, গ্রামে আসলে আমার বাড়ীতে একবেলা না খেয়ে কখনো যেত না। আমার নাসিরের বৌকে খুব ভালোবাসতো। চাচা খুব ভালো মানুষ ছিলোরে।
পাড়ার সবাই মিরপুর যাবে আইয়ূব জামাইরে দেখতে। ভাবছি আমিও যাবো। যাবি তুই? জিজ্ঞেস করে সফুরা।
কে কে যাবি?
রহমান, রহমানের বৌ, নাজমুলের মা, রিপনের মা, জাব্বার ভাই, ইয়ারুল ভাই, মর্জিনা, আমেনা, শহীদুল, লুতফর চাচা আর কে কে যেন যাবে।
নাসির বাড়ীতে নাই যাবো কি করে? যেতে তো আমারো ইচ্ছে করে।
নাসিরের বৌ তো আছে ওকে বলে চল।
বৌমা একা একা থাকবে ? নাসির তো বাড়ি থাকেনা, সারাদিন বাইরে বাইরে থাকে।
সফুরা নাসিরের বৌকে ডাকে, ও সুলেখা নাসির কে বলো আমরা মিরপুর যাবো। আইয়ূব জামাইকে দেখতে। তোমার শাশুড়ি কে নিয়ে যাবো ভাবছি।
সুলেখা উত্তর করে যাবেন কিসে? অনেক দুরের পথ।
সফুরা বলে এখান থেকে ভ্যানে বাউনিয়া যাবো, তারপর সেখান থেকে বাসে যাবো।
কিন্ত আমার শাশুড়ি তো কখনো বাইরে যায়নি, বাসে উঠেনি। যেতে পারবে তো?
সফুরা কপট বিরক্তি নিয়ে বলে আমরা আছি কি করতে?
দেখেন আমার শাশুড়ি যদি যেতে চায় তো তাহলে নিয়ে যান। তা যাবেন কবে?
সবাই তো কাল যাবে বলছে? আবার কালকেই সন্ধ্যার মধ্যে ফিরে আসবে।
আচ্ছা আমার শাশুড়ি কে নিয়ে যাইয়েন।
**
খুব ভোরে খাদিজার ঘুম ভেঙ্গে যায়।
আজ তার বেশ ভালো লাগছে, জীবনে প্রথমবারের মত বাসে উঠবে সে। আজ তার অনেক কিছুর হিসাব মেলানোর পালা। বাস দেখবে, একটু ছুঁয়ে দেখবে। বাসে চড়বে। বাস চড়তে কেমন তার স্বাদ নেবে। কখনো বাড়ির বাইরে যায়নি, দেখা হয়নি দুনিয়ার অন্যসব হালচাল। আজ সব দেখবে। সরু রাস্তাটা কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে, নদীর ওপারের মানুষগুলো কেমন, তাদের ভাষা কেমন, কেমন করে চলে বাস গাড়ী, কেমন তার শব্দ, কত বড় তার আকার, শহরের বুকে উচু উচু বিল্ডিং তা দেখবে। করদকান্দি গ্রামের পর কোন গ্রাম আছে আজ সব দেখবে। খাদিজার ৬০ বছরের জীবনে আজ প্রথম গ্রামের বাইরে যাবে, আজ প্রথম দুনিয়া দেখবে মন ভরে। খুশী তে আত্মহারা, রাতে তার ঠিকমত ঘুম হয়নি।
সবাই বকুলতলায় এসে হাজির। আজ মিরপুর যাচ্ছে সবাই।
এখানে ৩টা ভ্যান আসবে। ভ্যান নিয়ে যাবে ৭ কিমি দূরে বাউনিয়া তে। সেখান থেকে বাসে সরাসরি মিরপুর।
সফুরা এসে খাদিজা কে ডেকে নিয়ে গেলো।
আমিনা খাদিজাকে দেখে বলে ও বুবু তুমি কি একেবারে বের হয়ে এসেছো?
হ এসেছি? ক্যানো?
মুখে গুল লাগানো যে? মুখ ধুয়ে আসবানা?
ও ব্যাপার না, আচল দিয়ে মুছে নেবো।
এক যায়গায় যাচ্ছো একটু ভালো হয়ে আসবানা? আর কি তুমি খালি পায়ে ক্যানো?
আমি খালি পায়ে সমস্যা কোথায়? আমিতো জীবনেও স্যান্ডেল পড়িনা।
আমিনা বিরক্ত হয়ে বলে এইটা আবার কেমন ধরনের কথা? এক জাগায় গেলে তো একটু পরিপাটি হয়ে যাবা নাকি? তানা করে মুখে গুল লাগানো, পায়ে স্যান্ডেল নাই এমন করে কি কেউ মানুষের বাড়ী যায়? লোকে কি বলবে বলো?
আমি স্যান্ডেল পায়ে দেবো না। এমন করেই যাবো।
মর্জিনা এসে বলে যাও বুবু সুলেখার একজোড়া স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে আসো।
আমার স্যান্ডেল পড়তে ভালো লাগেনা। আমি পায়ে দেবো না।
এমন করেই যাবা? জিজ্ঞেস করেই মর্জিনা।
হ্যা এমন করেই যাবো। আর আমি কি মেয়ের বিয়ে দিতে যাচ্ছি নাকি? আইয়ূব জামাইয়ের ওখানে যাচ্ছি ওরা তো সব আমার গ্রামের লোক। খালি পায়ে গেলেই বা সমস্যা কি?
মর্জিনা বলে, স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে না গেলে মানুষে কি বলবে?
বলুক, আমি খালি পায়েই যাবো। খাদিজা বলে
আমিনা প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে মর্জিনা কে ডেকে নেয়, আর খাদিজার উদ্দেশ্য বলে এমন মুখ্যু সুখ্যু মানুষকে যাবার কথা বলে কে? এসব মানুষকে নিয়ে তো সমাজে চলা যায়না।
চলিস নি আমার সাথে। খাদিজাও উত্তর করে।
তোমার সাথে কোথাও যাওয়াও ঠিক না। এই মর্জিনা বু চলো তো আমরা অন্য একদিন যাবো। এদের সাথেই যাবোনা।
খাদিজা দেখে কেউ কিছুই বলেনা। কেউ তার পক্ষ নিয়ে কিছুই বলেনা।
খাদিজা বলে তোরাই যা, আমি আর যাবো না তোদের সাথে। আমার মত পা ফাটার সাথে গেলে কি আর তোদের শান্তি হয়? যাহ আমিই যাবোনা বলে বাড়ীর দিকে রওনা হয়।
সফুরা ছুটে গিয়ে খাদিজার হাত টেনে নিয়ে বলে চল খাদিজা চল। তুই না গেলে আমারো ভালো লাগবেনা। যা তুই বাড়ী গিয়ে সুলেখার একজোড়া স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে আয়।
খাদিজা আশাভঙ্গের মত সফুরার দিকে তাকায়। বলে না আমি যাবোনা। এই অবস্থায় আর যাবোনা।
খাদিজা টিপটিপ করে পা ফেলে বাড়ীর দিকে যাচ্ছে। সফুরা কয়েকবার ডাকে খাদিজা আয়, ও খাদিজা। ডাক টা আস্তে আস্তে ম্রিয়মাণ হতে থাকে। একটু পরে খাদিজা চোখের আড়াল হয়ে গেলো। আড়াল হয়ে গেল তার স্বাধের স্বপ্নটুকু। যেই স্বপ্নের কথা ভেবে সারা রাত ঘুমাইনি খাদিজা, সেই স্বপ্ন টা সূর্য উঠার আগেই মিলিয়ে যাবে তা কে জানতো। মর্জিনা, আমিনা বা সফুরা এরা কেউ জানবে না, কেউ জানতেই পারলো না তার এই স্বাধের স্বপ্ন টুকুর কথা। হয়তো সবার সব স্বপ্ন পুরন হয়না।
লুতফর চাচা বলে এই তোরা আয় তাড়াতাড়ি ভ্যান চলে এসেছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ১:২৮