somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আবারো সংকটে মিশরের গণতন্ত্র: ক্ষমতালিপ্সা না রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতা

০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১১:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গত ২২ নভেম্বর মিশরের প্রেসিডেন্ট ড. মুহাম্মাদ মুরসি 'নতুন পার্লামেন্ট নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের কোনো সিদ্ধান্তকে আইনিভাবে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না' মর্মে ডিক্রি জারি করে। এরফলে বিরোধীরা তাকে ক্ষমতা অধিগ্রহণ করে আধুনিক ‘ফারাও’ হয়ে উঠছেন বলে অভিযুক্ত করে এর প্রতিবাদে ২৩ নভেম্বর থেকে টানা সহিংস প্রতিবাদ শুরু করে ।

সরকারবিরোধীদের পাশাপাশি বিচারকদের সর্বোচ্চ সংগঠন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলও ধর্মঘটের ডাক দেয়। পরে সরকার পক্ষের নমনীয়তায় ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নিলেও সরকারবিরোধী দলগুলো ডিক্রিটি বাতিল করার দাবীতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।

ইতিমধ্যে ৩০ নভেম্বর মিশরের নুতন সংবিধান প্রণয়নের জন্য গঠিত সাংবিধানিক পরিষদ কতৃক প্রণীত খসড়া সংবিধান মিশরের প্রথম গণতান্ত্রিক সরকার সংসদে অনুমোদন করিয়ে নেয়ায় বিক্ষোভ আরো জোরদার হয়৷ কারণ সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের কমিটিতে বিরোধী দল এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু খ্রিস্টানদের যে প্রতিনিধিরা ছিলেন তাঁদের সবাই প্রস্তাবিত সংবিধানকে ‘অগণতান্ত্রিক' আখ্যা দিয়ে কমিটি থেকে নাম প্রত্যাহার করে। এরপর সরকার সংসদে খসড়া সংবিধান পাশ করিয়ে প্রেসিডেন্টের অনুমোদনের জন্য পাঠায়। প্রেসিডেন্ট খসড়া সংবিধান গণভোটের মাধ্যমে পাশ হবে ঘোষনা দিয়ে ১৫ ডিসেম্বর গণভোটের দিন ধার্য করে।

কিন্তু নতুন সংবিধান এবং গণভোট নিয়ে সরকারের মধ্যেই দেখা দেয় মতবিরোধ৷ গণভোট আয়োজনের জন্য গড়া বিশেষ কমিটির সভাপতির পদ থেকে সরে দাঁড়ান বিচারপতি জঘলৌল আল-বালসি৷ তিনি বলেন, যে সংবিধানের জন্য মিশরের জনগণের প্রাণ গেছে সেই সংবিধানের জন্য কোনো গণভোটে তিনি অংশ নেবেন না৷ এ সময় প্রেসিডেন্ট মুরসির প্রতি নতুন সংবিধান কার্যকর করার সিদ্ধান্ত থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সরে আসার আহ্বানও জানান তিনি৷

৪ ডিসেম্বর কায়রোতে ডিক্রির বিপক্ষে বিক্ষোভ-সমাবেশের ঘোষনা দেয় বিরোধীরা এবং একই দিন ডিক্রির প্রতি সমর্থন জানিয়ে কায়রোতে মিছিল-সমাবেশ করার ঘোষণা দেয় মিশরের সবচেয়ে প্রভাবশালী দল মুসলিম ব্রাদারহুড। প্রেসিডেন্ট মুরসি এই মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক শাখা ফ্রিডম এন্ড জাস্টিস পার্টির প্রার্থী হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। দুইপক্ষের এই পাল্টাপাল্টি মিছিল-সমাবেশের ঘোষণায় মঙ্গলবার কায়রো রণক্ষেত্রে পরিণত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছিল। অবশেষে মুসলিম ব্রাদারহুড তাদের মঙ্গলবারের মিছিল-সমাবেশ বাতিল করে।

পরবর্তীতে ৫ ডিসেম্বর বুধবার প্রসিডেন্ট প্রাসাদের সামনে গিয়ে বিক্ষোভ জানানোর ঘোষণা দেয় বিরোধী দলগুলো৷ জবাবে ক্ষমতাসীন দল মুসলিম ব্রাদারহুডও সেখানে অবস্থান নেবে বলে জানায়। পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাবার আশঙ্কা দেখা দেয় তখনই৷ তবে যতটা অনুমান করা হয়েছিল ঘটনার ভয়াবহতা তাকেও ছাড়িয়ে যায় ৷ প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের বাইরে সরকার বিরোধী বিক্ষোভকারী এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের সমর্থকদের মধ্যে দু'পক্ষের সংঘর্ষে ৫ থেকে ৬ জন নিহত এবং ৫০০ থেকে ৭০০ আহত হয়৷

সর্বশেষ আজ প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের বাইরে সেনাবাহিনীর ট্যাংক মোতায়ন করা হয়েছে সরকার বিরোধীদের অপসারন করতে।


এখন প্রশ্ন হলো :

* কেন ডিক্রি জারি করে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বাড়ানো হলো?
* কেন খসড়া সংবিধান কে অগণতান্ত্রিক বলে আখ্যা দেয়া হলো? এবং বিরোধীদল ও সংখ্যালঘু সদস্যগণ সংবিধান প্রণয়ন কমিটি থেকে নাম প্রত্যাহার করে নিলো ?


কেন ডিক্রি জারি করে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বাড়ানো হলো?

দেশের সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে আদালত পর্যন্ত প্রায় সকল জায়গায় মোবারকের নিয়োগকৃত এবং অনুগত লোকজন। মুরসী ক্ষমতাসীন হবার পরপরই সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কয়েকজন কর্মকর্তাকে অবসর দিয়ে অথবা অন্যভাবে সেনাবাহিনীকে সরকারের অনুগত করেছেন, সেটা ছিল সরকারের জন্য অন্যতম চ্যালেন্জ্ঞ। পরবর্তীতে নতুন সরকার প্রণীত সংবিধান আদালত কতৃক বাতিল হতে পারে আশংকায় প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্ত আদালতের উর্দ্ধে নিয়ে যেতে ডিক্রি জারি করা হয়।

কিন্তু এই ডিক্রি জারি আসলে রাজনৈতিকভাবে কতটা সঠিক ছিল সময়ই বলে দেবে। তবে এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে ঠিক হয়নি। প্রথমত- মিশরের জনগন এই মুহুর্তে 'ঘর পোড়া গরু' র মত যে 'শিদুরে মেঘ দেখলে ডরাবে' এটাই বাস্তবতা। দ্বিতীয়ত, এই ডিক্রি প্রেসিডেন্টকে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে স্বৈরাচারের সমান ক্ষমতা দিয়েছে। যা কোন গণতন্ত্রকামী সমাজে গ্রহনযোগ্য নয়। তৃতীয়ত, সরকার এক্ষেত্রে বড্ড তাড়াহুড়া করছে বলে মনে হয়। কারন একটা নির্দিষ্ট সময় পর নিশ্চয়ই মোবারকের অনুগত বিচারকগণ অবসর গ্রহণ করবেন, যদি তারা শুধু অন্যায্যই সরকারের বিরোধিতা করে থাকেন। ইতিমধ্যে মিশরের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয় আল আযহার ডিক্রি বাতিল করার আহবান জানিয়েছে।


কেন খসড়া সংবিধান কে অগণতান্ত্রিক বলে আখ্যা দেয়া হলো? এবং বিরোধীদল ও সংখ্যালঘু সদস্যগণ সংবিধান প্রণয়ন কমিটি থেকে নাম প্রত্যাহার করে নিলো ?

একটি নতুন দেশের সংবিধান অবশ্যই সেদেশের জাতীয় আশা-আকাঙ্খা থেকে শুরু করে সকল কিছুর সম্মিলনে সকলের ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে প্রণিত হবে। প্রত্যেক দলের নিজস্ব রাজনৈতিক দর্শন থাকতেই পারে। কিন্তু সংবিধানে ক্ষমতাসীন দলের দর্শন এককভাবে প্রতিফলনের সুযোগ নেই। যেহেতু মিশরের আজকের অবস্থার পেছনে একটি দীর্ঘ বিপ্লব আছে, অসংখ্য প্রাণহানী আছে, অনেক ত্যাগ-তীতিক্ষা আছে। যদিও মুসলিম ব্রাদারহুদ মনে করছে তারা গণতান্ত্রিকভাবে জনগনের প্রত্যক্ষ সমর্থনে ক্ষমতায় এসেছে সুতরাং জনগন তাদের পক্ষে আছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো ব্রাদারহুদ নির্বাচনে নিরুংকুশ সংখ্যাগরিষ্টতা পায়নি। ব্রাদারহুদের আদর্শের বাইরের দলগুলোও দেশে জনপ্রিয়। সুতরাং মিশরে এই অবস্থায় কোনভাবেই একটি দলের রাজনৈতিক আদর্শের ভিত্তিতে প্রণীত সংবিধান গণতান্ত্রিক হিসেবে গ্রহনযোগ্যতা পাবেনা।

ব্রাদারহুড রাজনৈতিক দল হিসেবে বেশ পুরাতন এবং ঐতিহ্যবাহী। প্রচুর ত্যাগ এবং ক্ষতি তাদের স্বীকার করতে হয়েছে এ অবস্থায় আসার জন্য। দীর্ঘ প্রায় তিন দশকের স্বৈরাচারী শাসনের কারণে তাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা চর্চার কোন অভিজ্ঞতা নেই। রাজনীতিতে এটা একটা বড় দুর্বলতা। অনেক বড় বড় দল / নেতা একারণে ক্ষমতা হাতে পেয়ে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।

এছাড়াও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মুসলিম ব্রাদারহুদকে বিপ্লবের সময়ে সমর্থন দিয়েছিল হয় নিরুপায় হয়ে অথবা এরা গণতন্ত্রের প্রতি কিছুটা কমিটেড ধরে নিয়ে। যদিও সে সময়ে ব্রাদারহুদকে নিজেদের গণতন্ত্রের প্রতি কমিটমেন্ট দেথিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায় করতে হয়েছিল।

অবস্থা শেষ পর্যন্ত যেখানে গিয়েছে, তাতে মনে হয় সরকারের এর থেকে সরে আসাটাই সময়োপযোগি সিদ্ধান্ত হবে। মনে রাখা দরকার মাত্র বিপ্লব সংঘটিত করা জনগণ (বা একাংশ) কে জোড় করে বাধ্য করা সম্ভব নয়।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১১:৫৩
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একটি জাতির কান্না......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ২২ শে অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ১১:৫২

একটি জাতির কান্না......

স্বাধীন সিকিম রাষ্ট্রের ভারত ভুক্তির নেপথ্য!
১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান ব্রিটিশদের কাছে থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। ওই সময় উপমহাদেশে ৫৬৫ টি "Princely States" বা "সতন্ত্র দেশিয় রাজ্য" ছিল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

এসব কিসের ইঙ্গিত?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২২ শে অক্টোবর, ২০২৪ দুপুর ১:২৯


ক্ষমতাচ্যুত হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মামলা প্রত্যাহার দাবিতে হঠাৎ দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ছাত্রলীগ নেতাদের বিক্ষোভ মিছিল! সোমবার (২১ অক্টোবর) সকালে গুলিস্তানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের সড়কে... ...বাকিটুকু পড়ুন

‘নির্দেশ আছে তোকে ক্রস ফায়ারে মেরে ফেলার’ - হুমায়ুন কবির

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২২ শে অক্টোবর, ২০২৪ দুপুর ২:১৪

(মানব জমিনে হুমায়ুন কবির ভাইয়ের গুম নির্যাতনের কথা পড়ে মনোকষ্ট নিয়ে বসে আছি। আপনার জন্য দোয়া করি, আপনাদের আত্মত্যাগেই এই জাতি স্বৈরাচার মুক্ত হয়েছে, এখন কাজ হচ্ছে তাদের বিচার করা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাকুরী থেকে বরখাস্ত করার জন্য কোটার দরকার আছে!

লিখেছেন সোনাগাজী, ২২ শে অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৩:৫৬



**** চাকুরী সৃষ্টি করতে জানে না বাংগালী জাতি, কিন্তু চাকুরী থেকে তাড়াতে জানে; কিছু কিছু ব্লগার মানুষকে তাদের কাজের যায়গা থেকে বিতাড়িত করার জন্য ব্লগে চীৎকার করছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

=ফিরে যেতে ইচ্ছে করে কৈশোরে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৫:২৫


এখানে কী আছে বলো তো, এখানে কী আছে আর
কেন যে সময়ের পিঠে হলাম সওয়ার;
সময় আমায় নিয়ে এ কোথায় এলো
স্বপ্ন সব হয়ে গেল এলোমেলো।

সেই প্রাথমিকের গন্ডি, পা রাখি ইচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×