সৃষ্টিকর্তার ধারনাটি যুগে যুগে মানুষ কে ভাবিয়েছে, এবং আজ এই একবিংশ শতকে এসেও পৃথিবীর প্রায় তিন চতুর্থাংশ মানুষ তাদের ব্যক্তিগত জীবনে ঐশী সত্ত্বার ধারনাটিকে লালন করে চলেছে; কখনও শ্রদ্ধায়, কখনও ভাবালুতায়, কখনও ভয়ে, কখনও অজ্ঞানতায়, কখনও কৃতজ্ঞতায়, কখনও দুর্বলতায়, কখনওবা শুধুমাত্র শৈশবে পাওয়া মতদীক্ষার কারনে, অভ্যাসের বশে।
এলাম আমরা কোথা থেকে আর যাচ্ছি আমরা কোথায়, জীবনের এই গূঢ় রহস্যের সমাধান যেমন ভাবিয়েছে দার্শনিক মানসকে, তেমনই ভাবিয়েছে সাধারণ্যকেও; আবার মানুষ টিকে থাকার স্বার্থেই বাধ্য হয়েছে জীবন চলার পথে, প্রতি মুহূর্তে, অনিশ্চয়তার রুঢ়তম বাস্তবতা গুলোর মোকাবেলাতেও।
চলার পথে উদ্ভুত অনিশ্চিত এই পরিস্থিতিগুলোর মোকাবেলায় মানুষ সম্মুখীন হয়েছে অসংখ্য বিকল্পের এবং চিরকাল হাবুডুবু খেয়েছে সঠিক সিদ্ধান্তটি গ্রহণে। নির্ণায়ক অবস্থানটি অনুধাবনের অক্ষমতা এবং বাস্তব-অধিবাস্তব-পরাবাস্তব ভাবনার বৃত্তজালের আবদ্ধতা মানুষকে ঠেলে দিয়েছে সহজতম সমাধানের পথ অলৌকিকত্বের ধারনায়।
আর সে কারনেই কয়েক হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা অলৌকিকত্বের ধারনার উপর গড়ে ওঠা সৃষ্টিতত্ত্ব ও জ্ঞানতত্ত্বের বিপরীতে নিয়মবদ্ধ উপায়ে প্রকৃতিকে বোঝার চেষ্টা, প্রকৃতির নিয়মগুলোকে তথ্য আর উপাত্তের ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করার প্রবনতা, গানিতিক প্রামান্যতা, এবং প্রাযুক্তিক উৎকর্ষের ভিত্তিতে মানুষের বুঝতে শিখার পরিশ্রমসাধ্য পথটির বয়স অত্যন্ত অল্প।
সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসীরা মনে করেন, ঈশ্বর স্বয়ম্ভু এবং অলৌকিক; তিনি তাঁর অলৌকিকত্বে সৃষ্টি করেছেন লৌকিক মহাবিশ্ব; লৌকিক মহাবিশ্বের জন্য প্রয়োজন লৌকিক নিয়মের, সেটা তাঁর অলৌকিক সত্ত্বার জন্য প্রযোজ্য নয়। অপ্রমানিত ও অলৌকিক এই সত্ত্বা সর্বময় ক্ষমতাশালী, সে ক্ষমতা সর্বচরাচর ব্যাপী ব্যাপ্ত; এবং তাঁর সৃষ্টি বা ধ্বংস নাই।
সকল ক্ষেত্রে, সকল লৌকিক নিয়মের বিপরীতে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপায়ে ব্যাখ্যা যোগ্য নয় এমন এক ঐশী শক্তির সরাসরি তত্ত্বাবধানের ধারনাটি এমনই এক মোহময়, কার্যকরী সান্ত্বনা যে তাতে আস্থা রাখাটাই সহজতম পথ। সে অলৌকিকতার প্রকৃতি বা স্বভাব নির্ধারণের চেষ্টাও অর্থহীন, কারন স্পষ্টতই সেটা বোধ ও বুদ্ধির অগম্য। অলৌকিক এই ঈশ্বরকে বোঝা বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী, কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। অনস্তিত্বশীলের বিদ্যমানতার প্রমাণ সোনার পাথরবাটি তুল্য।
অলৌকিকত্বের জন্মই হয় পরিপূর্ণ তথ্যের অভাবে। যতক্ষণ পর্যন্ত সেটা আপাত দৃষ্টিতে লৌকিক নিয়মের বিপরীত, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপায়ে ব্যাখ্যা যোগ্য নয় ও বুদ্ধির অগম্য থাকে, ততক্ষণ সেটাতে ঐশী শক্তির সরাসরি তত্ত্বাবধান পরিলক্ষিত হয়; কিন্তু যে মূহুর্তে সেটা পরীক্ষাযোগ্য ও ব্যাখ্যাযোগ্য হয়ে ওঠে, ঐশী শক্তিকে সেখান থেকে লুপ্ত হতে দেখা যায়।
চেষ্টাটা তাই অলৌকিকতার স্বরূপ নির্ধারণে ব্যয় করলেই তা অর্থপূর্ণ ও বোধগম্য হয়ে ওঠে, কারন ঈশ্বরের অলৌকিকতার স্বরূপই হল তার মূর্ত প্রকাশ; ধর্মগ্রন্থ।
ধর্মীয় শাস্ত্রবিধানের সংকলন মাত্রই ধর্মগ্রন্থ, এবং সাধারণ বিচারে ধর্ম একটি সুপ্রাচীন, জনপ্রিয়, পাপ-পুন্য বিচারে ভয় ও প্রাপ্তি ভিত্তিক অনুভুতিজাত দার্শনিক ধারণা। রহস্যমণ্ডিত অলৌকিক স্বত্ত্বায় বিশ্বাস, আধ্যাত্মিক চেতনা, আচার ও নির্দেশের চর্চা, অনুধাবন, অনুসরন এবং পালন প্রতিটি ধর্মেই অত্যাবশ্যকীয়। সে কারনেই সাধারন সংজ্ঞায় ধর্ম মুলত ঈশ্বরের ধারণা, ঈশ্বরে বিশ্বাস, ঈশ্বর প্রবর্তিত বিধান, বিধি ও ব্যবস্থার চর্চা, সাধনার জন্য সুনিদৃষ্ট পবিত্র স্থান, গ্রন্থ, ধর্মানুষ্ঠান, উৎসর্গ, উৎসব, সৎকার, বিবাহ, ধ্যান, প্রার্থনা, চিহ্ন, সংস্কার, ঐতিহ্য, পুরোহিত, অনুসরণকারী ইত্যাদি ইত্যাদির সমন্বয়কে বোঝায়।
কাজেই প্রকৃত অর্থে, একমাত্র ঈশ্বরবানীতেই ঈশ্বরকে অনুধাবন সম্ভব; কারন ঈশ্বর নিজে অবোধ্য হলেও ঈশ্বরবানীগুলো এবং তার নির্দেশিত আচার ও চর্চাগুলো লৌকিক বুদ্ধির অগম্য নয়। ধর্মগ্রন্থেই দাবী করা হয়, ঈশ্বর সেগুলোর পালন দাবী করেছেন এবং সেগুলো পাঠিয়েছেন মানুষেরই জন্য, যার অনুসরনে রয়েছে কল্যান। সেই দাবী মেনে, ধর্মগ্রন্থে উল্লেখিত বানী ও ধর্মাচারের ভিত্তিতেই, অনুধাবনের স্বার্থে, ঈশ্বর ধারনাটির ব্যবচ্ছেদ প্রয়োজন।
ধর্মের উৎপত্তি নিয়ে বহু তত্ত্ব প্রচলিত। বহুল জনপ্রিয় মতটি হচ্ছে, এটি সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত; তবে পরস্পর বিরোধী মতে পরিপূর্ণ ধর্মগুলো একই ভাষায় একই দাবী করে বলে এবং এর কোনটিই প্রামান্য না হওয়ায় এই তত্ত্বটি অসাড়তা সর্বস্ব।
অপর গ্রহণযোগ্য মতটি হচ্ছে সমাজ, সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক বিকাশের ধারার বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা,যেমন সমাজবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ব ও মনোবিজ্ঞানের ভিন্ন ভিন্ন গবেষণায় পরিলক্ষিত হয়েছে যে, আদিম সমাজে প্রাথমিক পর্যায়ের ধর্মীয় চেতনা বিকশিত হয়েছিল, যা পরবর্তীতে সংঘবদ্ধ ধর্মে রুপ নিয়েছে।
আত্মার ধারণা, গোত্র প্রতীক ও টোটেমবাদ, টোটেমবাদ থেকে অ্যানিমিজম বা সর্বপ্রাণবাদ, সর্বপ্রাণবাদ থেকে প্যানথেয়িজম বা সর্বেশ্বরবাদ, সর্বেশ্বরবাদ থেকে বহুঈশ্বরবাদ বা পলিথেইজম, এবং বহুঈশ্বরবাদ থেকে একেশ্বরবাদ বা মনোথেইজমের ধাপ গুলো স্থান-কাল ভেদে পরিবেশ-পরিস্থিতির সাথে পরিবর্তিত ও সমন্বিত হয়েছে।
সৃষ্টিকর্তা যিনি, তিনিই তিনিই জীবনের উৎস, তিনিই লালনকর্তা, তিনিই পালনকর্তা এবং তিনিই সংহারকর্তা; তিনি এক এবং অদ্বিতীয়, এই ধর্মীয় মতটিই একেশ্বরবাদ;
আপাত দৃষ্টিতে নিরীহ এই মতটির প্রতিষ্ঠার পেছনে লুকিয়ে আছে পৌরাণিক কিংবদন্তী ও বিশ্বাসের ভিতে স্থাপিত ধর্মানুরাগ ও ধর্মানুভুতি; এবং সেই অজুহাতে সংঘটিত হাজার বছরের সহিংসতা ও রক্তমাখা এক বেদনাদায়ক ইতিহাস।
সৃষ্টিকর্তা কে? কোন পন্থায় ও কি নামে উপাসনা করব তাকে?
এ প্রশ্নের উত্তরে ইহুদী ও খ্রীষ্টানেরা সামান্য মতদ্বৈততা সত্ত্বেও সমস্বরে বলেন, তিনি জেহোবা (Jehovah, YHWH); মুসলমানেরা বলেন তিনি আল্লাহ (ﺍﷲ); সনাতন হিন্দুরা বলেন তিনি পরমেশ্বর ভগবান, জরথুস্ট্ররা বলেন তিনি আহুরা মাজদা, শিখ ধর্মাবলম্বীরা বলেন এক ওঙ্কার।
কিন্তু এই সকল ধর্মগ্রন্থ গুলোতে বর্ণিত এই সৃষ্টিকর্তার কি স্বরূপ কি একই ভাবে মূর্ত? একইভাবে উপাস্য?
সেটা হলে তাঁকে ভিন্ন নামে ডাকলেও আপত্তির কোন কারন ছিলনা, কিন্তু সেটা না হলে তিনি ভ্রান্ত ভাবে অনুসৃত এবং কৌতুহলউদ্দীপক বিষয় হল প্রতিটি ধর্মগ্রন্থই তাঁর ভ্রান্ত অনুসরন ও ভ্রান্ত উপাসনার বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
এই আলোচনার সুবিধার জন্য প্রাথমিক ভাবে, প্রধানতম একেশ্বরবাদী ধর্মগুলোর গ্রন্থে বর্ণিত সৃষ্টিকর্তা (Jehovah, YHWH) ও আল্লাহ’র স্বরুপ অনুধাবন জরুরী; কারন বিশ্বাসীদের সিংহভাগই এর কোন না কোনটিতে আস্থাশীল।
YHWH নামটি দেখলেই প্রথমে একটু হোঁচট খেতে হয় এই ভেবে যে এ শব্দের উচ্চারণটি কি হবে? কেন এই খটোমটো শব্দ?
প্রাচীন হিব্রুভাষায় কোন স্বরবর্ণের ব্যবহার ছিলনা, যে কারনে শব্দটি এভাবেই লেখ্য।
আবার একই সাথে দ্বিতীয় প্রত্যাদেশে অকারনে YHWH এর নাম নেয়ার বিষয়ে বিধি নিষেধ (ঈশ্বরের রূপ কল্পনা নিষিদ্ধ অর্থে) থাকায় ইহুদিরাও YHWH কে ভিন্ন একটি নাম Adonai বলে সম্বোধন করত। তবে প্রাচীন গ্রীক ভাষার সহায়তায় শব্দটির উচ্চারন যে Yahweh, সে বিষয়টি আমরা নিশ্চিত হই; যা পরবর্তীতে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে Jehovah তে পরিণত হয়। [Aid to Bible Understanding (p. 885)]
আদি ইসরায়েলীদের একেশ্বরবাদী হওয়াটাকে বহু আধুনিক ধর্মীয় ইতিহাসবেত্তাই প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, ফলে ইহুদীরাই প্রথম একেশ্বরবাদের প্রচারক কিনা, সে বিষয়টিতে সম্পূর্ণ নিশ্চিত না হওয়া গেলেও একটি সময়ে তারা যে একেশ্বরবাদকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরেছিল সে বিষয়টি নিশ্চিত। মুলত Yahweh’র ধারনা ও প্রতিষ্ঠার বিষয়টি এবং ইহুদী জাতির বা ইহুদী ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর ইতিহাসটি তাদের ধর্মগ্রন্থ ওল্ড টেষ্টামেন্টে বিধৃত, যা অবিচ্ছেদ্য ও অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। স্মর্তব্য যে, Yahweh নিরাকার নন, তাঁর দৈহিক আকৃতি মানুষের মতই।
প্রাচীন আরামাইক ভাষার নবী শব্দটি হিব্রুতেও গৃহীত এবং ন্যায়পরায়ণ, স্থিতধী ও উন্নত নৈতিক চরিত্রের লোকেরাই নবী এবং তারাই সৃষ্টিকর্তার প্রতিনিধি হওয়ার যোগ্য; এ বিশ্বাস ইহুদীদের চিরকালীন। সেই সুত্র ধরেই মুসা এবং তদঞ্চলের সকল কথিত নবী একই ভাবে চিত্রিত। [Hebrew Bible and Ancient Versions: Selected Essays of Robert P. Gordon]
মুসা ভিন্ন অন্য নবীতে আস্থাশীল হওয়া সত্ত্বেও খ্রিস্টধর্মাবলম্বীরা জেহোবা (Jehovah, YHWH) কেই সৃষ্টিকর্তা মানে, সেই একই নামে ডাকে, এবং ওল্ড টেস্টামেন্টকে তাদের ধর্মগ্রন্থ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়; যদিও তারা যীশু প্রচারিত বাণীগুলোকে নিউ টেস্টামেন্ট হিসেবে যোগ করে, তা সত্ত্বেও খ্রিস্টধর্মাবলম্বীরা এই উভয় অংশকে একত্রে ধর্মগ্রন্থ বাইবেল নামে স্বীকৃতি দেয়। মুল খ্রিস্টান ধর্ম একেশ্বরবাদী ইহুদী ধর্ম থেকে উদ্ভুত হয়েও রোমান সম্রাট কন্সটান্টাইনের প্রভাবে তা একেশ্বরবাদের মূলনীতি থেকে সরে গিয়ে পেগান বহুইশ্বরবাদী ধর্ম থেকে বহু রীতি গ্রহণ করে।
মরুচারী পেগান আরব গোষ্ঠীর সাথে ইহুদী ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর ইতিহাস কোন ভাবেই সম্পৃক্ত নয় বলেই ধর্মতাত্ত্বিক বিচারে ইসলামের আল্লাহর স্বরুপ YHWH থেকে অনেকটাই ভিন্ন।
বস্তুত প্রাক ইসলামী আরবের পৌত্তলিক আরবেরা চন্দ্র দেবতা আল্লাহকে এক এবং অদ্বিতীয় তো মনে করতোই না, বরং আল্লাহ’র ধারনাটি ছিল বহুঈশ্বরবাদী; যা ইসলামী যুগে সমূলে উত্পাটন করে আল্লাহকে YHWH এর আলোকে সর্বময় ক্ষমতার একেশ্বরবাদী সৃষ্টিকর্তায় পরিণত করা হয়।
কুসংস্কারচ্ছন্ন আরবদের মনে এই বিশ্বাস ছিল যে পৃথিবী জ্বিনজাতি দিয়ে পরিপূর্ণ এবং আল্লাহর সাথে তাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক বিদ্যমান। আল্লাহ’র পুত্র এবং কন্যার ধারনাতেও তারা বিশ্বাসী ছিল।
[সূরা আল্-আন্-আম ৬/১০০]
সেই ধারনাটি থেকে ইসলামের আল্লাহও শেষাবধি মুক্ত হতে পারেননি। [ সূরা আল্-সাফ্ফাত ৩৭/ ১৫৮] .
মুসলমান পণ্ডিত ও মুসলমান ঐতিহাসিকদের বড় একটা ত্রুটি হল অসমর্থিত তথ্যকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার অপচেষ্টা করা, এবং সেই একই প্রচেষ্টায় তারা YHWH এবং আল্লাহকে এক করে দেখবার প্রয়াস করেছেন।
Yahweh ও আল্লাহ’র মিল কোথায়? কেনইবা তারা আলাদা?
Yahweh’র শিক্ষা ও আল্লাহ’র শিক্ষার তফাতটা কোথায়, কেন তাদের স্বরুপ একই ভাবে মূর্ত নয়, কেন তারা ভিন্ন ধারনার ঈশ্বর, সেটি নিচের তুলনামুলক আলোচনায় স্পষ্ট হবে। [ এই আলোচনায় তুলনামুলক ধর্মতত্ত্বের অংশটিকে অগ্রাহ্য করে শুধুমাত্র সরাসরি তফাতগুলোকে রাখা হয়েছে ]
মুসলমান ঐতিহাসিকেরা যে যে কারনে Yahweh ও আল্লাহ’কে সদৃশ্য মনে করেন,
- ছয় দিনে বিশ্বসৃষ্টি [ সূরা ইউনুস ১০/৩]
– নিজেকে একক এক উপাস্য বলা [ সূরাতুল মায়েদাহ ৫/৭৩, সূরা আন্-নিসা ৪/৮৭]
– নিজেকে আদমের সৃষ্টিকর্তা দাবী করা [ সূরা আল-বাক্বারাহ ২/৩০, ২/৩১]
– তিনি ইবরাহিমেরও উপাস্য বলে দাবী করা [ সূরা আল-বাক্বারাহ ২/১২৫]
– ফেরাউন ও তার সভাসদদের নিকট তিনিই মুসাকে পাঠিয়েছেন বলে দাবী [সূরা আল আ’রাফ ৭/১০৩]
– মারইয়াম-তনয় ঈসাকে তিনিই পৃথিবীতে পাঠান বলে দাবী [আল্-ইমরান ৩/৪৫-৫১]
– তিনি সত্যতার সাথে কিতাব নাজিল করেন, যা পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের সত্যায়ন করে [আল্-ইমরান ৩/৩]
অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করেই মুসলমান ঐতিহাসিকদের এমন দাবী অচিরেই হঠকারীতায় পরিণত হয় কারন Yahweh ও আল্লাহ’র বৈসাদৃশ্যও বিদ্যমান। কোরআনে Yahweh’র নাম বা তাওরাদ/ ইঞ্জিলের কোথাও Allah এর কথা উল্লেখিত নেই। অথচ ইসাইয়া-৮ এ তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, “আমিই প্রভু| আমার নাম যিহোবা| আমার মহিমা আমি অপরকে দেব না| যে মহিমা আমার পাওয়া উচিত্ সেই প্রশংসা মূর্ত্তিদের আমি নিতে দেব না [স্মর্তব্য যে, সেই সময়ে আল্লাহ ছিলেন কাবা ঘরের মূর্তি মাত্র] ।
Yahweh নিরাকার নন, তাঁর দৈহিক আকৃতি মানুষের মতই; আল্লাহ নিরাকার বলেই কথিত, যদিও তাঁর আরশ আছে।
তাওরাদে বলা আছে জিহোভার সন্তানের কথা, আবার বাইবেল [সামসঙ্গীত Psalms ২:৭-১২] অনুযায়ী জিহোভার পুত্র হলেন ঈসা; কোরআন [ সূরা আন্-নিসা ৪/১৬৩] বাইবেলকে সত্যগ্রন্থ মেনে নেওয়ার পরও আল্লাহ বলছেন তাঁর কোন সন্তান নেই, যা স্পষ্টতই সাঙ্ঘর্ষিক।
আল্লাহ বেশ কয়েকবার তাঁর নিজ আয়াত নিজেই রহিত করেন বা বিস্মৃত করিয়ে দেন [সূরা আল-বাক্বারাহ ২/১০৬] বা এক আয়াতের স্থলে অন্য আয়াত উপস্থিত করেন [সূরা নাহল ১৬/১০১]; কিন্তু জিহোভা কখনই পরিবর্তনশীল নন [মালাখি Malachi ৩/৬] এবং তাঁর বাণী চিরকাল থাকে [সামসঙ্গীত Psalms ১১৯/৮৯]
ওল্ড টেস্টামেন্ট, নিউ টেস্টামেন্ট উভয়ই মুসার দশ প্রত্যাদেশ (Ten Commandments) এর শিক্ষাকে মৌলিক বললেও কোরআনের শিক্ষা সেটাকে মেনে নেয়না; কোরআনের মতে সেগুলো বিকৃত এবং কোরআন সে শিক্ষাকে পরিশুদ্ধ ও বর্ধিত করেছে।
অতএব, ধর্মগ্রন্থের বানীতেই আল্লাহ ও জিহোভা নাম, শিক্ষা ও নৈতিকতায় সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্র।
সেক্ষেত্রে একেশ্বরবাদী হিসেবে পরিচিত ধর্মগুলোতেও ঈশ্বর রূপ একইভাবে বর্ণিত নয়, সকলেই ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে ভিন্ন ভিন্ন ঈশ্বরেরই আরাধনা করে চলেছেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ২:৫৮