একদা এক ভার্সিটি পড়ুয়া ছেলে ছিল। তাহার দুটি তীক্ষ্ণ কান, একটি খাড়া গম্বুজ আকৃতি নাক,নাকের উপর চশমা ছিল। ফিট ছয়েকের ছিপছিপে রোগা পাতলা দেহখানি নিয়া সে অতিশয় ভাবিত ছিল। বেচারা আন্ডারওয়েট। সে মনস্থীর করিল বহুত হইয়াছে। এইবার না হইলেই নয়। একটি টিউশুনি না পাইলে আর যে পোষায় না। আধাপেটা খাইয়া আর কয়দিন। এই জিনিস অবশ্য গত মাস ছয় ধরিয়াই চলিতেছে। জেলা শহরে টিউশুনি নেহাতই সোনার হরিণ স্বরূপ। ঐদিন ইচ্ছাদেবী অবশেষে মুখ তুলিয়া চাহিলেন। বালকটি দুইটি অবোধ শিশুকে পড়াইবার দায়িত্ব পাইল। শিশুদ্বয়ের একজন ষষ্ঠ আরেকজন চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। প্রতিদিন বিকাল হইলেই সে হাটিয়া হাটিয়া উহাদের বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হইত। হাটিতে হাটিতে হরেকরকম খাবারের ছবি আসিয়া তার মানসপটে হানা দিত - এই যেমন রসগোল্লা, দৈ-মিষ্টি, ঘিয়ে ভাজা পরোটা ইত্যাদি। এইসব দূর্লভ বস্তুর কথা ভাবিতে ভাবিতে একসময় সে বিশ্ববিদ্যালয় হইতে ক্রোশ খানেক দূরে অবস্থিত বাসাটিতে পৌছাইয়া যাইত।
ভাগ্য সুপ্রসন্ন হইলে কোন কোনও দিন এটা সেটা মিলিত বৈকি। একজন ঘোমটা পরা তরুনী মাঝে সাঝে এক খানা চিনা মাটির পাত্রে খান কতক বিসকিট আর গেলাস ভর্তি পানি রাখিয়া যাইতেন। সিস্টেম ব্রেক হইলে কাপ খানেক চা-ও মিলিত। তবে উহাকে নেহায়েত কম দামী পাতার তিক্ত স্বাদ যুক্ত পানিও বলা চলে। বালক যা পাইত গিলিয়া লইত। ইহাই বা মিলিবে কোথায়।
দিনের পর দিন শিশুদ্বয়ের মুখের দিকে খালি পেটে তাকাইয়া থাকিতে থাকিতে বালক ক্রমশ ক্লান্ত হইয়া উঠিতেছিল। তথাপি টিউশুনি উহার একমাত্র ভরসা বিধায় আশায় বিক বাধিয়াছিল, ভাবিত “আজি যে শিক্ষক আগামী দিন সে ভক্ষক (ভাল অর্থে)“। আজি কেবল চা মিলিয়াছে পরশু টাও মিলিবে। হায়াত নউত রিজিক বিবাহ সবই উপরউলার হাতে। যাই হউক ঐদিন ইচ্ছা দেবী যারপরনাই আনন্দিত ছিলেন। ঈশ্বর অবশেষে একমাসের ছুটি মঞ্জুর করিয়াছেন।
দুপুরবেলা তেমন কিছু খাওয়া হয় নাই। এই গরমের দিনে কড়া রোদে ভর দুপুর বেলা অনেকটা পথ হাটিয়া আসিতে হইয়াছে। বালকটির পেট বারং বার মোচড় দিয়া উঠিতে ছিল। এরই মাঝে বড় শিশুটি একটি কিম্ভুত কিমাকার দৃশ অংক নিয়া আসিল, কষিতে হইবে। এই ব্যাক্তিকে ডিফারেন্সিয়াল ইকুয়েশান হইতে সরল সুদকষা অব্দি সকলই শিখিতে হয়। শিশুদ্বয় অতীব দুষ্ট প্রকৃতির। একটা দিনও পড়া শিখিয়া আসে না। সাত পাঁচ ভাবিয়া বালক অংক কষিয়া দেখে ছোট শিশুটি অবাক দৃষ্টিতে উহার প্রতি চাহিয়া রইয়াছে আর বড়টি মিটিমিটি হাসিতেছে। ছোটটি হঠাৎ বলিয়া উঠিল- স্যার একটু আসি?
শিশুদের ব্লাডার অতিশয় দুর্বল হয়, সে ভাবিল টয়লেট চাপিয়াছে বুঝি। কহিল- যাও তাড়াতাড়ি আসিবা। তড়িত গতিতে যাইবা ঐ গতিতে ফিরিয়া আসিবা, বুঝিয়াছ। এইদিকে ক্ষুধারাম পেট হইতে কাধ অবধি চলিয়া আসিয়াছেন এই বুঝি মাথায় চাপিয়া বসিল। ভেতর হইতে হঠাৎ শিশুটি আসিয়া বলিল – স্যার আপনি একটু ভেতরে আসেন। বালকের মাথা চক্কর দিয়া উঠিল। বাচ্চাদিগকে মাঝে মধ্যে বকা ঝকার চেষ্টা করিয়া থাকে বটে তবে তা অধিকাংশ সময়ই ব্যাক ফায়ার হইয়া ফিরিয়া আসে। শিশুদ্বয় অতীব দুষ্ট। বেচারা লঘু পদে অন্দর মহলের দিকে হাটা দিল। মাঝখানের রুমটিতে একটা বেশ বড় টেবিল পাতা। কোন জানালা বিশেষ নাই। বাসাটি তেমন বড় কিছু নহে, মধ্যম আয়ের পরিবারে যেমনটি হয় আরকি। অন্ধকার থাকায় এইদিনের বেলাও আলো জ্বালাইয়া রাখা হইয়াছে। শিশুটি উহাকে টেবিলে বসিতে বলিয়া পলাইল। বালকটির কপালে এই শীতের দিনেও কিঞ্চিৎ ঘাম জমিয়া উঠিল। কি হইতে পারে?
আগেই বলিয়াছি এই বেলা ইচ্ছা দেবী অতি প্রসন্ন চিত্তে ছিলেন। বালকটি রুদ্ধশ্বাসে দেখিল এক অপূর্ব মায়াবতি বালিকা একথালা ভাত আনিয়া বালকটির সামনে রাখিয়া দিল। মৃদ্যু স্বরে কহিল – খান। সামান্য ভাত আর ডাল বালকটির নিকট অমৃতসম ঠেকিল। ডালের চচ্চড়ি আর ডিম ভাজা দিয়া খাওয়া শেষ করিয়া তৃপ্তির ঢেকুর তুলিবে এমন সময় দেখে বালিকা দরজার নিকট দাড়াইয়া মিটিমিটি হাসিতেছে। এক্ষণে বালকের মস্তিষ্কের কলকব্জা সচল হইল। ক্ষুধার যন্ত্রণা মাথা হইতে নামিয়া পায়ে ভর করিয়াছে। পা দুখানি বিরাট আটার বস্তার ন্যায় ভারী মনে হইতেছে। মুখচোরা ফিরিয়া আসিয়া দেখে শিশুদ্বয় কাটাকুটি খেলিয়া সমস্ত পাতা ভরাইয়া ফেলিয়াছে। খাইয়া বালক অতিশয় তৃপ্ত বিধায় বিশেষ আমলে না নিয়া অংকের খাতা খুলিয়া বসিল। কিন্তু একি শেষের অংকের নিম্নে গুটিগুটি হরফে ইহা কি লিখা – হস্তাক্ষর দেখিয়াতো তার নিজেরই বলিয়া মালুম হয়। এতটা অপদস্ত বোধহয় সে সারা জীবনে আর হয় নাই। বড় শিশুটি সুর করিয়া পরিতে আরম্ভ করিল -
“ক্ষুধা পায় ক্ষণে ক্ষণে
অষ্ট প্রহর বেলা
আমরণ ধুর ছাই
পেটের বড় জ্বালা”
--------------------------------
পুমশ্চঃ গল্পের দ্বিতীয় পর্ব বের হবে কিনা তা আপ্নারাই ঠিক করেন। গল্পের মাঝে একটি ভুল আছে। ভুলটা ইচ্ছাকৃত। বলেনতো ভুলটা কি ?
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুন, ২০১৩ ভোর ৪:৪৯