আজ বিকেলটা অন্যরকম। আকাশটা হলুদ হয়ে আছে। মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবীটাই যেন হলুদ। ইদানীং বিকেলে হাল্কা শীত পরে। এই সময়ে বারান্দায় বসে কফি খেতে বেশ লাগে! কফির মগটা পাশে রেখে ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিল ইসরাত। দূর দিগন্তপানে তার শূন্য দৃষ্টি। সময় ঘনিয়ে আসছে! জীবনে প্রথমবারের মত মা হতে চলেছে ইসরাত। প্রথম মা হতে গিয়ে অধিকাংশ মেয়েই বোধহয় খুব উচ্ছ্বসিত থাকে, সন্তানকে ঘিরে স্বপ্নে বিভোর থাকে! কিন্তু ইসরাতের বেলায় এমন ঘটেনি। সে নিজের মাঝে বিশেষ কোন অনুভূতি খুঁজ়ে পায়না। ডক্টর যেদিন বললেন, তার সন্তান মেয়ে হবে, কথাটা শোনা মাত্রই ইসরাতের খুব হাসি পেয়েছিল। ডক্টর হয়ত ভেবেছিলেন, মেয়ে সন্তান হওয়ার কথা শুনে ইসরাত খুব খুশি হয়েছে। আসলে, হাসির কারণ ছিল অনুমান মিলে যাওয়া। বহু আগে থেকেই ইসরাত জানত, তার প্রথম সন্তান মেয়েই হবে। কারণ, সে মনে প্রাণে যা আশা করে, সবসময় তার বিপরীতটাই ঘটে!
আজ হঠাৎ একটা দিনের কথা খুব মনে পড়ছে। সেদিন ভার্সিটিতে সকালের ক্লাসটা না হওয়ায় বান্ধবীরা মিলে ক্যান্টিনে খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছিল। এক বান্ধবী নতুন হাত দেখা শিখেছে, তাই সবার হাত দেখছিল আর ভবিষ্যতবাণী করছিল। একেক জনের ভবিষ্যতের কথা শুনে হাসতে হাসতে সবার অবস্থা কাহিল। ইসরাতের হাত দেখতে দেখতে ও বলেছিল, ইসরাতের প্রথম সন্তান নাকি মেয়ে হবে। একথা শুনে ইসরাত বলেছিল, আমি জানি আমার মেয়েই হবে! ইসরাতের বলার ভঙ্গিটা হয়ত অন্যরকম ছিল, তাই সাথে সাথে পাশ থেকে আরেক বান্ধবী বলে বসলো, কেন? তোর মেয়ে পছন্দ নয়? ইসরাত দৃঢ় গলায় বলেছিল, না! সাথে সাথে সব বান্ধবী চিৎকার করে উঠেছিল। মেয়ে হয়েও তুই মেয়ে সন্তান পছন্দ করিস না! ভার্সিটি পাশ দিয়েও সনাতন মনোভাব নিয়ে বসে আছিস! ছি! ছি! সবাই সেদিন ইসরাত কে ধিক্কার দিচ্ছিল। কিন্তু ইসরাতের মনের কথা শুনবার মত ধৈর্য্য কারো হয়নি। ইসরাতও কিছু বলেনি। কি হবে বলে? সব মেয়ের জীবন তো আর তার মত কষ্টের নয়!
বড় দুই ভাইয়ের পর ইসরাতের জন্ম। একমাত্র মেয়ে আর শেষ সন্তান হিসাবে বাবা-মা’র আদরটা এত বেশি ছিল যে ইসরাতের মনে হত, তাকে যেন সবসময় খাঁচায় বন্দী করে রাখা হয়। একটু বড় হতেই নানান বিধি মেনে চলার নির্দেশ দিতে থাকেন বাবা, মা। ঘরের বাইরে আর খেলতে যাওয়া যাবে না! যখন তখন ছাদে যাওয়া যাবে না! সমবয়সী যেসব ছেলেদের সাথে এতদিন খেলতো, তাদের সাথে খেলা দূরে থাক, প্রয়োজন ছাড়া খুব বেশি কথাও বলা যাবে না! ইসলামে নাকি নিষেধ আছে। এমনকি ভাইয়ারা ঘরে একা থাকলে নাকি সেই ঘরেও যাওয়া যাবে না! কারণ ছেলেরা একা থাকলে নাকি তাদের মাথায় শয়তান ভর করে আর তখন তারা মেয়েদের ক্ষতি করে। এসব উদ্ভট কথা শুনলে খুব মন খারাপ হত ইসরাতের। কিন্তু পূরো অবিশ্বাসও করতে পারত না। বাবা-মা কি ভুল বলবেন? তাছাড়া অবিশ্বাস করলে মা এমন সব বাস্তব গল্প শোনাতেন যা ইসরাতের একটুও ভাল লাগত না! আবার অমান্য করলে বাবাও খুব রাগ করতেন। তাই সব আদেশই মেনে চলত ইসরাত। বাবা-মা’র সাথে তাল মিলিয়ে ভাইয়ারাও সমানে শাসন করত – এই! তুই আর স্কার্ট পরবি না! ভাল মেয়েরা স্কার্ট পরে নাকি? রাস্তায় কোন মেয়ে স্কার্ট পরলে তো আমরা ক্ষেপাই, আর আমাদের বোন স্কার্ট পরবে? এখন থেকে ওড়না পরবি……
ক্লাস সিক্স থেকেই ইসরাত স্যালওয়ার-কামিজ পরতে শুরু করল। মনের বয়স শৈশবে থাকলেও পোষাকের কারণে হয়ত ওকে বড় দেখাত। আর তাই হয়ত কিছুদিন পরেই এলাকার পরিচিত বড় ভাইয়ারাই ইসরাত কে বিরক্ত করতে লাগল। ও স্কুল থেকে ফিরবার সময় পথ আটকে কথা বলতে চাইত, নাহয় বাসায় ভাইয়ারা না থাকলে ফোন করে কথা বলতে চাইত, বারান্দায় গোলাপ ছুড়ে মারত! ইসরাতের খুব অস্বস্তি হত, কাউকে কিছু বলার সাহসও পেত না! সব মিলিয়ে, ইসরাতও সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকত। নিজেকে আরো আড়াল করে রাখত। গৃহবন্দী ইসরাতের তখন লেখাপড়া ছাড়া আর কোন বিনোদন ছিল না। অথচ্ ভাইয়ারা কি মজা করে বাইরে খেলত, বন্ধুদের সাথে ঘুরে বেড়াত! ছোট্ট বোনটা সারাদিন বাসায় একা কি করে সেকথা ওরা ভাবতই না। ভাববেই বা কেন? ওরা যে বয়সে ইসরাতের চেয়ে অনেক বড়! ওরা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত থাকত। বাবা শুধু পড়াশোনার খোঁজ করতেন আর মা ব্যস্ত থাকতেন সংসার নিয়ে। একধরনের একাকীত্ববোধ, একধরনের বিষণ্নতা নিয়ে ইসরাত বড় হতে থাকে, দেখতে দেখতে একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দেয়।
হঠাৎ কো-এডুকেশনে এসে ছেলেদের সাথে আর ফ্রি হয়ে মিশতে পারছিল না ইসরাত। অন্যদিকে ভার্সিটির প্রোগ্রাম কিম্বা পিকনিকগুলোতে অংশ নিতে চাইলেও বাবা-ভাই কেউই অনুমতি দিত না। বলত, ওগুলো নিরাপদ না, নানান দুর্ঘটনা ঘটে! বিয়ের পর স্বামীর সাথে যেখানে খুশি যাবি।
জেদ করে কোন কাজ করতে শেখেনি ইসরাত। তাই সবসময়ই অভিভাবকদের কথা মেনে নিত, হোকনা যতই অভিমান! নিরবে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে ভাবত, হয়ত একদিন স্বামী নামের সেই রাজকুমার সত্যি আসবে তার জীবনে, মুক্ত করে দিবে তার এই বন্দী দশা!
এদিকে ভার্সিটিতে বছর তিনেক না যেতেই ইসরাতকে বিয়ে দেয়ার জন্য অস্থির হয়ে গেল সবাই। বাবা, মা, ভাই, আত্মীয়, প্রতিবেশী সবার মুখেই এক কথা। শাফিন ছিল ছোট ভাইয়ার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। যেমন মেধাবী, তেমনি অতিশয় ভদ্র! প্রায়ই বাসায় আসত। ইসরাতের সাথে কোনদিন আলাপ হয়নি, চেহারায় চিনত মাত্র। শাফিন ভাইয়ের চেহারাটাই কেমনজানি ভালমানুষ টাইপের। পড়ালেখা ছাড়া যে আর কোনদিকে তার বিশেষ আগ্রহ নেই তা মুখ দেখলেই বলে দেয়া যায়। হঠাৎ একদিন শাফিন ভাই অনেক মিষ্টি নিয়ে হাজির। জানা গেল, চাকুরী পেয়েছেন, বিদেশি কম্পানি, অনেক বেতন! সেদিনই প্রথম শাফিন ভাই ইসরাতের সাথে বেশ খানিক্ষণ কথা বললেন। সবই অবশ্য লেখাপড়া বিষয়ক কথাবার্তা! তবু অসস্তি লাগছিল ইসরাতের। হঠাৎ এত কথা বলার কি আছে! ভাবল, হয়ত ভাল চাকুরী পেয়ে খুশির চোটেই কথা বলেছে!
এর মাস খানেক পর শুরু হল আজব সব ঘটনা! শাফিন ভাই হঠাৎ এক দুপুরে ল্যান্ড ফোনে কল দিলেন। ছোট ভাইয়ার তখন বাসায় থাকবার কথা না, এটা তো ওনার ভালই জানার কথা! তবু কেন ফোন দিলেন? ইসরাতের কেমন জানি খটকা লাগল। ভাইয়া না থাকায় শাফিন ভাই সেদিন ইসরাতের সাথেই সৌজন্য কথা বলছিলেন। এরপর মাঝে মাঝেই দুপুরে ফোন করতেন তিনি। এমন একটা অবস্থা হল, যে ঐ সময়ে ফোন বাজলেই ইসরাত চমকে উঠত। ঐ সময়ে মা ঘুমিয়ে থাকতেন, বাকিরা বাইরে। তাই ইসরাতকেই ফোন ধরতে হত। এভাবে ধীরে ধীরে শাফিন ভাইয়ের সাথে ইসরাতের কথা হতে থাকে। টুকটাক কথার মাধ্যমেই কার কি পছন্দ, ভাললাগা, কার স্বভাব কেমন সব জানাশোনা হয়ে গেল। ইসরাত অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, ও অজান্তেই শাফিন ভাইয়ের ফোনের অপেক্ষা করে, বেশিরভাগ সময় শাফিন ভাইয়ের কথাই তার মাথায় ঘোরে। তাহলে কি ও শাফিন ভাইয়ের প্রেমে পরে যাচ্ছে?!!
এরপর একদিন শাফিন ভাই ইসরাত কে একটা গান শোনালেন – আমি তো প্রেমে পরিনি, প্রেম আমার উপরে পরেছে……! গানের কথাগুলো শুনে ইসরাত হতভম্ব! কি করবে বা কি বলবে বুঝে পায় না! অনেক ক্ষণ চুপ করে থাকার পর শাফিন ভাই-ই সেদিন সরাসরি বলে, ইসরাতের আপত্তি না থাকলে ওদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে। ইসরাত জিজ্ঞেস করেছিল, তার মত মেয়ে কে পছন্দ করার কারণ কি? শাফিন ভাই বলেছিলেন, তোমার মত ভাল মেয়ে এই যুগে সহজ়ে পাওয়া যায় না! ইসরাতের সেদিন মনে হয়েছিল, তার ভাল হয়ে থাকার পুরস্কার বুঝি আল্লাহ দিতে চলেছেন এবার! সেই দিন গুলো, সেই অনুভূতিগুলোই যেন ইসরাতের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতি। শাফিন ভাইয়ের মার্জিত আচরণ, লাজুক কথাবার্তা, কেয়ারিং মনোভাব সব মিলিয়ে ইসরাতের ভীষণ ভাল লেগে যায়। বুঝতে এতটুকু বাকি থাকে না যে সে শাফিন ভাই কে প্রচন্ড ভালবেসে ফেলেছে! তবু বলতে সাহস পায় না! যদি বলার পর আবার সব হারিয়ে যায়!
শাফিন আর ইসরাতের ব্যাপারটা একসময় অভিভাবক মহলে চলে যায়। শাফিনের অভিভাবক শ্রেণীর কিছু আত্মীয় একদিন বেড়াতে আসেন। ইসরাত বুঝতে পারে কি ঘটতে যাচ্ছে! বাড়ির সবাই খুব খুশি! যেন ঈদ লেগেছে বাড়িতে! ইসরাতের বিয়ে নিয়ে দুই ভাবির পরিকল্পনার শেষ নেই। বড় ভাইয়ের ছেলে-মেয়েরাও খুব খুশি। দেখতে দেখতে বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসল। সেই প্রথম বোধহয় ইসরাত বিষণ্নতাহীন এক জীবনানুভূতি টের পেয়েছিল। তার দুচোখ তখন স্বপ্নে ভরপুর! তার বন্দী জীবনের মুক্তি ঘটতে যাচ্ছে বুঝি! শাফিন নিশ্চয়ই তাকে অনেক ভালবাসা দিয়ে আগলে রাখবে! কোনদিন কাঁদতে দিবে না! দুজন মিলে অনেক ঘুরে বেড়াবে! অনেক মজা করবে! ইসরাতের ভীষণ আনন্দ হয়! তাকে যে বাড়ি ছেড়ে যেতে হবে একথা তার মাথাতেই আসে না! আর বিয়ে হলেই কি বাড়ি ছাড়তে হয়? কই? তার ভাবিরা তো যতদিন খুশি বাপের বাড়ি থাকে! ভাইয়ারাও গিয়ে থাকে! তাহলে তো শাফিনও ওদের বাসায় এসে থাকবে! আর ইসরাত যেরকম ভাল মেয়ে, শাফিনের পরিবারের সবাই নিশ্চয়ই ওকে খুব আদর করবে! বিয়ের দিন সবার মুখে এক কথাই বলতে শুনেছিল ইসরাত…… বর-বউ দুজনেই এত খুশি? এমনটা নাকি খুব একটা দেখাই যায় না! আসলে ভালবাসার জয় হলে তো বর-বউ খুশি থাকবেই!
হাসি মুখে শাফিনের হাত ধরে চলে এসেছিল ইসরাত। শাফিন সত্যিই ইসরাত কে অনেক ভালবাসে! তা নইলে ওকে ভাগ না দিয়ে একটা খাবারও খেতে পারে না কেন? এক গ্লাস শরবত দিলেও অর্ধেকটা ইসরাত কে খাওয়াবেই। সারাক্ষণ খোঁজ করবে ইসরাতের কোন অসুবিধা হচ্ছে নাকি! কিন্তু, স্ত্রীর প্রতি এই অনুরাগ, এই ভালবাসা যেন সহ্য করতে পারেন না শাফিনের মা! সরাসরি এমন সব মন্তব্য করে বসেন যে ইসরাতের চোখে পানি চলে আসে। অথচ্ এতে শাফিনের কোন প্রতিবাদ নেই, মন খারাপও হয় না ওর। শাফিন ওকে নিয়ে বেড়াতে গেলে কিম্বা ইসরাতদের বাসায় কটাদিন থাকলেই ওর মা মুখ ভার করে থাকেন, ছেলের সাথে কথা বলেন না! তখন ছেলে খুব কষ্ট পায়। ধীরে ধীরে ইসরাতদের বাসায় গিয়ে আর থাকতে রাজি হয় না।
শাফিন মায়ের বড় ছেলে, তারউপর বাবা বেঁচে নেই। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে, আর ছোট দুই ভাইবোন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, ওরা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত! কাজেই, মা তো নিঃসুঙ্গবোধ করবেনই। তাই মায়ের কাছে থাকাটাই যেন বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করে শাফিন। কোনক্রমেই মা কে কষ্ট দিতে চায়না সে। এদিকে ইসরাত আপ্রাণ চেষ্টা করেও শাফিনের মায়ের সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে না! অথচ্ ইসরাতের মা তার দুটো ছেলেবউকেই যেন নিজের মেয়ের থেকেও বেশি আদর করেন! ডক্টর আর ইঞ্জিনীয়ার বউ - দুজনেরই ব্যস্ততার শেষ নেই, ভাবিরা কোনদিন রান্না ঘরে ঢুকলে ইসরাত চুপ করে বসে থাকতে পারত না, মনে হত, ইস! ভাবিরা কাজ করছেন, আর ও আরাম করে বসে আছে! ইসরাত নিশ্চিত ছিল, তার শ্বশুরবাড়ির পরিবেশও হয়ত এমনই হবে। অথচ্ এখানে ছেলে বউ মানেই যেন নিজেকে বলি দিয়ে অন্যের জন্য করে যাওয়া।
নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে নূন্যতম যে সময় প্রয়োজন, ইসরাত তা পায় নি। বিয়ের পরদিন থেকেই তার মাথায় একের পর এক দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। দায়িত্ব পালনে আপত্তি ছিল না ইসরাতের, সেক্ষেত্রে সকলের সহযোগীতাটুকু অন্তত আশা করেছিল। কিন্তু তাও জোটেনি। বড় বউ হিসাবে তার মাথায় সমস্ত দায়িত্ব চাপানো হলেও, কর্তৃত্ব করবার কোন ক্ষমতা ছিলনা ইসরাতের। শাফিনেরও ছিলনা। সবই তার মায়ের দখলে। এমনকি, কোন বেলা কি রান্না হবে, বিকেলে কি নাশ্তা হবে সবই তার নির্দেশমত করতে হবে। ইসরাতের কোন স্বাধীনতা নেই, মন চাইলে হুট করে বাইরে বের হতেও পারে না। কোথায় ভেবেছিল, বিয়ের পর ও বন্দী জীবন থেকে মুক্ত হবে! বরং ওর মনে হত, ওর হাত পায়ে এখন শেকল বাঁধা! প্রথম প্রথম এসব নিয়ে অভিযোগ করতে গেলে শাফিনের সাথে ঝগড়া হত, শাফিন ইসরাত কে ভুল বুঝত, ইসরাত কেই দোষ দিত! বিয়ের পর কোথায় দুজন রোমান্টিক সময় কাটাবে, তা না! কান্নাকাটি করে ইসরাত অসুস্থ হত ঠিকই, কিন্তু তাতে শাফিনের যেন কিছু আসত যেত না!
শাফিন কেমনজানি বদলে যেতে থাকে ক্রমশঃ। ইসরাতের মনে হতে থাকে, ইসরাতকে পেয়ে গেছে বলেই যেন ওর প্রতি এখন শাফিনের আর কোন আগ্রহ নেই। এখন সে ইনকাম বাড়ানোর নেশায় ব্যস্ত। চাকুরীর বাইরে আরো চুক্তিভিত্তিক কাজ নেয়া, ব্যবসায় টাকা খাটানো ইত্যাদি তার প্রতি মুহূর্তের সঙ্গী। এত বেতনেও নাকি শাফিনের সংসার চলছে না! চলবে কি করে? দুই ভাইবোনের লেখাপড়ার খরচেইতো অধিকাংশ চলে যায়। তারপরেও কি তাদের আবদারের শেষ আছে? আজ এটা চাই তো কাল ওটা! ল্যাপটপ, নেটবুক, লেটেস্ট মোবাইল, এম্পিথ্রি প্লেয়ার, ক্যামেরা, টিভি, ফ্রীজ – যখন যার যা লাগছে, সব এনে হাজির করছে শাফিন। তবু কারো কৃতজ্ঞতাবোধ নেই। অথচ্, ইসরাত ভাইয়াদের কাছে প্রয়োজনীয় টাকা চাইতেও খুব সঙ্কোচবোধ করত। আর ভাইয়ারা নিজ থেকে কিছু দিলেতো আনন্দ রাখার জায়গাই হতনা! এদিকে ইসরাত হাতখরচার বাইরে কিছু আবদার করলেই শাফিনের নানান অজুহাত! অতীত-বর্তমান সব মিলিয়ে ইসরাতের অনেক রাগ হয়, মন খারাপ হয়। সারাক্ষণ শুধু মা আর ভাই-বোনদের কথা ভাবে শাফিন। ঠিক আছে, ভাবুক না! তাই বলে নিজের বউ কে বঞ্চিত করবে? স্বামীর কাছে স্ত্রীর স্বাভাবিক যে চাওয়া পাওয়া সেদিকেও যেন শাফিনের তেমন কোন আগ্রহ নেই।
ইসরাত বুঝে পায় না, এই শাফিনই কি তাকে ভালবাসার কথা শুনিয়েছিল? এই শাফিনই তাকে ফোন করে এত গল্প করত? অথচ্ আজ ইসরাতকে পাশে নিয়ে সে কোন কথাই খুঁজ়ে পায়না! শাফিনের মা, আত্মীয়রা, ভাইবোনেরা যখন ইসরাতকে কথা শোনায়, অমানবিক আচরণ করে, শাফিন তখন দেখেও দেখে না, বুঝেও প্রতিবাদ করে না। ইসরাতের অশ্রু ভরা চোখের দিকে তাকিয়েও শাফিনের মন কাঁপে না! আদর করে সান্ত্বনা দেয় না! ইসরাত আশা করে, আড়ালে হলেও শাফিন অন্তত সবার পক্ষ থেকে নিজেই ইসরাতের কাছে দুঃখ প্রকাশ করুক। প্রতিবাদ না করুক, তার পরিবারের মানুষগুলো যে ঠিক করেনি- এটুকু অন্তত স্বীকার করুক! কিন্তু শাফিন সর্বদাই নির্বিকার, ভাবলেশহীন! তবে কি এজন্যই শাফিন বউ হিসেবে ভাল মেয়ে খুঁজছিল? নইলে, ইসরাতের ভালত্বের মর্যাদা দেয়না কেন!
কষ্ট চাপতে না পেরে একদিন ইসরাত মা-বাবার কাছে গিয়ে বলেছিল, ও আর ফিরে যাবে না শাফিনের কাছে! অনেক অভিযোগ করেছিল ইসরাত। কিন্তু বাবা-মা কোনকিছুই সিরিয়াসলী নেননি, নাকি নিতে চান নি? উলটো বুঝিয়েছিলেন, ইসরাত যেন শাফিনের কথা মতই চলে। সবসময় শাফিনকে খুশি রাখে। শাফিনের মার সাথেও যেন কোনদিন খারাপ ব্যবহার না করে! তাছাড়া সংসার ছেড়ে চলে এলেই যে তার জীবনে বর্তমানের চেয়ে অধিক ভাল কিছু ঘটবে এমন নিশ্চয়তা কি আছে?
বাবা-মা’র কোন উপদেশই সেদিন ইসরাতের কানে ঢোকেনি, ইসরাত শুধু বুঝতে পেরেছিল, বাবা-মাও আর তার পাশে নেই, আর ভাইয়ারা তো দূরের ব্যাপার! সত্যিইতো, ঘর ভাঙ্গা নারীর অযথা ঝামেলা কেই-বা নিতে চাইবে? আর সমাজই কি তাকে নিরাপদ আশ্রয় দিতে পারবে? বরং আঙ্গুল তুলে ওকে দেখাবে! বাপ-মা এত ঘটা করে মেয়ের বিয়ে দিয়েছে, আর সেই মেয়ে সংসার ফেলে চলে এলে বাপ-মার সম্মান বলে আর কিছু বাকি থাকবে?
ইসরাত সেদিন চুপচাপ চলে এসেছিল শাফিনের বাড়িতে। এরপর থেকে সে কেমনজানি হয়ে গেছে। শ্বাশুড়ীর আদেশ অনুযায়ী মেশিনের মত কাজ করে যায় চুপচাপ। ইসরাত কে সময় না দিয়ে শাফিন দিনের পর দিন কাজে ডুবে থাকে। তবু ইসরাত আর অভিযোগ করে না। আজ ও সবকিছুই মেনে নিয়েছে। ইদানীং, প্রয়োজন ছাড়া শাফিনের সাথে কথাও বলতে ইচ্ছা করে না! শাফিনের মুখটা দেখলেও কেনজানি রাগ লাগে! তাই যতটা সম্ভব নিজের মাঝেই ডুবে থাকে ইসরাত। ইসরাত যে কত বদলে গেছে তাও কি শাফিনের চোখে পরে না?
নিজেকে খুব অসহায় লাগে ইসরাতের। মেয়ে হয়ে জন্মাবার দুঃখ প্রতি পদে পদে টের পায় ও। যে সমাজে শৈশব থেকেই ছেলে-মেয়েতে পার্থক্য তৈরি করা হয়, যে সমাজের স্বামী নামের পুরুষটি উচ্চশিক্ষিত হয়েও স্ত্রীর পরম বন্ধু হতে পারে না, স্ত্রীর যথাযথ মর্যাদা দিতে পারে না, যে সমাজের একজন মা তার ছেলের বউ কে নিজ মেয়ের মতন আপন করে বুকে টেনে নিতে পারে না, সেই সমাজে আরেকটি মেয়ের জন্ম দিতে সাহস পায় না ইসরাত। একজন ভীতু মা, একজন বিষণ্ন মা কি কখনও পারবে তার কন্যা সন্তান কে সঠিক ভাবে মানুষ করতে? পারবে কি একটা সুস্থ সমাজের নিশ্চয়তা দিতে? সুখের সংসার গড়ে দিতে? এস.এস.সি পাশ করা ইসরাতের মায়ের জীবন যেভাবে কেটেছে, ত্রিশ বছর পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর দিগ্রী নেয়া সত্ত্বেও ইসরাতের জীবনে ঠিক তাই ঘটছে অবিরাম! কাজেই, আগামী ত্রিশ বছর পর কি মেয়েদের জীবন আদৌ পাল্টাবে? হয়তবা পাল্টাবে, তার কন্যা হয়ত তখন সমাজের আধুনিকতায় গা ভাসিয়ে উচ্ছন্নের দিকেই ধাবিত হবে! আর ইসরাত হবে সেই পাপী সন্তানের মা! তাইতো সেদিন বান্ধবীদের বলেছিল, ও কন্যা সন্তান প্রত্যাশা করে না!