"সিদ্বান্ত"
-- পথিক
গুড়ি গুড়ি বৃস্টিতে মাধবী ভিজছে।কাঁধে তার আলোয়ানের ওড়নাটা যেন গায়ের সাথে লেপ্টে আছে।কিন্তু তাতে তার ভ্রুক্ষেপ নেই।গায়ের সালোয়ার ও কামিজের বিবর্ণ ধুলা যেন পানির সাথে না ধুয়ে প্রকৃতির বিরূপ পরিবর্তণের সাক্ষী হিসেবেআরো স্থায়ী হয়ে বসে আছে। সর্বাঙ্গে ভেজা চুপচুপা,এখন হয়তো তার মা পাশে থাকলে বলতো , 'মাধবী ভিতরে আয়, আর বৃস্টিতে ভিজিস্ নে! ঠান্ডা লাগবে।'
ঘরে আসলেই মা হয়তো তার আঁচল দিয়ে মাধবীর মুখ মুছিয়ে দিতেন। কত ভালোই না মা বাসেন মাধবীকে। হাজার হোক মায়ের একমাত্র মেয়ে। বাবা নেই। বাবা কি,তা মাধবী জানে না। কখনো মাকে প্রশ্ন করেনি। করবেই বা কেন? অভাব থাকলেই তো মানুষের পাওয়ার আকাঙ্খা জাগে।
মাধবীর এখনো মনে পড়ে, সে যখন ক্লাস থ্রিতে পড়তো, মা তাকে প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার সময় ফুচ্কা খাওয়াতেন। তার তো ফুচকা খুব পছন্দ মা সেটা জানেন। মাধবী জানতো তার মা -ই তার কাছে সবকিছু। মা ছাড়া সে থাকতেই পারবেনা। কোন প্রয়োজন, কোন অসুবিধে, মা তো আছেনই চিন্তা কি?
সেই শীতের ভেজা প্রকৃতির মাঝে দাড়ি য়ে মাধবীর হাত-পা কাঁপতে লাগলো।হাঁটু গেড়ে বসে মাটির দিকে তাকিয়ে তার কেবল ধুসর পান্ডুলিপিতে আবদ্ধ স্মৃতিগুলোই শুধু ভেসে উঠতে থাকে।চোখ যেন ঠিকরে বেড়িয়ে আসতে চায়,মাটিকে আলিঙ্গন করে চেতনালব্ধতায় চলে যেতে চায়।
তার মনে পড়ে,
যখন সে এইচ এস সি প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিল,দেশের সংসদ নির্বাচনের গন্ডগোল হওয়াতে মা তাকে নিয়ে কত উদ্বিগ্ন ছিলো।যেখানে যেতো মা ছায়ার মত তাকে অণুসরন করতেন।
মাধবী বোঝেনা।তার মনে পড়ে, একটু দেরীতে বাড়ি ফেরার কারণে মা তাকে কি মারটাই না মেরেছিলো। অবশ্য মাধবী তাতে কোনো রাগ করেনি। দেশের অবস্থা খারাপ তো তাই।গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা অার নেই, ক্ষমতায় এসেছে সেনানায়ক এলেণ মাহমুদ।স্বৈরাচারী শাসকের রূপ নিয়ে,নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে।
এলেন মাহমুদ এর ক্ষমতায় প্রথম দু'বছর মানুষ ভয়ে থাকতো। পরবর্তীতে দেখা গেলো,এলেণ মাহমুদ যোগ্য শাসক,দশ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের দশটি উন্নত রাস্ট্রের মাঝে স্থান করে নিয়েছে।
মাধবী এখন বিবাহিতা। তিন বছরের ছোট্ট একটি মেয়ে আছে তার। মা! মাতো নেই,বাবার কাছে চলে গেছে।সামনের রক্তে ভেজা শাড়িটি যেন বৃস্টির প্রতিটি ফোটাকে হত্যা করে চলেছে।অর্ধবন্ধ অবস্থায় চোখ দু'টি যেন মাধবীকে ইশারা করছে।একি হলো!একি হলো!!
মাধবীর এখন একটু হুঁশ ফিরল। চারিদিকে ভাঙ্গা ঘরবাড়ি, পাতাহীন বৃক্ষ, রাস্তায়,বাড়ির ছাদে,গাড়ির নিচে,আনাচে-কানাচে মানুষের দেহের ক্ষতবিক্ষত অঙ্গ। বিধ্বস্ত শহর!আর তারর মা!তার মা পড়ে আছে সেই ফুচকাওয়ালার গাড়িটির পাশে।
"এলেণ মাহমুদ!!!" মাধবীর মন আত্মচিৎকার দিয়ে উঠলো।
এলেন মাহমুদ এখন উন্নত বিশটি দেশের সেনানায়কের একজন।সে তো এখন খুব বড় একজন মানুষ। নিজের স্বার্থের জন্য, আরো বড় দেশের অধিপতি হওয়ার জন ইউরেণিয়ামের জন্য যুদ্ধ লাগিয়ে দিলো। ছি! ছি! এই ছিল কি এলেন মাহহমুদের আধুনিক বাংলাদেশের গড়ার সিদ্বান্ত?
সে আর বসে থাকতে পারলোনা। মিলি!মিলি! আর্তচিৎকারে মৃত লাশ গুলি কেঁপে উঠলো।কিন্তু মিল কই কতবার সে মানা করেছে তাকে ছেড়ে যেতে।
কাঁধে আলতো করে হাতের পরশ।।পিছনে তাকিয়ে দেখে তার স্বামী ফারুক। কোলে মিলি।কিন্তু মিলির মুখটা এতো সাদাটে কেন?চোখের পলক ফেলছেনা কেন?
আর ফারুক বাকরুদ্ধ কেন?
মাধবীর হটাৎ করে দেশের প্রতি ঘৃণা জন্মাতে লাগলো। আর অভিশাপ দিতে লাগলো এলেন মাহমুদকে। তার সিদ্বান্তহীণতার জন্য আর কত মানুষকেই বা ভুগতে হবে?
বুকের ভেতর হঠাৎ প্রচন্ড ব্যথা হতে লাগলো। এ ব্যথা কিসের?শোক না ঘৃণা?