৯ মে, ২০২৩
ভোরের আলো ফুটেছে, পাশ থেকে খট-খট শব্দে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। আমি স্লিপিং ব্যাগের চেইনটা খুলে মাথা বের করে গাড়ির ভিতর থেকে ঘুম ঘুম চোখে বাইরে তাকালাম। মরুভূমির মাঝে এই রেস্ট এড়িয়া, যেদিকে চোখ যায় সুউচ্চ পাহাড় বেষ্টিত এই রেস্ট এড়িয়া, পাহাড়ে কোন গাছ নেই, নেই পাখির কলতান, শুধু আছে নীরবতা আর বাতাসের শো-শো শব্দ। আমার পাশে সাড়ি সাড়ি কিছু গাড়ি পার্কিং করা, ভেতরে সুখ নিদ্রা যাচ্ছে সবাই, হয়ত আমারই মতন পথিক, সারাদিন গাড়ি চালিয়ে রাতে ঘুমিয়ে পরেছিল এখানেই। কয়েকজন মানুষকে দেখলাম খট-খট শব্দ করে গাড়ি থেকে বের হয়ে ওয়াস রুমের দিকে যাচ্ছে। গতকাল লস এঞ্জেলস থেকে সারাদিন গাড়ি চালিয়ে আমার গন্তব্য মরুভূমি রাজ্য এরিজোনাতে এসে পৌঁছেছি, ঘুমিয়েছি এই রেস্ট এড়িয়াতেই। সব ঠিক থাকলে আজকেই পৌঁছে যাব আমার নতুন শহর টুসনে (Tucson)।
ভদ্রলোকের নাম জেকব ওয়াল্টয (Jacob Waltz), তিনি ডাচম্যান বলে খ্যাত। জেকব মৃত্যু পথযাত্রি, বিছানায় শুয়ে মৃত্যুর জন্য ইন্তেজার করছেন, শুধু প্রাণ বায়ু বের হওয়া বাকি তারপরই কেল্লা ফতে! ভদ্রলোজ ১৮৯১ সালে মৃত্যুর আগে বিছানায় বসে একটি ম্যাপ অঙ্কন করে জানিয়ে গেলেন এরিজোনার সুপার স্টেশন নামক পাহাড়ে গুপ্ত ধন এবং সৌন্য মুদ্রা রক্ষিত আছে, যে তা পাবে সেই মালামাল হবে। তার মৃত্যুর পরে হাজার হাজার মানুষ মালামাল হবার লোভে ঝাঁপিয়ে পরল গুপ্তধন খোজার লোভে কিন্তু আফসোস এখন পর্যন্ত কেউই তার হদিস পায়নি। অনেকে বলে এটি একটি কিংবদন্তি, সত্যিকার অর্থে জেকব ডাচম্যান বলে খ্যাত হলেও সে নাকি আসলে একজন জার্মান ইমিগ্রান্ট ছিল। এতদিন পর এখন নিশ্চিন্ত করেই বলা যায় জেকব সাহেব গুপ্তধনের যেই কথা বলে গিয়েছিলেন সেটা আসলে শুধুমাত্র কিংবদন্তই ছিল!
এরিজোনাকে নিয়ে এরকম অনেক কিংবদন্তি এবং লোককথা প্রচলিত আছে। এরিজোনা আমেরিকার মরুভূমি রাজ্য নামে পরিচিত, শুষ্ক তাপমাত্রা, বাতাসে পানির পরিমাণ খুব কম। অনেকের ধারনা হতে পারে আমেরিকার সবচেয়ে হটেষ্ট বা গরম রাজ্য হল এই এরিজোনা! তবে বাস্তবতা হল এরিজোনার বার্ষিক গড় তাপমাত্রার হিসেবে এরিজোনা আমেরিকার দশটি রাজ্যের ভিতরও পরেনা! তবে শুধু দক্ষিণ এরিজোনার তাপমাত্রার গড় হিসেবে করলে সেটা আমেরিকার অন্য রাজ্যগুলো থেকে অবশ্যই প্রথম হবে! গত সপ্তাহে অফিসে আমার বসের সাথে আলাপ হচ্ছিল এরিজোনা নিয়ে, তিনিও সম্প্রতি এই রাজ্যে নতুন এসেছেন, তিনি আমাকে বললেন এরিজোনা প্রচণ্ড গরম তবে তুমি যদি এক বা দেড় ঘণ্টা ড্রাইভ করে পাহাড়ে ঘুরতে যাও, যত পাহাড়ের উপরে উঠবে তত ঠাণ্ডা পাবে, পাহাড়ে উপরে গেলে তোমাকে শীতের কাপড় নিয়ে যেতে হবে। সেখানে বরফ আছে এবং মানুষজন বরফে স্কি করে সেখানে। এটা আমার জন্য চমক-পদ তথ্য ছিল, এরিজোনাতে স্কি করা যায় এটা আমার জানাই ছিল না!
এরিজোনার কোন এক লেইকের ছবি।
সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে ঘুম থেকে উঠেছি, আমি হাতমুখ ধুয়ে যাত্রার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। মোবাইলের ম্যাপে দেখাচ্ছে টুসন শহরে যেতে বড়জোর তিন-সাড়ে তিন ঘণ্টার মত লাগবে! গাড়িতে গ্যাস নেয়া দরকার, তাছাড়া সকালে নাস্তা করিনি, ভাবলাম মাঝখানে একটি গ্যাস স্টেশনে নেমে গ্যাস নিব আর সকালের নাস্তা সেরে চলে যাব গন্তব্যে। আমি অরিগনে থাকতেই এখানে দুই বেডরুমের একটি বাসা নিয়েছি, অরিগগে এক রুমের বাসায় ছিলাম, দুই রুমের বাসা দু-হাজার ডলারের নীচে নেই সেখানে, আমার ছেলের বয়স সাত তার কড়া নির্দেশ এবার বাসা নিলে দুই-বেড রুমের বাসা নিতে হবে, একটি রুমকে সে তার প্লে-রুম বানাবে! আমার বউ ছেলে এখন দেশে আছে, ঈদ করতে গেছে, এদিকে আমি এক রুম বেডরুম আরেক রুমকে অফিস রুম বানিয়ে বসে আছি! এটা নিয়ে এক ঝামেলা হতে পারে পরে, তবে আমি প্রস্তুত! যাইহোক আমার অফিস থেকে বাসার দুরুত্ব দের থেকে দু মাইলের ভিতর। আমি সাধারণত বাসা নিলে অফিসের কাছেই নেবার চেষ্টা করি।
আমি চলছি গন্তব্যে, রাস্তার দু-ধারে শুধু ধু-ধু মরুভূমি, পাহাড়গুলোতে কোন গাছ নেই বললেই চলে। তবে যখন আসতে আসতে শহরে প্রবেশ করছিলাম তখন একটি জিনিষ লক্ষ্য করছিলাম, আমেরিকার অন্য রাজ্যগুলো থেকে এরিজোনা দেখতে অন্যরকম, এখানকার বাড়িঘরের ডিজাইন, বাড়ির পাশে পাম ট্রি, ক্যাকটাস এবং ছোট ছোট গাছগুলো দেখলে অনেকটা দুবাই-দুবাই একটি ভাইব আসে মনে! এই বৈশিষ্ট্যটুকু সত্যিই চোখে পরার মত। আমি অরিগণ থেকে এসেছি, অরিগণ প্রচণ্ড ঠাণ্ডা ছিল, এরিজোনাতে এসে মনে হল যেন গরম ওভেনে ঢুকে পরেছি! এখানে বলে রাখি এরিজোনা বিভিন্ন কারণে বিখ্যাত হলেও মূলত সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত গ্র্যান্ড কেনিয়নের কারণে, এই গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন দেখতে প্রতিবছর সারা পৃথিবী থেকে প্রায় ৬ মিলিয়ন পর্যটক এই এরিজোনাতে আসে। তাছাড়া এরিজোনা খরচ তুলনামূলক ভাবে আমেরিকার পাশের ষ্টেইট বিশেষ করে ক্যালিফোর্নিয়ার থেকে কম, তাছাড়া এখানকার আবহাওয়া, রৌদ্রজ্জ্বল-দিন বিবেচনা করে অনেক আমেরিকান শেষ বয়সে রিটায়ার্ড করে এই এরিজোনাতে আসে বসবাসের জন্য!
ভদ্র মহিলাটির নাম লা-লরোনা ( La Llorona), তিনি নিজের স্বামীর উপর রাগ করে নিজের সন্তানকে পানিতে চুবিয়ে হত্যা করেন, তার ধারনা ছিল তার স্বামী অন্য কোন মেয়ের সাথে ফষ্টিনষ্টি মানে পরকীয়া করছিল। নিজের সন্তানকে মেরে লা-লরোনা বেশ অনুসূচনায় ভুগে। সহস্র বছর আগের ঘটনা এটি, ধারনা করা হয় এখনো লা-লরোনার ভাটাকতে হুয়ে আতমা এরিজোনাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে! পিতামাতারা তাদের সন্তানদের রাতে কোন নির্জন রাস্তা দিয়ে বিশেষ করে কোন পানির সামনে দিয়ে যেতে নিষেধ করেন কারণ লা-লরোনা আত্তা একা পেলে নাকি চুবিয়ে মারে! এটা একটি মেক্সিকান কিংবদন্তি, আমি আগে উল্লেখ্য করেছিলাম আমেরিকার এরিজোনা, টেক্সাস, ক্যালিফোর্নিয়া-সহ আরো অনেক রাজ্য এক সময়ে মেক্সিকোর অধীনে ছিল তাই এখানকার অনেক কিংবদন্তি, কালচার মেক্সিকো থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে এসেছে।
পৌছে গেলাম আমার গন্তব্য এরিজোনার টুসন শহরে।
যাইহোক এবার কিংবদন্তি থেকে বাস্তবতায় ফেরা যাক। আমি একটি গ্যাস স্টেশন দেখে গাড়ি থামিয়ে গাড়িতে গ্যাস নিলাম, তারপর একটি দোকান থেকে সকালের নাস্তা সারলাম। সকাল তখন সাড়ে আটটার মত বাজে, আমার ম্যাপে দেখাচ্ছে সকাল দশটার মাঝে আমি পৌঁছে যাব আমার এপার্টম্যান্টে। আমি এর মাঝে আমার এপার্টমেন্টের ম্যানেজারের সাথে কথা বলে ঠিক করলাম কখন তার সাথে দেখা করে এপার্টমেন্ট বুঝে নেব। ম্যানেজার বলল আসার সময় বাসা ভাড়া এবং ডিপোজিট বাবদ মালপানি যেন ক্যাশে নিয়ে আসি, আমি বললাম তথাস্থ! এবার মনঃস্থির করলাম আর রাস্তায় থামাথামি নেই একেবারে চলে যাব গন্তব্যে। আমি সকাল দশটার দিকে পৌঁছে গেলাম এপার্টম্যান্টে, ম্যানেজারের সাথে দেখা করে এপার্টমেন্টের কিছু ফর্মালিটি সেরে এপার্টমেন্ট বুঝে নিলাম। অনেক ধকল গেল গত কয়েকদিন, অবশেষে পৌঁছে গেলাম।
আমার প্রচণ্ড ভালোলাগা এবং একইসাথে কিছুটা দুঃখবোধ হচ্ছে। দেখতে দেখতে এই কয়দিনের যাত্রাটা শেষ হয়ে গেল, অনেকটা ভাবের মাঝে ছিলাম এতদিন, যখন লম্বা কোন জার্নিতে থাকি তখন বাস্তবতা থেকে ভিন্ন এক জগতে থাকি, নিজের তৈরি এক কাল্পনিক জগত যেখানে সব কিছু হয় আমার নিজের ইচ্ছাতেই, নিয়মের কোন তোয়াক্কা করতে হয় না, ক্ষুধা লাগলে খেয়ে নিলাম কোন রেস্টুরেন্টে, চাইলে ঝিমিয়ে নিলাম গাড়ির ভিতর, অনেকটা যেখানে রাইত সেখানেই কাইত! আসলে পৃথিবীতে নিয়মের ভিতর কোন মজা নেই বরং নিয়ম ভাঙ্গার মাঝেই সব সুখ এবং শান্তি যেন নিহিত আছে তবে মানুষকে নিয়ম মানতে হয় এবং মানতে হবে, এই কয়টা দিন নিয়মের তোয়াক্কা না করেই কাটিয়েছি তাই কিছুটা নষ্টালজিক অনুভূত হচ্ছে বৈকি। এই মাসের পনের তারিখে আবার নতুন চাকরিতে জয়েনিং, আবার ফিরে আসবে বাস্তবতার জগতে।
আজ এ পর্যন্তই। সবাইকে ধন্যবাদ এই সিরিজটির সাথে থাকার জন্য।
এরিজোনাতে বেশ কিছু জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি, বিভিন্ন সময়ে তোলা এরিজোনার কিছু বিচ্ছিন্ন ছবিঃ
এটি একটি স্টেইট পার্কে তোলা ছবি
কয়েকদিন আগে তোলা ২০০ বছর বয়সী গাছ, The Great Mesquite!
আগের পর্বগুলো
আমেরিকার অরিগণ থেকে এরিজোনায় রোড ট্রিপ (পর্ব চার): লস-এঞ্জেলেসে একদিন
আমেরিকার অরিগণ থেকে এরিজোনায় রোড ট্রিপ (পর্ব তিন): পৌছে গেলাম ক্যালিফোর্নিয়ার সান-ফ্রানসিসকো
আমেরিকার অরিগণ থেকে এরিজোনায় রোড ট্রিপ (পর্ব দুই): যাত্রা শুরুর দিন
আমেরিকার অরিগণ থেকে এরিজোনায় রোড ট্রিপ (পর্ব এক): ভ্রমনের ইতিকথা
কয়েকদিন আগে এরিজোনার একটি স্টেইট পার্কে গিয়েছিলাম ঘুরতে। এরিজোনা যে শুধু মরুভূমি রাজ্য ব্যাপারটা তা নয়, এখানে অনেক কিছু আছে এক্সপ্লোর করার জন্য। ভিডিওটি এখানে শেয়ার করছিঃ
সরাসরি ইউটিউব ভিডিও লিংক