আমার এক প্রাক্তন পাকিস্তানি সহকর্মী ওমর বলছিল, এক গবেষণায় দেখা গেছে পাকিস্তানিরা নাকি সবচেয়ে বেশী খরচ করে নানা রকমের মুখরোচকর খানা-খাদ্যে। খাবার টেবিলে বসে দানারদান খানা-খাদ্য পেটে চালান করার ক্ষেত্রে তাদের জুরি মেলা ভার। পাকিস্তানে কিছু খাবারের রেস্তোরাঁয় বিছানা বালিশেরও বন্দোবস্ত আছে, কাস্টমার চাইলে খাওয়া দাওয়া করে ভাত ঘুমও দিতে পারে। যাইহোক পাকিস্তানের নাম নেয়াতে অনেকে বেজার হতে পারে, তাদের দিল খুশ করার করা জন্য বলছি আমরা বাঙ্গালীরাও কিন্তু খানা খাদ্যে পিছিয়ে নেই বরং আমি বলব এগিয়েই আছি!
আমরা বাঙ্গালীরা আণ্ডা বাচ্চা থেকে শুরু করে বৃদ্ধ সবাই বেশ ভোজন রসিক। কোন বিয়ে বাড়িতে আণ্ডা বাচ্চা বৃদ্ধ সবাই গোল হয়ে খেতে বসেছেন, দেখবেন আশে পাশের সবাই সেই বৃদ্ধকে দেখিয়ে বলবে ওই চাচার প্লেটে বেশী করে খাবার দে, চাচা কয়দিন বাচে ঠিক নাই! অথবা মোল্লার প্লেটের মুরগীর ঠ্যাংটা শেষ হয়ে গেলে দেখবেন মোল্লা সাহেব পাশে বসা হাজী সাহেবকে দেখিয়ে বলে এই তোরা হাজি সাহেবের প্লেটের দিকে তাকাস না কেরে? আরেকটা মুরগীর ঠ্যাং-দে হাজি সাহেবরে, মতলব সবার চোখ যেন মোল্লার খালী প্লেটের দিকে পরে এবং হাজী সাহেব যাতে খুশী হয়ে উল্টো বলে আরে না না আপনি নেন আরেকটা মুরগীর ঠ্যাং মোল্লা সাহেব। এতে প্রতীয়মান হয় আমরা পাকিস্তানীদের থেকে এগিয়ে গেছি, আমরা বটম-মুক্ত বাস্কেট নই বরং বটম-যুক্ত বাস্কেট!
যাইহোক খাবার নিয়ে জুলিয়া চাইল্ড সাহেব (সাহেব নাকি মুহ্তারামাহ হবে ঠিক জানিনে) "খাবারের স্বাদটা তখনই সুন্দর হয় যখন আপনি তা নিজের পরিবারের সাথে বসে খান।" অর্থাৎ খাবার পারিবারিক বন্ধন শক্ত করতেও সাহায্য করে। গিল মার্কস সাহেব এক ডিগ্রি উপরে গিয়ে বলেছেন "কোনও সমাজ বা জাতি সম্বন্ধে জানতে তাদের খাবার সম্পর্কে জানা শুরু করুন।" জর্জ বার্নাড শো সাহেবের ভাষায় "খাবারের প্রতি ভালোবাসার চেয়ে অন্য কোনও ভালোবাসা এত মহৎ হতে পারে না।" কথাটায় সত্য পদার্থ থাকার কথা কারণ কথায় আছে পেটে ভাত না থাকলে নাকি স্বর্গেও শান্তি নাই!
খাবার নিয়ে আমি কিছু মজার কৌতুক শেয়ার করছি এখানে! এক ভদ্রলোক তার বউকে ইংরেজি শিখতে বলেছে। তার বউ ইংরেজি শেখার জন্য খুব আগ্রহ দেখাচ্ছে এবং ইংরেজি শেখার চেষ্টা করছে। একদিন তার বউ দুপুর বেলায় তার স্বামীকে খেতে দিয়ে বলল "এই নাও তোমার ডিনার।" স্বামী বলল "তুমি একটা গাধা এখন হচ্ছে দুপুর আর তুমি এটাকে ডিনার বললে এটা কে বলতে হবে লাঞ্চ।" স্ত্রী রাগে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে বলল "তুমি একটা গাধা, তোমার চৌদ্দ-গুষ্টি গাধা, এগুলো গত রাতের বাসি ভাত দিয়েছি। তাই এটা ডিনার। এবার বুঝলে?" ভদ্রলোক খামোশ হয়ে গেল।
রাতের বেলায় সেই ভদ্রলোক আর তার বউ একসঙ্গে খাবার খাচ্ছিল। খাবার খাওয়ার সময় বউকে আহ্লাদিত গলায় বলল "জানু আমি বলছি কি.." ভদ্রলোককে কথা বলা থামিয়ে দিয়ে বউ বলল "খাবার সময় আমাকে জানু মানু ডাকবে না, খাবার সময় একদম খামোশ থাকবে, খাওয়ার সময় কথা বলতে নেই।" রাতের খাবার পর বউ তার স্বামীকে বলল "জানু তুমি খাবার সময় কি বলতে চেয়েছিলে এখন বল।" ভদ্রলোক বলল ইয়ে মানে তখন বলতে চেয়েছিলাম তোমার খাবার প্লেটে একটি তেলাপোকা ছিল, তুমি-তো বলতে দিলে না এবং সেটা চিংড়ি মাছ ভেবে খেয়ে ফেললে।" বউ উত্তর শুনার পর ভদ্রলোকের অবস্থা কি হয়েছিল সেটা বুদ্ধিমান পাঠক মাত্রই অনুমান করার কথা, তারপরও এই লেখার শেষের দিকে এই ভদ্রলোক আবার আসবে আপাতত মূল প্রসঙ্গে আসা যাক।
আমি আমেরিকার অরিগনে আছি। অরিগনে সামার শেষ, এখন থেকে সামনের বছর মে পর্যন্ত টানা বৃষ্টি নামবে, সূর্যের দেখা মেলে কালে ভদ্রে। গত সপ্তাহ থেকে টানা বৃষ্টি হচ্ছে, বৃষ্টি দেখলে অনেকের খিচুড়ি খেতে মনে চায় তবে আমার মনে চায় কাচ্চি বিরিয়ানি খেতে। আমি জানি ঝড় বৃষ্টি বাংলাদেশেও হয়েছে কিছুদিন আগে, অনেকে এই ঝড়ে অনেক কিছু হারিয়েছে, কেউ বেমারে পরে বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে আছে। এই সময়ে খানা খাদ্যের ছবি দেয়া ঠিক না, তবে ভাবলাম আমি খানা খাওয়া ছেড়ে দিলেই সবাই বিছানা থেকে ফাল দিয়ে দাঁড়িয়ে যাবে ব্যাপারটা এমন না, তাই ভাবলাম আজ ছুটির দিন, বৃষ্টি হচ্ছে কাচ্চি রান্না করি!
খাসির কাচ্চি।
ভোজন রসিক আদম হিসেবে আমার অল্প বিস্তুর সুপরিচিতি আছে। দেশে গেলে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে ঘুরে ঘুরে এগুলো খাই। গতকাল শুক্রবার ছিল। গতকাল রাতে অফিস থেকে ফিরেই কাচ্চি রান্না করেছিলাম। কয়েক সপ্তাহ আগে এক ফার্মে গিয়ে হালাল গরুর মাংস নিয়ে এসেছিলাম (আট জন মিলে একটি গরু দিয়েছিলাম)। ফ্রিজে গরুর মাংস অনেক, গতকাল রাতে গরুর কাচ্চি করেছিলাম, তবে ভাল ছবি নেই। উপরের কাচ্চি গত সপ্তাহে রান্না করেছিলাম খাসির মাংস দিয়ে।
কাচ্চি এবং বিরিয়ানি আমার দুটোর খুব পছন্দের, আমার সব চেয়ে বেশী পছন্দের খাবার হল কাচ্চি। তাই এই দুটো খাবার রান্না শেখা আমার কাছে ফরজ ব্যাপার ছিল। এখানে বলে রাখা ভাল আমার হাতের বিরিয়ানি এবং কাচ্চা খেয়ে উহ-আহ করেনি এমন আদম খুব কমই আছে! চামে দিয়া একটু নিজের গুণগান করলাম আরকি, কথায় আছে না নিজের ঢোল নিজেই পিটাতে হয়, অন্য কাউকে দিলে ফাটিয়ে ফেলার সম্ভাবনা আছে!
তবে এখানে বলে রাখি কাচ্চি বা বিরিয়ানি দুটো খাবারই কিন্তু আমাদের অরিজিনাল বাঙ্গালী খাবার নয়। কাচ্চা উর্দু শব্দ যার মানে কাচা, কাচ্চি সাধারণত কাচা মাংসের সাথে চালকে একসাথে পাকানো হয় তাই এর নাম কাচ্চি। কাচ্চি আমাদের দেশে এসেছে মোগলদের হাত ধরে। বিরিয়ানির ইতিহাস নিয়ে বলতে হয় জনশ্রুতি আছে এটা নাকি সম্রাট শাহজাহানের আমলে শুরু হয়েছে। মমতাজ নাকি একদিন তাদের সৈনিকদের ব্যারাকে গিয়ে দেখতে পেলেন প্রত্যেক সৈনিকের স্বাস্থ্য ভঙ্গুর। তিনি বাবুর্চিকে নির্দেশ দিলেন সৈনিকদের জন্য মাংস এবং চাল মিশিয়ে স্বাস্থ্যকর কোন খাবার বানাতে, তার কথামত বাবুর্চি তৈরি করলেন সুস্বাদু এই খাবার। যাইহোক বিরিয়ানি বা কাচ্চির ইতিহাস বা পাতিহাঁস জানানো আমার এই লেখার উদ্দেশ্য নয়।
কাচ্চি বা বিরিয়ানি নিয়ে অনেক কপচালাম। যাইহোক এবার কথামত সেই ভদ্রলোক এবং বউ এর প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। বউকে তেলাপোকা খাইয়ে ভদ্রলোকের কি হয়েছিল সেটা বলা যাক। বউ এর ঝাড়ি খেয়ে ভদ্রলোক গেল সমুদ্রে গোসল করতে, ভদ্রলোক এমনিতেই ছিল জম কিপ্টা। সমুদ্রে গোসল করতে গিয়ে ডুবে যেতে লাগলো। সে তখন দোয়া করতে লাগলো বিধাতার কাছে, “হে বিধাতা আমি যদি বেঁচে যাই তাহলে ১০০০ জন এতিমকে ২ বেলা বিরিয়ানি খাওয়াবো “ তখনি এক বড় একটা স্রোত এসে তাকে সাগর তীরে ঠেলে দিলো! সে তখন দাঁড়িয়ে বলল, “হাহ! কিসের বিরিয়ানি!!” তখন আচানক আরেকটা বড় ঢেউ এসে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো! তখন সে বলতে লাগলো. “ইয়ে মানে আমি বলতে চাচ্ছি চিকেন বিরিয়ানী নাকি কাচ্চি বিরিয়ানি ।
বুদ্ধিমান পাঠক মানে বুঝতে পারা উচিৎ এখানে যেই কৌতুকগুলো ব্যাবহার করা হয়েছে এগুলো আমার পেট থেকে বের হয়নি। আমি শুধু চরিত্রগুলো পরিবর্তন করে প্রত্যেকটি কৌতুককে একটি সূত্রে গেঁথেছি। যাইহোক শেষের কৌতুকটি আমাকে হেভিওয়েট লেখক হুমায়ুন আহমেদের একটি লেখাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, যদিও এখানে খুব প্রাসঙ্গিক নয় তবে এখানে লেখতে লোভ সামলাতে পারছি না।
অনেক দিক আগে পড়েছিলাম, নিজের স্মৃতি থেকে লেখেছি, হুমায়ূন আহমেদ যেভাবে বর্ণনা করেছে সেভাবে বলার চেষ্টা করছি, আমি এক কঠিন নাস্তিককে চিনতাম, যে কিনা খাতা কলমে নিয়ে অংক কষে প্রমাণ করে দেয় ঈশ্বর বলতে কিছু নেই। কিছুদিন পর সেই নাস্তিকের ঠোটের কোনে কালো কিছু একটা হল, ডাক্তার সেটা ক্যান্সার হিসেবে সন্দেহ করল। সেই নাস্তিক ভয় পেয়ে গেল এবং একজন পাক্কা আস্তিক হয়ে গেল, এমনই আস্তিক যে কিনা তাহাজ্জুদের নামাজও বাদ দেয় না। ডাক্তার কয়েকদিন পর পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানাল সেটা ক্যান্সার নয়, ভয়ঙ্কর কিছু নয় এমনিতেই সেরে যাবে। ভদ্রলোক শুনে হাফ ছেড়ে বাঁচল এবং আবার পুনরায় নাস্তিক হয়ে গেল! এই গল্পে এখানে বলার অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই, কেউ নিজের গায়ে নিবেন না, রাস্তার ময়লা নিজের গায়ে নেবার দরকার নেই!
এবার ইতি-টানা যাক, আজ বৃষ্টির দিন, দুপুরে এক প্লেট কাচ্চি পেটের ভিতর চালান করে দিলাম, আসলে একটু সাবধানে খাই বেশী খেলে পেটের ভিতর নাড়িভুঁড়ি ছেড়ে দাও বাবা কেধে বাঁচি বলে আন্দোলন শুরু করতে পারে। খাওয়া দাওয়া সেরে একটু পাশের শহরে গিয়েছিলাম বাজার করতে, আমাদের পাশের শহরে ফ্রেশ মাছে দোকান আছে, ভাবলাম কিছু মাছ আনি। তবে খাবার নিয়ে এই কিচ্ছা কাহিনী শুনে ব্লগারেরা খাবারের উপর আবার ঝাঁপিয়ে পরবেন না, এমনিতেই দেশে জিনিষ পত্রের দাম বেড়ে চলছে, বেশী খেয়ে জিনিষ পত্রের দাম বাড়িয়ে দিয়েন না! ফ্রান্সিস বেকন সাহেব কিন্তু আবার সতর্ক বানী উচ্চারণ করে বলেছেন "যত বেশি করে খাবার খাবে, তত বেশি ঔষধের প্রয়োজন হবে।" তাই সাধু সাবধান, নিজ দায়িত্বে খান! তবে যদি নিতান্তুই বেশী খেতে চান, আপনাদের জন্য একটি কথা আছে "পরাজয়ে ডরে না বীর!"
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে অক্টোবর, ২০২২ সকাল ৮:১০