সেই নুহু নবীর আমলের কথা, সবে মাত্র কলেজ পেরিয়েছি । বাড়ির পাশের চাচাতো ভাইয়ের টং দোকানে বসে ধুমছে আড্ডা দেই তখন । সাধারণত হালকা বা ছোটখাটো কোন বিষয়ে আড্ডা দেওয়ার মত নাদান আমরা না, আমাদের আড্ডার বিষয় বস্তু খুবই উঁচুমানের , এই যেমন সোভিয়েত ইউনিয়ন কেন ভেঙ্গে গেল, আমেরিকার আগ্রাসীনীতির অবসান কবে অথবা চীন বা ভারতের সুপার পাওয়ার হবার অন্তরায় কি কি ? দোলনা থেকে কবরে এক পা দেওয়া বিভিন্ন বয়সি আড্ডা প্রিয়রা আড্ডা দিচ্ছি, আমাদের আড্ডার মধ্যমণি মধ্যবয়সী চাচাত ভাই , জ্ঞানী মানুষের মত তার মাথার মাঝখানটায় ফকফকা সুবিশাল একটা টাক, কিছুক্ষণ পর-পর মাথার চারপাশ থেকে চুল টেনে তা ঢাকার চেষ্টা করেন । টাকের উপর আমার একটা ছোটখাটো গবেষণা আছে , সেটা এখানে শেয়ার করছি । সাধারণত দুই ধরনের টাক হয় আমাদের সমাজে, কারো কারো টাক দেখতে খুবই তেলতেলে এবং পিচ্ছিল, এই ধরনের টাকওয়ালারা খুবই জ্ঞানী হয়। এদের সাধারণত মধ্যরাতে টকশোতে দেখা যায় । আরেক ধরনের টাক আছে দেখতে খসখসা ,মনে হয় বাটাল দিয়ে খুটিয়েছে মাথার মাঝখানে। এই কিসিমের টাক সাধারণত চিন্তা ভাবনায় এবং অভাব অনটনে হয় । এরা সাধারণত আমজনতা, জ্ঞানের পরিধি আট-দশটা সাধারণ মানুষের মতই । আমার চাচাতো ভাইয়ের টাকটা অদ্ভুত কারণে তেলতেলে এবং পিচ্ছিল । তিনি আমেরিকার আগ্রাসীনীতির ঘোর বিরোধী, পারেতো ঝাঁঝালো ভাষায় আমেরিকাকে ভস্মীভূত করেন ।
তখন চৈত্রকাল , চৈত্রের খরায় মাঠ ঘাট ফেটে চৌচির । ঐ দিকে আমরাও টং দোকানে বসে টক-শো করছি, ‘ দেশে এত প্রাকৃতিক সম্পদ থাকার পরও কেন দেশ আগাচ্ছে না ?’ এই হল আমাদের আজকের টক-শো-এর বিষয় বস্তু । আণ্ডা বাচ্চা সবাই যার যার বক্তব্য পেশ করছে , চৈত্রের উওপ্ততা আমাদের টকশোতেও ছড়িয়ে পরেছে ! হঠাৎ লক্ষ্য করলাম দোকানের পিছনের দিকে গোটখোল গাছটা (গাছটার ভাল নাম আমার জানা নাই) ভেঙ্গে পরে আছে । বেশ কয়েকদিন আগে ঝর বৃষ্টি হয়েছিল , হয়ত তখন ভেঙ্গেছিল গাছটা । অদ্ভুত কারণে গাছের ভাঙ্গা অংশ দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে পানি ঝরছে , দুই একজন দাড়িয়ে দাড়িয়ে এটা অবলোকন করছে।
আরও কয়েকদিন কেটে গেল । চৈত্রের খরায় গাছ-পালা অঙ্গার অথচ গাছ দিয়ে এখনও পানি ঝরছে , এটা হতে পারে না। কথায় আছে ‘আ-কথা বাতাসের আগে ছড়ায়’ তবে গাছ দিয়ে পানি ঝরায় খবরটি বাতাসের আগে না বরং ঝরের বেগে ছড়িয়ে পরল চারদিকে । এটা সাধারণ কোন গাছ নয় অসাধারণ গাছ । দলে দলে মানুষ দেখতে আসতে শুরু করল , সবারই এক প্রশ্ন – ‘এর রহস্যের কি?’ আমি গাছের পাশের দাড়িয়ে থাকতাম উৎসুক জনতার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে অশেষ নেকি হাসিলের জন্য !! এই ধরনের ক্ষেত্রে সাধারণত দার্শনিকের মত উত্তর দিতে হয়, আমি গাছের পাশে দাড়িয়ে থেকে দার্শনিকের মত উপরের দিকে নির্দেশ করে বলতাম “সবই লীলা খেলা” !
লীলা খেলা যাতে বন্ধ নয়া হয়ে যায় সেজন্য আমি সুযোগ বুঝে গাছে উঠে পানি ঢেলে আসতাম লোক চক্ষুর অন্তরালে । আমার চাচাত ভাই বলত দেখ ‘মানুষ কত বোকা’, আমি বলতাম ‘দেখি ব্যাপারটা কত দূর যায়, কিছু বইলেন না !’ এবার আর মানুষ শুধু দেখতে এসেই সন্তুষ্ট না, লোটা, খালি বোতল এবং মানত নিয়ে আসা শুরু করল । দূর দূরান্ত থেকে বোরকা পরে আসা শুরু করল । আমি যদি লাল কাপর মাথা বেধে গাছের পাশে বসে থাকতাম তবে নিশ্চিত সবাই আমাকে গাছ বাবা বানিয়ে দিত ।
এটা আমাদের দেশের একটা চিত্র, মানুষের এই কুসংস্কার বা অন্ধ বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করেই দেশে আনাচে কানাচে ভণ্ড বাবারা তাদের কর্ম সম্পাদান করছে । আর মানুষও সচেতনতার অভাবে প্রতারণার শিকার হচ্ছে , একদিন গভীর রাতে একজন আমাকে ফোন দিয়ে বলল ‘আমি জিনের বাদশা।’ আমিতো মহা খুশী, আমার মত মানুষের কাছে স্বয়ং জিনের বাদশার ফোন, ভাবা যায় !! তবে এটা ছ্যাচড়া বাদশা, টাকা চায় । আমি বললাম ‘হে জিনের বাদশা, আপনি সালতানাতের শাহেনশা , টাকা পয়সার অভাব নাই, উল্টো আপনি আমাকে টাকা পয়সা দিয়ে লাল বানিয়ে দেন !’ জিনের বাদশার আমার কথা পছন্দ হল না, তিনি আমার লাইনটা কেটে দিলেন । যাইহোক এখনও অনেক মানুষ আছেন, জিনের বাদশার ফোন পেয়ে টাকা পাঠিয়ে দেন, দরকার সচেতনতার । সচেতনতা বৃদ্ধি পেলে কুসংস্কার আপনা আপনি উঠে যাবে, এতে যেমন আমরা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হব তেমনি দেশ এইয়ে যাবে ।