somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

“তোমার মা” “তোমার বাবা” “তোমার ভাই” “তোমার বোন”

১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ১২:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

“তোমার মা”
“তোমার বাবা”
“তোমার ভাই”
“তোমার বোন”

শব্দগুলো পরিচিত লাগছে?

আমি শিউর, বেশীরভাগ বিবাহিত মেয়েদের কাছে শব্দগুলো খুবই পরিচিত।
কারন তাদের জামাই থেকে এ শব্দগুলো এভাবে শুনে শুনে তারা অভ্যস্থ।

কিছু জিনিষ আমি খুব খেয়াল করি।

জেন্ডার নিয়ে পিএইচডি করেছি বলে না।
জেন্ডার নিয়ে রিসার্চ করেছি বলে না।

আমাদের সমাজে, যে কেউ- একজন মানুষ হিসেবে নূন্যতম যতটুকু জেন্ডার সেনসিটিভ হওয়া দরকার, ততটুকুও যদি হয়- তাহলে এ বিষয়গুলো তার চোখে না পড়ে উপায় নেই।

যেখানেই যাই, যাকেই দেখি, যেভাবেই দেখি, কিছু বিষয় অটোমেটিক আমার নজরে পড়ে যায়।

তারমধ্যে এটা একটা-

ছেলেরা তাদের বউদের পরিবার নিয়ে যখন কথা বলে, খুব খুব খুব রেয়ারলি দেখেছি তারা শ্বশুড় শ্বাশুড়ির অনুপস্থিতিতে তাদেরকে আব্বা বা আম্মা বলে রেফার করে।

সবচে কমন এড্রেস হলো ‘তোমার বাবা’ ‘তোমার মা’।

***

অনার্সে পড়ার সময় আমার রুমের বারান্দায় বেশ অনেক গাছ লাগিয়েছিলাম।

তো একবার দেখি হলের নীচে, বিল্ডিং’র পাশেই যেখানে ঝোপ ঝাড় ওখানে দেখতে খুবই সুন্দর একটা পাতাবাহারের গাছের মত হয়েছে নিজে নিজেই।

আমি ওটার একটা কান্ড রুটস সহ ছিঁড়ে নিচ্ছি দেখে দারোয়ান চাচা আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আম্মা, এইটা দিয়া কী করবেন?’

বললাম, আমার বারান্দার টবে লাগাবো।

এরপর প্রায় প্রতিদিন আসা যাওয়ার পথে, যেদিনই উনার ডিউটি পরতো গেটে, আর দেখা হতো, জিজ্ঞেস করতেন, গাছটা ঠিক আছে কিনা।

একদিন বললাম, গাছটা টিকেনি, মরে গেছে।

সপ্তাহ খানেক পর, একদিন সকালে দেখি উনি ছোট্ট একটা পলিথিনে ঐ গাছটারই আরেকটা ছোট্ট অংশ মাটি সহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন।

আমাকে দেখেই বললেন, ‘আম্মা, এইটা আপনার জন্য। ঐ গাছটাই। ইনশাআল্লাহ দেখবেন, এইবার এইটা টিকবো’।

দারোয়ান, আয়া, বুয়া, কাজের মানুষ এরা কোন এক অজ্ঞাত কারনে আমাকে খুব আদর করতেন।
উনাদের আদরে আমি অভ্যস্থ।
তাই দারোয়ান চাচার এই গাছ নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করাতে অবাক হলাম না মোটেও।

অদ্ভুত কথা হলো, গাছটা টিকলো!

ক’দিন পর দেখি ছোট্ট ছোট্ট সবুজ পাতা ছেড়েছে!

খুব অবাক হয়ে এর পরের বার যখন দারোয়ান চাচার সাথে দেখা হলো, জিজ্ঞেস করলাম আমি যেটা লাগিয়েছিলাম, ওটার এত যত্ন করার পরও টিকলো না, কিন্তু আপনি যেটা দিলেন, ওটা টিকলো কেনো?!

উনি চমৎকার একটা কথা বলেছিলেন।

বলেছিলেন-
গাইছ হইলো মাইনষের মত আম্মা। আপনে খালি গাছটা নিছিলেন, যেই মাটিতে হে বড় হইছে, যেই মাটিতে হের জন্ম, হেই মাটি ফালাইয়া গেছিলেন। তাই বাছে নাই। আমি এই অংশটার মাটি সহ নিয়া তারপর হেই মাটির লগে আরো মাটি মিশাইছি। গাছে মাটি চিনে আম্মা। যেই মাটিতে হের জন্ম, হেই মাটি ফালোন যায় না। হেই মাটি ফালাইয়া দিলে হে বাছে না।

***

আমার গার্ডেনিং’র খুব শখ।
কিন্তু কখনোই বড় করে সাধ মিটিয়ে গার্ডেনিং করা হয়ে উঠেনি এখনো।
তাই গার্ডেনিং’র ব্যপারে অত জানি না।

তারপরও যে টুকটাক গাছ লাগাই, চাচার ঐ কথার পর থেকে, আর কখনোই কোনো গাছের চারা লাগালে, চারার সাথের মাটি ফেলে দেই না।

কারন, গাছ মানুষের মত।

মানুষ যেমন তার রক্তের পরিবারকে কখনো ফেলে দিয়ে পুরো মানুষ হয়ে বাঁচতে পারেনা, গাছও তার গোড়ার সাথে লাগানো জন্মের মাটি ফেলে দিলে বাঁচতে পারেনা।

***

আমার খুব ইচ্ছে করে, কোনো বিয়েতে যখন নতুন জামাই দেখি, ইচ্ছে করে কাছে গিয়ে জামাইটাকে বলি-

ভাই, যাইই করো, তোমার বউ’র রুটসকে, রক্তকে, পরিবারকে সম্মান করো। নাহলে তোমার বউ জীবনেও তোমাকে মন থেকে সম্মান করবেনা।
তোমার বউ তার পরিবারের অংশ। সে পরিবারকে যদি আপন করে না নাও, তোমার বউ’র শরীরই তোমার আপন হবে, মন আর পাবা না।
কারন তুমি একটা মেয়েকে বিয়ে করছো মানে আসলে ঐ মেয়ের পুরো পরিবারকে বিয়ে করছো।

***

বাংলাদেশের- আমার ধারনা- একশ’তে নিরানব্বইটা পরিবারেই দু’টো প্রবনতা আছে।

এক-

কোনো না কোনো ভাবে যে মেয়েকে বিয়ে করিয়ে এনেছেন নিজের ছেলের সাথে, সেই মেয়ের পরিবারকে নীচু করার চেষ্টা করা।

এটা শুধু শ্বশুড়-শ্বাশুড়ি-ভাসুর-দেবর-ননস-ননদ-জা এরাই করে না, জামাই ও এতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যোগ দেয়।

যেমন, এর খুব মডারেট ভার্সন হচ্ছে- মেয়ে যে এলাকার/জেলার মেয়ে, ওখানকার মানুষদেরকে নিয়ে ঠাট্টা মশকারা করা।

ওখানকার মানুষদের কোনো ফানি অভ্যাসের কথা বলে পুরো এলাকার মানুষদেরকে নীচু দেখানোর চেষ্টা করা।

একবার এক পরিচিত ভাই’র বাসায় খেতে বসে থতমত খেয়ে গিয়েছিলাম।
টেবিল ভর্তি খাবারের আইটেম!

এত বেশী আইটেম যে প্লেট রাখার জায়গা নেই!

বললাম, ভাবী, এত রকমের খাবার, এক লোকমার সাথে একটা করে আইটেম টেষ্ট করলেও তো সব আইটেম টেষ্ট করে শেষ করতে পারবো না!

ঐ ভাবী হাসিমুখে বললেন, এত আইটেম করেও তো তোমার ভাইয়ার মন ভরেনা। কেনো অন্ততঃ এক পদের ভর্তা করিনি তাইই বলছিলো এই একটু আগেও!

ঐ ভাই দেখি ভাবীর কথাটাকে মাটিতেও পড়তে দিলেন না।

তার আগেই পালটা বলে বসলেন,
‘অমুক জেলার মানুষরা [যে জেলায় ভাবীর বাবার জন্ম!] মেহমান আসলেও তিন পদের বেশী রান্না করেনা। আমরা আবার ডিফরেন্ট। ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি মা-খালারা মেহমান আসলে এত এত রান্না করতেন যে আমাদের জেলার নামই আছে মানুষকে খাওয়ানো দাওয়ানোতে!’

উপস্থিত সবাই তখন কোন জেলার মানুষ কত দাওয়াত খাওয়ায় তাই নিয়ে কথাবার্তা শুরু করেছিলো।

কিন্তু আমি আর একটা কথাও বলিনি।

খাবারগুলোও বিস্বাদ ঠেকছিলো মুখে।

ভদ্রলোকের এই কমেন্টে কেউ দেখলো না, তার বউ কোলের বাচ্চা নিয়ে বিদেশে একলা একলা এতগুলো মানুষের জন্য এই দশ/বারো রকমের ডিশ রান্না করে টেবিলে পরিবেশন করার পরও ভদ্রলোক কত স্থুলভাবে বউকে অপমান করলেন এতগুলো মানুষের সামনে!- যা অপমানকরই না শুধু, অমানবিকও।

অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, ঐ ভাবীও গা করলেন না।

পরে একটু ভেবে বুঝলাম, ঐ ভাবী গা করলে আর এমন লোকের সাথে সংসার করতে পারতেন না যে লোক নিজের বউকে এপ্রিশিয়েট করবে তো দূরের কথা, এই বউ যদি শুধু এক টেবিল না, দুই টেবিল ভর্তি খাওয়া দাওয়াও রেডী করে মানুষ খাওয়ায়, আমি ড্যাম শিউর, তারপরও কোথাও না কোথাও ঐ লোক বউ’র খুঁত খুঁজে বের করে ফেলবে।

***

দুই-

দ্বিতীয় আরেকটা প্রবনতা হলো -

মেয়ে এবং মেয়ের পরিবার ছেলে এবং ছেলের পরিবারকে সবসময় তেলিয়ে যাবে, সবসময় উঁচু করে রাখবে, এমন একটা আশা বা আবদার করা না, এটাই যেন নিয়ম, এটাই হতে হবে, এমন একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং।

শ্বশুড় বাড়ির উদাহরন না দিয়ে জামাই’র উদাহরনই দেই।
শ্বশুড় বাড়ির উদাহরন টানতে গেলে এই লেখা আর শেষ হবেনা!

খুব কমন একটা উদাহরন-

বিদেশে যেসব বাংলাদেশীরা থাকে, তাদের মধ্যে কমন প্র্যাক্টিস হলো- মেয়েটা তার শ্বশুড় শ্বাশুড়িকে রেগুলার ফোন করবে।

আগেই বলেছি, কিছু জিনিষ আমি অটোমেটিক নোটিশ করি; আবার কিছু জিনিষ চান্স পেলেই জিজ্ঞেস করি।

যেমন, সুযোগ পেলেই এই ‘ফোন করার’ বিষয়টা নিয়ে আমি পরিচিত অপরিচিতদেরকে জিজ্ঞেস করি। ছেলেরা তাদের শ্বশুড়-শ্বাশুড়িদেরকে নিজের থেকে ফোন করে কিনা।

একজনকে চিনি, বিয়ের পর থেকে প্রায় দশ বছর ধরে রেগুলার শ্বশুড়বাড়িতে ফোন দিতেন।
ইনফ্যাক্ট প্রতি একদিন পর পর আগে নিজের শ্বাশুড়ীকে ফোন দিতেন, তারপর শ্বাশুড়ীর সাথে কথা বলে ফোন রেখে নিজের মাকে ফোন দিতেন।

এত্তগুলো বছর পর, হঠাৎ শ্বশুড়বাড়িতে ফোন দেয়া প্রায় বন্ধই করে দিয়েছেন। কালে ভদ্রে এখন দেন।

খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম,
এই এত্তগুলো বছর যা আপনি রেগুলার করে এসেছেন, এক-দুই বছর না, প্রায় দশ বছর, এত্তগুলো বছর পর কেনো হঠাৎ করে আপনি ফোন দেয়া বন্ধ করে দিয়েছেন?

যা উত্তর দিয়েছিলেন, ভাবার মত।

জানলাম,
বিয়ের পর উনার জামাই’র সাথে উনার প্রথম অভিমান হয়েছিলো এই বাবা-মা কে ফোন করা নিয়েই।
বিয়ের প্রায় দেড়মাস পর উনি উনার জামাইকে অভিমান করে বলেছিলেন ‘তুমি আমাকে মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করো আমার বাবা মা কেমন আছে, কই তুমি তো এই দেড়মাসে একদিনও নিজের থেকে ওদেরকে ফোন দাওনি!’

ঐ অভিমান দেখানোর পর একবার কি দুইবার উনার জামাই উনার মা-কে ফোন দিয়েছিলেন।

কিন্তু তখনই উনি আরেকটা বিষয় রিয়েলাইজ করেছিলেন-
ফোনে একবারও উনার জামাই উনার মা-কে ‘মা’ ডাকেনি।

যেহেতু বিয়ের পর পর, রোমান্টিক সময়ের রোমান্টিক প্রমিজ; দু’জনের কেউ একজন কোন কিছু নিয়ে কষ্ট পেলে আরেকজন থেকে গোপন করবেনা, তাই আবার জামাইকে বলেছিলেন- ‘তোমার বাবা মা কে বিয়ের দিন থেকেই আমি আব্বা আম্মা ডাকি, সেখানে আজকে এতদিন পরেও তুমি আবার বাবা-মা কে আব্বা আম্মা ডাকতে হেজিটেট করছো!’

উনি ভেবেছিলেন, নিজের অভিমান এভাবে একদম স্পষ্ট করে বলে দেয়ার পর হয়তো উনার জামাই ভুল শুধরে নিবে।

কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম,
তারপর কী হলো?

উনি হেসে বললেন-
ঐ অভিযোগ করার পর ঐ একবারই ফোন করা।
এই দশবছরের সংসার জীবনে ও নিজের থেকে কয়বার আমার বাবা মা কে ফোন করেছে, কয়বার আমার বাবা-মা কে আব্বা আম্মা ডেকেছে, আমি এক হাতের আংগুলে গুনে বলে দিতে পারবো!

জিজ্ঞেস করেছিলাম,
বিদেশে আসার পর আপনার জামাই যদি আপনার বাবা-মা কে ফোন না দেয় আপনি কেনো তাহলে রেগুলার শ্বশুড় শ্বাশুড়িকে ফোন দিতেন?

উনার উত্তর ছিলো-
দেখো, বাংলা ক্লাসে একটা কবিতা পড়িয়েছিলো মনে আছে? কুকুরের কাজ কুকুর করেছে কামড় দিয়েছে পায়/ তাই বলে কী কুকুরের পায়ে কামড় দেয়া শোভা পায়?- ঐরকম না কী যেন লাইনটা ছিলো।
ওকে প্রথম দিকে আর দশটা ছেলে থেকে ব্যতিক্রম ভাবলেও, পরে বুঝেছি আমার পরিবারের ক্ষেত্রে ও আর দশটা ছেলের মতই।
ও বিয়ের রাতেই আমাকে বলে নিয়েছে, আর যাইই করি যেন ওর পরিবার নিয়ে কখনো লাইন ক্রস না করি।
আমি আমার কথা রেখেছি, কখনো লাইন ক্রস করিনি।
দশ বছর ধরে ওর পরিবারকে একদম নিজের পরিবারের মত করে ট্রীট করে গিয়েছি।
নিজের মা’র জন্য কখনো ডায়মন্ড রিং কিনিনি। ওর মা’র জন্য কিনেছি।
অনেক সময় হাতে সময় না থাকলে নিজের মাকে কল দেইনি। ওর মা-কে কল দিয়েছি।
এই যে দেখো এখন বলছি “ওর মা”, গত দশ বছর ধরে একবারের জন্যও ভুলে এভাবে “ওর মা” “ওর পরিবার” এরকম বলিনি। আম্মা-ই বলেছি।
অনেক সময় বরং মানুষ কনফিউজড হয়ে যেতো, আব্বা আম্মা মানে আমার নিজের বাপ মা নাকি! ব্যখ্যা করে বলতে হতো, যে না, আমি আমার শ্বশুড় শ্বাশুড়ির কথা বলছি!

জিজ্ঞেস করেহিলাম,
দশ বছর পর তাহলে কী হলো এমন যে এভাবে ধুম করে পুরাই রিভার্স মুডে চলে গেলেন?

উনি জানালেন, যে কোনো একটা কারনে উনার ডেইলি রুটিনে দেশে ফোন করা হঠাৎ করে উলটা পালটা হয়ে গিয়েছিলো।
কাউকেই ফোন করার সময়ই পাচ্ছিলেন না। তারপরও তিন/চারদিন পর পর এমনও অনেক সময় হয়েছে, টয়লেট করতে করতে দেশে ফোন দিয়েছেন! কারন জানেন যে এরপর আর সময় পাবেন না!
তাও নিজের মা-কে ফোন না দিয়ে শ্বাশুড়িকেই আগে ফোন দিয়েছেন।
কিন্তু মজার কথা হলো, সবাই জানে উনি কী চরম পরিস্থিতির ভিতর দিয়ে যাচ্ছেন, তারপরও সপ্তাহ খানেক পরে রিয়েলাইজ করলেন, উনার শ্বশুড়বাড়ি থেকে কেউ একজন অলরেডী তার জামাই’র কাছে কথায় কথায় বা কোনো না কোনোভাবে জানিয়েছে যে উনি এখন রেগুলার ফোন দিচ্ছেন না!!

একটু বিরতি নিয়ে বললেন-
বিষয়টা যখন জানলাম, হঠাৎ করে একটা রিয়েলাইজেশান হলো। ঐ যে বাংলা ক্লাসে আরেকটা বাগধারা না কী যেন পড়িয়েছিলো, মনে আছে? কুকুরের লেজ যতই চোঙ্গার ভিতর ভরে রাখো, কখনোই সোজা হয়না!
ও কখনোই আমার বাবা মাকে ফোন দেয়না নিজ থেকে, কখনোই আমার পরিবারের জন্য নিজ থেকে কিছুই করেনি, কোনো ধরনের সত্যিকার আগ্রহ দেখায়নি, স্রেফ ভদ্রতা করে হয়তো কয়েক মাসে এক দুইবার জিজ্ঞেস করেছে ‘তোমার বাসার সবাই ভাল আছে?’, আমি ঐ যে বিয়ের পরে একবারই অভিমান করে বলেছিলাম।
গত দশ বছরে একবারও এ নিয়ে কমপ্লেইন করিনি।
উলটা ওর পরিবারকে নিজের পরিবার থেকে এক চিমটি কম করে দেখিনি।
কিন্তু বিনিময়ে কী পেয়েছি?
কোনোদিন ও থ্যাঙ্কস বলেছে?
কোনোদিন এপ্রিশিয়েট করেছে?
হাহাহাহা! উলটা কী হলো? দশ বছর, ভেবে দেখো, দশ বছর ধরে করে যাওয়ার পর, আমার চরম দূর্দিনে যখন মাত্র দুই কি তিন সপ্তাহ ফোন করতে অনিয়ম হয়েছে, দেখো, কেমন সবাই অভিযোগ করা শুরু করেছে!
অদ্ভুত না?
বিয়ের পর পরেই শিখেছি ওদের থেকে কোন ধরনের ‘এপ্রিসিয়েশান’ প্রত্যাশা না করতে।
কিন্তু দশ বছর লেগেছে এটা শিখতে যে এপ্রিসিয়েশান তো দূরের কথা, নো ম্যাটার্স হোয়াট আই ডু ফর দেম, আমি সারাজীবন ওদের জন্য ঘরের বউ’-ই থেকে যাবো, কখনোই ওদের মেয়ে হয়ে উঠতে পারবো না।
সো আই জাষ্ট সিমপ্লি স্টপড ট্রায়িং ফর দ্যাট ইম্পসিবল!

***

একজন আপু – আরেককজনের বাসায় দাওয়াত খেতে গিয়ে উনার সাথে দেখা হয়েছিলো ঐ একবারের জন্যই, তখন জেনেছিলাম উনার পারিবারিক জীবন খুব ঝামেলার।

(মেয়েরা মেয়েরা যখন কথা বলে, পরিচিত হোক বা অপরিচিত, ঘরের হাড়ির ভিতরের খবরও খুব দ্রুত তখন আড্ডার বিষয়বস্তু হয়ে যায়!)

তো উনিই কথা শুরু করেছিলেন।

চান্স পেয়ে কথায় কথায় জিজ্ঞেস করাতে একটা কথা বলেছিলেন-
‘অমুক বলেছে আপনি বাংলাদেশের মেয়েদেরকে নিয়ে পিএইচডি করেছেন। আমি জানিনা আপনি গবেষনা করে কী পেয়েছেন।
কিন্তু আমার কী মনে হয় জানেন?
আমরা যারা সাধারন মেয়ে, আমরা আসলে সবাই এক একজন ভাল মানের একাউন্টেন্ট।
আমরা সবকিছু করি হিসাব নিকাষ করে।
আমার কথাটা শুনতে খুব র’ শোনাতে পারে।
কিন্তু আমার মনে হয়, বেশীরভাগ মেয়েই নিজের সাবকনশান্সে বিষয়টা এভাবেই দেখে।
জামাই টাকা-পয়সা দেয়।
সামাজিক নিরাপত্তা দেয়।
সব বৈষয়িক প্রয়োজন পূরন করে।
বিনিময়ে জামাইকে আমরা শরীর দেই।
তার জন্য, সংসারের জন্য রান্নাবান্না করি। যা যা লাগে করি।
আজকে আমার বর আমাকে ছেঁড়ে দিলে, কালকেই সমাজ আমাকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে।
এই আমার কথাই ধরুন, আমি কোন চাকরি করি না। দুই বাচ্চার মা।
আমার এখনো পিআর (পার্মানেন্ট রেসিডেন্সি) হয়নি।
আমার জামাই যদি আমাকে ছেড়ে দেয় বা আমি তাকে ছেড়ে চলে যাই, আপনার কোন ধারনা আছে বাংলাদেশে ডিভোর্সী মেয়েকে কীভাবে দেখে?
বাজারের খোলা কাঁঠালের মত।
চোর বাটপার থেকে শুরু করে ভদ্রলোকেরা পর্যন্ত তখন মাছির মত ভন ভন করতে থাকে।
যেন একটা ডিভোর্সী মেয়ের শরীর মাগনা এঁটে পুঁটে খাওয়ার জিনিষ।
তার উপর ফেরত গেলে কোথায় যেতে হবে?
বাপের বাড়ি।
একবার রাগ করে চলে গিয়েছিলাম। বাচ্চারা হওয়ার আগে।
আমার বড়ভাই ডেকে কী বলেছে জানেন?
বলেছে, ‘বিয়ের পর মেয়ের শ্বশুড় বাড়িই মেয়ের বাড়ি। মেয়েমানুষের শরীরে অত রাগ থাকলে চলে না। ধৈর্য্য ধরতে হয়’।
তখনই বুঝেছি, মারুক ধরুক বা জামাই যেমনই হোক, এই সংসারই আমার শেষ ঠিকানা’।

উনি অনেক কথাই বলেছিলেন, কিন্তু ঐ কথাটা কানের মধ্যে খট করে লেগেছিলো, ‘জামাই সব দেয় বিনিময়ে জামাইকে আমরা শরীর দেই’!

***

প্রায়ই এটা দেখি, ওটা দেখি, এটা শুনি, ওটা শুনি, আর ভাবি-

বাংলাদেশের ছেলেরা আর ছেলেদের পরিবারগুলোর মধ্যে একটা জিনিষ কমন- ওরা ভাবে মেয়েটাকে যে মুহুর্তে বিয়ে করিয়ে এনেছে, দ্যাটস ইট, যেন বাজার থেকে একটা বান্দী কিনে এনেছে।

এই বান্দী এই পরিবারের জন্য একশতে দুইশ’ করবে।

এই পরিবারের জন্য নিজের রক্ত, নিজের শরীর দিবে।

এই পরিবারের তথাকথিত “বংশ”কে আগে বাড়াবে নিজের শরীরে এই পরিবারের সন্তান ধারন করে (তাও আবার ছেলে না হলে তো খবর আছে!)

এই পরিবারই তার অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত।

এই পরিবারই তার উত্তর-দক্ষিন-পূর্ব-পশ্চিম।

বিনিময়ে...

‘বিনিময়ে’ মানে?!

‘বিনিময়ে’ আবার কী জিনিষ?!

বাজার থেকে কেনা বান্দী তার মৃত্যু পর্যন্ত মাগনা খাটবে, তার আবার বিনিময় কী?

তার আবার বাপ মা কী?

তার আবার রক্তের পরিবার কী?

তার আবার বন্ধু-বান্ধব কী?

তার আবার ক্যারিয়ার... ওরে বাপরে, ক্যারিয়ার?! সেটা আবার কী?!?

***

শেষ করি আরেকজনের আরেকটা কাহিনী দিয়ে।

উনার ভাষাতেই শুনুন-

“... যেহেতু আমার বান্ধবীর থ্রুতেই ওরা আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব এনেছিলো, ওরা দেখেছে যে আমার ঐ বান্ধবী আমার বোনের চে’ কম ছিলো না আমাদের পরিবারে।
আব্বা আমার সে বান্ধবী প্রস্তাব এনেছে, তাতেই রাজী হয়ে গিয়েছিলো!
... বিয়ের পর ও প্রথম দিকে বেশ কয়েকবার এসেছিলো। আমার বরের বাসায় তো কাউকেই চিনিনা। সারাদিন বাসায় থাকি। খুব দম বন্ধ লাগতো।
আমার বর সেই সকালে চলে যেতো চাকরিতে, সন্ধ্যায় আসতো।
এসেই টিভি দেখতে বসে যেতো ভাই বোনদের সাথে। আমি নাস্তা বানিয়ে দিতাম।
ওদের পারিবারিক আড্ডায় রাত হয়ে যেতো।
রাতের খাবার খেয়ে যখন ও রুমে ঘুমাতে আসতো, তখন ও নিজেই খুব টায়ার্ড।
আমাকে তাও জিজ্ঞেস করতো দিন কেমন কাটলো।
কিন্তু কী উত্তর দিবো বলো?
প্রতিটা দিনই তো একইরকম।
এক বাসার ভিতর অপরিচিত একটা পরিবারের সাথে আছি, যেখানে আমার উঠা বসা চলা ফেরা কথা বার্তা প্রত্যেকটা জিনিষ বুঝে শুনে মেপে মেপে করতে হয়, যেন কিছু ভুল করে না ফেলি!
... একেক একটা দিন জানো, ও ওর শারিরীক চাহিদা মিটিয়ে নাক ডেকে ঘুমাতো। আর আমি শুয়ে শুয়ে অন্ধকার দেখতাম। ঘুম আসতো না।
... এই অবস্থায় আমার বান্ধবীটা যখন আসতো, মনে হতো যেন জেলখানায় কেউ আমাকে দেখতে এসেছে! কী যে খুশী লাগতো!
... কিন্তু তিন কি চারমাস পর, আমার বর একদিন খুব বিরক্ত নিয়ে বলে, তোমার ঐ বান্ধবী এত ঘন ঘন আসে! ওর নিজের ঘর সংসার নেই?
... আমাকে বাইরে থেকে বুঝা যায়না, কিন্তু ভিতরে ভিতরে খুব সেনসিটিভ মেয়ে। ঐ দিনই ঐ বান্ধবীকে ফোন করে বলে দিয়েছি, তুই আর এই বাসায় আসিস না।
... অবাক হই জানো? মানুষ কত অমানবিক হতে পারে। আমি আমার বরের কথা বলছি। কোথায় উলটা আশা করেছিলাম বলবে, তোমার বান্ধবী এমনি এমনি আসে, একদিন দাওয়াত দিয়ে ভাল কিছু খাওয়াও, উলটা যেভাবে বিরক্তি দেখিয়েছে, যেন আমার বান্ধবী থাকাটা উচিত না। ...”

***

এসব লিখে কোন লাভ নেই জানি।

তারপরও লিখি, এ আশায়, কেউ না কেউ হয়তো এসব পড়ে ভাববে নিজেকে নিয়ে।

... যদি একটা ছেলেও এ লেখা পড়ে বুঝে- যে মেয়েকে সে বিয়ে করেছে বা করবে, ঐ মেয়ে বাজার থেকে কিনে আনা মাগনা-বান্দী না।

ঐ মেয়ে থেকে তার ততটুকুই আশা করা উচিত, যতটুকু সে ওই মেয়ের জন্য করে।

আপনি যদি চান আপনার বউ আপনার পরিবারকে আপন করে নিবে, আপনিও আপনার বউ’র পরিবারকে আপন করে নিন।

আপনি একলাই শুধু চাইবেন আপনার বাবা-মা’র জন্য আপনার বউ জান-প্রান দিয়ে দিবে, বিনিময়ে আপনি এমন ব্যবহার করবেন যেন আপনার বউ’র বাবা-মা অস্তিত্বহীন, আপনার বউ’র পরিবার পৃথিবীতে এক্সিস্ট করে না, ওয়েল, আপনি নিজেও জানেন না আপনি কত হতভাগা।

কারন আপনার এমন ব্যবহারের বিনিময়ে, আপনার বউ’র শরীরটাই আপনি পাবেন। মন পাবেন না।

আর পৃথিবীর সবচে’ হতভাগা ছেলে ঐ ছেলেটাই, যাকে একটা মেয়ে করুনা করে, দয়া করে, বাধ্য হয়ে শরীর দিয়ে যায়। অথচ মনে মনে তাকে ভালবাসা তো দূরের কথা, অবচেতন মনে বরং ঘেন্না করে।

আপনি যদি এমন হয়ে থাকেন, আপনার জন্য আমারও করুনা!!
বেচারা আপনি!!

ফারজানা মাহবুবা
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ১২:১৬
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে মৈত্রী হতে পারে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০০


২০০১ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে, গত ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৪) আওয়ামী লীগ সুদে-আসলে সব উসুল করে নিয়েছে। গত ৫ আগস্ট পতন হয়েছে আওয়ামী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×