আমি ভাই খুবই সাধারণ লোক। দিন আনি দিন খাই। কৈশোরের উদ্দীপ্ত মহান ভাবসমূহকে এই পড়ন্ত যৌবনে এসে প্রতি মূহুর্তে বিকিয়ে দেই। কষ্ট লাগত। অতি কষ্ট লাগত। তবে আজকাল বোধ হয় আর লাগে না। তাই বিকাই। নিজেকে বিকাই পতিতার মত। অন্য সবার মত। ভুলে গেছি শেষ কবে ন্যায় এর জন্য আন্দোলন করেছিলাম, ঠিক যেভাবে অন্য সবাই ভুলে যায়; আমিও গেছি-তাতে কার কি হলো?
আমি বাসে যাতায়াত করি, গরমে ঘামে কষ্ট লাগে। দাঁড়িয়ে আছি আমি এবং আর কয়েকজন, তবুও হেল্পারের "গুলশান১/২, বাড্ডা, নতুনবাজার" শুনে আমার হাত নিশপিশ করে। একমাত্র ওকেই বোধ হয় আমি মারতে পারি! কিন্তু আমি মারি না, ভয় করে, তবে মুখে উদ্ধার করি ওর চৌদ্দপুরুষ, বাস এর গেট ঘেষে দাঁড়াই... আমি এবং আমরা, ভিতরে থাক ফাঁকা, উঠতে দেব না আর একজনও, আমি তো উঠেছি। এটাই আমাদের ডিপ্লোম্যাটিক অস্ত্র।
আবার কখনো মহিলারা দাঁড়িয়ে ঠেলা ধাক্কা খেয়ে যায় আর আমি তাদের জন্য সংরক্ষিত সীটগুলোর একটা দখল করে নির্লিপ্ত ঔদাসিন্যে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকি। তাদের কেউ সীট ছাড়তে বললে আমি বধির হয়ে যাই। আজন্ম বধির। কারণ আমি ভাই সাধারণ, আমি একটু বসতে চাই...আমার স্বার্থটুকু ছাড়া আর কিছুই আমি বুঝি না। তবে মাঝে মাঝে আমি বাঘ হয়ে যাই! যখন কোন ছোকড়া টাইপ ছেলে আমাকে বলে "ভাই, সীটটা ছাড়েন, ঐটা লেডিস সীট", তখন আমি সন্তর্পনে পরিস্থিতি আঁচ করি। যেই দেখি দলের লোক একজন হলেও আছে, আমি ঐ কিশোরের বারোটা বাজিয়ে দেই। "সীটের লিঙ্গ নাই, মহিলাদের বাইরে বের হবারই কি দরকার, যে আগে আসবে সেই সীটের প্রকৃত মালিক..." প্রভৃতি বচনে তাকে নিরস্ত করি। তাতেও কাজ না হলে তাকে "লুচ্চা, টাঙ্কিবাজ" অথবা সমার্থক উপাধীতে ভূষিত করি। দলের লোকগুলোও তাকে ধর্ম শিক্ষা পড়ায়। আমি আমার সিংহাসনে অধিকার পোক্ত করি। সম্মিলিত উদ্যোগে আমরা তার নীতিবোধকে ধর্ষণ করি, আমাদেরই মতো আরেকটি সাধারণ মানুষ তৈরীর জন্য। আজও তাই করেছি সগর্বে। কিন্তু ছেলেটি নেমে যাবার সময় বলে গেছে "এটুকু 'লুচ্চা' না হলে বোধ হয় জন্মের ঋণ শোধ হয় না, ভাই! ভালো থাকবেন।" সিংহাসন কেঁপে ওঠে আমার! বুকের মাঝখান থেকে অনেক আগে হারিয়ে যাওয়া আমার আমি বলে ওঠে "আবার তোরা মানুষ হ"। একটু কি ফিরে পাই নিজেকে? আমার আমি কে? যে এক সময় সৎ ছিল, মানুষ ছিল?
আরে না ভাই, আমি অতি সাধারণ......আমি জানালা দিয়ে ঐ লুচ্চা ছোকড়ার উদ্দেশ্যে এক দলা থুতু ফেলে আমার সিংহাসনে আরও জাকিয়ে বসি।