[বেশ পুরাতন লেখা...এই সিরিজটি বুয়েটে লাইফে লেখা]
একটা ছেলে কাঁধে গিটার ঝুলিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে…।এরকম দৃশ্য দেখে,একসময় খুব ইচ্ছে হয়েছিলো গিটার শেখার।বুয়েটে এসে আহসানউল্লা হলের সেরা আড্ডাবাজ গণরুম ১০১-এ উঠে,সেই ইচ্ছেটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো।একথা শুনে,আমাদের ১০১-এর নিয়মিত অতিথি সুকান্তি বলল,বস্ গিটার শিখবা কেন?গিটারের চেয়ে বেহালায় ভাব বেশি।বরং আসো বেহালা শিখি।আইনষ্টাইনও বেহালা বাজাতেন। কথাটা বেশ মনে ধরলো,পোলাটা খারাপ কথা কয় নাই।তাইতো, গিটারতো অনেকেই শেখে…এমন কিছু শিখতে হবে যা কম মানুষ পারে…আর কলেজ জীবনে দেখা ‘মোহাব্বতে’ ছবিতে শাহরুখ খানের বেহালা বাজানোর দৃশ্য এখনো চোখে ভাসছে।বেহালা বাজিয়ে যদি বুয়েটের কোন আতেঁল এবং সুন্দরী মেয়ে পটিয়ে ফেলা যায়,তবে মন্দ কি?
কথা হলো, বেহালা কোথায় শেখা যায়? খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেল, আমাদের হলের চার তলায় এক দাদা আছেন যিনি বুলবুল ললিতকলা একাডেমি(বাফা)-তে বেহালা শিখেন।দাদাকে গিয়ে আমরা জানালাম আমাদের বেহালা শেখার আগ্রহের কথা।কথাবার্তার পর ঠিক হলো ,পরের শুক্রবারে উনার সাথে আমরা যাব বাফায়।শুক্রবার কাক ডাকা ভোরে আমি আর সুকান্তি ওই দাদার সাথে পুরানো ঢাকার ওয়াইস ঘাটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম।বাফার অফিসে গিয়ে জানা গেল,চার বছরের বেহালার অনার্স কোর্সের প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হয়েছে আজ থেকে প্রায় দু’মাস আগে।আমরাও ছেড়ে দিতে নারাজ।ভর্তি হয়ে গেলাম দুজন বেহালার প্রথম বর্ষে।মনে মনে বেশ পুলকিত হচ্ছি,একই সময়ে দুই সাবজেক্টে অনার্স কমপ্লিট হবে- ক্যামিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং আর বেহালা! বেহালা কেনা হয়নি,তবু ভাবলাম একটু ঘুরে যাই।
বাফার মূল বিল্ডিংটা অনেক পুরানো।কেমন যেন একটা ইতিহাসের গন্ধ আছে । সবকিছু চুম্বকের মতো টানছে আমাদেরকে । একদিকে কেউ বসে ছবি আঁকছে,ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা নাচছে।সিঁড়ি ভেঙ্গে দোতালায় উঠে এলাম ।বারান্দার পাশে এক রুমে বেহালার ক্লাস হচ্ছে ।বারান্দা থেকে বুড়িগঙ্গা খুব কাছে।মনে হয়,যেন হাত বাড়ালেই বুড়িগঙ্গার জলে হাত ভেজানো যাবে।আচ্ছা, বুড়িগঙ্গা নামের মানে কি? গঙ্গা কি বুড়ি হয়ে বুড়িগঙ্গা হয়ে গেছে?মাথায় এরকম অবাধ্য প্রশ্নের আনাগোনা।আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে আছি।বারান্দায় অনেকে বেহালা বাজাচ্ছে।বুড়িগঙ্গার বাতাস এসে গায়ে লাগছে।আর আমি ভাবছি,আহারে এখন যদি সাথে একটা বেহালা থাকতো! খুব তাড়াতাড়ি বেহালা কিনতে হবে,আর দেরি করা ঠিক হবে না।বারান্দায় অবশ্য বেশিক্ষণ দাড়াঁলো গেল না,এক বেরসিক বেহালায় ‘আমরা সবাই রাজা’ ধরেছে(খুব সম্ভবত নতুন শিখেছে)।এমন রোমান্টিক পরিবেশে ‘আমরা সবাই রাজা’? ব্যাটা গর্দভ…।এদিকে ওই বড় ভাইয়ের ক্লাস শেষ।অনেক কষ্টে তার মাধ্যমে এক টিচারকে রাজি করালাম, উনি পরদিন বেহালা কিনতে আমাদের সাথে যাবেন।
পরদিন সকাল থেকেই মনটা কেমন কেমন লাগছে,কখন বেহালা কিনতে যাব।অনেকটা উত্তেজনা নিয়ে ক্লাস শেষে রুমে ফিরলাম দুপুরে।আমার সময় যেন কাটে না…।অবশেষে দুপুর গড়িয়ে বিকাল হলো।ঘড়ির কাঁটায় বিকাল চারটা।আমি,সুকান্তি আর ওই দাদা রওয়ানা দিলাম সায়েন্স ল্যাবের দিকে।ওখানেই আসবেন আমাদের শিক্ষক।গিয়ে দেখি,ওই টিচার আসেননি।আমি আর সুকান্তি বারবার ঘড়ি দেখছি।আমাদের এই অবস্থা দেখে ওই দাদা বললেন,তোমাদের দেখি আর তর সইছে না।কিছু সময় অপেক্ষার পর টিচার এলেন।বেহালাও কেনা হলো।বেহালার বাক্স হাতে অনেক ভাব নিয়ে হলে ফিরলাম।রুমে বসে বেহালা বাজানোর অপচেষ্টা করলাম কিছুক্ষণ।বলা বাহুল্য,বেহালা দিয়ে কোন সুর বের হলো না।লাভের উপর লাভ হলো,রুমমেটরা আগুন ঝরা দৃষ্টিতে তাকালো।যেন ওদের গালি গালাজ করছি! ভিসুভিয়াস জাগ্রত হবার আগেই আমরা ক্ষান্ত দিলাম।
পরের শুক্রবার এলো।বেহালার ক্লাসে আজ আমাদের প্রথম দিন।তখন বেহালার বিভিন্ন স্বরলিপি শেখানো হচ্ছে।আমরা সা-রে-গা-মাও তুলতে পারি না।এদিকে স্যার একটা স্বরলিপি একবার বাজিয়ে সবাইকে বলছেন নিজে বাজানোর জন্য,আর তিনি হাত নাড়াচ্ছেন।আমি ভাবলাম,খুব সম্ভবত কাঠি বাসায় ভুলে ফেলে এসেছেন।টিভিতে দেখেছি অনেক জন বসে বেহালা বাজায়,আর ওস্তাদ সামনে দাঁড়িয়ে কাঠি নাড়েন।অনেকটা সেরকম দৃশ্য।আমি আর সুকান্তি বেহালায় থুতনি ঠেকিয়ে একজন আরেকজনের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছি,আর হাত দিয়ে বাজানোর ভাব করছি।শুধু শুধু কে মান সম্মানের বারোটা বাজাতে চায়? অনেক জন একসাথে বাজানোতে আমরা বাজাচ্ছি কিনা তা অবশ্য বোঝা যাচ্ছে না।বিরস মুখে সেদিনের ক্লাস শেষে বের হয়ে এলাম। রাতে ওই দাদার রুমে গিয়ে সা-রে-গা-মা তুলে নিলাম কোন মতে।তবে প্র্যাক্টিস করা যাচ্ছে না।রুমমেটরা বেহালার সুরেলা আওয়াজে খুব বিরক্ত হয়।যারা সঙ্গীত পছন্দ করে না,তারা মানুষ খুন করতে পারে-এই ডায়লগ বেশ কয়েকবার ঝাড়ার পরেও কোন রকম সহানুভূতি পাওয়া গেল না।আমাদের প্র্যাকটিস করাও তাই বন্ধ।যা হোক, কয়েক শুক্রবার গেলো।আমরা ক্লাসে যাই,ওস্তাদ স্বরলিপি বাজাতে বলেন।আমরা বেহালাতে থুতনি ঠেকিয়ে উদাসীন ভঙ্গিতে বসে হাত নাড়াই।অন্যদের সুমধুর সুরের মাঝে আমাদের কর্কশ সুর চাপা পড়ে যায়।ইতোমধ্যে বেহালা নিয়ে হলের বন্ধুরা টিপ্পনি কাঁটা শুরু করে দিয়েছে।কিছুদিন পর…আবার এক শুক্রবার এলো।সকালে ঘুম থেকে উঠে সুকান্তিকে জাগাতে গেলাম।সুকান্তি বললো, বস্ …আজ যেতে ইচ্ছে করছে না।আমি ভাবলাম,হু…গিয়ে শুধুতো বসেই থাকি…আজ থাক।
পরের শুক্রবার এলো।আজ আমার যেতে ইচ্ছে করছে না।এভাবে ৪/৫ টা শুক্রবার কেটে গেল।কোনদিন আমার যেতে ইচ্ছে করে না,কোনদিন সুকান্তির যেতে ইচ্ছে করে না।কোন কোন দিন আবার দু’জনের যেতে ইচ্ছে করে না।তাই বেহালার ক্লাসে যাই না আর।এদিকে টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা কাছাকাছি চলে এসেছে। না যাওয়ার আরেকটা অজুহাত পাওয়া গেছে।বন্ধুরা বাঁকা চোখে জিজ্ঞেস করে,দোস্ত বেহালা শেখা কতদূর? আমরা বলি ,এই টার্মে আর হবে নারে, আপাতত বন্ধ, অন্য সময় শিখব……।
সেই অন্য সময় আর আসেনি।বুয়েট লাইফের অনেকটা শেষ প্রান্তে চলে এসেছি।তবু ,আমাদের সময় আসেনি…আসবে বলেও আর মনে হয় না।বেহালার বাক্সের উপর রাজ্যের ধূলা জমেছে।মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়,একবার খুলে দেখি…।জানি কর্কশ কিছু সুর ছাড়া আর কিছু বের হবে না…তবুও ইচ্ছে হয়।আবার,মাঝে মাঝে মনে হয়,বিক্রি করে দেই…।কি লাভ, চোখের সামনে ব্যর্থতার একটি জীবন্ত প্রতিমূর্তিকে শুধু শুধু বাঁচিয়ে রেখে?