মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর জীবন ও কাজ নিয়ে লেখালেখি হয়নি বলা অন্যায় হবে; কিন্তু মওলানার ওপর ভালো ও নির্ভরযোগ্য কোনো জীবনীগ্রন্থ আমরা এখনও পাইনি। সেটা সম্ভবত বিপজ্জনক কিছু নয়, একই কথা সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা ফজলুল হক এমনকি শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে বলা চলে। সাধারণভাবে নিজেদের ইতিহাস সম্পর্কে আমরা অসচেতন, সে কারণে আমরা কী ছিলাম, কী হয়েছি এবং কী হয়ে উঠতে পারি বা হয়ে উঠতে চাই—এসব প্রশ্ন আমাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নয়। ফলে বাংলাদেশের জনগণের সম্ভাব্য ঐতিহাসিক অভিমুখ কী হতে পারে, তাকে প্রশ্ন আকারে তুলতেও আমরা অক্ষম। আমরা একদল নিজেদের ‘বাঙালি’ বলে ভাবি, সেটাও নাকি আবার ‘আবহমান’—অর্থাত্ বাঙালি হয়েই আমাদের নাকি আবির্ভাব, আর বাঙালি হয়েই আমাদের যুগ-যুগান্তরে বহমান হয়ে থাকা—ইত্যাদি। আরেক দল এর প্রতিক্রিয়ায় নিজেদের ‘বাংলাদেশী’ বলেন। এই পরিচয়ের আড়ালে নিজেদের কখনও ‘মুসলমান’ কখনও ‘বাঙালি’ পরিচয়টাকে প্রধান ভাববার সুযোগ থেকে যায়, সেটা একটা সুবিধা। যাঁরা সেটা চান না, তাঁরা নিজেদের ‘মুসলমান’ ভাবতেই পছন্দ করেন। যেহেতু ধর্মের সঙ্গে ইতিহাসের জটিল সম্পর্ক বিচার করতে আমাদের প্রবল আলস্য রয়েছে, আলস্য রয়েছে ধর্মের সঙ্গে সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির সম্পর্ক বিচারের ক্ষেত্রেও, সে কারণে ‘বাঙালি’ বা ‘বাংলাদেশী’ পরিচয়ের বিপরীতে সমাজের একটা বড় অংশ নিজেদের ‘মুসলমান’ ভাবতেই অভ্যস্ত। তার পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক ধারাগুলো শক্তিশালী হয়েছে। একাত্তরের যুদ্ধে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকার কারণে রাজনীতিতে ইসলামের প্রভাব, গ্রহণযোগ্যতা ও ন্যায্যতা হ্রাস পেয়েছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু পুরো সত্তর দশকব্যাপী বাংলাদেশে ও উপমহাদেশে ইসলাম প্রশ্নকে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও বাংলাদেশের জনগণের ইতিহাসের দিক থেকে মোকাবিলা করার কোনো চেষ্টাই হয়নি। যে সুযোগ তৈরি হয়েছিল, তাকে কাজে না লাগিয়ে এটাই নানাভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছে যে, ইসলাম ‘বাঙালি’ সংস্কৃতির আন্তরিক কোনো উপাদান নয়। এটা বাইরের জিনিস। তেল আর জল যেমন মেশে না, ইসলাম ও বাঙালিও তেমনি পরস্পরবিরোধী একটি ব্যাপার। ইসলামের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের ক্রমাগত বিদ্বেষমূলক রাজনৈতিক তত্পরতার কারণে রাজনীতিতে ইসলাম আরও গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবে হাজির হয়েছে, যার মীমাংসা এখন আর আগের মতো সহজ নয়; বরং অনেক কঠিন বলেই আমার মনে হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি এবং সামগ্রিকভাবে পাশ্চাত্যের ইসলামবিদ্বেষ ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ রাজনৈতিক ইসলাম—অর্থাত্ যে রাজনৈতিক ধারা ইসলামের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের ভীতি, বিদ্বেষ ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে লড়ছে—তাকে নতুনভাবে রাজনৈতিক বৈধতা দিয়েছে। এই ধারাকে ‘মৌলবাদী’, ‘সন্ত্রাসী’ ইত্যাদি নামে আখ্যায়িত করে এর ঐতিহাসিক আবির্ভাবের কার্যকারণকে যেমন এখন আর মুছে ফেলা যাবে না, একইভাবে সাম্রাজ্যবাদ ও আন্তর্জাতিক পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থাবিরোধী শ্রেণী-রাজনীতির দুর্বলতার কারণে এই ধারার রাজনৈতিক ন্যায্যতা ও বৈধতাকেও নাকচ করা সম্ভব নয়।
আমাদের মাথার মধ্যে একটা রাজনৈতিক ‘ছক’ বাসা বেঁধে থাকতে পারে। বাস্তবতার সঙ্গে তা খাপ না খেলে আমরা আমাদের আদর্শের আলোকে সেই ছককে না বদলিয়ে বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। দাবি করি বাস্তবতা আমার মাথায় বাসা বেঁধে থাকা ছকের মতো হয়ে উঠুক। এই আহাম্মকি আমরা হরদম করছি। বাংলাদেশের শ্রেণী বা বিপ্লবী রাজনীতির হয়েছে সেই দুর্দশা। সেদিক থেকে ইসলামকে বোঝা ও পর্যালোচনার কথা যখন ওঠে, তখন আমরা মনে করি আমরা বুঝি বিপ্লবী রাজনীতির ধারা পরিত্যাগ করে ইসলামী রাজনীতির পক্ষে বয়ান খাড়া করছি, বয়ান দিচ্ছি। অথচ এই কালে প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের দেশে সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের রাজনৈতিক বয়ান, নীতি ও কৌশল কী হবে। এটাই হচ্ছে আসল প্রশ্ন।
মোটা দাগে রাজনৈতিক ইসলামকে আমরা দুটি ধারায় ভাগ করতে পারি। একটি পাশ্চাত্য উদারনৈতিক বা লিবারেল ধারা, যারা নির্বাচনী ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে ও প্রয়োজনে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় গিয়ে ‘ইসলাম’ কায়েম করতে চায়। সাধারণত এরা দাবি করে, ইসলাম ও গণতন্ত্রের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। সেদিক থেকে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গেও তার মৌলিক কোনো বিরোধ নেই; বরং লড়াই নাস্তিক ও কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে। এদিক থেকে তারা গণতন্ত্র ও নির্বাচনকে সমার্থক গণ্য করে। গণতন্ত্র রাষ্ট্রের বিশেষ একটি ধরন বলে তারা মনে করে না, যার সঙ্গে ইসলামের শরিয়া ও ইসলামী শাসনব্যবস্থা আসলে সাংঘর্ষিক। অন্য ধারা পুঁজি ও পাশ্চাত্য রাষ্ট্রশক্তিগুলোর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও বলপ্রয়োগের বিপরীতে বলপ্রয়োগের নীতিতে বিশ্বাস করে। এদেরকেই মৌলবাদী, সন্ত্রাসী ইত্যাদি বলে মূলধারার রাজনীতি সবসময়ই বিরোধিতা করে থাকে। কিন্তু কৃষক শ্রমিক নিপীড়িত শ্রেণীর মধ্যে যতটা নয়, তার চেয়েও অনেক বেশি মধ্যবিত্ত তরুণ সমাজের মধ্যে বলপ্রয়োগের বিরুদ্ধে বল প্রয়োগের নীতিতে বিশ্বাসীদের সংখ্যা বাড়ছে বলেই আমার ধারণা। সেটাই স্বাভাবিক। এই ধারা সাধারণত মনে করে পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও গণতন্ত্রের সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক সাংঘর্ষিক। পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ বা গণতন্ত্র বলতে তারা কী বোঝে সেটা ভিন্ন তর্কের বিষয়; বলা বাহুল্য তারা সেটা মার্কস লেনিন বা মাও জে দংয়ের মতো বোঝে না। কিংবা তারা এটাও মানে না যে, পাশ্চাত্য এনলাইটমেন্টই বা পাশ্চাত্য সভ্যতার মানদণ্ড সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও ইতিহাস বিচার করার একমাত্র পদ্ধতি। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার অর্থ এই পদ্ধতিকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলা। গ্রিক-খ্রিস্টীয় জগত্ই মানুষের একমাত্র জগত্, তার বাইরে আর কোনো জগত্ গড়া যায় না, এটা তারা মানতে রাজি নয়। এসবের ফাঁকফোকরে আরও কিছু মানুষ অবশ্যই আছেন, যারা বিভ্রান্ত, কিংবা মনে করেন এসব পরিচয়বিভ্রাট বা রাজনীতি পার্থিব জীবন পালনের জন্য আদৌ গুরুত্বপূর্ণ নয়; কিন্তু মুশকিল হচ্ছে অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না।
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে নিয়ে ভাবতে গেলে আমাদের সময়ের এই নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতি চোখ বন্ধ করে রাখলে চলবে না। প্রাচীন চিন্তা, বদ্ধমূল ধ্যান-ধারণা ও ফালতু আবেগ এবং নীতিকথার ফুলঝুরি ছুটিয়ে এই নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার সীমা ও সম্ভাবনা কোনোকিছুরই বিচার করা যাবে না। কিছু মানুষ থাকবে যারা নেড়ি কুকুরের মতো মোড়ে মোড়ে চিত্কার করে যাবে। এদের সম্পর্কে একটি আরবি প্রবাদ আছে, সেটা হলো—কুকুর চিল্লায়, কিন্তু কাফেলা থামে না; কারণ তাকে চলতে হবে, এগিয়ে যেতে হবে সামনে, সম্মুখের গন্তব্যে।
অতএব আমাদেরও এগিয়ে যেতে হবে সামনে। প্রশ্ন হচ্ছে, গন্তব্য সম্পর্কে আমাদের আদৌ কোনো ধারণা আছে কি-না। আসলেই আমরা কোথায় যাচ্ছি? এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া যদি কঠিন হয় তাহলে ঘুরিয়ে বলি, কোথায় যেতে চাই আমরা? এই ‘আমরা’ মানে আসলে কারা? আর এসব প্রশ্নের ওপর যখন হুমড়ি খেয়ে পড়ি, তখনই মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তাঁর পাঞ্জাবি, লুঙ্গি ও তালের টুপি পরে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে যান। তাঁর এই রূপের রাজনৈতিক তাত্পর্য আছে যা তাঁর আদর্শ, জীবন ও ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। সেই তাত্পর্য অনুধাবনের চেষ্টার মধ্য দিয়ে এসব প্রশ্নের মানে অনুধাবন করা ও সমাধানের প্রণোদনা লাভ করতে পারি আমরা। একই সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা বিচারের কাজও সহজ হয়।
মওলানা ভাসানীকে দু’ভাবে আত্মস্থ করার চেষ্টা চলে। একদল হচ্ছে প্রাচীন বামপন্থী, ষাট দশকের পর যাদের আর বয়স বাড়েনি। তারা মওলানার ইসলাম চায় না, কিন্তু মওলানার কমিউনিজম চায়। মওলানার সেক্যুলারিজম তাদের পছন্দের। তারা মওলানার ‘লাল’ দিকটা চায়। মওলানা তাদের কাছে ‘লাল মওলানা’; কিন্তু মওলানার এই লালিমা প্রশান্ত, সেখানে জঙ্গি ভাব নেই। সেটাও আরামের। আর অন্য ধারাও মওলানার বিপ্লবী ও জঙ্গি রূপ চায় না, তার শান্তশিষ্ট পীররূপ ও মুরিদগিরিই তাদের পছন্দ। তাকে নির্জীব, নিবীর্য বানিয়ে তার কবর পূজা ও ওরস করে কাটাতে চায় তারা। লাল মওলানার বিপরীতে এই সৌন্দর্যকে আমরা বলতে পারি ‘সবুজ মওলানা’। সবুজ মওলানার মধ্যে কোনো হানাহানি নেই, শ্রেণীসংগ্রাম নেই, অত্যাচারীর বিরুদ্ধে ‘খামোশ’ হুংকার নেই, কিংবা জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের বলপ্রয়োগ ন্যায্য—এই সত্য ঘোষণা করার হিম্মত নেই। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের ইতিহাসকে গায়েব করে মওলানাকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার চেষ্টা করে আর যারা মওলানাকে সবুজ কিংবা লাল বানিয়ে কবরে শুইয়ে রাখার চেষ্টা করে তাদের ধারণা বর্তমানের রাজনীতিতে মওলানা ভাসানীর আর কোনো তাত্পর্য নেই। তিনি বড়জোর স্মৃতিমাত্র। তার ‘ইসলামী সমাজতন্ত্র’ একটি স্ববিরোধী ধারণা, কিংবা তার ‘রবুবিয়াত’ বা ‘হুকুমতে রব্বানি’র ধারণা বুড়া বয়সে ভীমরতি মাত্র। তিনি একসময় কমিউনিস্ট ছিলেন; কিন্তু বুড়া বয়সে ইসলামপন্থী হয়ে গেছেন।
বলা বাহুল্য, মওলানা ভাসানী সম্পর্কে এই তিন ধরনের বিচার ও রাজনীতির আমি ঘোরতর বিরোধী। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতির দিকনির্দেশহীনতার মধ্যে যদি আমরা কোনো দিশা খুঁজে পেতে চাই, তাহলে মওলানা ভাসানীকে ছাড়া আমাদের চলবে বলে আমি মনে করি না। এজন্য নয় যে, তিনি একটা আদর্শ খাড়া করে দিয়ে গেছেন যা চিরায়ত বা এমন কর্মসূচি আমাদের দিয়ে গেছেন যা বাস্তবায়ন করাই আমাদের কাজ। না, সেটা মোটেও নয়। দুর্ভাগ্যবশত তিনি খুব লেখালেখি করেননি। বিচ্ছিন্ন কিছু প্রচার-পুস্তিকা ছাড়া। সে কারণে তাঁর জীবনী ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডই আমাদের সম্বল। সেখানে তাঁর চিন্তাকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে আমাদের এবং একই সঙ্গে এখনকার জন্য তার রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতাকেও অনুধাবন করতে হবে। বরং তাকে মনে রেখে এ সময়ের জন্য প্রাসঙ্গিক কিছু অবস্থান আমরা দাঁড় করাতে পারি কি-না, সেই চেষ্টার সাফল্যের মধ্যেই তার গুরুত্ব আমরা ধরতে পারব।
যেমন, ইসলাম—বিশেষত ভাসানী যেভাবে ‘ইসলাম’ বুঝেছেন ও চর্চা করেছেন, সেই ইসলামের সঙ্গে কমিউনিজমের যে বিরোধ আমরা অনুমান করি এবং স্নায়ুযুদ্ধের প্রচারণার কারণে যে বিরোধকে আমরা এখনও সত্য বলে ধরে রেখেছি, তার আদৌ কোনো ভিত্তি আছে কি-না, সেটা নতুন করে বিচার করতে ভাসানী আমাদের বাধ্য করেন। নিজের জীবন ও কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তিনি ইসলাম ও কমিউনিজমের সম্পর্ক বিচারের নতুন একটি দিগন্ত উন্মোচন করেন যে জগতে আমরা এখনও প্রবেশ করার বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তি অর্জন করেছি দাবি করা যাবে না। কিন্তু তার হাত ধরে সাহস করে কদমে কদমে এগিয়ে যাওয়ার সংকল্প নিতে পারি। তবে এটা পরিষ্কার যে, কমিউনিস্ট হওয়া আর নাস্তিক হওয়া যে সমার্থক নয়, সেটা এখনও ভাসানীর কাছ থেকে শিখতে আমাদের বাকি আছে।
দ্বিতীয়ত ধর্মতত্ত্ব হিসেবে ভাসানী ইসলামকে নাকচ করেছেন বলে প্রমাণ নেই; কিন্তু তাঁর রাজনীতির সঙ্গে ইসলামের একটি সঙ্গতিপূর্ণ ব্যাখ্যা তিনি খাড়া করার চেষ্টা করেছেন। সেটাই তাঁর ‘রবুবিয়াতে’র রাজনীতি। তিনি বলছেন :
“আমরা বলিয়া থাকি, মানুষ হিসাবে গড়িয়া উঠিলে সকল সমস্যার সমাধান হইবে। কিন্তু মানুষ কী করিয়া মানুষ হিসাবে গড়িয়া উঠিবে, তাহার পথ দেখাইয়া দিই না। খাইয়া পরিয়া স্বাস্থ্য ভালো হইতে পারে; কিন্তু আধ্যাত্মিক উন্নতি ব্যতীত চরিত্র গঠন হইবে না। সাময়িক ভাবোন্মাদনায় যে উন্নত চরিত্র ফুটিয়া ওঠে তাহা জোয়ারভাটা মাত্র। যে জাতি কেবলই কল্যাণের দিকে গতিশীল, তাহাই আধ্যাত্মিক উন্নতির পথ বাছিয়া লয়। যখন জাতীয় চরিত্র রাব্বুল আলামিনের রবুবিয়াত বা প্রতিপালনের বিধি-বিধানের সন্ধান লাভ করে, তখন হইতেই সুখ ও শান্তির পথে দেশ এবং জাতি গঠিত হইতে থাকে। তাই মানুষকে প্রথমে সবকিছুর মূলের দিকে এবং সামঞ্জস্যমণ্ডিত সকল বিধান প্রতিবিধানের প্রতি নজর দিতে হইবে।” (‘হুকুমতে রব্বানী’ প্রসঙ্গে মওলানা ভাসানী (র.), ১৫ই এপ্রিল ১৯৭৪ নবাবপুর, ঢাকা)
তাঁর এই উদ্ধৃতি থেকে কয়েকটি দিক নজরে আনা যায়।
তিনি ‘মানুষ’ নামক কোনো আগাম ধারণা করেননি, যাকে দর্শনে essentialism বলা হয়। এর সঠিক বাংলা করা কঠিন, তবে মানুষকে এক ধরনের বিমূর্ত শাশ্বত সত্তা হিসেবে আগাম ধরে নেয়া বা এ ধরনের কোনো ধারণায় পর্যবসিত করা বোঝায়। ইসলাম মানুষকে এ ধরনের কোনো শাশ্বত ধারণা দিয়ে অনুমান করে না, অন্তত মানুষকে যখন আল্লাহর ‘খলিফা’ হিসেবে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে কোরআন বলে তখন মানুষের ধারণা একইসঙ্গে আল্লাহর সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের ধারণা দিয়েই স্থির হয়, বিচ্ছিন্নভাবে ‘মানুষ’ নামক কোনো সত্তা দিয়ে নয়। দার্শনিক আলোচনার ক্ষেত্র নয় বলে এর বেশি ব্যাখ্যার মধ্যে না গিয়েও আমরা বুঝতে পারি ‘মানুষ কী করিয়া মানুষ হিসাবে গড়িয়া উঠিবে তাহার পথ দেখাইয়া’ দেয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক-দার্শনিক ধারণা। কী করে সেই পথ দেখানো সম্ভব? মানুষ হয়ে ওঠা নিছকই বৈষয়িক উন্নতির ব্যাপার নয়, মওলানা নিজেকে অর্থনীতিবাদী ধারণার মধ্যে বন্দী রাখেননি, সেটা তাঁর এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট। ভোগী মানুষ মানেই উন্নত মানুষ নয়। ঠিক যে, রাজনৈতিক বা ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই মানুষ মানুষ হয়ে ওঠে। কিন্তু তার একটি ‘আধ্যাত্মিক’ বা অবৈষয়িক দিক আছে। সে দিকটি তাকে তার জীবচরিত্র অতিক্রম করে তার দিব্যচরিত্র বিকাশের দিকে ধাবিত করে। বলা বাহুল্য, এখানে বহু কিছু ব্যাখ্যার দিক বাকি রয়েছে। কিন্তু এটা পরিষ্কার যে, শুধু আইন করে বা রাজনৈতিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে মানুষকে মানুষ বানানো যায় না। কারণ, ‘সাময়িক ভাবোন্মাদনায় যে উন্নত চরিত্র ফুটিয়া ওঠে তাহা জোয়ার-ভাটা মাত্র’। মওলানা বিপ্লবকে আরও ‘চিরস্থায়ী’ করার পথ অনুসরণ করছিলেন। তার প্রস্তাব হছে, “যখন জাতীয় চরিত্র রাব্বুল আলামিনের রবুবিয়াত বা প্রতিপালনের বিধি-বিধানের সন্ধান লাভ করে, তখন হইতেই সুখ ও শান্তির পথে দেশ এবং জাতি গঠিত হইতে থাকে। তাই মানুষকে প্রথমে সবকিছুর মূলের দিকে এবং সামঞ্জস্যমণ্ডিত সকল বিধান প্রতিবিধানের প্রতি নজর দিতে হইবে।”
ভাসানীর এই নতুন চিন্তা সম্পর্কে বিশাল কিছু দাবি করা আমার ইচ্ছা নয়; বরং ভাসানী যে প্রশ্ন তুলেছেন তাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়ার বেশি আমি এখন আর কিছু দাবি করতে চাই না। যে রাষ্ট্রের কথা তিনি ভাবছেন, তাকে তিনি তাঁর এই পরিভাষায় আর সমাজতন্ত্র বলছেন না, বলছেন ‘প্রতিপালনের বিধিবিধান।’ শুধু মানুষ নয়—পশুপাখি, জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ সবকিছুরই প্রতিপালন চাই। সবার ‘হক’ আছে। এ এক নতুন ধরনের ‘সমাজতন্ত্র’—যা মানুষকেন্দ্রিক নয়। ‘প্রতিপালনের বিধিবিধান’ কায়েম। সম্পূর্ণ নতুন ধরনের রাজনীতির সম্ভাবনা আমাদের সামনে হাজির করছেন ভাসানী। আমার বিনীত দাবি, ভাসানীর সঙ্গে এই নতুনভাবে ভাবার এবং নতুন রাজনীতি আবির্ভাবের সম্ভাবনার চর্চা করার কথা ভাবতে হবে আমাদের।
ভাসানী যেভাবে ইসলাম বুঝেছেন, সেদিক থেকে তার এই নতুন রাজনৈতিক চিন্তার সঙ্গে ইসলামের কোনো বিরোধ দেখেননি। অর্থাত্ ইসলামের একটি ব্যাখ্যা তিনি হাজির করতে চেয়েছেন, যার লক্ষ্য হচ্ছে প্রতিপালনের বিধিবিধানের সন্ধান লাভ করা। এটাই তাঁর আধ্যাত্মিকতা।
ভাসানী শ্রেণীসংগ্রামের বাস্তবতা কখনোই অস্বীকার করেননি, জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের বিপ্লবী লড়াইকে ত্যাগ করতে বলেননি, জালিমের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগের ন্যায্যতাকেও তাঁর শেষজীবনের কোনো লেখায় বাতিল গণ্য করেননি। কারণ ওর মধ্য দিয়েই মানুষ যে আসলে বিদ্যমান ব্যবস্থার ফল মাত্র নয়; বরং ব্যবস্থার বাইরের দৈব সত্তা—মানুষ আদতে ‘আধ্যাত্মিক’ জীব—সেই সত্য ঐতিহাসিকভাবে মানুষ উপলব্ধি করতে পারে। এর মধ্য দিয়েই মানুষ নিজেকে নিজে আবিষ্কার করে। বিদ্যমান ব্যবস্থার শেকল মানুষকে চিরকাল শৃঙ্খলিত রাখতে পারে না। মানুষকে সেই পথ দেখানোই বিপ্লবী রাজনীতি।
ভাসানী কখনোই কমিউনিজম বা নতুন কৌম বা ‘সমাজ’ গড়ে তোলার আদর্শ থেকে সরেননি; বরং বিপ্লবী রূপান্তরের লক্ষ্যকে মানুষের নিজের রূপান্তর হিসেবে নতুনভাবে সূত্রায়িত করে গেছেন।
তাঁর মৃত্যুদিবসে যদি এতটুকু বুঝি, তাহলে এটাও বুঝব তাকে অর্ধেক লাল অথবা অর্ধেক সবুজে বোঝার চেষ্টা ভুল—তিনি বা তাঁকে তেমন করে বোঝাই আমাদের কাজ—তখন বাংলাদেশে বিপ্লবী রাজনীতি পুনর্গঠনের সঙ্গে কীভাবে ইসলাম প্রশ্ন জড়িত, সেই দিকগুলো যেমন আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে, তেমনি আগামী দিনে আমাদের গন্তব্য আসলে কোন দিকে, তার নিশানা নির্দেশ করাও সহজ হবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০১২ দুপুর ১:০৬