দ্বিতীয় পর্ব
আমি বলি, 'তো অস্ত্র - শস্ত্র নিয়ে মোনায়েম খানের বাসার ভেতর ঢুকলেন? শুরু হলো অপারেশন?'
মোজাম্মেল ভাই বলেন, 'ওই দিন বাসার ভেতরে ঢুকতে পারলেও সেদিনই অপারেশন করতে পারিনি। পর পর দুবার ব্যর্থ হই। ... প্রথমবার ওই সন্ধ্যায় মোনায়েম খানের বাসায় ঢুকে গেটের পাশের কলাবাগানের ঝোঁপে ঘাপটি মেরে বসে থাকি। একটু পরে তার রাখাল সেই শাজাহান ভাই এসে খবর দেয়, মোনায়েম খানের শরীর খারাপ। সে দোতলায় উঠে গেছে। দোতলায় যেতে গেলে তার ছেলের ঘরের সামনে দিয়ে যেতে হবে। আবার বাড়ি ভর্তি লোকজন।'
'অপারেশন ওইদিন স্থগিত রেখে আমি সেখান থেকে চলে যাই পাশের বনানী খ্রিস্টান পাড়ায়। সেখানে প্রচুর ইটের পাঁজা ছিল। ইটের পাঁজায় হাতিয়ারের ব্যাগটি লুকিয়ে চলে আসি।'
'পরে আরেকদিন সন্ধ্যায় হাতিয়ারের ব্যাগ নিয়ে শাজাহান ভাইয়ের সঙ্গে আবার মোনায়েম খানের বাসায় যাই। আবার সেই কলাবাগানে ঘাপটি মেরে বসা। কিন্তু তখন একটি উজ্জল বৈদ্যুতিক বাল্বের আলোয় চারপাশের সব কিছু পরিস্কার। আমি অন্ধকারের আড়াল পেতে সেই বাতিটি ইট মেরে ভেঙে ফেলি। এতেই বিপত্তি দেখা দেয়।'
'একজন চাকর ভাঙা বাল্ব দেখে চিৎকার - চেঁচামেচি শুরু করে, বাড়িতে চোর ঢুকেছে! মোনায়েম খানের বাসা পাহারা দিতো যে সব বেলুচিস্তানের অবাঙালি পুলিশ, তারা হুইসেল বাজিয়ে, টর্চ মেরে চোর খোঁজাখুঁজি শুরু করে। আমি বিপদ দেখে আবার পালাই।'
*
আমি বলি, 'ও আচ্ছা। কিন্তু এতোদিন পত্রিকায় কিন্তু এই সব ঝক্কি - ঝামেলার কথা পড়িনি। আমি ভেবেছি'...।
মোজাম্মেল ভাই হাসেন, 'আরে পত্রিকা ওয়ালারা এতো কথা লিখতে চায় না। ওরা হচ্ছে, সংক্ষেপে বিস্তারিত!'
'তো তারপর তো আমার মন খুব খারাপ। পর পর দুবার অপারেশনে বাধা। আর বুঝি হবে না! এদিকে শাজাহান ভাই ভাটারা এসে একদিন আমাকে ধরে, কী ভাই, যুদ্ধ হবে না? তার কথায় আবার মনোবল ফিরে পাই।'
'এবার সহযোগি হিসেবে সঙ্গে নেই আনোয়ার ভাইকে (আনোয়র হোসেন, বীর প্রতীক)। আবারো সন্ধ্যার পর মোনায়েম খানের বাসার ভেতরের সেই কলাঝোপে দুজন লুকিয়ে বসে থাকি। একটু পরে শাজাহান ভাই এসে খবর দেয়, আজকে অপারেশন সম্ভব। মোনায়েম খান, তার মেয়ের জামাই (জাহাঙ্গীর মো. আদিল) আর শিক্ষামন্ত্রী (আমজাদ হোসেন) বাসার নীচ তলার ড্রইং রুমে বসে গল্প - গুজব করছেন।'
'আমি জানতে চাই, কে মোনায়েম খান, চিনবো কী ভাবে? শাজাহান ভাই জানান, একটি সোফায় তিনজনই একসঙ্গে বসে আছে। মাঝের জনই মোনায়েম খান, তার মাথায় গোল টুপি রয়েছে।...আমি অপারেশনের পরের পরিস্থিতি আন্দাজ করে গোয়লা জব্বার চাচা আর শাজাহান ভাইকে জামা - কাপড় নিয়ে বাসা থেকে পালাতে বলি।'
'শুনশান নিরবতার মঝে হাতিয়ার বাগিয়ে আমরা দুজন মূল বাড়িটির দিকে এগিয়ে যাই। আমার প্ল্যান হচ্ছে, স্টেন গানের একটি ম্যাগজিন পুরো খরচ করবো মোনায়েম খানের ওপর। বাকি দুজনকে আরেকটি ম্যাগজিন দিয়ে ব্রাশ করবো।...ব্যাকআপ আর্মস হিসেবে হ্যান্ড গ্রেনেড আর ফসফরাস বোমা তো আছেই।'
'আমরা বাড়ির ড্রইং রুমের দরজায় পৌঁছে দেখি দরজাটি খোলা। দরজার দিকে মুখ করে তিনজন একটি সোফায় ঘনিষ্টভাবে বসে মাথা নীচু করে কোনো শলা - পরামর্শ করছে। মাঝখানে গোল টুপি মাথায় মোনায়েম খান। আমি স্টেন দিয়ে ব্রাশ করি। কিন্তু একটি মাত্র সিঙ্গেল ফায়ার বের হয়, গুলিটি মোনায়েম খানের পেটে লাগে। সে -- ও মা গো-- বলে রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। ...বাকি দুজন ভয়ে --বাবা গো, মা গো, বাঁচাও, বাঁচাও-- চিৎকার শুরু করে।...আমার স্টেন গান দিয়ে আর ফায়ার হয় না। আমি ম্যাগজিন বদলে বাকী ম্যাগজিন দিয়ে ফায়ার করার চেষ্টা করি, তাতেও কাজ হয় না। আনোয়ার ভাই সেফটি পিন খুলে গ্রেনেডটি ছুঁড়ে মারেন। এবারো ভাগ্য খারাপ। গ্রেনেডটিও ছিলো অকেজো, সেটি দেয়ালে বারি খেয়ে ফেরত আসে।'
'এদিকে তার বাড়ির বেলুচিস্তানী পুলিশরা চিৎকার - চেঁচামেচি শুনে একের পর এক ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার করতে থাকে। আমরা দেয়াল টপকে পালাই।'
*
'দৌড়ে গুলশান - বনানী লেকের কাছে পৌঁছে দেখি জব্বার চাচা আর শাজাহান ভাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমি আনোয়ার ভাইকে ওদের সঙ্গে লেক সাঁতরে ওপারে চলে যেতে বলি। স্টেন গান নিয়ে আমার পক্ষে সাঁতার দেওয়া হয় না। ...খুঁজতে খুঁজতে আমি একটি কোষা নৌকা পেয়ে যাই। সেটা নিয়ে আমি গুলশান ২ নম্বর ব্রিজের কাছাকাছি আসি।'
'এদিকে গোলাগুলির শব্দে একের পর এক পাক আর্মির ট্রাক মোনায়েম খানের বাসার দিকে রওনা হয়েছে। দূরে বড় রাস্তা দিয়ে ট্রাকের চলাচল দেখি। ওই ব্রিজটির ওপর আর্মির চেক পোস্ট ছিলো। আমি ধরা পড়ার ঝুঁকি নিয়েই ক্রলিং করে ব্রিজের নীচ দিয়ে একটু একটু করে ভাটারা পৌঁছাই।'
'ভাটারা বাজারে তখন একটি চায়ের দোকানে সহযোগি তিনজন আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। স্টেনগান কাঁেধ সেই প্রথম গ্রামের মানুষ আমাকে দেখে। এর আগে তারা কানাঘুষায় শুনেছিল, আমি ট্রেনিং নিয়েছি। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করেনি। তখন আমাকে দেখে ভয়ে সবাই দৌড়ে পালায়। আমি শীতে কাঁপতে কাঁপতে (তখন অক্টোবর মাস) কোন রকমে আনোয়ার ভাইকে স্টেনগান দিয়ে বলি, আমার খুব শরীর খারাপ লাগছে! এর পর আমি জ্ঞান হারাই।'
'জ্ঞান ফিরে আসে রাতে আমার বাড়িতে। দেখি, বাড়ির লোকজন ছাড়াও জব্বার চাচা, শাজাহান ভাই আর আনোয়ার ভাই আমাকে ঘিরে আছেন। আনোয়ার ভাই বলেন, এখানে থাকা নিরাপদ নয়। আমরা নারায়নগঞ্জের রূপগঞ্জে যাচ্ছি। তুমিও আমাদের সঙ্গে চলো। আমি তাদের বলি রওনা হয়ে যেতে। আমি রাতটুকু এখানেই বিশ্রাম নিয়ে পরদিন রূপগঞ্জে পৌঁছাবো।'
'পরদিন সকালে ঘুমিয়ে আছি, আমার এক চাচা এসে বললেন, রাতে আকাম করে এসে এখনও তুই বাড়িতে! রেডিও খবরে বলছে, মোনায়েম খান মারা গেছে। এখনই তুই পালা।...আমি রূপগঞ্জে পালিয়ে যাই। সেখানে আমাদের গ্র“পের অন্য সহযোদ্ধারা আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।'
*
এবার আমি একটু অফ ট্র্যাকে যাই। জানতে চাই, 'আচ্ছা মোজাম্মেল ভাই, স্বাধীনতার ৩৬ বছরেও তো স্বাধীনতা বিরোধী - যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলো না। এর কারণ কী বলে মনে হয়?'
মোজাম্মেল হক বলেন, 'অতীতে রাজনৈতিক দলগুলো কোনো না কোনো স্বার্থের কারণে জামায়াতসহ স্বাধীনতা বিরোধী -- যুদ্ধাপরাধীদের লালন - পালন করেছে। তারা ক্ষমতার লোভে ঘৃণ্য এই সব চরম অপরাধীদের সঙ্গে আপোষ করেছে।'
'আপনি কী মনে করেন, দল নিরপেক্ষ এই সেনা সমর্থিত তত্ত্ববধায়ক সরকার যে এখন স্বাধীনতা বিরোধী - যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলছে, এই দাযিত্ব তাদেরই নেওয়া উচিৎ?'
'অবশ্যই। সবদেশে সরকার পক্ষই স্বাধীনতা বিরোধী - যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দায়িত্ব নেয়। এই সরকার দুর্নীতি ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে এরই মধ্যে সুনাম কুড়িয়েছেন। এখন তাদের উচিত হবে বক্তৃতাবাজীর বাইরে চরম অপরাধী হিসেবে স্বাধীনতা বিরোধী - যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজটা অন্তত শুরু করা। নইলে আমরা ধরে নেবো, অতীতের সরকারগুলোর মতো দলনিরপেক্ষ এই তত্ত্বাধবায়ক সরকারেরও কোনো কেনো স্বার্থ রয়েছে; তারাও আপোষকামী। এ ক্ষেত্রে অতীতের সরকারগুলোর সাথে তাদের কোনো পার্থক্য থাকবে না।'
তার কাছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সহযোদ্ধাদের কথা জানতে চাই। মোজাম্মেল ভাই বলেন, '১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলেও মিরপুরে বিহারীদের কাছে প্রচুর অস্ত্র ছিল। তারা তখনও অস্ত্র সমর্পন করেনি। বিহারীদের পরাজিত করতে সে সময় একাধিক যুদ্ধ হয়। আমি নিজেও এরকম কয়েকটি যুদ্ধে অংশ নেই। মুক্তিযোদ্ধা জহিরুদ্দীন ঢালি ও দিল মোহাম্মাদ ঢালি একটি প্রাইভেট কার নিয়ে মিরপুরে ঢোকার চেষ্টার করলে দুই দিক থেকে বিহারীরা গুলি করে তাদের খুন করে। সহযোদ্ধাদের এমন করুন মৃত্যূর খবরে আমি নিজেই তাদের লাশ নিয়ে আসার জন্য অপারেশন চালাই। দেখি, গুলিতে ঝাঁঝড়া হওয়া গাড়ির ভেতরে তাদের দুজন রক্তাক্ত অবস্থায় মরে পড়ে আছেন। তীব্র আক্রমনের মুখে তাদের লাশ আর নিয়ে আসতে পারিনি। কিন্তু সব সময়েই তাদের কথা মনে পড়ে।'...
'আর মুক্তিযোদ্ধাদের তো কেউ ঠিকভাবে মূল্যায়নই করেনি' বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি, 'সারাদেশেই সব মুক্তিযোদ্ধারাই অবহেলিত। আর এখন সবখানেই রাজাকার, আলবদর, আল শামসের জয়জয়াকার। ...যখন পত্রিকায় পড়ি, মুক্তিযোদ্ধা রিকশা চালান, ভিক্ষে করেন, তখন মনে হয়, এই রকম বাংলাদেশ তো আমরা চাইনি। ...একদিকে টাকার পাহাড় গড়ে উঠছে, আরেকদিনে মানুষ অভাবে, অনাহারে, অপুষ্টি আর অশিক্ষায় ধুঁকে ধুঁকে মরছে।...আমাদের দাবি, খুব সামান্য -- মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারগুলোকে যেনো রাষ্ট্র নূন্যতম সন্মান দেয়। কিন্তু গত ৩৬ বছরে কোনো সরকারই এই কাজ করেনি।'
'মুক্তিযোদ্ধাদের দুরাবস্থা দেখে, এখন মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্ন করি, তাহলে কী একাত্তরে আমরা ভুল করেছি? গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জমি - জমা সংক্রান্ত ৫০ টি মিথ্যে মামলায় আমাকে হয়রানী করা হয়। এর মধ্যে ৮ টি মামলায় আমাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে দুমাস জেল খাটতে হয়। অথচ আমি একজন বীর প্রতীক, ইউপি চেয়ারম্যান। তাহলে সারাদেশে অন্য সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের কী অবস্থা, তা তো সহজেই অনুমেয়।'
*
মোজাম্মেল হক, বীর প্রতীকের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতা শেষে আমি যখন ফিরে আসছিলাম, তখন অন্য নানান কথা সঙ্গে তার সেই শেষ কথাটিই বার বার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে, ' তাহলে কী একাত্তরে আমরা ভুল করেছি?'...
(শেষ)
আলোচিত ব্লগ
স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?
স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?
সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী
বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন
জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন
=বেলা যে যায় চলে=
রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।
সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন