প্রস্তাবিত
পুলিশ অধ্যাদেশ ২০০৭-এর খসড়া প্রসঙ্গে
সৈয়দা আইরিন জামান
ওয়ান ইলেভেনের পর বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১৮৬১ সালে প্রণীত পুলিশ আইন পরিবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। উদ্যোগের অংশ হিসেবে ২০০৭ সালের মার্চ মাস থেকে পুলিশ রিফর্ম প্রজেক্ট (পিআরপি)-এর সহায়তায় প্রস্তাবিত পুলিশ অর্ডিন্যান্স ২০০৭ -এর খসড়া তৈরি করা হয়।
প্রস্তাবিত খসড়া পুলিশ অধ্যাদেশ ২০০৭ -এ মোট ১৫টি অধ্যায়, ১৬৩টি ধারা এবং ৫টি তফসিল রয়েছে। অধ্যাদেশের খসড়া প্রণয়ন কমিটির সদস্য ছিলেন ১৫ জন। এর মধ্যে ১২ জনই পুলিশ বিভাগের। এই অধ্যাদেশে ১৮৬১ সালের আইনের সীমাবদ্ধতা তুলে ধরা হয়েছে এবং এ বিষয়ে কি কি সংস্কার করা প্রয়োজন তার সুপারিশ রয়েছে।
বৃটিশ সরকার ভারতীয় জনগণের উপর অন্যায্য ও নির্দয়ভাবে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে শাসন ও শোষণ নির্বিঘ্ন রাখার প্রয়োজনেই পুলিশ এ্যাক্ট ১৮৬১ প্রণয়ন করেছিল। মূলত ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন ছিল বাংলায় মুঘল শাসন ব্যবস্থা থেকে বৃটিশ শাসন ব্যবস্থায় উত্তরণের চূড়ান্ত পদক্ষেপ।
ঐ আইনে পুলিশ বাহিনী পরিচালনার সার্বিক দায়িত্ব সরকারের উপর ন্যস্ত করা হয়। প্রস্তাবিত পুলিশ অর্ডিন্যান্স ২০০৭ -এ স্বাধীন দেশের প্রোপটে বৃটিশ সরকার প্রণীত আইনের ১০টি অসঙ্গতি উল্লেখ করা হয়েছে। ১৮৬১ সালে আইন প্রণয়নের শুরু থেকেই সরকারকে রায় পুলিশকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
বৃটিশ রাজত্বে ভারতের জনগণ ছিলেন প্রজা আর পাকিস্তানীদের কাছ থেকে মুক্ত হয়ে এদেশের মানুষ প্রজা থেকে নাগরিক হয়েছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা জনগণের। ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানের ৭ (১) নং অনুচ্ছেদে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা হয়েছে ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’।
অথচ স্বাধীন দেশের পুলিশ পরিচালিত হচ্ছে ১৪৭ বছর পূর্বের ঔপনিবেশিক আইনে, যে কারণে প্রতিটি সরকার পুলিশকে দলীয় ও রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছে। পুলিশ ‘দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন’ নয়, বরং ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক-দুষ্টকেই সহায়তা দিয়েছে।
এভাবে ব্যক্তিস্বার্থে ও দলীয় স্বার্থে ব্যবহৃত পুলিশ বাহিনী পদোন্নতি, ভালো পোস্টিং ইত্যাদির প্রত্যাশায় একান্তভাবেই সরকারের অনুকম্পা প্রত্যাশী এক সংস্থায় পরিণত হয়েছে। প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে পূর্বে প্রণীত আইন থেকে পুলিশ বাহিনীকে বের করে আনবার জন্য ১৩টি নির্দিষ্ট প্রস্তাব রাখা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে পুলিশ হবে পেশাদারিত্ব সম্পন্ন, জনবান্ধব, সেবাধর্মী এবং সকল অবৈধ প্রভাবমুক্ত একটি সংস্থা।
সরকার ও যথাযথ কর্তৃপক্ষের আইনানুগ নিয়ন্ত্রণাধীনে পুলিশ বাহিনী পরিচালিত হবে। সরকার অথবা কোন ব্যক্তি পুলিশকে আইন বহির্ভূত কোন কাজের নির্দেশ দিতে পারবে না। জনগণের সকল গণতান্ত্রিক এবং সাংবিধানিক অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও এর যথাযথ সংরক্ষণ পুলিশের জন্য বাধ্যতামূলক।
সমাজের দুর্বল গোষ্ঠী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, নারী এবং শিশুর অধিকার রক্ষাসহ এদের প্রতি যে কোন অপরাধমূলক আচরণ প্রতিরোধে পুলিশকে অধিকতর মনোযোগী ও বিশেষভাবে সচেতন থাকার নির্দেশ রয়েছে প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে। পুলিশ ফোর্সের পরিবর্তে হবে পুলিশ সার্ভিস।
পুলিশ প্রধান পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি)-এর বদলে হবেন পুলিশ প্রধান। জাতীয় পুলিশ কমিশন হবে ১১ সদস্যের। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হবেন এই কমিশনের চেয়ারম্যান। সরকার ও বিরোধীদলের ২ জন করে চারজন সংসদ সদস্য, সুশীল সমাজের তিনজন প্রতিনিধি, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে কর্মরত একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশ প্রধান এই কমিশনের সদস্য থাকবেন।
কমিশন পুলিশ প্রধানকে নিয়োগ প্রদান করবে। সরকার নির্দিষ্ট মেয়াদের পূর্বে কমিশনের সম্মতি ব্যতীত পুলিশ প্রধানকে অপসারিত অথবা অন্যত্র পদায়ন করতে পারবে না। প্রস্তাবিত আইনে জ্যেষ্ঠতা, মেধা, সততা, নিষ্ঠা, প্রশিক্ষণ ও কর্ম দক্ষতা বিবেচনা করে নম্বরভিত্তিক মেধাতালিকা প্রণয়নপূর্বক পুলিশ কর্মকর্তাদের উচ্চপদে পদোন্নতির বিধান রাখা হয়েছে।
প্রস্তাবিত অধ্যাদেশের ৮৩ ধারায় অপরাধের সঙ্গে জড়িত পুলিশ সদস্যদের শাস্তি দেয়ার জন্য পুলিশ ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান রয়েছে এবং মানবাধিকার সমুন্নত রাখার জন্য ৮২ ধারায় ‘কোড অব কনডাক্ট’ রাখা হয়েছে। প্রস্তাবিত পুলিশ অধ্যাদেশ ২০০৭ সম্পর্কে এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে জনমত যাচাই-এর উদ্যোগ নেয় সরকার। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে বিলি করা হয়েছে ছয়টি প্রশ্ন সম্বলিত কাগজ।
ছয়টি প্রশ্নের তিনটিতে ১৭টি পৃথক মন্তব্যের কলাম রয়েছে। সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে অধ্যাদেশের খসড়া কপি, বিদ্যমান অ্যাক্টের সীমাবদ্ধতা ও প্রস্তাবিত অধ্যাদেশের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কিত একটি সার-সংক্ষেপ। ছয়টি প্রশ্নের বাইরে কোন মতামত থাকলে জানাতে বলা হয়েছে।
তৃতীয় প্রশ্নে জানাতে বলা হয়েছে- প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে বর্ণিত কোন কোন বিষয় আপনি যৌক্তিক ও সেবাধর্মী পুলিশ সার্ভিস গঠনে সহায়ক হবে না বলে মনে করেন? প্রস্তাবিত পুলিশ অধ্যাদেশ ২০০৭ -এর খসড়া ইতোমধ্যে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে।
প্রশাসন ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশন সরাসরি এর বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছে। উচ্চ পদমর্যাদার প্রভাবশালী কর্মকর্তারাও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আর পুলিশের বিভাগীয় কর্মকর্তারা অধ্যাদেশের অসঙ্গতিসমূহ নির্দিষ্ট করে করে দেখিয়ে দিচ্ছেন।
প্রস্তাবিত অধ্যাদেশটির মাধ্যমে পুলিশ সরকার কাঠামোর বাইরে থেকে যাচ্ছে। অধ্যাদেশের অন্তত ৩০টি ধারায় সরকারকেই পুলিশ প্রধানের সঙ্গে পরামর্শ করে নানা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার বিধান রাখা হয়েছে। সরকার এবং পুলিশ প্রধানের মধ্যে দ্বিমত সৃষ্টি হলে পুলিশ কমিশনের সিদ্ধান্তই কার্যকর হবে।
সরকারের সার্বিক কাজ রাষ্ট্র পরিচালনা করা আর পুলিশের কাজ জনগণের জান-মাল হেফাজত করা এবং আইন শৃঙ্খলা সমুন্নত রাখা। সরকারকে কেন পুলিশ প্রধানের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে- বিষয়টি বোধগম্য নয়। এ অধ্যাদেশটি রুল অব বিজনেস ১৯৯৬-এর অ্যালোকেশন অব বিজনেস (রুল-৩) এবং তফসিল বর্ণিত কার্যপদ্ধতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
জাতীয় পুলিশ কমিশনে মধ্যবিত্ত এবং মজুর শ্রেণীর কোন প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়নি। অথচ কে না জানে এদেশে সৎ, নিষ্ঠাবান, নিরীহ মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত মানুষই অধিকমাত্রায় শোষিত, লাঞ্ছিত এবং ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হন।
এক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত এবং মজুর শ্রেণীর দুজন করে প্রতিনিধি কমিশনে অন্তর্ভুক্ত থাকলে তারা ঐ দুই শ্রেণীর মানুষের জীবন সম্পৃক্ত সমস্যাবলী সমাধানের জন্য পুলিশের করণীয় সম্পর্কে সুপরামর্শ দিতে পারবেন। নতুন অধ্যাদেশে স্বাধীনতার নামে পুলিশকে অবাধ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ স্ক্যান্ডিনেভিয়ান কোন দেশ নয়, যে আইন বদলে দিলেই ব্যক্তির চরিত্র বদলে যাবে। ঘুষ, জালিয়াতি, অবাধ দুর্নীতি, সামাজিক অবক্ষয় দেখে যে শিশু বড় হয়েছে- অবাধ ক্ষমতা পেলে সে কি করবে? কথায় আছে-‘খারাপ হবার সুযোগ পাইনি, তাই ভাল আছি।’
কাজেই পুলিশকে অবাধ ক্ষমতা দেবার আগে এ দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপট ভেবে দেখতে হবে। পুলিশ গুরুতর অপরাধ করলে সাধারণ মানুষ পুলিশ কমপ্লেইনস কমিশনে অভিযোগ করতে পারবে। তবে প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে অভিযোগ তদন্তের যে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে তাতে পুলিশের অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাবে এবং সাধারণত মানুষ সুবিচার পাবে না।
কাজেই পুলিশের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগের তদন্তের প্রক্রিয়াটি সহজ করতে হবে। প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা পুলিশ সুপারের সম্পর্কের বিষয়ে কোন নির্দেশনা নেই। অধ্যাদেশে বলা হয়েছে , দণ্ডবিধি ২৬৮-২৯৪ ধারার অপরাধের বিচার এসপি অথবা এএসপি করতে পারবেন। অথচ পুলিশের কাজ হওয়া উচিত- প্রকৃত অপরাধীকে সনাক্ত করা, অপরাধের বিচার করা নয়।
অধ্যাদেশে বলা হয়েছে ব্যুরো অব পুলিশ রিসার্চ হবে ন্যাশনাল পুলিশ কমিশনারের স্থায়ী সচিবালয়। ব্যুরো অব পুলিশ কাজ পর্যালোচনা করে দেখতে হবে-এ ধরনের কাজের জন্য আলাদা সচিবালয় গঠনের প্রয়োজন রয়েছে কি না? অধ্যাদেশে পরিবর্তন আনলেই পুলিশ জনগণের বন্ধু হয়ে যাবেন এমনটি ভাববার কোন অবকাশ নেই। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলতেই হচ্ছে, ‘ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব রাতারাতি বদলায় না’।
রাজনীতিবিদেরা-যারা সরকার গঠন করে থাকেন তাদের দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন না হলে সব আইনই ‘আলোকিত অন্ধকার’ হয়ে থাকবে। এছাড়া পুলিশের ব্যক্তিস্বার্থগত অনিময়মের কারণেও পুলিশের ভাবমূতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পুলিশ বাহিনীর জন্য ‘স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতার অবকাঠামো’য় ঘেরা এমন একটি আইন প্রণয়ন করতে হবে যেন তা প্রশাসনের সঙ্গে সংঘাতপূর্ণ না হয়। গণতন্ত্রে ও আইনের শাসনের স্বার্থেই পুলিশকে দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখা একান্ত প্রয়োজন।
সেই সঙ্গে ব্যক্তি-পুলিশকে সৎ ও নিষ্ঠাবান হতে হবে এবং স্থান-কাল পাত্রভেদে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। ন্যায়ধর্ম বিসর্জন দিয়ে বিশেষায়িত কাগজের উপকরণের প্রতি আকৃষ্ট হলে চলবে না; বোধের মর্মমূলে নৈতিক শক্তির উদ্বোধন জাগাতে হবে।
[লেখক: ফ্যাকাল্টি মেম্বার, বাংলা বিভাগ, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।]