আমাদের অনেকেই কিছু শব্দ আওড়াতে বেশ পছন্দ করি - সামাজিক অবক্ষয়, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, পুঁজিবাদ-সামন্তবাদ-সাম্রাজ্যবাদ, পশ্চিমা বিশ্বের ষড়যন্ত্র, বস্তুবাদ, পরজীবি বুদ্ধিজীবি ইত্যাদি ইত্যাদি। ইদানিং এর সাথে যোগ হয়েছে কর্পোরেট থাবা, কর্পোরেট দখল, কর্পোরেট লোভ বা এই জাতীয় কিছু শব্দ। মোট কথা বড় কম্পানীগুলোর ব্যবসা-বানিজ্যের ধরণের বিরুদ্ধে এক ধরণের ঘৃণা বা অপছন্দতা। দেশে বড় কিছু ঘটলেই যেমন কিছু মানুষ অবধারিতভাবে ধরে নেয় এটা ইন্দো-মার্কিন-ইজরায়েল এর চক্রান্ত, তেমনি দেশের বড় বড় কম্পানীগুলো তাদের মুনাফা বৃদ্ধির জন্য কোন নতুন কিছু করলেই গেলো গেলো রব উঠে যায়। ভাবখানা এমন এই কম্পানীগুলোর সিইও হচ্ছে স্বয়ং ইবলিশ শয়তান আর তাদের জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে আমাদের এই গরীব দেশটাকে চুষে নিঃশেষিত করে দেওয়া।
কর্পোরেট বলতে আমরা সাধারণত বড় কম্পানীগুলোকেই বুঝাই। এগুলোর অনেকগুলোই আবার বহুজাতিক কম্পানী। কর্পোরেট এর প্রতি আমাদের ঘৃণা যতোই হোক না কেনো, আমাদের একটা মুহুর্তও কর্পোরেট এর উৎপাদিত পণ্য ছাড়া চলবেনা। আঠারো শতকের দিকে যে শিল্প বিপ্লব শুরু হয়েছিলো ইউরোপে, আজকের কর্পোরেট তারই বিশ শতকীয় সংস্করণ। এই যে আমি যেই কম্পিউটার ব্যবহার করে এই লেখাটি লিখছি সেটি ডেল নামক বহুজাতিক কম্পানীর তৈরি, ইন্টারনেট কানেকশন নেওয়া হয়েছে আরেক বিশাল কম্পানী কমকাস্ট থেকে, আমার ঘরের প্রায় প্রত্যেকটি জিনিসপত্র কোনো না কোনো কম্পানীর তৈরি। পানি, বাতাস, আর মাটি ছাড়া বেঁচে থাকার জন্য যা যা দরকার তার সবই আসে কর্পোরেট থেকে। আমার নিজের চাকুরীটাও একটা বহুজাতিক কম্পানীতে! এবং এ চাকুরী পেয়ে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি! এবং সেটাই কি আমাদের সবার জন্য সত্যি নয়? আমাদের সবাই কি একটা ভালো কম্পানীতে একটা ভালো চাকুরী পেলে নিজেদের ধন্য মনে করি না?
পৃথিবীর সভ্যতার চাকা ঘুরানোর মূল রসদগুলো আবিষ্কার করেন বিজ্ঞানী, গণিতবিদ, অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী এঁরা। কিন্তু এগুলো পৃথিবীর ছয় বিলিয়নেরও বেশি মানুষের কাছে তাদের ব্যবহারের মতো পণ্য বা সেবা হিসেবে প্রস্তুত করে নিয়ে যায় মূলত বিভিন্ন বেসরকরারী প্রতিষ্ঠান এবং কম্পানীগুলো (কিছু ক্ষেত্রে সরকারও এই কাজটি করে থাকে)। কম্পানীগুলো এই কাজটি কোনো জনসেবার চিন্তা থেকে নয়, বরং পুরোপুরি মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে। কিন্তু এই মুনাফা লাভ করতে গিয়ে ওরা অসংখ্য মানুষকে চাকুরী দেয় আর মানুষের জীবনকে করে দেয় অনেক বেশি আরামদায়ক। এখন ওরা কতোটুকু লাভ করবে, কিংবা কী প্রক্রিয়ায় ব্যবসা করবে এই আইনগুলি ঠিক করে দিবে দেশের সরকার, যেই সরকারকে নির্বাচন করে ক্ষমতায় আনবে সেই দেশের জনগন। জনগন যেহেতু সরকারকে ক্ষমতায় আনবে, তাই সরকার এমনভাবে আইন করবে যাতে জনগনের স্বার্থ সবার আগে রক্ষা হয়। এক্ষেত্রে এটাও মনে রাখতে হবে যারা ওই কম্পানীগুলোর মালিক/অংশীদার তারাও এই জনগনের অংশ, এবং তারাও অসংখ্য মানুষের চাকুরীর ব্যবস্থা করে দেশের অর্থনৈতিক চাকাকে সচল রাখছে।
আমরা যারা বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়এ পড়ছি বা পড়ে পাশ করে বের হয়েছি, আমাদের সবার লক্ষ্য কী? প্রায় সবাই কি একটা ভালো চাকুরী করতে চাই না? বড় বড় টেলিকম কম্পানীগুলো, কিংবা বড় বড় বুহুজাতিক কম্পানী-ব্যাঙ্কগুলো হয় আমাদের প্রথম টার্গেট, কারণ সেগুলো সবচেয়ে বেশি বেতন দেয়। একটা স্বাভাবিক জীবন যাপনের জন্য সবারই টাকা দরকার হয়, টাকা নিয়ে যতোই বড় কথা বলি না কেনো আমরা। আর সেই টাকার একটা বড় অংশ অর্থনীতিতে পাম্প করে এই কম্পানীগুলো। অর্থনীতিকে সচল রাখতে কম্পানীগুলোর কোনো বিকল্প নেই।
উন্নত দেশগুলিতে এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপকে প্রচন্ড উৎসাহ দেওয়া হয়। বৈদ্যুতিক বাল্বসহ অসংখ্য আবিষ্কারের জনক থমাস আলভা এডিসন ছিলেন একজন সফল উদ্দোক্তা (এন্ট্রাপ্রেনিউর)। মাইক্রোসফট এর বিল গেটস, গুগলের ল্যারি এবং সের্গেই, এইচপি এর হিউলেট এবং প্যাকার্ড - এরকম অনেক কম্পানীর প্রতিষ্ঠাতারা আক্ষরিক অর্থেই জিনিয়াস পর্যায়ের মানুষ। এই কম্পানীগুলো বিংশ এবং একবিংশ শতকের সভ্যতার পরিবর্তনের অন্যতম চালক। তেমনি করে সারা পৃথিবী জুড়ে খেলাধুলা, ইলেক্ট্রনিক্স, কম্পিউটার, টেলিকম, পেট্রোলিয়াম, কসমেটিক্স, খাদ্যদ্রব্য, যানবাহন, উড়োজাহাজ, স্বাস্থ্য - ইত্যাদি বিভিন্ন খাতে অসংখ্য শিল্প প্রতিষ্ঠান নির্ভর কম্পানী নানারকম পন্য এবং সেবা দিয়ে পৃথিবীতে আমাদের জীবন যাপনকে করে দিয়েছে অনেক বেশি সুবিধাজনক আর আরামদায়ক। আমাদের আজকের এই মোবাইল ফোন বিপ্লব, মিডিয়া বিপ্লব এগুলোর পেছনেও রয়েছে কর্পোরেট। মোবাইল ফোন ছাড়া কি একটা দিনও থাকার কথা ভাবা যায়? আর কর্পোরেটকে বাদ দিয়ে সরকারীভাবে ফোন সেবা দিতে চাইলে যে কী অবস্থা হয় সেটা টিএন্ডটি আর টেলিটককে দেখলেই বুঝা যায়!
দেশের অর্থনীতির স্বাস্থ্য অনেকাংশেই নির্ভর করে এই কম্পানীগুলোর স্বাস্থের উপর। কম্পানীগুলোর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে টাকা কামানো, সরকার সঠিক আইনের মাধ্যমে এই কম্পানীগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে। কম্পানীগুলোকে ঘৃণা করে দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন ঘটানো যাবে না। দুঃখের বিষয় এমনকি বিয়ে করার সময় পাত্র ব্যবসা করে এমন কথা শুনলে আমাদের অভিভাবকরা তাদের মেয়ে বিয়ে দিতে চায়না অনেক সময় সেই পাত্রের কাছে। ব্যবসা মানেই মুদির দোকানী বা এরকম কিছু, কিংবা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে না পেরে কিছু একটা করার চেষ্টা - এই ধারণা থেকে আমাদের বের হতে হবে। মেধাবী ছেলেমেয়েরাও ব্যবসা করে, এবং সেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অনেক মেধাবী ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-ব্যবসা প্রশাসন গ্র্যাজুএট কাজ করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে - এটাকে একটা বাস্তবতা হিসেবে আমাদের মেনে নিতে হবে।
আমাদের দরকার অনেক অনেক ব্যবসায়ী উদ্দোক্তা, অনেক অনেক কর্পোরেট কম্পানী। সিলিকন ভ্যালীর মতো সভ্যতা পরিবর্তনকারী ব্যবসা'র জায়গা তৈরী হয়েছে শুধুমাত্র উদ্দোক্তাদের মাধ্যমে। সিলিকন ভ্যালীর উদ্দোক্তারা প্রায় সবাই কোটিপতি, কিন্তু তাদের পন্য ব্যবহার করে আরো বেশি মানুষ কোটিপতি হয়েছে এবং তার চেয়েও বেশি মানুষ আরামদায়ক জীবন যাপন করছে তাদের প্রযুক্তি ব্যবহার করে। "কর্পোরেট" শব্দটাকে একটা ভালো শব্দ হিসেবে দেখতে হবে। কর্পোরেটএ চাকুরী পাবার জন্য একের পর সিভি জমা দিবো কিন্তু ব্লগে বসে কর্পোরেটকে গালি দিবো সেটা হওয়া উচিত নয়। এরচেয়ে গণহারে সমালোচনা না করে স্পেসিফিক সমালোচনা করলে ব্যাপারটা অনেক বেশি ঠিক হয়। কর্পোরেট যেনো আমেরিকার মতো হয়ে না পড়ে - আমেরিকাকে সবাই গালি দেয় কিন্তু সবাই সেখানে যেতে চায়, ডিভি লটারিতে সবচেয়ে বেশি আবেদন পড়ে বাংলাদেশ থেকে! কর্পোরেট যেনো একটা আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়, এন্ট্রাপ্রেনিউর হওয়া ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-ম্যানেজার হওয়ার চেয়ে কম স্মার্ট ব্যাপার না। একটি সফল পণ্য তৈরি ও বাজারজাত করা এবং সেটিকে সবার নিত্যদিনের ব্যবহার্য করে তোলা একটি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার, এবং এই কাজের জন্য দরকার ভিশন এবং এক্সিকিউশন। আজকের দিনের সেরা ব্র্যান্ডগুলি তৈরির পেছনে অসংখ্য প্রতিভাবান মানুষের অনেক বছরের পরিকল্পনা আর পরিশ্রম রয়েছে। এই পরিশ্রমকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই।
তবে কর্পোরেট যেনো মানুষের ক্ষতির কারণ না হয়ে দাঁড়ায় তার জন্য থাকতে হবে শক্ত আইন এবং তার শক্ত প্রয়োগ। বন উজাড় করে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, চাষাবাদের জমি এবং নদী দখল করে আবাসিক প্রকল্প গড়ে তোলা, সেবার তুলনায় টাকা বেশি নেওয়া ইত্যাদি ব্যাপারে সরকারকে থাকতে হবে তৎপর। কিন্তু এসব যাতে কর্পোরেট এর বিরুদ্ধে নির্বিচার ঘৃণার কারণ না হয়ে উঠে সেটি খেয়াল রাখতে হবে। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে কর্পোরেট এর বিকল্প নেই। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে বছর বছর যে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং, বিবিএ, অর্থনীতি, রাজনীতি বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান, ইত্যাদি অসংখ্য বিষয় থেকে পাশ করে বের হচ্ছে তাদের পর্যাপ্ত চাকুরীর জন্য দরকার অনেক অনেক কর্পোরেট কম্পানী। শুধু খেয়াল রাখতে হবে আমাদের সরকার যেনো দেশের আইনটা ঠিকমতো প্রয়োগ করে আর সাধারণ মানুষের স্বার্থের দিকটা ঠিক রাখে।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুলাই, ২০০৯ দুপুর ১২:১১