লেখাটির মূল কপি : এখানে দেখুন
""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""
'স্যার আমি লুবনা, গ্রামীণফোন কাস্টমার কেয়ার থেকে বলছি। আপনি কি আমাদের হেল্প সেন্টারে কোনো অভিযোগ উত্থাপন করেছিলেন?'
মোবাইল ফোনটা রিসিভ করে কানে লাগাতেই উপরের কথাগুলো ভেসে আসে আমার কানে।
আচমকা আমি থমকে যাই। কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলি। মূলত এই কারণে নয় যে, গ্রামীণফোন থেকে আমাকে একটি মেয়ে ফোন করেছে।
লুবনা আমার এতো পরিচিত একটা নাম, তার কণ্ঠস্বর শোনেই আমি থমকে যাই।
এক নিমিষে ফিরে যাই সাতটি বছর আগে।
ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে সবে মাত্র একটা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে সিএসইতে ভর্তি হয়ে ঢাকায় এসেছি।
মনে ফুরফুরে আনন্দ, চোখে রঙিন স্বপ্ন।
আমার হাতে তখনও মোবাইল ফোন আসেনি। কঠিন শাসনে আমাদের ভাই-বোনগুলোকে বেড়ে তোলা আমার বাবা দেম-দিচ্ছি করছেন।
আমার সম্বল পত্রমিতালী। সেই ক্লাস সেভেনে যখন কাবস্কাউটে ভর্তি হয়ে ক্যাম্পে গিয়েছিলাম, বন্ধু গড়ে উঠাদের সাথে যোগাযোগ করতেই পত্রমিতালী আমার সঙ্গী হয়ে গিয়েছিলো।
আমি গল্প লিখতাম। লিখতে ভালো লাগতো। কেননা, আমি তখন তিন গোয়েন্দা বই আর আর বইয়ের পোকা ছিলাম। বই পড়তে পড়তে মনে হতো যদি আমিও এমন লিখি তাহলে কেমন হয়?
টুকটাক লিখতাম। যেগুলো কালেভদ্রে দৈনিক ও বিভিন্ন সাপ্তাহিক পত্রিকাতেও ছাপা হতো।
দুইহাজার দুই সালের এপ্রিল সংখ্যা মাসিক তারকালোকে আমার একটি গল্প ছাপা হলো। পত্রিকাওয়ালারা কি কারণে সেখানে আমার ঠিকানাও ছেপে দিলেন।
যার ফল স্বরূপ বেশ কিছু চিঠি পেলাম।
এর মধ্যে একটা মেয়ের একটা চিঠি আমাকে খুব ভাবিয়ে তুললো। তার লেখার ভাষা ছিলো মার্জিত-পরিপাটি আর আকর্ষণীয়।
ভাবলাম এতোদিন তো শুধু ছেলেদের সাথে পত্রবন্ধু করলাম। এবার একটি মেয়ের সাথে করলে কেমন হয়?
মনের মাধুরী মিশিয়ে চিঠির জবাব দিলাম।
সপ্তাহ না ঘুরতেই রঙিন খামে সে জবাব দিলো। এবারের চিঠি আরও সুন্দর। তার ভাবনাগুলো ছিলো অতি চমৎকার আর আমাকে সেগুলো ভাবিয়ে তুলতো।
আমি তাকে আমার সমমনা মনে করতাম যদিও সে তখন ক্লাস টেনে পড়তো।
ধীরে ধীরে এমন হলো যে, তার চিঠি একটু দেরিতে পেলে আমার টেনশান হতো, ভালো লাগতো না।
একবার সে চিঠিতে লিখলো, তোমাকে অনেক মিস করি, আর মিস করি তোমার চিঠিগুলো। তুমি অনেক দেরিতে চিঠি লেখো। কিংবা পিয়ন আমাকে দেরিতে চিঠি পৌঁছায়। বন্ধু, তুমি কি কুরিয়ারে চিঠি পাঠাতে পারো না?
শুরু হলো কুরিয়ারে চিঠি পাঠানো। সপ্তাহে দুই তিনটি চিঠি তাকে লিখতাম আর সেও আমাকে লিখতো।
কখনো সপ্তাহের প্রতিদিন তাকে চিঠি লিখতে হতো। কেননা, না লিখলে সে পড়ালেখায় অনিয়ম করবে, খাবে না বলে আমাকে আলটিমেটাম দিতো।
সে প্রায়ই লিখতো, রুদ্র, ভেবে দেখো আমরা একই শহরে একই আকাশের নীচে আছি, অথচ কেউ কাউকে দেখছি না, দেখা করছি না, কিন্তু আমরা পরস্পরকে কতই না মিস করি।
সত্যিই, এটা ভাবতে আমার খুবই ভালো লাগতো। ভাবতাম, সত্যিই আমার একটা চমৎকার বন্ধু আছে যে আমাকে বুঝতে জানে, আমাকে পড়তে জানে। আমি তাকে মিস করতাম। অবসরে তার নামে মালা জপতাম।
আমি যদি লিখতাম, আমাদের কি কখনোই দেখা হবে না? সে লিখতো, না। তারপর হেসে হেসে লিখতো, আরে বোকা হবে হবে, অতো ধৈর্য হারাচ্ছো কেন? মনের দিক থেকে আমরা যেদিন অনুভব করবো যে, হ্যাঁ এখন আমাদের দেখা হওয়া প্রয়োজন সেদিনই দেখা করবো। তার আগে নয়। বুঝেছো বোকারাম?
আমি লিখতাম, তোমাকে দেখতে বড্ড মন চায়। একটা ফটো দেবে?
সে লিখতো, কখনোই নয়। ছবি সেতো স্থির। তোমাকে শুধু কষ্টই দেবে। প্রশ্ন করলে জবাব দেবে না। আমিও তোমার ছবি চাই না।
শেষের দিকে, আমাদের বন্ধুত্ব যখন অনেক গাঢ়, ও লিখতো, তোর মতো বন্ধু পেয়ে আমি আনন্দিত, আমার জীবন স্বার্থক। তুই অনেক ভালো রে...
মনে মনে আমি ভাবতাম, এই কথাগুলো তোর জন্যও ঠিক লু, তোর জন্যও...
দুই.
এভাবে কেটে গেলো আমাদের কয়েকটি বছর।
সে এসএসসি পাশ করলো। সে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করলো। ভর্তি হলো একটা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে।
একদিন মেইল করে জানালো, ইন্টারমিডিয়েটে ভালো রেজাল্টের জন্য বাবা তাকে মোবাইল কিনে দিয়েছে। আমি যেনো শিগগিরই মোবাইল কিনি।
লুনার কথা শুনে আমার খুব খারাপ লাগলো। কথা ছিলো, মোবাইল দুজনে একসাথে কিনবো।
এতোদিন আমি ইচ্ছে করেই মোবাইল নিইনি। আমার গ্যানগ্যানানিতে বাবা যদিও বছর খানিক পর রাজি হয়েছিলেন মোবাইল কিনে দিতে, কিন্তু লুনা যখন বললো, এখন মোবাইল নেবো না আর তুমিও নিও না তখন আমি বাসায় জানালাম, আমার মোবাইল এখন লাগবে না। যখন লাগবে চেয়ে নেবো।
আর ও কিনা আমাকে না জানিয়েই হুট করে নিয়ে নিলো?
আমি ওকে চিঠি লেখা বন্ধ করে দিলাম।
ও একের পর এক চিঠি লিখতে লাগলো। কিন্তু আমার কষ্টটা নিয়ে ও কিছুই লিখলো না। কেন? কে জানে! এতে আমার অভিমান আরও বাড়লো।
হুট করে আমি আমার বাসা পরিবর্তন করে অন্যজায়গায় চলে গেলাম। কারণ ওকে ফাঁকি দেয়া। আমার ভয় ছিলো, ওকে চিঠি না লিখলে ও হুট করে হয়তো একদিন চলে আসবে আমাকে হাতে নাতে ধরতে। আগের বাসার কেয়ারটেকারকে বললাম, আমার চিঠি এলে রেখে দিতে, আমি সময় করে এসে নিয়ে যাবো।
এভাবে কেটে গেলো ছয় মাস।
একদিন মনটা এতো খারাপ ছিলো, কী করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। লুনার নাম্বারটা নিয়ে একটা দোকান থেকে মোবাইল করলাম ওকে।
তিন.
ওপাশ থেকে একটা রিনিঝিনি কণ্ঠস্বর বলে উঠলো, হ্যালোও...
বললাম, লু, আমি রুদ্র।
: রুদ্রঅঅঅঅঅঅঅঅঅঅ ! অ-মাই গড, সব কথা পরে বলছি, কিন্তু তোর আল্লার দোহাই লাইনটা কাটিস না। আল্লার দোহাই...
: আমি গরিব মানুষ, দোকান থেকে ফোন করতে অনেক টাকা লাগবে...
: আমার সাথে ভং করবি না, টাকা না থাকলে দোকানের কাম করে পরিশোধ করবি, আমার জন্য করবি, শুধু আমার জন্য।
: আচ্ছা, লাইন কাটবো না, বল...
: তুই আমার সাথে এমন করলি কেন রুদ্র, কেন করলি?
কথাগুলো বলতে বলতেই ভ্যাঁ করে কেঁদে দিলো। আমি তো অবাক! দোকানের মানুষগুলোর সামনে আমি কী বলবো?
চুপ করে রইলাম। দুই তিন মিনিট পর ও একটু শান্ত হয়ে বললো, তুই আমার সাথে এমন করতে পারলি? কেমন করে পারলি?
: তুই কেমন আছিস?
: তোর লজ্জা হওয়া উচিত এমন প্রশ্ন করার জন্য।
ওকে রাগানোর জন্য বললাম, আমি লজ্জিত...
: ঢং করবি না, বদের হাড্ডি, তোকে আমি আস্ত রাখবো না... তোর হাড্ডি আমি জ্বালিয়ে কয়লা করবো, এখন কোথায় আছিস বল?
......
......
চার.
আজ এতোটা বছর পর যখন শুনলাম, 'স্যার আমি লুবনা, গ্রামীণফোন কাস্টমার কেয়ার থেকে বলছি। আপনি কি আমাদের হেল্প সেন্টারে কোনো অভিযোগ উত্থাপন করেছিলেন?'
তখন ওকে চিনতে একটুও ভুল হলো না। ওর মিষ্টি রিনঝিনে কণ্ঠস্বর কি কখনো ভুলা যায়?
মূলত গতকাল কাস্টমার কেয়ারে ফোন করেছিলাম আমার জিপির নেট স্পীড খুব বাজে হয়ে গেছে। পিং থাকে না। সেই অভিযোগ করেছিলাম। ওরা আমার নম্বর টুকে রেখেছিলো, যেনো সমাধান করে আমাকে জানাতে পারে।
পাঁচ.
[আগামীকাল লিখবো]
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই আগস্ট, ২০০৯ রাত ১২:৫৩