পাখিরা সব ফিরে আসে ডেরায়, আকাশে গোধূলীর রাতুল পান করতে করতে এখন সন্ধ্যা ঘনায়, আমরা এখন অন্ধকারে বসে থাকি, সন্ধ্যার পর পর থেকে । আগেও আসতো সন্ধ্যা, আগেও আমরা বসে থাকতাম অন্ধকারে , গাছের পাতার শরীর ধরে আসতো গায়ে মিন্টের স্বাদ বুলিয়ে দেয়া বাতাস । এসে ক্ষাণিক থেমে গা জুড়োত । এখন গাছ নেই, বাতাস নেই । মিগালোম্যানিয়ার উপসর্গ উচু উচু চিরযুবক দালান গুলো বাতাস আগলে দাঁড়িয়ে থাকে । আমাদের ঘিরে থাকে শুধু অন্ধকার আর শরীর জুড়ে ক্লেদাক্ত ঘাম ।
লোডশেডিং এখন আমাদের নাগরিক জীবনের প্রধান অনুভব । বিদ্যুৎ থাকাটা একটা দুর্ঘটনা মনে হয় । প্রায় সারাদিন ই বিদ্যুত নেই, রাতেও খুব ব্যতিক্রম হয় না । একটু আগে, এক বন্ধু মেসেঞ্জারে মেসেজ পাঠালো -
বাসা থাইকা বাইর হইসি সকাল ৮ টায়, যাওয়ার সময় দেখি ইলেক্ট্রিসিটি নাই । অফিস থাইক্কা বাসায় ফিরসি সন্ধ্যা ৬ টায়, একটু পরে ইলেক্ট্রিসিটি আসলো, হাত মুখ ধুয়ে বসলাম নেটে, বসতে না বসতেই আবার গেল গা । বিরক্ত হইয়া, গেলাম স্টুডেন্টের বাসায়, পড়াইতে । এইখানেও নাই । বাসায় ফিরা আইলাম । যাহ বাবা, এখনো আসে নাই । রেলিং নাই সিড়ির, আন্ধাইরে হাতায়া হাতায়া উঠলাম । এখন আইসে আবার । ভাত খামু । জানিনা খাওয়া শেষ করতে পারমু কি না ! তবে ১২ টার পরে আবার যাইবো, ১ টায় আসবো -- এইটা রুটিন ।
গত সরকারের আমলে বিদ্যুত খাতে যে রকম দুর্নীতি হয়েছে, তা আর কোন খাতে হয়েছে বলে মনে হয় না । সিরাজগঞ্জের এম পি প্রাক্তন বিদ্যুতচোরা ইকবালের বাড়িটায় শর্ট-সার্কিট দিয়ে পুড়াতে পারলে শান্তি পেতাম ! রাত ৮ টার পরে সকল দোকান পাট বন্ধ হয়ে যায় । তারপরও বিদ্যুতের এই অবস্থা ! যদি ৮ টার পরেও দোকান খোলা থাকতো, তাহলে তো মনে হয় শাহাজীবাজার আর কাপ্তাই বিদ্যুত কেন্দ্র ও মোমবাতিতে চালনো লাগতো ।
কলকারখানার কথা বাদ ই দিলাম । এইগুলা সরকারী উদাসীনতা আর বিদেশী বেনিয়া আগ্রাসনে প্রায় বিলুপ্ত । প্রোডাক্টিভিটির মন্দন সবসময় ই ছিল । এখন সেই মন্দনের ত্বরণ হচ্ছে, এই যা !
এস এস সি পরীক্ষা শুরু হয়েছে । কয়দিন পরে শুরু হবে এইচ এস সি । এই দুঃসহ অভ্যস্থ গরম আর মোম বাতির অনভ্যস্থ আধো-অন্ধকারে কিভাবে যে পড়বে বাচ্চাগুলি, ভেবেই মায়া লাগছে । হয়তো মা পাশে বসে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করবেন , একটু পরপর উঠে গিয়ে শরবৎ বানিয়ে দেবেন গরম পানিতে ( ঠান্ডা পানি নাই, কারন ফ্রিজ বন্ধ ।) মধ্যবিত্ত মায়ের চিরকালীন টানাপোড়েনের সাথে ৪০ টাকা কেজি চিনির সাথে মারামারি, অতঃপর জন্ম নেবে গরম শরবৎ । সেই শরবৎ খেয়ে বাচ্চাগুলার গলা পরীক্ষার হলে ঢুকার সময় যেমন শুকায় তারচেয়ে বেশি শুকাবে ।
সুতরাং আমাদেরকে সামন্ত যুগের ঐতিহাসিক ঐতিহ্যগুলো পুনঃ অভ্যাস করতে হবে ।
ষ্ট্রীট লাইট গুলো যখন মৃত একলা দাঁড়িয়ে অন্ধকারে চাঁদের আলোর মায়াবী রূপোলী ব্যাংগ সহ্য করবে, তখন পথ চলতে হবে চাঁদের আলোতে । অমাবস্যায় তো চাঁদ নেই । কী করা? হুম ! জোছনা রাতে পাওয়া পথ সম্পর্কিত জ্ঞান কাজে লাগাতে হবে । অমাবস্যায় কোন অচেনা রাস্তায় যাওয়া যাবে না । এইসব হামবাড় কর্পোরেট নাগরিকদেরকে চাঁদের গুরুত্ব বোঝাতে লোডশেডিংয়ের গুরুত্ব অপরিসীম ।
বেতশিল্প প্রায় মৃত । বেতশিল্পের পুনঃর্জীবন লোডশেডিংযের অবদান হতে পারে । হাতপাখা, শীতল পাটি, মাদুরের বাজার সরব হলো বলে । তাড়াতাড়ি কিনে ফেলুন । অভাগা দেশে ভালো ও অতি প্রয়োজনীয় জিনিস তাড়াতাড়ি বাজার বিতাড়িত হয় যে !
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে এপ্রিল, ২০০৮ রাত ১২:০৩