আজ পবিত্র শবে মেরাজ। এই মহমিান্বিত রজনীতে মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় বন্ধুকে দর্শন দিয়েছিলেন। দর্শন করিয়েছিলেন সৃষ্টির গুপ্ত রহস্য সমূহ। এই পবিত্র রজনীতে অনেকেই যারা বিস্তারিত অবহিত নন, তাদের জন্য সংকলিত পোষ্ট শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারলাম না। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সেই জ্ঞান সমুদ্রে অবগাহনের সুয়োগ দিন।
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মোজেযা সমূহের মধ্যে মেরাজ গমন একটি বিস্ময়কর মোজেযা। এজন্যই মেরাজের ঘটনা বর্ণনা করার আয়াতের শুরুতেই আল্লাহ পাক “সুবহানআল্লাহ” শব্দটি ব্যবহার করেছেন যা আশ্চর্যজনক ঘটনার সময়ই ব্যবহার করা হয়।
سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلاً مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ البَصِيرُ
পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রি বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যান্ত-যার চার দিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি যাতে আমি তাঁকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল। [সুরা বনী ইসরাইল : ০১]
স্বশরীরে মেরাজের গমনের প্রমাণ স্বরূপ কোরআনের ‘বিআবদিহী’ শব্দটি তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা ‘আবদুন’ শব্দটি দ্বারা বুঝান হয় রূহ ও দেহের সমষ্টিকে। তদুপরি বোরাক প্রেরন ও বোরাক কর্তৃক নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বহন করে নিয়ে যাওয়ার মধ্যেও স্বশরীরে মেরাজ গমনের প্রমাণ পাওয়া যায়। স্বপ্নে বা রূহানীভাবে মেরাজের দাবী করা হলে কুরাইশদের মধ্যে এত হৈ চৈ হত না। মেরাজের ঘটনাটি নবীজীর জীবনে এত গুরুত্বপূর্ণ এজন্য যে, এর সাথে গতির সম্পর্ক এবং সময় ও স্থানের সংকোচনের প্রশ্নটি জড়িত।
আলোর গতি সেকেন্ডে একলক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল। পৃথিবীতে সূর্যের আলো পৌঁছাতে লাগে আট মিনিট। এ হিসেবে পৃথিবী হতে সূর্যের দূরত্ব নয় কোটি তিরিশ লক্ষ মাইল। অথচ নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুহূর্তের মধ্যে চন্দ্র, সূর্য, সিদরাতুল মুনতাহা, আরশ-কুরসি ভ্রমণ করে লা-মাকানে খোদার দীদার লাভ করে নব্বই হাজার কালাম করে পুনরায় মক্কা শরিফে ফিরে এলেন। এসে দেখলেন বিছানা তখনও গরম রয়েছে। এর চেয়ে আশ্চর্যের আর কী হতে পারে?
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর গতি কত ছিল তা এ থেকে অনুমান করা যেতে পারে। কেননা তিনি ছিলেন নূর। নূর অর্থ
শুধু আলো নয়। আলো এবং শক্তি। মিরাজের মধ্যে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল -অন্যান্য নবীগণের মোজেজা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মধ্যে একত্রিত হয়েছিল। হযরত মুসা আলাইহিস সালাম তুর পর্বতে খোদার সাথে কালাম করেছেন। হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম স্বশরীরে আকাশে অবস্থান করছেন। হযরত ইদ্রিস আলাইহিস সালাম স্বশরীরে বেহেস্তে অবস্থান করছেন। তাঁদের চেয়েও উন্নত মাকামে ও উচ্চ মর্যাদায় আল্লাহ পাক নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিয়ে সবার উপরে তাঁকে মর্যাদা প্রদান করেছেন। মুসা আলাইহিস সালাম নিজে গিয়েছিলেন তুর পর্বতে। আর আমাদের প্রয় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ তাআলা দাওয়াত করে বোরাকে চড়িয়ে ফেরেস্তাদের মিছিল সহকারে বাইতুল মোকাদ্দাসে নিয়েছিলেন। সেখানে সমস্ত নবীকে স্বশরীরে উপস্থিত করে হুজুর করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মোক্তাদি বানিয়েছিলেন। সমস্ত নবীগণ অষ্ট অঙ্গ দিয়ে স্বশরীরে নামাজ আদায় করেছিলেন।
মেরাজের রাত্রে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রথম সম্বর্ধনা দেয়া হয়েছিল জিবরাঈল, মিকাইল ও ইস্রাফিল ফেরেশতাত্রয়ের অধীনে সত্তর হাজার ফেরেশতা দিয়ে।
দ্বিতীয় সম্বর্ধনা দেয়া হয়েছিল নবী আলাইহিস সালামগণের মাধ্যমে।
তৃতীয় সম্বর্ধনা দেয়া হয়েছিল আকাশের ফেরেশতা ও হুর দিয়ে।
চতুর্থ ও শেষ সম্বর্ধনা দিয়েছিলেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা।
সিদরাতুল মুনতাহা অতিক্রম করার পর স্বয়ং আল্লাহ একশতবার সম্বর্ধনামূলক বাক্য ‘হে প্রিয় বন্ধু মুহাম্মদ আপনি আমার অতি নিকটে আসুন’ - বলে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্মানীত করেছিলেন।
কোরআন মজীদে ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّى (অতঃপর নিকটবর্তী হল ও ঝুলে গেল।) “সুম্মা দানা ফাতাদাল্লা আয়াতটি এই দিকেই ইঙ্গিতবহ বলে তফসিরে মুগনী ও মিরসাদুল ইবাদ গ্রন্থদ্বয়ের বরাত দিয়ে রিয়াজুন্নাসেহীন কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে। উক্ত কিতাবখানা সাত শত বৎসর পূর্বে ফারসি ভাষায় লিখিত। মেরাজের ঘটনা ঘটেছিল নবুয়্যাতের ১১ বছর ৫ মাস ১৫ দিনের মাথায়। অর্থাৎ নবুয়্যাতের দায়িত্ব অয়ালনের মাঝামাঝি সময়ে। সে সময় হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বয়স হয়েছিল ৫১ বছর ৫ মাস ১৫ দিন।
তিনটি পর্যায়ে মেরাজকে ভাগ করা হয়েছে।
মক্কা শরিফ থেকে বায়তুল মোকাদ্দাস পর্যন্ত অংশকে বলা হয় ইসরা বা রাত্রি ভ্রমণ।
বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে সিদরাতুল মুনিতাহা পর্যন্ত অংশকে বলা হয় ই’রাজ। কিন্তু সাধারণভাবে পূর্ণ ভ্রমণকেই মেরাজ নামে অভিহিত করা হয়।
মেরাজের প্রথম পর্যায়
রজব মাসের ২৭শে রাত্রের শেষাংশে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিবি উম্মেহানী রাদ্বিআল্লাহু আনহা এর ঘরে অবস্থান করছিলেন। উক্ত ঘরটি ছিল হেরেম শরিফের ভেতর। হযরত জিবরাঈল আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘরের ছাদ দিয়ে প্রবেশ করে নূরের পাখা দিয়ে, অন্য রেওয়ায়েত (বর্ণনা) মোতাবেক গাল দিয়ে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কদম মুবারকের তালুতে স্পর্শ করতেই নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর তন্দ্রা ছুটে যায়। জিবরাঈল আলাইহিস সালাম আল্লাহর পক্ষ হতে দাওয়াত জানালেন এবং নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জমজমের কাছে নিয়ে গেকেন। সিনা মুবারক বিদীর্ণ করে জমজমের পানি দ্বারা ধৌত করে নূর এবং হেকমত দ্বারা পরিপূর্ণ করলেন। এ যেন মহাশূণ্যে ভ্রমণের প্রস্তুতি পর্ব শেষ করলেন। নিকটেই বোরাক দন্ডায়মান ছিল।
মূলতঃ বোরাক ছিল বেহেস্তি বাহন - যার গতি ছিল দৃষ্টি সীমান্তে মাত্র এক কদম। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বোরাকে সওয়ার হওয়ার চেষ্টা করতেই বোরাক নড়া চড়া শুরু করল। জীব্রাইল আলাইহিস সালাম নবললেন - তোমার পিঠে সৃষ্টির সেরা মহামানব সওয়ার হচ্ছেন। সুতরাং তুমি স্থির হয়ে যাও। বোরাক বলল, কাল হাশরের দিনে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার জন্য খোদার দরবারে শাফায়াত করবেন বলে ওয়াদা করলেই আমি শান্ত হব। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওয়াদা করলেন। তিনি বোরাকে সওয়ার হলেন। জিবরাঈল আলাইহিস সালাম সামনে, মিকাইল আলাইহিস সালাম পেছনে এবং ইস্রাফিল আলাইহিস সালাম গদি ধরে অগ্রসর হলেন। পেছনে সত্তর হাজার ফেরেস্তার মিছিল। এ যেন দুলহার সাথে বরযাত্রী। প্রকৃতপক্ষে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন আরশের দুলহা (তফসিরে রুহুল বয়ান)।
মক্কা শরিফ থেকে রওনা দিয়ে পথিমধ্যে মদীনার রওজা মোবারকের স্থানে বোরাক থামল। জিবরাইলের ইশারায় সেখানে তিনি দুই রাকাত নামাজ আদায় করলেন। এমনিভাবে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মস্থান বাইতুল লাহাম (বেথলেহেম বলে পরিচিত) এবং মাদইয়ান নামক স্থানে হযরত শুআইব আলাইহিস সালাম এর গৃহের কাছে বোরাক থেকে নেমে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দু’রাকাত করে নামাজ আদায় করলেন। বরকতময় স্থানে নামাজ আদায় করা সুন্নাত। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, আমি বোরাক থেকে দেখতে পেলাম হযরত মুসা আলাইহিস সালাম তাঁর মাজার শরিফে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করছেন।
অতঃপর জিবারইল আলাইহিস সালাম বায়তুল মুকাদ্দাস মসজিদের সামনে বোরাক থামালেন। সমস্ত নবীগণ পূর্ব হতেই সেখানে স্বশরীরে উপস্থিত ছিলেন। জিবরাইল আলাইহিস সালাম দড়ি দিয়ে সেখানে বোরাককে ছাখরা নামক পবিত্র স্থানে পাথরের সাথে বাঁধলেন এবং আজান দিলেন। সমস্ত নবীগণ সমস্ত নবীগণ নামাজের জন্য দাঁড়ালেন। জিবরাইল আলাইহিস সালাম নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পেশ মোসাল্লাতে ইমামতী করার জন্য অনুরোধ করলেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সকল আম্বিয়ায়ে কেরাম এবং সত্তর হাজার ফেরেশতাকে নিয়ে দুই রাকাত নামাজ আদায় করলেন। তখনও নামাজ ফরজ হয়নি। প্রমাণিত হল নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন ইমামুল মুরসালীন এবং নবীউল আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম। নামাজ শেষে আয়োজিত সংক্ষিপ্ত সভায় নবীগণ নিজেদের পরিচয় দিয়ে বক্তব্য পেশ করলেন। সবশেষে সভাপতি হিসেবে (মীর মজলিস) নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভাষণ দান করলেন। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সভাপতির ভাষণে আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করে বললেন, আল্লাহ তাআলা আমাকে আদম সন্তানগণের মধ্যে সর্দার, আখেরী নবী এবং রহমাতাল্লিল আলামিন (মহাবিশ্বের জন্য রহমত) হিসেবে পাঠিয়েছেন।
এখানে একটি আক্বিদার প্রশ্ন জড়িত আছে। আম্বিয়া কেরামগণের মধ্যে কয়েকজন ব্যতীত ইতিপূর্বে সকলেই ইন্তেকাল করেছেন। এবং তাঁদের রওজা মুবারকও বিভিন্ন জায়গায় অবস্থিত। যে চারজন নবী ইন্তেকাল করেননি তাঁরা হচ্ছেন -
হযরত ইদ্রিস আলাইহিস সালাম - বেহেশতে,
হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম - আকাশে,
হযরত খিজির আলাইহিস সালাম জলভাগের দায়িত্বে এবং
হযরত ইলিয়াস আলাইহিস সালাম স্থলভাগের দায়িত্বে।
জীবিত ও ইন্তিকালপ্রাপ্ত সকল আম্বিয়ায়ে কেরাম আলাইহিমুস সালামগণকে মেছালী শরীরে বায়তুল মোকাদ্দাসে উপস্থিত করেছিলেন।” নবীগণ মেছালী শরীর ধারন করে মুহূর্তের মধ্যে আসমান জমিন ভ্রমণ করতে পারেন এবং জীবিত লোকদের মতই সব কিছু শুনতে ও দেখতে পারেন (মেরকাত ও তাইসির)।…
মেরাজের দ্বিতীয় পর্যায়
মেরাজের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে শেষ হয় সিদিরাতুল মুনতাহাতে গিয়ে। প্রথম আকাশে গিয়ে জিবরাইল আলাইহিস সালাম ডাক দিলেন প্রথম আকাশের ভারপ্রাপ্ত ফেরেস্তাকে এবং দরজা খুলে দিতে বললেন। উক্ত ফেরেস্তা পরিচয় নিয়ে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নাম শুনেই দরজা খুলে দিলেন।
প্রথমেই সাক্ষাৎ হল হযরত আদম আলাইহিস সালাম এর সাথে। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে সালাম দিলেন। কেননা ভ্রমণকারীকেই প্রথমে সালাম দিতে হয়। হযরত আদম আলাইহিস সালাম নবীগণের আদি পিতা। তাই তাঁকে দিয়েই অভ্যর্থনা জানানো হল। হযরত আদম আলাইইস সালাম এর নেতৃত্বে অন্যান্য আম্বিয়ায়ে কেরাম এবং প্রথম আকাশের ফেরেস্তারা উক্ত অভ্যর্থনায় যোগদান করেন। এমনিভাবে দ্বিতীয় আকাশে হযরত ঈসা ও হযরত ইয়াহিয়া আলাইহিস সালাম এবং অন্যান্য নবী ও ফেরেস্তারা উক্ত অভ্যর্থনায় যোগ দিলেন। এমনিভাবে দ্বিতীয় আকাশে হযরত ঈসা ও হযরত ইয়াহিয়া আলাইহিমুস সালাম এবং অন্যান্য নবীগণ ও ফেরেস্তারা অভ্যর্থনা জানালেন। হযরত জাকারিয়া আলাইহিস সালামও উক্ত অভ্যর্থনায় শরীক ছিলেন। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন - যখন আপনাকে করাত দিয়ে দ্বিখন্ডিত করা হচ্ছিল, তখন আপনার কী অনুভব হয়েছিল?
উত্তরে জাকারিয়া আলাইহিস সালাম বললেন - তখন আল্লাহ তাআলা আমার সাথে সাক্ষাৎ দিয়ে বললেন - আমি তোমার সাথে আছি। এতদ্বর্শনে আমি মউতের কষ্ট ভুলে গিয়েছিলাম।
প্রকৃতপক্ষে আশেকগণের মউউতের সময় মাশুকের দিদার নসিব হয় এবং মউতের কষ্ট অনুভূত হয় না। [বেদায়া ওয়ান নেহায়া : জাকারিয়া অধ্যায়]
তৃতীয় আকাশে হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম এর নেতৃত্বে অন্যান্য নবী ও ফেরেস্তাগণ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অভ্যর্থনা জানান এবং সালাম ও কালাম বিনিময় করেন।
চতুর্থ আকাশে হযরত ইদ্রিস আলাহিস সালাম, পঞ্চম আকাশে হযরত হারুন আলাইহিস সালাম ফেরেশতাগণসহ অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। ষষ্ঠ আকাশে হযরত মুসা আলাইহিস সালাম এর সাথে সাক্ষাৎ হয়। তিনি অভ্যর্থনা জানিয়ে বিদায়কালে আফসোস করে বললেন -- “এই যুবক নবী শেষে এসেও আমার পূর্বে বেহেস্তে যাবেন এবং তাঁর উম্মতগণ আমার উম্মতের পূর্বে বেহেস্তে প্রবেশ করবে।” হযরত মুসা আলাইহিস সালাম নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর উম্মতের বিশেষ মর্যাদা দেখে আনন্দাশ্রুর কান্না কেঁদেছিলেন। যেমন মা সন্তানের কোন সুসংবাদ শুনতে পেলে আনন্দে কেঁদে ফেলেন। তাঁর আফসোস ছিল আনন্দসূচক ও স্বীকৃতিমূলক।
হযরত মুসা আলাইহিস সালাম সে সময় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট একটি হাদিসের ব্যখ্যা জানতে চেয়েছিলেন। হাদিসটি হল -- “আমার উম্মতের জাহেরী বাতেনী এলেম সম্পন্ন আলেমগণ বনী ইসরাইলের নবীগণের মতো (এলমের ক্ষেত্রে)।”
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রিহানী জগত থেকে ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি আলাইহিকে হযরত মুসা আলাইহিস সালাম এর সামনে হাজির করলেন। হযরত মুসা আলাইহিস সালাম বললেন, “আপনার নাম কী?” উত্তরে ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি আলাইহি নিজের নাম, পিতার নাম, দাদার নাম, পরদাদার নামসহ ছয় পুরুষের নাম বললেন। হযরত মুসা আলাইহিস সালাম বললেন, আমি শুধু আপনার নাম জিজ্ঞেস করেছি। আপনি এত দীর্ঘ তালিকা হাজির করলেন কেন? ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি আলাইহি আদবের সাথে জবাব দিলেন প্প আড়াই হাজার বৎসর পূর্বে আপনিও তো খোদা তাআলার ছোত একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে দীর্ঘ বর্ণনা দিয়েছিলেন। ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর এলেম ও প্রজ্ঞা দেখে হযরত মুসা আলাইহিস সালাম মুগ্ধ হয়ে যান এবং হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদিস খানার তাৎপর্য স্বীকার করে নেন। [রুহুল বয়ান : তৃতীয় পারা, ২৪৮ পৃষ্ঠা] ...
হযরত মুসা আলাহিস সালাম থেকে বিদায় নিয়ে জিবরাইল আলাইহিস সালাম নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম সহ সপ্তম আকাশে গেলেন। সেখানে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ফেরেশতাগণসহ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অভ্যর্থনা জানালেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন -- “আমি হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে একটি কুরসিতে বসে বাইতুল মামুর মসজিদের গায়ে হেলান দিয়ে বসা অবস্থায় দেখতে পেয়েছি।” [রুহুল বয়ান]
হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম দুনিয়াতে আল্লাহ্র ঘর কাবা শরিফ তৈরী করেছিলেন। তার বিনিময়ে আল্লাহ তাআলা তাঁকে সপ্তাকাশের বাইতুল মামুর মসজিদের মোতওয়াল্লীর ন্যায় সম্মান প্রদর্শন করেছেন।
আসমানে ভ্রমণের সময়ই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বেহেশত ও দোযখ প্রত্যক্ষ করেছেন। বিভিন্ন পাপের কী রকম শাস্তি পরকালে হবে তার কিছু নমুনা তিনি মেছালি সুরতে প্রত্যক্ষ করেছেন।… বেহেস্তে হযরত খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা এর জন্য সংরক্ষিত প্রাসাদ, হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর প্রাসাদ, হযরত বেলালের পাদুকার আওয়াজ -- এসব দেখেছেন এবং শুনেছেন।
বেহেশতের চারটি নহরের উৎস স্থল নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখানো হয়েছে। বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম এর চারটি শব্দের চারটি হরফ থেকে চারটি নহর প্রবাহিত হয়ে হাউজে কাউসারে পতিত হয়েছে। দুধ, পানি, শরবত ও মধু -- এই চার প্রকারের পানীয় বেহেশতবাসীকে পান করানো হবে। যারা ভক্তি ও ঈমানের সাথে ভাল কাজ বিসমিল্লাহ বলে শুরু করবে, তাদের জন্য এই নেয়ামত রাখা হয়েছে। তফসীরে রুহুল বয়ানে বিসমিল্লাহর ব্যখ্যায় এর বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে। সপ্তম আকাশ ভ্রমণের পর জিবরাঈল আলাইহিস সালাম গাইদ ও খাদেম হিসাবে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সিদিরাতুল মুনতাহা বা সীমান্তের কুল বৃক্ষের নিকট নিয়ে গেলেন। হাদিসে এসেছে -- “এই বৃক্ষের পাতা হাতির কানের মত বড় এবং ফল ওহোদ পাহাড়ের ন্যায় বড়। শহীদগণের রূহ মোবারক সবুজ পাখির সুরতে উক্ত বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করছেন।” নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বচক্ষে তা দর্শন করেছেন। এই বৃক্ষ পৃথিবীর সপ্ত তবক নিচ থেকে চৌদ্দ হাজার বৎসরের রাস্তা দূরে অবস্থিত। এখান থেকে আরশের দূরত্ব ছত্রিশ হাজার বৎসরের রাস্তা। সর্বমোট পঞ্চাশ হাজার বরসরের দূরত্বে আরশে মোয়াল্লা। আরশে মোয়াল্লা থেকে আল্লাহ তাআলার যাবতীয় নির্দেশ ফেরশতাদের নিকট আসে। হযরত জিবরাইল আলাহিস সালাম সিদরাতুল মুনতাহা থেকেই আল্লাহ তাআলার যাবতীয় নির্দেশ গ্রহণ করে থাকেন।
মেরাজের তৃতীয় পর্যায়
সিদরাতুল মুনতাহায় পৌঁছে জিবরাঈল আলাইহিস সালাম নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বিদায় নিলেন এবং বললেন
“ সিদরাতুল মুনতাহা থেকে এক আঙ্গুল অগ্রসর হলে আমার ছয়শত নূরের পাখা খোদার নূরের তাজাল্লীতে জ্বলে পুড়ে যাবে।
সোবহানআল্লাহ!! যেখানে নূরের ফেরেশতা জিবরাইল আলাইহিস সালাম জ্বলে যায় সেখানে আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বশরীরে সামনে অগ্রসরমান। ...বিদায়ের সময় জিবরাইল আলাইহিস সালাম একটি আরজ করেছিলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে -- আল্লাহ যেন হাশরের দিন পুলসিরাতের ওপর তাকে ছয়শত নূরের পাখা বিছিয়ে দেয়ার অনুমুতি দান করেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উম্মতগণ যেন ঐ পাখার উপর দিয়ে পার হয়ে যেতে পারে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ্র দরবারে জিবরাইলের এই ফরিয়াদ পেশ করলে আল্লাহ তাআলা এই প্রার্থনা মনজুর করেন সাহাবায়ে কেরাম ও আহলে মুহব্বতের লোকদের জন্য। ” [মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া]
জিবরাইল আলাইহিস সালাম থেক বিদায়ের পর রফ রফ নামে এক বাহন এসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আরশে আযিমে পৌঁছিয়ে দেয়। এ পথে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সত্তরটি নূরের পর্দা ভেদ করেন। এক এক পর্দার ঘনত্ব ছিল পাঁচশত বৎসরের রাস্তা। এ হসাবে ৩৬ হাজার বৎসরের রাস্তা অতিক্রম করে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরশের মাকামে পৌঁছান। এ পথে যখন তিনি একাকীত্ব অনুভব করছিলেন, তখন হযরত আবু বকর সিদ্দিকে রাদ্বিআল্লাহু আনহু এর আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলেন এবং শান্ত হয়েছিলেন। আর একটি আওয়াজও তিনি শুনতে পেয়েছিলেন --
“হে প্রিয় মুহাম্মদ (দরুদ), আপনি থামুন, আপনার রব সালাত পাঠ করছেন।”
আল্লাহ্র দিদারের সময় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ্র দরবারে এই দুটি বিষয়ের রহস্য জানতে চাইলান।
আল্লাহ তাআলা বললেন, আমার সালাত অর্থ আপনার উপর দরুদ পাঠ করা। আর আবু বকর এর সুরতে এক ফেরেশতা সৃষ্টি করে আবু বকরের আওয়াজ নকল করা হয়েছিল যেন আপনি শান্ত হন।
মহিউদ্দিন ইবন আরাবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর তফসিরে বলা হয়েছে -- হযরত আবু বকর সিদ্দিকীই রুহানীভাবে তথায় উপস্থিত ছিলেন। এটা ছিলে তার কারামত। কেননা, তিনি ছিলেন রাসুলে পাকের নিত্য সঙ্গী। তিনি দুনিয়া ও মাজারে এবং হাশরের ময়দানে ও জান্নাতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সঙ্গী থাকবেন।
আরশে পৌঁছার পর লওহে মাহফুজ অবলোকনের সময় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেখতে পেলেন সেখানে একটি বাক্য লেখা ছিল -- “আমার রহমত আমার গজবের উপর প্রাধান্য বিস্তার করে আছে।”
… নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরশকে জিজ্ঞাসা করলেন -- আমি সমগ্র জাহানের জন্য রহমত। তোমার জন্য কিরূপ রহমত?
আরশ তখন আরজ করল -- আল্লাহ যখন আমার মধ্যে কালেমার প্রথম অংশ ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহ’ লিখলেন, তখন আল্লাহ্র জালালী শানে আমার মধ্যে কম্পন শুরু হয়েছিল। মনে হয়েছিল আমি টুকরো টূকরো হয়ে যাব। তার পর যখন তার পার্শ্বে আপনার জামালী নামের অংশটুকু -- ‘মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ লিখে দিলেন, তখন আমার কম্পন বন্ধ হয়ে গেল (শানে হাবীব)! সুতরাং আপনি আমার জন্যও বিরাট রহমত।
(চলবে)
সংকলিন সূত্র:
গ্রন্থ সূত্র : নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
রচনা : অধ্যক্ষ হাফেজ আবদুল জলীল।
ফেসবুক পোস্ট : আনিসুল আরওয়াহ- انیس الارواح-রুহের বন্ধু
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই এপ্রিল, ২০১৯ সকাল ১০:৫১