এ আজব হাওয়াই ঘুড়ি; উড়ছে হাওয়ায় শূন্যে সখা
বিধান সাহা
আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী
তুমি থাক সিন্ধু পাড়ে ওগো বিদেশিনী
সপ্তপদীর তিনতালার ভাঙ্গা কার্নিশ ধরে নিঃঙ্গতার বিপরীতে হাওয়ায় হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছে আমার এ নিরস কণ্ঠের উন্ন্যাসিকতা। হাওয়ায় অবশ্য আরো উড়ছে কড়া লিকার কড়া মিষ্টি মিশ্রিত চা-সিগ্রেটের ধোঁয়া, কাঠ মিস্ত্রীর খট খট শব্দের শিল্পীত অনুবাদ, অসংখ্য মানুষের উচ্চারিত খণ্ড খণ্ড শব্দের কোরাস। সব মিলিয়ে একটি কবিতা। তাৎক্ষনিক কবিতা। কবিতার কথা মনে হতেই কোত্থেকে এক উড়নচণ্ডি ব্যাকুলতা এসে দাবি জানালো কবিতার। স্মৃতির তল্লাটে ঢুঁ মেরে খুঁজে চলছি কবিতা ; শব্দ। আবৃত্তি হলে ভালো হতো কিন্তু আবৃত্তি আমাকে দিয়ে হয়না। তবে কেউ আবৃত্তি করলে বাধ্যগত ছাত্রের মতো নিবিড় মগ্নতায় আচ্ছন্ন হয়ে যাই প্রতিবার। ক্রমাগত মগ্নতার বৃত্ত ভেঙ্গে ভেঙ্গে আমি ছুটে যাচ্ছি আরো মগ্নতার দিকে, কবিতার খোঁজে। হঠাৎ খেয়াল করে দেখলাম আমার ভাবনা জুড়ে কবিতা নেই আর। ভাবছি মহাজাগতিক কথা। ভাবছি বিজ্ঞান- ‘টাইম মেশিনে করে মানুষ অতীতে ফিরে যেতে পারেনা কেন, কখনও পারবে? কোথাও কি অজ্ঞাতসারে কেউ হরদম ইচ্ছেমাফিক ঘুরে আসছে অতীত থেকে? আমরাও কি পারবো কোন একদিন? সেই মেঠোপথ, বটগাছের নিচে বসে স্কুলের প্রথমপাঠ, ঘুমহীন পুরো দুপুর মায়ের দস্যি ছেলে হয়ে পুরোটা বাড়ী মাতিয়ে রাখা, সেই নদী, দলবেঁধে ডুব-সাঁতার, আমাদের রাখাল ভজনের কাঁধে চড়ে পাড়াময় টো-টো করে বেড়ানো, সন্ধ্যার আগে আগে দলবেঁধে পলানটু, গোল্লাছুট, বৌচি খেলার ধুম। সেই সব বহু রঙের দিন গুলোতে ফিরে যাওয়া যাবে? অথবা ‘এ শহরে এতো এতো জায়গা থাকতে এখানে কেন? বসার মতো আর কি কোন জায়গা ছিলনা? আগে যেমন হান্নানের বই’র দোকান, বাচ্চুর চা’র দোকান, পোস্ট অফিস মোড়ে নিকুঞ্জর চা’র দোকান, খোকন পার্ক, এ্যাডওয়ার্ড পার্কে বসতাম। এখন তত টানেনা কেন? কবিতার সাথে কি এর কোন সম্পর্ক আছে? অর্থাৎ কোথাও আমি তৃপ্ত হতে পারছি না কেন? অথচ একটা সময় কী দূর্দান্ত ভালোলাগা ছুঁয়ে যেত। এই ছুটে চলা কেন? কিসের জন্য?
না! আমার আর কবিতার কাছে যাওয়া হলো না শেষ পর্যন্ত। স্মৃতি মাঝে-মধ্যে আমার সাথে বড় বেশি বিমাতা সুলভ আচরণ করে। হঠাৎ হঠাৎ কী যেন বলতে চাই। কী যেন খুঁজে চলি। কিন্তু আমার সেই বলতে চাওয়া শব্দ, বলতে চাওয়া বাক্য শেষ পর্যন্ত আর বলা হয়না। সেই খুঁজে চলা জিনিসটা শেষ পর্যন্ত আর পাওয়া হয়না। সে অধরা। সে-ই আমার অব্যক্ত, অতৃপ্ত সার্থক কবিতা।
০২.
তুমি তা জানোনা কিছু- না জানিলে
আমার সকল গান তবু তোমারে লক্ষ্য করে;
জীবনানন্দ দাশ
শৈবাল ভাল আবৃত্তি করে। আমার বন্ধু। শৈবালকে পেলে খুব ভাল হতো এসময়। আবৃত্তির সাথে গানের দিক দিয়েও কম যায় না। কণ্ঠের সাথে তাল, লয়, সুরের সংমিশ্রন অপূর্ব। কখনও কখনও ওর কথাগুলোকেও আমার আবৃত্তি মনে হয়। বসে আছি। গভীর মনযোগের সাথে তাকিয়ে আছি- শূন্যতায় ভেসে যাচ্ছে সিগ্রেটের ধূসর ধোঁয়া। সেই ধোঁয়ার মধ্যে বিক্ষিপ্ত ভাবে ভেসে উঠছে বিচ্ছিন্ন সব চিত্রভাষা। কখনও মানচিত্রের বিকৃত রূপ, পশু-পাখি, মেঘ-ফুল, গতকাল ফুটপাতে দেখা পাগলটার মতো অদ্ভুত দাড়িওয়ালা পোট্রেট। হঠাৎ সমস্ত চেতনায় ছেদ ঘটিয়ে একটি কোমল হাত আমার পিঠ স্পর্শ করে। তাকিয়ে দেখি শৈবাল, সাথে একটি মেয়ে।
কী দাদা, একা একা।
শৈবালকে আমি বন্ধু ভাবি বয়সের বিভেদটাকে ছুটি দিয়ে। ও সে কারণেই আমাকে দাদা ডাকে।
এই যে বসে আছি।
ওরাও আমার মুখোমুখি বসে পড়ে নির্দ্বিধায়।
‘ও প্রতিমা। আমার বন্ধু।’ পাশের মেয়েটার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। ‘ও আচ্ছা’ ছাড়া মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে ঐ মুহুর্তে আর কিছু বলার ক্ষমতা আমার ছিলনা।
ও ভাল গান, কবিতারও নিমগ্ন পাঠক।
‘তাই! আজ তাহলে জমবে ভাল।’ বললাম বটে! কিন্তু এবার আর মেয়েটার মুখের দিকে তাকানোর সাহসও হলোনা আমার। কেন? আমি তখন ক্ষমতা হারানোর তাৎক্ষনিক বেদনায় ছটফট করছি। সেই অপলক মায়াভরা লাজুক দৃষ্টির কী এমন ক্ষমতা ছিল যে, আমার দৃষ্টি সমান্তরাল দাঁড়াতেই পারলো না? তাহলে আমি কী মেয়েটার সঙ্গে গোপন অথচ প্রচন্ড ক্ষমতা সম্পন্ন অপ্রাসঙ্গিকতায় জড়িয়ে ফেলছি নিজেকে? পৃথিবীতে এতো এতো সুপ্রসঙ্গ বাদ দিয়ে সেই অপ্রাসঙ্গিকতার প্রসঙ্গেই বা আমি কতটুকু বুঝি?
... বুঝি তো অনেক কিছু। কিন্তু নিশ্চিত করে বলতে গেলে আমি কী বলবো! আমি জানি, নিশ্চিত করে আমি কিছুই বলতে পারবো না।
আবারও কবিতা। সত্যিই কি কোন কবিতাকে আমি ব্যাখ্যা করতে পারবো? তা হোক না খেয়ালে-বেখেয়ালে অথবা একটা ঘোরের মধ্যে আমার হাত থেকেই জন্ম নেয়া। কবিতা তো প্রতিমার সেই চোখের মতো, অনুভব্যতার গভীরে গিয়ে প্রতিনিয়ত ষষ্ঠেন্দ্রিয়কে চুমু দিয়ে উড়ে যায় হাওয়াদের বন্যদেশে।
০৩
একটা স্বল্পদৈর্ঘ্য নিরবতা চলল। এই নিরবতার মাঝে ওরা দু’জনও সম্ভবত নিজস্ব চিন্তাবৃত্তে জমাচ্ছিল খন্ড কালীন অভিজ্ঞতা অথবা ওদের মতো আমিও হয়তো এক অজ্ঞাত অস্থিরতা থেকে মুক্তি খুঁজছিলাম!
শৈবাল, এবার কবিতা শুনতে চাই। যে কবিতাতে খুঁজে পাওয়া যাবে অনুভব্যতার নিবিড় আস্বাদন। আমাদের প্রতিদিনের বহুবর্নিল কথকতা, বর্তমানের উপস্থিতি, আমাদের ভালোবাসা, ঘৃণা, ক্রোধ, অভিমান, আমাদের সমস্ত পিছুটান। যে কবিতায় ডুব দিয়ে আমরা কুড়িয়ে আনব ভালোলাগার প্রাচীন প্রবাল।
‘আবু হাসান শাহরিয়ারের বালিকা আশ্রম-০২ কবিতাটি পড়ছি আমার ভালোলাগাকে বিচারক বানিয়ে।’
'নটে গাছ মুড়ালেও জানি
আমাদের গল্প ফুরাবে না
দিনভর কড়ইয়ের পাতা
গুড়ি গুড়ি কথোপকথনে
বাতাসে ওড়াবে রূপকথা বাঁচো
কে এক বালিকা নাকী পাখি
পালকে পালকে ছিল ঢেউ
আজও সেই ঢেউয়ের পালকে
কবিতার খাতা ভরে ছবি
আঁকি আর বালিকাকে ডাকি আছো?'
নিখুঁত উচ্চারণ আর দরদী কণ্ঠের মুগ্ধতায় বার বার বিমোহিত হচ্ছিলাম। খেয়াল করে দেখলাম প্রতিমাও বেমালুম ডুবে গেছে কবিতার গহীন আবেগের কাছে আবৃত্তির সাথে সাথে ওর চোখে প্রচন্ড বিস্ময়ের আবহাওয়া খেলা করছে, কপালে ভাঁজ পড়ছে, মাথা দুলছে সাথে শরীরও খানিকটা। ভাবছি, কয়েকটি শব্দবন্ধের ক্ষমতার কথা আর আশান্বীত হচ্ছি। যদি কয়েকটি শব্দ, কয়েকটি পংক্তি মানুষের শরীরকে দুলিয়ে দিতে পারে; তাহলে নিশ্চয়ই... নিশ্চয়ই একদিন...
০৪
বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। ঝমঝম শব্দের মূর্চ্ছনায় পৃথিবী প্লাবিত হচ্ছে। এর মাঝেই কিছু মানুষ জীবিকার তাগিদে ছুটছে এদিক-সেদিক। আহ! বৃষ্টি এই ভ্যাপসা গরমে কোন অজ্ঞাত দেশ থেকে নেমে এলে!
‘প্রতিমা এবার তোমার কণ্ঠে শুনতে চাই।’ যেন অপ্রসঙ্গিক বিষয় উপস্থাপন করে ফেললাম, যেন হঠাৎ করে বজ্রপাত, তাল-লয়ে ছেদ। প্রথম দিকে কিছুটা সংকুচিত হলো। লজ্জা মাখানো চিরায়ত মেয়েলী ঢংয়ে বললো,‘আমিতো ভাল আবৃত্তি করতে পারিনা। পড়তে পারি।’
‘তারপরও শুনতে চাই।’ এবার আমার এই স্বল্প সময়ের পরিচিত মেয়েলী স্বভাবের প্রতিমা কী করে যেন হঠাৎ নারীতে পৌঁছে গেল। না, না নারী না। পূর্ণ মানুষ হয়ে গেল। জড়তাহীন কণ্ঠে বলে বললো, ‘নবনীতা দেবসেনের পানি গ্রহণ কবিতার কিছুটা পড়ছি- ’
'কাছে থাকো। ভয় করছে। মনে হচ্ছে
এ মুহুর্ত বুঝি সত্য নয়। ছুঁয়ে থাকো।
শ্মশানে যেমন থাকে দেহ ছুঁয়ে একান্ত
স্বজন। এই হাত, এই নাও হাত।
এই হাত ছুঁয়ে থাকো, যতক্ষণ
কাছাকাছি আছো, অস্পৃষ্ট রেখো না।
ভয় করে। মনে হয়, এ মুহুর্ত বুঝি সত্য নয়।
যেমন অসত্য ছিল দীর্ঘ গতকাল
যেমন অসত্য হবে অনন্ত আগামী।'
আমি তখন প্রতিপর্বে বিভক্ত হয়ে বিস্ময়ের ঘেরাটোপে বন্দী। কী দারুণ স্বত:স্ফুর্ত ভাবে আবৃত্তি করে গেল। একেবারে নিঃসংকোচে, নিঃসংশয়ে। মেয়েরা বুঝি এভাবেই প্রতিভা লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করে! আর এই কবিতা; এটা কি আমাকে উদ্দেশ্য করে, নাকি শৈবাল? কিন্তু এটা তো আমার কবিতা, আমার জন্য লেখা। আমি তো মনে মনে এ কথাগুলোই বলতে চাইছিলাম। আমার ভালোলাগা কবিতাটা ওরও ভাল লাগলো কেন? এটাই বুঝি কবিতার সার্বজনীনতা!
০৫
এই অবেলায় আমার বুকের মধ্যেও যে বৃষ্টি হচ্ছে, ঝড় হচ্ছে। এক মন বালিকার জন্য ভিজে যাচ্ছে হৃদয়ের পূর্ণাংশ, কেউ কী তা জানে? জানে না। শহরের রাস্তায় নিজস্বতা আর বেখেয়ালীপনা রেখে বৃষ্টি চলে গেল। কোন কোন দেয়াল তা স্বীকার করে নিচ্ছে নন্দনতত্বের বাহারি কলতানে।
হঠাৎ টোরিয়েডর-১ রিংটোন নিয়ে বেজে উঠল শৈবালের মোবাইল ফোনটা। ‘হ্যালো’। শৈবালের চোখ-মুখের অভিব্যক্তিতে ঝরে পড়ছিল দুপুর রোদের বিরক্তি।
বুঝলাম ঘরে ফেরার তাড়া হয়তো। অথবা ... অথবা দীর্ঘ কোন পিছুটান। অনেকটা সময়ও যে আমরা পার করে এসেছি এই মাত্র বুঝলাম। মেঘলা দিনের মতো গম্ভীর মুখ করে বললো, ‘আজ উঠতে হবে।’ বহুদিন পর ওর মুখে সেই পুরণো ঢং। সেই শিশুতোষ অভিমান। ওরা চলে যাবে। শুধু আমি একা একা নিঃসঙ্গতার বিশ্বস্ত বন্ধু হয়ে বিশ্বাস রক্ষা করে যাব আজন্ম। এক অজানা হাহাকারে কেঁপে উঠলো বুকটা। প্রতিমার মুখের দিকে এক পলকের জন্য চাইতেই ও বললো, ‘দাদা, অন্যদিন অনেক সময় ধরে আড্ডা দেয়া যাবে। সেদিনও সমস্ত কিছুর উর্ধ্বে উঠে কবিতাতে প্রধান্য দেব হৃদয়।’
শেষ সৌজন্যতা দেখিয়ে ওরা চলে যায়। আমাকে পেছনে রেখে ক্রমাগত দূরত্ব বাড়ায়। এক সময় আমার দৃষ্টির সীমাকেও অতিক্রম করে যায়। হঠাৎ সব কিছুকে স্তব্ধ করে দিয়ে আকাশ-পাতাল, গ্রহ-নক্ষত্র, জীবন-দর্শন, সমস্ত বাধাঁকে উপেক্ষা করে বুকের মধ্যে প্রচন্ড ধাক্কা মেরে কে যেন বলে গেল-
দৃশ্যের পেছনেও কিছুটা দৃশ্য থেকে যায়
তার পেছনে আমি
এবং এক একটি
দীর্ঘশ্বাস...